মায়ামি থেকে নিউইয়র্কে আসব। ফ্লাইট ভোর ছয়টায়। আমার Brother-in-Law ভোর চার টায় নামিয়ে দিল এয়ারপোর্টে। সীকুরিটি শেষ করে গেটের কাছে এসে দেখলাম ফ্লাইট দেরীতে ছাড়বে। ঘণ্টা পাচেক পড়ে। নিউইয়র্কে বরফ পড়ছে। প্লেনের কর্মকর্তারা আমরা যারা প্যাসেঞ্জার সবার হাতে দশ ডলারের একটা ভাউচার ধরিয়ে দিয়ে বলল, সরি, এটা দিয়ে আপাতত নাস্তা করে নিন। সময় মত জানাব কখন আমরা রওয়ানা দেবো।
অগত্যা কফি আর পেস্ট্রি কিনে এনে বসলাম এক কর্নারে।
হঠাৎ ই সামনের দশ নাম্বার গেটের লাউঞ্ছে চোখ পড়তেই অনেক লোকের মাঝে এক জনের মুখটা চেনা মনে হোল ।
সেলিম।
একসময় গাড় বন্ধুত্ত ছিল। সময়ের ব্যাবধানে তাতে মরচে পড়ে গেছে। কিন্তু চিনতে অসুবিধা হোল না। স্মরণশক্তি যে এখন ও প্রখর তাই ভেবে নিজেকে বাহবা দিলাম।
কফি আর পেস্ট্রি টা হাতে, আর ব্যাগপ্যাক টা পিছনে বেঁধে ওর সামনে এসে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ সে তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে। তারপরই উচ্ছ্বাসিত হয়ে দাড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরার আগেই বললাম, হলড অন, হলড অন কফিটা পড়ে যাবে।
চিনতে পেরেছিস তাহলে।
না চেনার তো কথা নয়। তোর কপালের ওই দাগ টা তো মার্কা মারা।
সানফ্রান্সীস্কর দিকে যাচ্ছিস মনে হচ্ছে, ঐখানে থাকা হয় বুঝি?
হা, দেখনা প্লেন তিন ঘণ্টা ডিলে।
তোর তো তিন, আমার আপাতত পাঁচ। চল কোথাও গিয়ে বসি।
আমরা এসে বসলাম একটা নিরিবিলি জাগায়। আমার প্রথম প্রশ্ন, তামান্নাকে দেখছিনা?
ও তাকাল আমার দিকে। ওর চোখের চাহুনী দেখে মনে হোল এই প্রশ্ন আমার এই মুহূর্তে করা উচিৎ হয়নি। তার আগে আরও কিছু ফেলে আসা কথা বলা উচিৎ ছিল। আসলে তামান্নাকে আমিও চিনতাম অনেক কাছ থেকে, হয়ত সেই কারনেই ওর নামটা আমার প্রথমে মনে এসে ছিল। আর শুধু তাই নয়। তামান্না সেলিমের বৌ।
না, আমি একাই এসেছিলাম একটা কনফারীন্সে। আর বলতে কি ও আমার সাথে নেই। আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে।
ঠিক এই রকম উত্তর পাবো আশা করিনি।
আমি সত্যিই দুঃখিত।
না দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। নয় বছর ঘর করার পর মনে হোল আমরা দুজনে দুই মেরুর। জোড়াতালি দিয়ে তো ঘর করা চলে না। তাই বেড়িয়ে এলাম, তাও তো আজ ছয় বছর হয়ে গেলো।
ভালোবেসে তো বিয়ে করেছিলি। তাহলে?
বিয়ের আগের ভালবাসা আর বিয়ের পরের ভালবাসার মাঝে পার্থক অনেক। বোঝা দায়। তোর কি মনে হয়।
আমিতো ঐ পথে পা বাড়াই নি বন্ধু।
এখনো ব্যাচেলার।
হাঁ। তোর কথা বল, বাধন ছিড়ে গেলো কেনও?
