ছোট্ট একটা পার্স

ছোট্ট একটা পার্স। আমার না। উনার। উনার নাম তনয়া। তনয়ার সাথে দেখা না হলে আজ খাতা কলম নিয়ে না বসলেও চলতো। কিন্তু না। বসতে হোল কারন ঐ পার্সটা আমাকে অনেক ভোগান্তি দিয়াছিল। সেই সাথে দিয়েছিল তার সান্নিধ্যতা, অন্য আরও কিছু।

আমি তনয়ার শুদ্ধ বাংলা কথায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। না বলতে পারিনি যখন  সে বলেছিল এই বিদেশ বিভুয়ে আপনি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। এই সমস্যার সমাধান আমি একলা করতে পারবনা। আমার ভয় হচ্ছে। ঐ পার্সটা আমার ভীষণ দরকার।  অল্পক্ষনের পরিচয়ে মনে হচ্ছে আপনি আমার অনেক কাছের। তাই তো আপনাকে আমি অনুরোধ করছি, আপনি আমার সাথে থাকুন। প্লীজ।

ঘটনা টা আরম্ভ হয়েছিল ঠিক এই ভাবেঃ

রোমে কয়েকটা দিন কাটিয়ে এসে পৌছালাম লীসবনে। সেখান থেকে আমার গন্তব্যস্থল প্যারিস। সকাল এগারটায় আমার ফ্লাইট। যথারীতি হাতে বেশ কিছু সময় নিয়ে এয়ারপোর্টে পৌছালাম। গেটের কাছে বসে আছি। আধা ঘণ্টা বাকি প্লেন ছাড়বার। কিন্তু তখনো বোর্ডিং এর জন্য না ডাকাতে বুঝলাম সময় মতো যাওয়া হবে না। যাহা চিন্তা তাহাই বাস্তব ।

এনাউন্স করলো প্লেন এক ঘণ্টা লেট। অগত্যা না শেষ করা উপন্যাস টা খুলে বসলাম। দুপাতা উল্টাতেই, শুদ্ধ বাংলায়, আপনি বাঙালি,কথাটা শুনে ফিরে তাকালাম।

 উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, কাঁটা কাঁটা চেহারা, লাল ব্লাউজের সাথে কালো ট্রাউযার, গলায় সাদা পার্লের মালা, কাঁধে ঝোলান ছোট্ট একটা পার্স। চোখ সড়াতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো। সেটা আমার দোষ নয়, দোষ ঐ সুন্দর চেহারার। নিখুঁত ভাবে বানিয়ে পাঠানো হয়েছে এই দরাধামে।

পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে বলল, বসতে পারি?

নিশ্চয়?

কার লেখা বই?

জিজ্ঞাসা করতেই উপরের কাভার টা দেখালাম।

প্রিয় লেখক বুঝি? আমারও।

এই বলে লেখকের আরও কতগুলো বইএর কথা বলতেই বুঝলাম কথা চালাতে অসুবিধা হবে না।

 জিজ্ঞাসা করলাম, এই লীসবনের মাটিতে কতদিন। উত্তরে বললও, এসেছিলাম মাদ্রিদে বান্ধবীর বাসাতে। সেখান থেকে লীসবন। তিনদিন কাটিয়ে ফিরে যাচ্ছি প্যারিসে।

দেখুন তো, আমার নাম টাই বলা হলনা। আমি তনয়া।

হ্যান্ডসেক করে আমি আমার নাম বললাম।

একলা বুঝি?

পাশে যখন কেউ নেই, তখন তো একলাই বলতে হবে। এই মুহূর্তে আপনি আছেন। কথাটা বলে ভাবলাম বলাটা কি ঠিক হোল?

একটু হেসে বললও, আমিও আপনারই মতো। এই ক্ষণে আমি আর আপনি। আপনি আর আমি।

সেইক্ষণে ওর ডান গালের টোলটা আমার চোখে পড়ল।

এতো সহজ ভাবে তনয়া  কথা গুলো বলল যে মনে হোল ওর সাথে আমার পরিচয় আজকের নয়।

এনাউন্সমেন্ট কানে এলো। বোর্ডিং শুরু হতে যাচ্ছে।

তনয়া তার নিখুঁত ভাবে সাঁজা চোখ দুটো দিয়ে তাকাল আমার দিকে,” আপনার সীট নাম্বার কতো?”

