নিত্য দিনের মত আজও সকালে ম্যাকডোনাল্ডে এলাম নাস্তা করবো বলে। লাইনে আমার সামনে এক বয়স্ক মহিলা।
কি কি যেন অর্ডার দিতেই কাউন্টারের মেয়ে টা ডলার পরিমাণ টা জানালো। মহিলা তার পার্স এবং জ্যাকেটের
সবগুলো পকেট খুজে ডলার গুলো মেয়েটার সামনে রাখতেই সে বলল, আরও এক ডলার লাগবে। মহিলা তাকালও মেয়েটার দিকে। বলল, তাহলে হাসব্রাউন টা উঠিয়ে নাও, ওটা আজ আর খাবো না।
আমি পিছনে থাকাতে সব কথাবার্তাই আমার কানে আসছিলো। উদারতা দেখানো আমার চরিত্রে আছে বলে মনে হয় না।
কেনও সেদিন সেই মনভাব আমার মাঝে এসেছিল আমি জানি না।
একটু এগিয়ে যেয়ে বললাম, বাকি পয়সাটা যদি আমি দিয়ে দেই আপনি কি কিছু মনে করবেন।
মহিলা তাকালও আমার দিকে, বলল, না। একদিন হাসব্রাউন নাই বা খেলাম।
না, বলার মাঝে আমি দেখতে পেলাম তার ব্যাত্তিত্ব।
ধন্যবাদ দিয়ে সে তার ট্রে টা নিয়ে চলে গেলো।
আমি নাস্তাটা নিয়ে আমার নিদির্স্ট জায়গায় যেয়ে বসলাম।
বাহিরে চলমান গাড়ী দেখতে আমার ভাল লাগে। পাশের স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হৈ হৈ করে রাস্তা দিয়ে চলছে দেখলে আমার ছোট বেলার কথা মনে পরে। আজ তার সাথে যোগ দিয়েছে ঝিরি ঝিরি বরফের কনা।
বসতে পারি?
চোখ তুলে চাইলাম। সেই মহিলা। মনে হোল বয়স সত্তর পেরিয়েছে।
বললাম অবশ্যই।
হাতের লাঠিটা পাশে রেখে বসল সে। চোখে মুখে বিষণ্ণতার ছাপ। কোন ভূমিকা না করে জিজ্ঞাসা করল, আজ তারিখ টা কত?
বললাম, ১৯ শে জানুয়ারি।
দশ বছর আগে এইদিনে আমার নাতিকে ওরা গুলি করে মেরেছিল। বেচে থাকলে আমার নাতি আজ ২৬ বছরের যুবক হতো। বলে চোখ টা মুছে নিলো হাতের নাপকীন টা দিয়ে।
হঠাৎ ভূমিকা ছাড়াই গল্পের আবির্ভাবে আমি একটু অবাকই হলাম। তবুও বললাম, এতো কম বয়সে কে, কারা মারলও ওকে?
তাহলে বলি, আমার বুকটাকে একটু হাল্কা করতে চাই। এই দিনটা এলে আমি অস্থির হয়ে যাই। তোমাকে আমি চিনি না জানি না, তবুও মনে হচ্ছে তুমি অনেক আপন। শুনবে আমার কথা?
কথা গুলো বলে আমার দিকে তাকাল সে।
ওর চোখের চাহুনীতে মনে হোল সে যেন দুরে কোথাও কি যেন খুজছে। বললাম, বলও তোমার নাতির কাহিনী?
গরীব হলেও আমি আমার স্বামী ভালভাবেই জীবন যাপন করছিলাম আমাদের দেশে।
কোন দেশ?
জিজ্ঞাসা করতেই বলল, নাই বা শুনলে দেশের নাম।
ঠিক আছে, বলও।
ও কাজ করতো এক কারখানায়। ভোর সকালে বেড়িয়ে যেতো, ফিরত রাতে। মেয়েদের কোন কাজ ওখানে ছিল না, তাই আমাকে বাসাতেই থাকতে হতো। ভালই কেটে যাচ্ছিল দিন গুলো।
একদিন ও রাতে কাজ থেকে ফিরতেই বললাম, আমি প্রেগন্যান্ট। ওর খুশি যদি তুমি দেখতে। বছর ঘুরতেই এক মেয়ে এলো।
সংসারের টানা পোড়নের মাঝেও ওকে মানুষ করতে পেরেছিলাম। তখনকার পারিপার্শ্বিক অবস্থা আর আজকের পারিপার্শ্বিক অবস্থার মাঝে অনেক ব্যবধান। এই বলে দীর্ঘ নিশ্বাস নিলো।
বললাম, এক কাপ কফি নিয়ে আসি, কি বলেন?