তবে শোন, তুই তো আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলি তামান্নার সাথে।
মনে পড়ে তোর, ক্যান্টিনে বসে তোরা দুজন চা নাস্তা খাচ্ছিলি। আমাকে দেখে ডাক দিয়ে বসতে বললি তোদের টেবিলে। সেই প্রথম তামান্নাকে আমি দেখি। তুই পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললি, তামান্না, ইকনমিক্সে মেজর।
মনে পড়ে?
পড়বে বৈকি। কিছুক্ষণ পর তামান্না উঠে চলে গেল। ওর ক্লাস আছে। তুই বলেছিলি, এই শমিত, লাইন লাগিয়ে দিবি আমার সাথে। প্রথম দেখায় প্রেম। আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলি, আমার সাথে কি ধরনের সম্পর্ক। বলেছিলাম, সে আমার বান্ধবী, এতটুকুই। তুই চাইলে প্রেম সম্পর্কিত সম্পর্ক গড়তে পারিস।
তারপর তুই চলে গেলি নেপথ্য।
পরের দিন আমি দাঁড়িয়েছিলাম ইকোনমিক্স ডিপার্টমেন্টের সামনে। তামান্না বেড়িয়ে আসতেই বলেছিলাম, শমিত আসতে পারলনা, ও একটু কাজে ব্যস্ত, (পুরো টাই বানান।) যদি কিছু মনে না করেন, ক্যান্টিনে বসতে পারি কি চা খেতে। তামান্না আপত্তি করে নি। তুই তো জানিস, তোর মতো, মেয়েদের সাথে অনর্গল কথা বলার মতো চৌকস আমি নই।
একটু বারিয়ে বলছিস। তাই যদি হবে, তবে আজও শিকে ছিঁড়ল না কেনও?
তার বিশ্লেষণ আজ আমি করবো না। সেটা তোর নিজেস্ব ব্যাপার। তবে সেদিন রুমাল দিয়ে বার বার ঘাম মুছতে দেখে তামান্না জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনার শরীর ভাল তো?
ইচ্ছে করেই বলিনি, তাতে তোর নার্ভাসনেস টা আরও বেড়ে যেতো। মেয়েরা নার্ভাস প্রকৃতির ছেলেদের কে মোটেই পছন্দ করে না।
না আর মুছতে হয়নি। নার্ভাসনেস কেটে গেছে। আমরা দুজন কখন ক্যান্টিনে, কখন ইগলু তে বসেছি। কথা বলেছি, যার কোন মাথা মুণ্ডু নেই। তামান্নাই বলত বেশি। তুই মাঝে মাঝে এসে যোগ দিতি। আজ বলতে বাধা নেই, আমি চাইতাম না তুই আমাদের সময়টাতে ভাগ বসাস। বলতে পারিস এটা একরকম সেলফীস্নেস। এটাই স্বাভাবিক। প্রেমের রাজ্যে দুজনের মাঝে তৃতীয় জনের ঠাই নাই। তুই বুঝতে পারতিস কিনা জানিনা। তবে আমার মনে হতো, তোকে বলি, বন্ধু, এবার কেটে পরো।
কেটে আমি পড়তে চেয়েছিলাম, কিন্ত তামান্না আমাকে চলে যেতে দেই নি।
কি বলছিস?
আজতো বলতে বাধা নেই, তামান্না তোরা কোথায় কখন বসবি, আমাকে জানাত। না করলে বলত, তুমি এলে আমার আর সেলিমের সম্পর্কে কোন ঘুন ধরবে না। আমি চাই তুমি এসো। বরং তুমি ক্যাটালিস্ট হিসাবে কাজ করবে। আর তাছাড়া আমি দেখতে চাই সেলিমের মনে কোন সন্দেহ জাগে কিনা। যদি না জাগে তবে বুজব সে সত্যিই আমাকে ভালবাসে।
বাহ, এই পরীক্ষার কথা তো আমার জানা নেই। তবে তোকে এইটুকু বলতে পারি, ওকে সত্যিই আমি ভালবেসেছিলাম। আপাতদৃষ্টিতে মনে না করার কোন উপায় ছিলনা যে সে আমাকে ভালবাসে না। শুধু একটা ছবি—- যত নষ্টের মুল।
ছবি?