দেখালাম।

উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলো, ভবিতব্য।

আচমকা উচ্চকণ্ঠে ভবিতব্য বলে উঠাতে আমি চারিদিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার?

আমরা সীট টা ঠিক আপনার পাশেই, গল্প করতে করতে সময়টা পার করে দেয়া যাবে।

শুনে আমি যে আনন্দিত হয়নি তা নয়, তবে তার প্রকাশ বাহিরে না দেখিয়ে বললাম, দুই থেকে তিন ঘণ্টার গল্পের খোরাক আছে কি?

আমার আছে। তবে আপনি যদি আমার সান্নিধ্যে বিরক্ত বোধ করেন তাহলে আমার বলার কিছু নেই। আমি কিন্তু আপনার সান্নিধ্য ভীষণ ভাবে উপভোগ করছি। এই যাত্রা তিন ঘণ্টা না হয়ে যদি পাঁচ ঘণ্টা হতো তাহলে অনেক কথা বলা হতো যা কখনো—-।

কথা শেষে হওয়ার আগেই কাউন্টারের মেয়ে টা ডাকদিলো।

ওর কথা গুলো আমার মনে ছন্দ জাগালো, এ যেন তরঙ্গমালা, প্রতিটি শব্দ গুঞ্জরিত হতে থাকলো আমার তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে।

শেষ কথাটার শেষ কি ভাবে শেষ হতো সেই কথা ভাবতে ভাবতে আমি ও এগিয়ে গেলাম কাউন্টারের দিকে।

প্লেনের মাঝামাঝি অংশে আমাদের সীট। আমার হাতের ছোট্ট সুটকেস টা উপরে উঠিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম তার হাতের ব্যাগটা দেবে কিনা।

বলল না ওটা আমার পায়ের কাছেই থাকবে।

বেল্ট টা বেঁধে তাকালাম তনয়ার দিকে। বললাম এবার আপনার কথা শুরু হোক। প্রথম থেকে। এখনো আমাদের পরিচয়ের পর্ব শেষ হয়নি।

কোথা থেকে আরম্ভ করবো বলুন। বলে সে তার কাঁধে ঝোলানো পার্স টা পায়ের কাছে রেখে দিলো।

সেই জন্মস্থান থেকে।

বাড়ী আমার বাংলাদেশের রাজশাহী তে। বাবা ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকনমিক্সে ভাল রেজাল্ট নিয়ে পাশ করাতে একটা অফার পেয়েছিলাম উচ্চশিক্ষারতে লন্ডনে আসার।

 মা আসতে দিতে চায়নি। বাবা রাজি থাকাতে মা আর বাড়ন করেনি।

লন্ডন থেকে প্যারিস?

শিক্ষা শেষে চাকরি নিয়ে চলে এলাম প্যারিসে। তাও অনেক দিন হয়ে গেলো।

দেশে শেষ কবে গিয়েছিলেন।

আর ফিরে যাওয়া হয়নি। মা কেও আমার আর শেষ দেখা হয়নি।

ব্যক্তিগত একটা প্রশ্ন করব যদি কিছু মনে না করেন।

প্রশ্ন শুনে বলল, আপনি কিন্তু দুরেই রয়ে গেলেন। এখনো কাছে আসতে পারলেন না। জানেন রবি ঠাকুরের একটা গান আমার খুব প্রিয়।

কোন টা?

“না চাহিলে যারে পাওয়া
যায়। তেয়াগিলে আসে হাতে
দিবসে সে ধন হারায়েছি

আমি পেয়েছি আঁধারও রাতে”

এখন প্রশ্ন করুন?

ওর এই গানের মানে টা আমি খুজতে চাইছিলাম। কেনও হঠাৎ করে রবীন্দ্রনাথ কে টেনে আনল।

রহ্যসের জাল ওখানে রেখেই বললাম, না মানে, বলছিলাম কি, আপনি কি প্যারিসে একা ?

ও উত্তরের দেওয়ার  আগেই ক্যাপ্টেনের ঘোষণা,

 অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি মেকানিক্যাল প্রবলেমের জন্য আমাদের এই প্লেন উড়তে সক্ষম নয়। আপনাদেরকে অন্য আর একটা প্লেনে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। আপনারা যার যার ল্যাগেজ নিয়ে নেমে আসুন।

তাড়াতাড়ি করে মানতে যেয়ে হোঁচট খেলাম সামনের ভদ্রমহিলার টানা সুটকেসের সাথে। ভদ্রমহিলা কটমট করে চাইল আমার দিকে। দোষটা আমার নয় তার। চলতে চলতে হঠাৎ করে সে দাড়িয়ে পড়েছিল। পিছনে খিলখিল করে হাসতে শুনে তাকিয়ে বললাম, আপনি হাসছেন?