রাজি হোল।
জানো মেয়েটার কপালই খারাপ। লেখাপড়া খুব একটা করেনি। অল্প বয়সে এক ছেলের পাল্লায় পড়েছিল। বলতে পারো বকাটে ছেলে। বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিতে হয়েছিল। কারন ফীদাল তখন পেটে। হতচ্ছাড়া ছেলেটা কাজকর্ম না করে পাড়ায় পাড়ায় মাস্তানি করে বেড়াতো। আর থাকতো আমার বাসায়। ফীদাল জন্মানোর কয়েক মাস পড়েই বকাটে ছেলেটা যে কোথায় চলে গেলো আর ফিরে এলো না।
লোকে বলে ওকে কেউ খুন করে গুম করে দিয়েছে।
আমার মেয়ে কাজ নিলো এক দোকানে। সকালে যায় রাতে ফেরে। ফিদেলের দেখাশোনার ভার পড়ল আমার উপর।
ফীদেলের যখন বয়স পাঁচ তখন ওর মা ওকে রেখে দিয়ে আর একজনের সাথে ঘর করতে চলে গেলো অনেক দুরের এক গ্রামে। সেই থেকে ফীদেল আমার কাছেই মানুষ হয়ে ছিল।
দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো বাহিরের থেকে, তাকাল আমার দিকে, বলল, জানো, সময়ের সাথে সাথে দেশের পরিস্থিতি অনেক পাল্টে গেছে তখন, উঠতি বয়সের ছেলেদের সরকারের পক্ষ থেকে কাজে ঢোকাবার কোন পরিকল্পনা নেই। এরা রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে। কোন দলের নেতাদের সাথে মিলে তার স্বার্থ উদ্ধারে লিপ্ত হয়। খুন করতেও দ্বিধা করেনা।
সেই সাথে এসেছে ড্রাগ।
আমি ভয়ে ভয়ে থাকি ফীদেল কে নিয়ে। একদিন ফীদেল ফিরছিল স্কুল থেকে। তিন মাস্তান এক গলির মাঝে দাড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিল। ফীদেল ওদেরকে না দেখার ভান করে হেটে যেতেই, ওরা ডাক দিল ওকে। ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসতেই, একজন তার হাতের সিগারেট টা ওর হাতে দিয়ে বলল, জোড়ে টান দে।
ফীদেল চেনে ওদেরকে। এক বিরাট বড়লোকের চেলা এরা। বড়লোকের ড্রাগের ব্যবসা। সব নেতারা তার হাতের মুঠোয়।
কি রে টান দে? বলে মাথায় একটা চাপড় মারলও একজন। জামাটা সরিয়ে দেখালও পিস্তল ।
বাসায় আসতেই ওর চেহারা দেখেই বুঝতে পাড়লাম কিছু একটা হয়েছে। জিজ্ঞাসা করতেই বলল, সব ঘটনা।
এরপর আস্তে আস্তে ফীদেল বদলে যেতে লাগলো। স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলো।
ওকে প্রশ্ন করতেই বলল আমি আর স্কুলে যাবনা। কি হবে যেয়ে ? কয় টাঁকা বেতন পাবো চাকরি করে?