হা, ছবি। ছবি টা ছিল আমার আর রাবেয়ার।
রাবেয়া? রাবেয়া কে?
রাবেয়া আমার স্কুল জীবনের একজন। সে আর এক কাহিনী।
তখন বয়স আমার ১৫ কি ১৬। আমাদের বাসার সামনে রাস্তা। রাস্তা পেড়িয়ে এক শান বাধানো পুকুর। পাশে কৃষ্ণচুড়া গাছ। ঐ রাস্তা দিয়ে আমি প্রতিদিনই আসা যাওয়া করি, কিন্তু সেদিন আমাদের বাড়ীর গেটের দরজা খুলে বের হতেই চোখ পড়ল পুকুরের দিকে। একটা মেয়ে। সিঁড়ির পাড়ে দাঁড়ানো। চিনতে পারলাম না। কে সে? চোখে চোখ হোল।
মেয়েটা সরে এসে কৃষ্ণচুড়া গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল। তাকাল আর একবার। পরক্ষনে সরে যেয়ে দাঁড়াল সে পুকুরের সিঁড়িতে। আস্তে আস্তে নেমে গেলো পানিতে। আমি দাড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। ষোল বছরের শরীরের রক্তে ঢেউ খেলে উঠল।
বাহ,বাহ! এতো সিনেমার প্রথম পর্ব। তারপর? তা সেই ফটোর সাথে কি সম্পর্ক?
আহা, বলছি। পরের দিন একি ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আমার মনে হোল আমি ওর প্রেমে পড়ে গেছি। এবং দৃঢ় ধারনা হোল সেও আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কিন্তু কে সে সেটাই জানা হোল না।
এই বয়সে এই ঘটনা নিজের মাঝে চেপে রাখা সহজ নয়। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু কে বললাম। সে সব বিষয়ে তুখর।
বলল, চল আমি দেখছি।
পরদিন, সে ঘাটের সিঁড়ির পরে বসা। আমাদের দুজন কে এক সাথে দেখে সে আর পানিতে নামলো না। সোজা চলে গেলো ঘাট ছেড়ে উলটো দিকে।
আমার বন্ধু চিনে ফেলেছে। বলল, ও তো শফিকদের বাসাতে থাকে, শফিকের মামাতো বোন। চল, আজ শফিকদের বাসাতে যাবো। ওদের বাসার সামনে ব্যাডমিন্টন খেলা হয়। ব্যাডমিন্টন খেলতে এসেছি বলে শফিককে ডাক দেবো, এবং ওদের বাসাতে ঢুকে পরবো। এই তার পরিকল্পনা।
মাথা খারাপ। আমার দাড়া হবে না। বলে আমি হাটতে আরম্ভ করলাম।
বন্ধু টি খেপে গেলো। বলল, তবে প্রেম করতে এসেছ কেনও। প্রেম করতে হলে অনেক কাঁটার আঁচড় খেতে হবে।
মনে হোল সে জীবনে অনেক বার এপথ মাড়িয়েছে।
সাহস করে বললাম, ঠিক আছে।
যেই কথা সেই কাজ। আমরা বিকেলে এসে হাজির হলাম শফিকের বাসায়। ডাক দিতেই সে বেড়িয়ে এলো।
বন্ধুটি বলল, কিরে বাহিরে দাড় করিয়ে রাখবি না ভেতরে বসাবি।
শফিক নিয়ে এলো ভিতরে। ঢুকতেই দেখি মেয়ে টি বাহিরে শুকনো কাপড় গুলো উঠাচ্ছে। তাকাল সে। আমার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে।
সেই বয়স থেকেই তোমার নার্ভাসনেস।
আসলেই তাই। সে তাকাল আমার দিকে। বিশ্বাস হচ্ছে না তার, আমি আসতে পারি ওদের বাসাতে।
দ্রুত ঢুকে গেলো সে ঘরের ভিতর।
বন্ধু টি ওর নাম টা জেনে নিলো।
বলল, আজই একটা চিঠি লেখে ফেলবি। আমি ওর হাতে পৌছে দেবার বন্দোবস্ত করব।
চিঠি, আমি লিখব চিঠি। তাও প্রেমপত্র।
প্রেম করবা আর প্রেমপত্র লিখতে পারবে না।
লিখে ছিলি তুই?