কি করব বলেন, উনি যে ভাবে আপনার দিকে তাকালেন মনে হোল আপনাকে উনি ভস্ম করে দিতে পারে চোখের চাহুনী দিয়ে।

কি মনে হচ্ছে জানেন, ঐ যে বলে, সকালে উঠিয়া এ মুখো দেখিনু দিন যাবে আজি ভাল।

আমার বেলায় হয়েছে উলট। বলতে গেলে, সকালে উঠিয়া যে পেঁচা দেখেছি, দিন আজ ভাল নাহি যাবে।

সে হাসতে হাসতে বলল, তা সে পেঁচাটা কে?

ঐ পেঁচা মার্কা রীসেপ্সনীস্ট।

কথা বলতে বলতে আমরা নেমে এলাম প্লেন থেকে। নিচে বাস অপেক্ষা করছে আমাদের কে নিয়ে অন্য প্লেনের কাছে পৌছে  দেবার জন্য। তনয়া তার হাতের ব্যাগ নিয়ে উঠতে অসুবিধা হওয়াতে আমি আমার হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। ও ধরল আমার হাতটা। ওর মসৃন শীতল হাতটা আমার উষ্ণ হাতটাকে শীতল করে দিলো।

ও তাকাল, বলল, আপনার হাতটা গরম, জ্বর আসেনি তো?

  বললাম, না। আমার শরীরের তাপমাত্রা একটু বেশিই থাকে। ওর কথাটা কানে আমার বাজতে থাকলো।

বাস আসে থামল নতুন প্লেনের কাছে। নেমে এলাম। বিরক্ত বোধ করছিলাম কয়েক ঘণ্টা পিছিয়ে গেলাম পৌছাতে। বন্ধু এসে দাড়িয়ে থাকবে এয়ারপোর্টে। যার যার সীটে এসে বসতেই ক্যাপ্টেন ঘোষণা করলো, আমাদের প্লেন কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে যাবে, শুধু মালপত্র উঠার অপেক্ষায়।

আমার কিন্তু বেশ ভালই লাগছে, এক প্লেন থেকে আর এক প্লেন, সাথে আপনি, কথা বলার সাথী, শুধু সাথীই নন, আরও—

আমার পার্স ?

কোন পার্সের কথা বলছেন, যেটা আপনার কাঁধে ঝোলান ছিল ?

হাঁ। কোথায় সেটা?
শেষ আমি দেখেছিলাম আপনার পায়ের কাছে ঐ আগের প্লেনে।

কান্না কান্না স্বরে তনয়া বলল, ওটা যে আমার ভীষণ দরকার। ওর ভিতরে আমার সব দরকারি কাগজ, শুধু তাই নয় আমার কাজের আইডেন্টীফিকেস্ন কার্ড আর চাবি। ওটা যে আমার না হলেই নয়।

ওর কথা শুনে মনে হোল আমিই একমাত্র ব্যাক্তি যে কিনা এটা উদ্ধার করতে পারি। ওর চোখের দিকে চেয়ে মনে হোল এখনি সে কেঁদে ফেলবে।

বললাম দেখি কি করা যায়।

প্লেনের সিঁড়ি তখনো সরিয়ে নেওয়া হয়নি। উঠে যেয়ে প্লেনের ক্রু দের প্রধান কে জানালাম, ওর পার্সের কথা।

সব শুনে সে বলল, দেখি কি করতে পারি।

তনয়ার সেই হাস্যজল চেহারায় মলিনতার ভাব। উৎকণ্ঠা। আমাকেও ভাবিয়ে তুলল।

এক মিনিট দুই মিনিট করে পাঁচ মিনিট কেটে গেলো।

এগিয়ে আসতে দেখলাম সেই ক্রু কে।

পাওয়া গেছে? ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলো তানয়া।

পাওয়া গেছে, তবে সেটাকে লস্ট এন্ড ফাউন্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওটা নিতে হলে যার পার্স তাকে নেমে যেতে হবে এই প্লেন থেকে। চেক ইন ল্যাগেজ গুলো নামিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে টার্মিনালে। পরের ফ্লাইটে চেক ইন করতে হবে নতুন করে। মাত্র পাঁচ মিনিট সময় আছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।