ওর কথা শুনে আমি ভয়ে জড় সর। বললাম, আমাকে সব খুলে বল। কি করছিস তুই ইদানীং।
বলল, নানী, ওরা বাধ্য করেছে আমাকে এই পথে যেতে। তুমি জাননা ওদের কি ক্ষমতা। আমাকে ওরা পিস্তল চালানো শিখিয়েছে। বলেছে ওদের কথা মতো না চললে তোমাদের সবাই কে শেষ করে দেবে। ওদের কথা মতো আমাকে চলতেই হবে নানী। এই বলে অঝোরে কাঁদতে থাকলো আমার নাতি।
আসলে ও ভাল ছেলে ছিল, পরিবেশ ওকে থাকতে দিলো না।
এই বলে মহিলা চুপ করে থাকল।
বললাম, আজ এই পর্যন্তই থাক, কাল শুনবো।
না, তোমাকে বলে আমি হাল্কা হতে চাই।
ফীদেল বাসা নিয়েছিল কিছু দুরে। মাঝে মাঝে আসতো।
একদিন এসে আমার হাতে অনেক গুলো টাকা দিয়ে বলল, এটা রাখো, নানা কে জানাবে না।
আমি নিতে পারিনি। বলেছিলাম, এই টাকা আমি রাখতে পারবো না। তুই ফিরে আয় আমার কাছে।
বলেছিল, আমার আর ফেরার পথ নেই। ইচ্ছে করলেও পারবো না।
সেই শেষ দেখা তার সাথে। আর ফেরে নি সে।
এর পরের ঘটনা গুলো ওর মেয়ে বন্ধুর কাছ থেকে শোনা। তাও ফীদেলের মৃত্যুর অনেক দিনপর।
ফীদেলের বন্ধুদের মধ্যে রোনাল্ডো ছিল ও কাছের মানুষ। একদিন সে নিয়ে এলো ফীদেলকে ভিক্টরের কাছে।
ভিক্টরের আছে বিভিন্ন ব্যাবসা। টাকা পয়সার অভাব নেই। অসৎ পথে এসেছে এই ধন সম্পদ।
সাগরেদদের কথায় এবার তার মন্ত্রিত চাই। তার বিপরীতে সান্তস।
অনেক অনেক পরিচিত নাম।
ভোটে জিততে হলে একটাই পথ, সান্তস কে সরিয়ে দিতে হবে পৃথিবী থেকে। সেই জন্য রোনাল্ডো নিয়ে এসেছে ফীদেল কে ভিক্টরের কাছে।
ভিক্টর জানে ফীদেল এখনো বয়স্কদের পর্যায়ে আসেনি। ও খুন করলেও ফাসী তার হবেনা।
ভিক্টরের হয়ে ফীদেল অন্য কাজ করেছে। মারপিটে অংশ নিয়েছে। তবে কোনদিন খুন করেনি। ভিক্টরকে সে দুই একবার দেখেছে, কথা হয়নি। কাজের শেষে টাকা সময় মতো তার হাতে এসে গেছে।
ভিক্টর বসেছিল তার প্যালেসের ফুল দিয়ে ঘেরা উঠানে।
ফীদেল এসে ওর সামনে দাড়াতেই ওকে বসতে বলল সামনের চেয়ারে। অনন্যাও দেরকে চলে যেতে বলে শুধু রোনাল্ডো কে থাকতে বললও।
ফীদেলের হার্ট বীট উৎরতর বাড়তে বাড়তে এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়াল যে সে ভিক্টর কে প্রশ্ন না করে থাকতে পারলো না।
“ আমাকে কি কোন কাজের জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন, স্যার?” প্রশ্ন টা করে হাতের রুমাল টা দিয়ে কপালের ঘাম টা মুছে নিলো ফীদেল।
হাঁ। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। তার জন্য তোমাকে প্রচুর টাকাও দেওয়া হবে। রোনাল্ডো তোমাকে Details বলবে। কথা শেষে ভিক্টর তাকালও রোনাল্ডোর দিকে।
রোনাল্ডো ফীদেলের হাতে টিপ দিয়ে বলল, চল।
ছোট্ট একটা জলাশয়, কচুরি পানায় ভরা। ফীদেল এতদূরে কোনদিন আসেনি। রোনাল্ডোই নিয়ে এলো। পথের সময় টুকু কোন কথা না বলেই কেটে গিয়েছিল। দুইজনে এসে বসলো জলাশয়ের পাশে।