হা, লিখেছিলাম। শুধু তাই নয়। আমার বন্ধু টি শফিকের মাধ্যমে পৌছিয়ে দিয়ে ছিল। তার উত্তর অবশ্য আমি পাই নি। পরিবর্তে একদিন বন্ধুটি বলল, আগামীকাল বিকেলে আমার বাসায় আসবি।
কেন?
সে কথা পরে হবে।
বিকেলে পৌছে দরজায় টোকা দিতেই শফিক এসে দরজা খুলে দিলো। ওকে দেখে আমি অবাক। তাকিয়ে দেখি ড্রয়াং রুমে রাবেয়া বসা।
তুই আমার অবস্থা বুজতে পারছিস।
হাঁ, তা পারছি।
শফিক হঠাৎ করে কোথায় চলে গেলো। বন্ধুটির কোন পাত্তা নেই।
সেদিন কি কথা হয়েছিল আজ আর তা মনে নেই। শুধু এই টুকু মনে পরে রাবেয়া বলেছিল, সামনের মাসে সে গ্রামের বাড়ীতে চলে যাবে। তার বাবা আর তাকে এখানে রাখবে না।
সেই কথা শুনে ষোল বছরের প্রেম গুমরে উঠল। হঠাৎ বলেছিলাম, চল আমরা একটা ফটো উঠিয়ে রাখব।
ও অবিশ্বাসও দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকাল। ঠিক সেই সময় আমার বন্ধুটি এসে হাজির।
ওকে বলতেই, বলল, এ একটা ব্যাপার। চল আমরা চারজন মিলে মিল্টনের স্টুডিওতে ফটো উঠাব।
বললাম, চারজন কেন?
সে বলল, দুজন মিলে উঠালে এই ছোট্ট শহরে ঢি ঢি পরে যাবে। চল।
আগে পিছে করে এলাম স্টুডিওতে।
চারজন বসলাম। ওরা দুজন বসল দুই দিকে একটু ব্যবধান রেখে।
ফটো তোলা শেষ। রেবেয়া চলে গেলো। সেই শেষ দেখা।
তারপর? সেই ফটো?
চারদিন পর বন্ধুটি নিয়ে এলো ফটো টা আমার বাড়ীতে। বললও, একটা কেঁচি নিয়ে আয়।
কেঁচি কেন?
যা বলছি তাই শোন।
নিয়ে এলাম। ও ছবি টা বের করলো। দুই দিক থেকে ওর আর শফিকের ছবি কেটে বাদ দিয়ে আমাকে আমাদের দুজনের ছবিটা দিয়ে বলল, এবার বুকের মাঝে রেখে দাও।
এই ছবিই সেই ছবি?
হা। কেন এই ছবি আমার অনেক অনেক পুরানো এ্যালবামে রয়ে গিয়েছিল আমি নিজেও জানি না।
তামান্না সেই ছবি পেয়ে প্রশ্নের পরে প্রশ্ন। যতই বোঝানোর চেষ্টা করি সে বুঝতে নারাজ। আস্তে আস্তে সন্ধেহের বাতীক দেখা দিল তার মধ্যে। তুই তো জানিস সন্দেহ একটা রোগ। এ যদি একবার কারো মাঝে বাসা বাধে তবে তার থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সহজ নয়। আমারও ভাগ্যে তাই হোল।
আমি কলেজের প্রফেসর। সেই সুবাদে কত মেয়েই আসে আমার কাছে প্রশ্ন নিয়ে। তারই খেসারত আমাকে দিতে হয়। সন্দেহ প্রবন মন। সবকিছুতেই সন্দেহ। সেটা চরমে উঠল যে দিন অলকা এসে বেল বাজিয়ে ছিল আমাদের বাসায়।
অলকা কে?