ওর ফ্যাকাসে মুখটার দিকে তাকালাম।

ও আমার দিকে চেয়ে বলল, আপনি থাকুন আমার সাথে, প্লীজ।

ওর কথার মধ্যে কি ছিল জানিনা, আমি রাজি হয়ে গেলাম। মনে হোল আমি যেন কি জয় করতে চলেছি। ওকে ওর সমস্যার থেকে উদ্ধার না করলেই নয়।

ও ছলছল নয়নে বলল, আপনাকে আজ পাঠানো হয়েছিল আমারই জন্য। ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না।

নেমে এলাম আমরা দুজন। বাস আমাদের কে নিয়ে এলো টার্মিনালে।  যত সহজ মনে হয়েছিল আসলে তা নয়। ক্রু আমাদের কে সঠিক ইনফরমেশন দেয়নি।

লস্ট এন্ড ফাউন্ডে এসে জিজ্ঞাসা করতেই বলল, এই ধরণের কোন পার্স আমাদের এখানে জমা দেওয়া হয়নি।

তবে যে প্লেন থেকে বলল, এখানে—

কথা শেষ করার আগেই মেয়ে টা গম্ভীর ভাবে রাগন্ত স্বরে বলল, ওরা কি বলেছে জানিনা আমার কম্পিউটারে ওটার হদিস নাই। তোমরা এয়ার লাইন্সের লস্ট এন্ড ফাউন্ডে যেয়ে জিজ্ঞাসা করো।

ওটা কোথায়।

টার্মিনালের বাহিরে।

তাহলে তো আমাদের কে আবার নতুন করে ইমিগ্রেশন করে ঢুকতে হবে।

হাঁ, আবারও রাগন্ত স্বরে বলল, তাই করতে হবে।

ভয়ে ভয়ে তনয়া জিজ্ঞাসা করল, আর আমাদের ল্যাগেজ?

ওটা পড়ে থাকবে ব্যাগেজ ক্লেমে। নেক্সট যে ফ্লাইটে যাবে সেখানে উঠিয়ে দেওয়া হবে। তবে  তার আগে নেক্সট কোন ফ্লাইটে তোমরা সীট পাবে তার ব্যবস্থা করো যেয়ে।

আমি আপনাকে খুব অসুবিধার মধ্যে ফেললাম, তাই না? কি করে আমি আপনার এই ঋন আমি পরিশোধ করবো। আমি জানি না।

আমি  উদার কণ্ঠে বললাম, সে কথা থাক, চলুন আগে টিকিটের ব্যবস্থা করি। তারপর আবার ফিরে আসবো এই খানে।

আমি  উদার কণ্ঠে বললাম, সে কথা থাক, চলুন আগে টিকিটের ব্যবস্থা করি। তারপর আবার ফিরে আসবো এই খানে। এর মঝে ওদের কম্পিউটারে ওটা এসে যেতেও পারে।

নতুন করে টিকিটের লাইন বড় না হলেও সময় লাগছে অনেকক্ষণ। যারা লাইনে তাদের সবারই সমস্যা। এই লাইন সমস্যার লাইন।

এক ঘণ্টা পেড়িয়ে যাওয়ার পরও খুব বেশি দুর যে এগিয়েছি মনে হোল না।

তনয়ার আবারও বলল, আমার পার্স টা পাবো তো ?

তাতো জানি না তবে এক কাজ করুন, আপনি ফিরে যান আগের সেই লস্ট এন্ড ফাউন্ডে। দেখুন কোন খবর এসেছে কি না।

তনয়া চলে গেলো। আমি হিসেব কষতে বসলাম। লাভ লোকসানের পাল্লায় কোন পাল্লাটা ভারী। মনে হলো ও যেন কি বলতে চাইছে অথচ বলছে না। আবার সব টাই হয়তো আমার তৈরি করা মনের খোরাক।

আমি গুটি গুটি পা করে বেশ কিছুটা এগিয়ে এসেছি। সামনে মাত্র তিনজন। তনয়ার কোথাও চিহ্ন আমি পাচ্ছিনা। অস্থিরতা আমার বেড়েই চলল। এই উটকো ঝামেলা আমি নিজে হাতে তৈরী করেছি। নিজের উপর এই মুহূর্তে রাগ হোল। আমার সামনে এর একজন লোক।

ঠিক সেই মুহূর্তে আমি দেখতে পেলাম তনয়াকে। সে হাসছে। সে দৌড়িয়ে আসছে। কাঁধে তার পার্স।

কি হোল?