কোন ভূমিকা না করেই রোনাল্ডো বলল, “ শোন, সান্তসকে সরিয়ে দিতে হবে এই পৃথিবী থেকে। এই কাজ তোকে করতে হবে আগামীকাল। সান্তসের বাসায় তার দলের মিটিং আছে। মিটিং শেষে সান্তস যাবে পাঞ্ছুতে মিছিলে অংশ নিতে। ওর গাড়ী বেড়িয়ে বড় রাস্তায় টার্ন নেওয়ার সময় তোকে এই কাজ শেষ করতে হবে।
সান্তস সব সময় বসে গাড়ীর পিছনের সীটে। বা দিকে। হেলমেট পরে নিবি, যাতে কেউ চিনতে না পারে।
কাজ শেষে সোজা এসে দাঁড়াবি কেন্টন আর পার্থ রাস্তার কর্নারে। ওখানে তোকে পাওনা মিটিয়ে দেবো”। এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে সে উঠে দাঁড়াল।
ফীদেল জানে এই কাজ তাকে করতেই হবে। এক হচ্ছে টাকা অন্য দিকে মরনের ভয়। ভিক্টর তাকে বাচতে দেবেনা যদি সে পিছিয়ে যায়। এ দ্রুবসত্য।
সকাল দশটা। মোটর সাইকেলের উপর বসে ছিল ফীদেল। গলি আর বড় রাস্তার উল্টো দিকে দাড়িয়ে আছে রোনাল্ডো। ওর ইশারা পেলেই সে মোটর সাইকেল স্টার্ট দেবে। সান্তসের বাসার সামনে অনুগামীদের জটলা। সংখায় ততটা নয়। তবুও ছোট গলি বলেই জটলা টা অনেক মনে হচ্ছে।
সান্তস বেড়িয়ে আসতেই কিছু লোক এগিয়ে গেলো কর্মদন করতে। সান্তস দুই একজনের সাথে হাত মেলাল। হাত নেড়ে অভিনন্দন জানিয়ে গাড়ীতে উঠতেই দেহরক্ষী গাড়ীর দরজা বন্ধ করে দিল।
ধীর গতিতে গাড়ি বড় রাস্তার কাছে আসতেই সান্তস জানালা টা খুলে আবারও হাত নাড়িয়ে অভিনন্দন জানানোর মুহূর্তে ফীদেলের ছুটে আসা মোটর সাইকেল থেকে দুটো ঘুলি সান্তসের কপাল ভেদ করে বেড়িয়ে গেলো।
ঢলে পড়লো সান্তস। বিকট শব্দ করে ফীদেলের মোটর সাইকেল মিলিয়ে গেলো। চারিদিকে শুধু হৈ চৈ।
ফীদেল এসে দাঁড়ালো কেন্টন আর পার্থ রাস্তার কর্নারে।
জাগাটা নিরিবিলি। মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ী ছুটে চলে যাচ্ছে।
মোটর সাইকেল টা রাস্তার পাশে পার্ক করে সিগারেট টা ধরাল। বুকের ধরপড়ানি একটু কমে এসেছে। রোনাল্ডো তার টাকা পয়সা মিটিয়ে দিলেই সে ঠিক করেছে এই এলাকা ছেড়ে চলে যাবে। আর নয়।
রোনাল্ডোর আসতে দেরী হওয়াতে একটু চিন্তিত হোল ফীদেল। তার জানা মতে ভিক্টর কখনো কথার খেলাপ করেনি।
দুরে একটা মোটর সাইকেল আসতে দেখে ফীদেল এগিয়ে এলো। মোটর সাইকেল টা এসে দাঁড়ালো ফীদেলের কাছে। চালকের মাথায় কালো হেলমেট। পিছনে ব্যাগপেক।
এই রোনাল্ডো, বলে ফীদেল এগিয়ে আসতেই লোকটা তার কোমরে গোজা রিভলভার বের করে গুলি করলো ফীদেল কে।
ফীদেল পড়ে গেলো মাটিতে। রক্তে ভিজে গেলো তার টি সার্ট।
ভিক্টর তার অপকর্মের কোন ছিন্ন রাখতে চায় নি। পাছে ফীদেল ধরা পড়ে। সবকিছু ফাঁস হয়ে যায়।
আমাকে খবর দিয়েছিল ওর এক বন্ধু। লাশ সনাক্ত করে দিয়ে এলাম। সেই শেষ।
মহিলা চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। গাল বেয়ে পানি পড়তে দেখে ন্যাপকীন টা এগিয়ে দিলাম। চোখটা মুছে তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে। মনে হোল তার দৃষ্টি এখানে নয়, চলে গেছে সেই সুদুর দেশে যেখানে ফীদেল ঘুমিয়ে আছে।