আমার ছাত্রী।
কলিং বেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলতেই দেখি অলকা। কি ব্যাপার ? জিজ্ঞাসা করতেই বলল, কাল আমার এনগেজমেন্ট। আপনি আর ভাবী অবশ্যই আসবেন। বলেই যে রিক্সায় এসেছিল, তাতে করেই চলে গেল।
কখন যে তামান্না আসে পাশে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারিনি।
জিজ্ঞাসা করল মেয়ে টি কে?
বললাম।
মনে হোলনা সে বিশ্বাস করেছে। বলল, মেয়েটি আমাকে কিছু না বলে চলে গেলো যে।
বললাম, হয়ত তাড়া আছে। অথবা ভেবেছে একজন কে বললেই যথেষ্ট।
সে কথা সে শুনতে রাজি নয়। এরপর আমাদের মধ্যে যে ধরণের কথোপকথন হয়েছিল তা আমার মাঝেই থাক।
সেই শেষ। আর নয়। বুঝলাম এবার বিচ্ছিন্ন হবার পালা। আমাদের দুজনের দুটিপথ দু দিকে বাক নেওয়াই ভাল।
কিছুক্ষণ আমরা দুজনেই নীরব।
নীরবতা ভঙ্গ করে জিজ্ঞাসা করলাম, বেল তলায় আবার গিয়েছিস কি?
হাঁ, গিয়েছি।
ঠিক সেই মুহূর্তে এনাউসমেন্ট হোল, সানফ্রানসীস্ক যাওয়ার যাত্রীদের পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বোর্ডিং এর জন্য ডাকা হবে।
বিদায় নিয়ে উঠে দাড়ালাম। এক দু পা এগোলাম। সেলিম ডাক দিল পিছন থেকে।
ফিরে এলাম।
সেলিমের চোখটা মাছের চোখের মত ঘোলাটে মনে হোল। সে চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। মনে হোল যেন ঝরের পূর্বাভাস।
না, আমি জানিনা, আমি জানতাম না ? বলে ওর গম্ভীর মুখের দিকে তাকালাম।
তাহলে শোন, তামান্না কোনদিনই আমাকে ভালোবাসেনি। ভালবেসেছিল তোকে। আমার মাঝে তোকে দেখতে পেতো সে রাতের অন্ধকারে। তাইতো আলো জ্বলতেই আলুথালু বেসে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতো আমাকে। নয়টা বছর আমি তোর হয়ে শুধু প্রক্সী দিয়েছি। তুই এই খেলা না খেললেও পারতিস।
এই বলে সে এগিয়ে যেয়ে লাইনে দাঁড়াল।
আস্তে আস্তে গেট পেরিয়ে চলে গেলো চোখের আড়ালে । পিছন ফিরে তাকালো না।
আমি কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। কানে শুধু বাজতে থাকলো একটি কথা,
আমি শুধু প্রক্সীই দিয়ে গেলাম, নটি বছর শুধু প্রক্সীই দিয়ে গেলাম।
ফোনের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। ভাইবারের আওয়াজ। রিংএর শব্দটা শুনলেই বোঝা যায়। ঘড়ির দিকে তাকালাম। ভোর ছয়টা। এতো ভোরে একমাত্র দেশের থেকেই কল করা সম্ভব। ফোনটা তখনো বাজছে। নাছোড় বান্ধা। সাধারণত আমার পাশের বালিশের উপরেই ওটা থাকে। হাত দিলাম। পেলাম না। অগত্যা মাথা টা উঠিয়ে দেখতে চাইলাম। ওটা দু বালিশের মাঝে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ততক্ষণে শব্দ টা বন্ধ হয়ে গেছে।