পেয়েছি।

তা তো দেখতে পারছি? কি ভাবে।

আর একটা মেয়ে সাহায্য করেছিল। খুব ভাল মেয়ে টা। কোথায় যেন ফোন করল, তারপর বললও আর একটা লস্ট এন্ড ফাউন্ডের জাগা আছে, সেখানে যাও। জাগাটা খুজেতে একটু সময় লেগেছিল তাই দেরী হয়ে গেল। আপনি খুব সুন্দর সাজেসন দিয়েছিলেন। ধন্যবাদ।

আমরা কাউন্টারে এসে গেলাম। বুঝিয়ে বললাম। বলল, পরের ফ্লাইটে সীট আছে তবে দুই ঘণ্টার মধ্যে ছাড়বে। তোমাদের কে বের হয়ে যেয়ে নতুন করে ঢুকতে হবে।

ল্যাগেজ?

জিজ্ঞাসা করতেই বলল, ওটা ওই ফ্লাইটে চলে যাবে।

দৌড় দিলাম। তনয়ার পায়ে হিলের জুতা।

বললাম, ভ্রমনে বেড়িয়ে এই জুতা কি মানায়।

ফিরে যাচ্ছি, তাই পড়েছিলাম। বলে হাসল।

বাহ এখন তো বেশ হাসি আসছে। আবারও হাসল সে

ইমিগ্রাসনের লাইন দেখে আতকীয়ে উঠলাম। হাতে আছে এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট।

তনয়া তার হাত ঘড়িটা দেখল। তাকাল আমার দিকে।

পারবো কি যেতে? এর পরে তো আবার সীকুরিটি চেক আছে। বলে আবারও দেখল ঘড়িটা।

বললাম, ওপরওয়ালা কে ডাকা ছাড়া এর কোন উপায় আছে বলেত মনে হচ্ছেনা।

বাঁধা বিঘ্ন পেড়িয়ে অবশেষে প্লেনের ভিতরে এলাম। শরীর টা এলিয়ে দিলাম সীটে। ভীষণ ক্লান্ত আমি, তনয়া উভয়ে।

কিন্তু সামনে যে আরও কিছু অপেক্ষা করছে তা তো জানা ছিলনা। সে কথা আসবে পরে।

তনয়াকে বললাম আর নয়। এবার চোখ বন্ধ। ঘুম।
না। আমার কথা তো এখনো শেষ হয়নি।

শেষ হয়নি। আমি দু চোখ মেলে জিজ্ঞাসা করলাম।

এর মাঝে ড্রিঙ্কস আর স্যান্ডউইচ দিয়ে গেলো।

ড্রিঙ্কসে চুমুক দিয়ে বললও, আমি কিন্তু আমার সব কিছুই বলেছি, আপনার কিছুই আমি জানিনা।

আপনার শেষ গন্তব্য স্থান, ভ্রমনের পরে কি করবেন, বলবেন কি?

বললাম, থাকি স্টেটসে, কাজ করি একটা ল ফার্মে। ঘুরতে বেড়িয়ে ছিলাম এক মাসের ছুটিতে। ফিরে যেয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ব কাজ নিয়ে।

শুধু কাজ নিয়ে? আর কিছু নিয়ে নয়। বলে তনয়া আমার চোখের থেকে দৃষ্টি সরাল না।

ও কি বলতে চাইছে আমার বুঝতে বাকি রইল না। মনে হোল এই মরীচিকার পিছনে না ছোটাই ভাল। বললাম, না আর কিছু নেই। শুধু আমি।

ও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। জানালার দিয়ে তাকিয়ে রইল দুরে ভেসে যাওয়া মেঘ গুলোর দিকে। কিছুটা রোদের আভা জানালা দিয়ে ওর মুখে এসে পড়েছিল। মনে হোল আমি যদি তুলি দিয়ে আঁকতে পারতাম, তাহলে এই মুহূর্তে এক অসাধরন ছবির জন্ম হতো।

নাহ, মনের এই দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। আর কয়েক ঘণ্টা পরে হবে ওর সাথে আমার শেষ দেখা। তাই হোক।

ও মুখটা ফিরিয়ে নিলো জানালা থেকে। বলল, আচ্ছা আমাদের কি আর কখন দেখা হতে পারে না। আপনার কি ইচ্ছে করে আবার আপনার সাথে আমার দেখা হোক।

আপনার করে কি?