থাক ওখানে পড়ে। উঠাতে ইচ্ছা করলো না। যে ব্যাক্তিই হয়ে থাক বুঝতে পেরেছে, এখানে এখনো ভোরের আলো এসে পৌছায় নি।
বন্ধের দিন।
কাজেই পাশ ফিরে গায়ের কম্বল টা চেপে ধরলাম। ঠিক সেই সময়ে ঝমঝম করে আবার বেজে উঠল ফোনটা। দাঁত খিচিয়ে ফোন টা উঠালাম। ভেবে ছিলাম প্রথমে একটা কষে ধমক দেবো। তা এর হোল না।
হ্যালো বলার আগেই, খুব কাকুতি মিনতি করে বললও, সরি দুলাভাই, আমি ডলি, আপনার ঘুম ভাঙ্গালাম। অনেক বার কল করেছি আপনাকে, বিভিন্ন সময়ে, পাইনি। তাই এই অসময়ে আমাকে ফোন করতে হোল। ক্ষমা করে দিয়েন দুলাভাই।
মনে পড়লো, অনেক গুলো কল এসেছিল ঠিকই, নাম্বার টা চেনা নয়, তাই খুব একটা গুরুত্ত দেই নি। কাজেই দোষটা কিছুটা আমার। এই ভেবে অতি ভদ্র গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, সব খবর ভাল তো?
সুসংবাদ আছে দুলাভাই।
কি?
আমার ছোট মেয়ে মৌর বিয়ে?
কোথায়? দেশে?
না, আপনাদের ওখানে। নিউইয়র্কে না, অরলান্ডো তে। আপনাকে আসতেই হবে দুলাভাই।
ডলির এই আন্তরিকতা শুধু আজ নয়। যেদিন থেকে ওকে আমি দেখেছি, ওর সাথে পরিচিত হয়েছি, সেদিন থেকে। ও আমার কেউ নয়। ও আমার শ্যালিকার ছোট বেলার বান্ধবী। এক পাড়ার মেয়ে। আমার বৌ কে আপা বলে ডাকতো। সেই সুবাদে আমি দুলাভাই। দেশে গেলে ওর বাসায় একবেলা হলেও আমাদেরকে যেতে হতো।
বলত, আপনার কথা আপার কাছে ফোনে শুনতে শুনতে আমি আপনার অতি ভক্ত হয়ে গেছি।
সেই হৃদয়ের টান টা আজও রয়ে গেছে।
বললাম, তারিখ টা বলও, আমি চেষ্টা করব।
বলল, ৭ ই ডিসেম্বর গায়ে হলুদ, ৮ ই ডিসেম্বর বিয়ে। আপনাকে দুটোতেই আসতে হবে।
সবুর করো, ছুটি ছাটার ব্যবস্থা করতে হবে। তোমাকে আমি জানাবো। এই বলে কথার ইতি টেনে, কম্বল টা মাথার উপরে টেনে দিলাম।
বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে আটটা বেজে গেলো। রবিবারের সকাল। জানালার Blinds গুলো টেনে উপরে উঠিয়ে দিতেই এক ঝলক নরম সূর্যের আলো এসে ড্রয়াইং রুম টা ভিজিয়ে দিলো। আমি Keurig এ বানানো কফির পেয়ালাটা এনে জানালার পাশে বসলাম। বাহিরে ফুলের গাছগুলো তাদের সজীবতা হারিয়ে ফেলেছে শীতের তীব্রতায়। । দুমাস আগের উজ্জ্বল নানা রঙে রঞ্জিত আবরণ কোথায় যেন লুকিয়ে রেখে আজ ভিখারির সাজে সজ্জিত। আমি তাকিয়ে ছিলাম দুর পানে।
ফোনটা বেজে উঠল। ঝর্না, আমার শ্যালিকার ফোন। এতো ভোরে সাধারণত সে কল করেনা। আশ্চর্য না হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি, ডলির কল পেয়েছ নিশ্চয়?
কি করে বুঝলেন?
এতো ভোরে তুমি তো কল করার বান্দা নও।
কিছু চিন্তা করেছেন? জিজ্ঞাসা করে একটু থেমে বলল, আপনি যদি বিয়েতে আসেন তবেঁই আমার যাওয়া হবে।
তাহলে তো অবশ্যই চেষ্টা করতে হয়। বললাম, আগামী সপ্তাহে তোমাকে জানাবো।
নানা কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়াতে ভুলে গিয়েছিলাম ডলির প্রস্তাব টা। হঠাৎ ফেসবুকে জয়ার ছবি দেখে মনে পড়ে গেলো ডলির কথা।
জয়া মৌ র বড় বোন।
ওই আমার বেশি পরিচিত। মাঝে মধ্যে টেক্সটে, ফোনে কথা যে হতো না তা নয়। বড্ড মিষ্টি মেয়ে। আমার ভীষণ ভাল লাগত। ওরা তিন বোন। জয়া, জেসী, আর মৌ। শেষ যখন মৌকে দেখেছিলাম সে ছিল ছোট্ট, স্কুলে পড়া একটি মেয়ে। আজ সে বিয়ের পাটিতে বসতে চলেছে।
মনে হোল মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। বুঝতে পারিনি।
চড়াই উতরাই পাড় হয়ে আজ আমি যেখানে এসে পৌঁছেছি তাতে করে মনে হোল হাতে সময় হয়তো বেশি নাও থাকতে পারে। তাই সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম আমি যাবো। অনেক দিন দেখিনি ওদেরকে।
ঝর্নাকে কল দিলাম। বললাম আমি আসছি। সে থাকে মায়ামীতে।
ওখান থেকে গাড়ী নিয়ে অরলান্ডো যাবো।
টিকিট কাঁটা শেষ।
জয়া কে জানালাম, আমরা আসছি। সে থাকে লসএনযেলিসে । বললাম, বিয়ের ভেনুর কাছাকাছি কিছু হোটেলের নাম পাঠাও।
উত্তরে তার উচ্ছলতা আমার হৃদয়কে স্পর্শ করলো।
“আমি যে কি excited খালু তুমি আর ঝর্না খালা আসবে শুনে। আমি এখনি মৌ কে বলে দিচ্ছি, সে তোমাকে সব জানাবে”।
মিনিটের মধ্যে টেক্সট এসে গেলো। আমি হোটেল বুক করে ফেললাম।
জানি, এখনি ডলি কল করবে, ঠিক তাই। ফোনটা বেজে উঠল। ওর মেয়েরা জানিয়ে দিয়েছে, আমরা আসছি বিয়েতে।
ডলির সেই একই কথা, আমি কি যে খুশি হয়েছি দুলাভাই, আপনাকে বুঝাতে পারবো না।
দিন এলো। আমি রওয়ানা হয়ে গেলাম। মায়ামীতে এক রাত কাটিয়ে, আমি আর ঝর্না বেড়িয়ে পড়লাম গাড়ী নিয়ে। সকাল দশটা। যেতে সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগবে। পথের জন্য বেঁধে নিয়েছি বিস্কুট ,বাদাম আরও সব মুখরোচক ভাজা পোড়া।
গল্প করতে করতে সময় পেড়িয়ে গেলো। সেই পুরানো দিনের ফেলে আসা সব ঘটনা। মাঝে মাঝে ফিরে যাচ্ছি অনেক পিছনে। কে যেন হাতছানি দিয়ে বলছে, এসো, আমার আবার মিলি দুজনে।
গাড়ী চালাতে চালাতে চোখ ঝাপসা হলে চলবে না। তাই ঝর্না কে বললাম, এবার বলও অন্য কথা।
ঠিক তিন টায় এসে পৌছালাম হোটেলে।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় অনুষ্ঠান।
বাহিরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। পনের মিনিটের পথ হোটেল থেকে বিয়ের ভেনু। আমার শ্যালিকা সুন্দর করে সেজেছে। বলল, দুলাভাই টিপ টা আনতে ভুলে গেছি।
বললাম, আহা, ওটা থাকলে সপ্তকলা পূর্ণ হতো। তবে যাই বলও, ওটার অবর্তমানেও তোমাকে যা লাগছে তাতে আমাকে তোমার উপর নজর রাখতে হবে যাতে কেউ যেন নজর না দেয়।
থাক ঠাট্টা করতে হবে না, এবার চলেন।
এসে পৌছালাম Maitland Civic center এ। এই বৃষ্টি মাথায় করে অনেক লোক এসে গেছে। আমরা কাউকে চিনিনা। নতুন বৌ তখনও এসে পৌছায়নি। আশেপাশে তাকাতেই একজন এসে বলল, আপনারা এখানে?