করে। ইচ্ছে করে আবার দেখা হোক। আপনার উত্তর আমি পাইনি। বলে তাকাল।

ওর চোখের ভাষা আমার বুঝতে বাকি রইল না। তবু সোজা ভাবে উত্তর না দিয়ে বললাম। পৃথিবী টা খুব ছোট, আর গোল। কাজেই দেখা হবে বৈকি?

ক্যাপ্টেনের কথা ভেসে এলো। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই প্যারিসে অবতরন করব। আপনারা যার যার সীট বেল্ট বেঁধে নিন।

তনয়া তার পার্স টা দেখে নিলো।

আমাদের ল্যাগেজ আসবে পাঁচ নম্বর Corousel এ। যথারীতি প্লেন ল্যান্ড করলো। আমরা নেমে এলাম। আবারও সেই

ইমিগ্রাসনে। আবারও সেই ভিড়। তনয়াকে ক্লান্ত মনে হচ্ছে। আমিও ক্লান্ত।

সব শেষ করে বের হতে আধা ঘণ্টার উপর হয়ে গেলো। Corousel এর কাছে এসে দেখলাম আমদের প্লেনের মালপত্র এসে গেছে। দুই একটা সুটকেস পরে আছে। আমাদের টা নেই।

হায়রে কপাল।

“ আর কত দুরে নিয়ে যাবে হে সুন্দরী—“ তনয়া গুনগুণ করে বলে উঠল।

আপনার এখনও কবিতা আসছে।

কেন আসবে না। সমস্ত ভোগান্তি টা হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছি।

ভোগান্তি, সামনে আরও কতো ভোগান্তি আছে সেটা ভাবতে যেয়ে মনে হোল, ভোগান্তি ছিল বলেই যে মিষ্টতা আমি পেলাম তার পরিমাণ তোঁ কম নয়। তনয়ার সান্নিধ্য আমাকে আনন্দ দিয়েছে। বৃষ্টির শেষেই তো রোদ আসে।

এসে দাঁড়ালাম আবারও সেই লস্ট এন্ড ফাউন্ডে। সব কিছু বলতেই ভদ্রলোক তার কম্পিউটারে কি যেন দেখল।

বলল, কোণটা শুনতে চাও আগে, ভাল টা না মন্দটা?

এতো রাতে রসিকতা ভাল লাগছিল না। তবুও রাগের প্রকাশ না করে বললাম, সুখবর আগে দাও।

সে বলল, তোমাদের সুটকেস আসছে।

আসছে? আসছে মানে? তনয়ার বিস্ময়।

আসছে মানে, সুটকেস গুলো আসবে নেক্সট ফ্লাইটে। এবং সেটা আসবে আরও দেড় ঘণ্টা পরে।

রাত তখন এগারটা। ল্যাগেজ নিয়ে আমরা এসে দাঁড়ালাম বাইরে।

দুজনে তাকালাম দুজনের দিকে।

জিজ্ঞাসা করলাম কেউ নিতে আসবে কি?

বলল, না আসবে না, আমি একা। আমার কি মনে হচ্ছে জানেন।

বলেন।

এ যেন সেই “ Solva Saal” মুভি। সকাল থেকে রাত আমরা কাটিয়ে দিলাম এক সাথে। আর কি দেখা হবে না আমাদের?

হবে, তিন মাস পরে আবার আমি আসব এই খানে। কথা দিলাম।

এই চিরকুট তে আমার ফোন নম্বার। ট্যাক্সিতে যেয়ে খুলবেন, তার আগে নয়। এই বলে সে ট্যাক্সির দিকে এগিয়ে গেলো, পিছন ফিরে তাকাল, বলল, তিন মাস পরে দেখা হবে। কথা দিয়েছেন।

ওর ট্যাক্সির আলো মিলিয়ে গেলো দুরে।

আমার ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো। চিরকুট টা খুললাম।

ফোন নাম্বার, নিচে লেখাঃ

“তুমি না হয় রহীতে কাছে

,কিছুখন আরও না হয় রহীতে কাছে,

 আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে।—“

Continue Reading