ঝর্নার পরিচিত।
যাক একজন কে পাওয়া গেলো। সে ছেলের মা কে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিলো। নিউইয়র্ক থেকে এসেছি শুনে বলল, খুবই ঘনিষ্ঠ বুঝি?
খুবই।
কথা বলে ভাল লাগলো। আন্তরিকতা পূর্ণ ব্যবহার। আমিই বললাম, আপনি ছেলের মা, অনেক দায়িত্ব । অনেক লোকজন আসছে। আপনি ওদেরকে দেখাশোনা করুন।
বসে আছি। একজন এসে বলল, বৌ এসেছে, বৌ এসেছে।
আমরা উঠে দাঁড়ালাম।
বাপের হাত ধরে যে মেয়েটি সলজ নয়নে এলো, তাকে আমি দেখলাম বহুদিন পড়ে। লাল রঙের শাড়ী পেঁচিয়ে উঠেছে মাথা অবধী। ঘোমটা টানা। গয়না দিয়ে ঢাকা গলা, কপালে স্বর্ণ খচিত অলঙ্কার। নাকে নথ।
এ এক লজ্জাবতী লতা।
মনে হোল এ পানিতে ভাসা পদ্মফুলের কুড়ি। আস্তে আস্তে উদ্ভাসিত হবে।
আমি যেন স্বপ্ন দেখছি।
ওর মুখের উপর আর একটা মুখ ভাসছে। ওরা সবাই দেখতে একি রকম। এই দিনে ওদের জ্যোতি ছড়িয়ে পড়ে সবার মাঝে। ওদের হাসিতে ঝরে মুক্তো। ওদের চাহুনী বলে, আমি এলাম, আমি জয় করলাম তোমাকে, তোমাদের সবাই কে।
দুলাভাই? কি হোল, ছবি উঠাবেন না?
হাঁ, তাইতো, দেখছিলাম মৌ কে।
খুব সুন্দর লাগছে দেখতে তাই না?
অপূর্ব। দেখো জয়া আর জেসী কে। কি সুন্দর সাঁজ। খুউব মানিয়েছে।
ডলি এসে পাশে দাঁড়ালো।
মৌ আর সউমিক পাশাপাশি বসল স্টেজে।
ফ্লাস পড়ছে। ওরা হাসছে। ওদের হোল নতুন জীবন শুরু।
ডলিকে বললাম, সার্থক হোল আমা্র আসাটা।
কিছুটা সময় কেটে গেলো সবার সাথে কথা বলতে বলতে। হঠাৎ ই কাধে আলতো ছোঁয়া।
ফিরে তাকালাম।
মৌ।
এসো খালু তোমার সাথে একটা ছবি উঠাই।
আমি তাকালাম ওর কাজলে টানা চোখ দুটোর দিকে। ও চোখে মায়া ঝরছে।