তনয়া তুমি

যেখানে তনয়া আর আমার শেষ দেখা হয়েছিল, সেই খানে আমি আবার ফিরে এসেছিলাম তিন মাস পর। কথা আমি দিয়েছিলাম, কথা আমি রেখেছি।
বলতে গেলে ডেভিডই আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, অন্য মনস্ক ভাবে কাজ করলে, এই ফার্ম তোমাকে রাখবে না। ডেভিড আমার কলীগ। একি জাগায় কাজ করি। তনয়ার কথা তাকে বলেছিলাম।
শুনে বলেছিল, এতদিনে তোমার হৃদয়ে ঝর্নার জল ধারা বইতে শুরু করেছে মনে হচ্ছে। এ স্বপ্ন নয়তো।
বলেছিলাম মনে তো হচ্ছে না। তবে –
তবে মানে?
মানে প্রেম শব্দ টা কোনদিনই আমার ডিকশনারিতে ছিল না। ওটা আমার কাছে সবসময়ে মনে হয়েছে সময়ের অপব্যবহার।
ছোট ছোট কথা বলা, এঁকে অপরেরে দিকে তাকিয়ে থাকা, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে বিদায়ের পর্ব। এসবের কোন মানে ছিল না আমার কাছে যদিনা দেখা হতো তনয়ার সাথে।
দেখেছো কি সরুসরু আঙ্গুলের নখের উপরে ট্রান্সলুসেন্ট নেল পলিসের প্রলেপ। দেখেছো কি ভিজে ভিজে ঠোটের পরে লালের আভা।
রাখ তোমার কাব্য। কথা হয়েছে কি?
বলেছিলাম, না, ঐ চিরকুট টা আমি হারিয়ে ফেলেছি। শুধু তাই নয় আমার ফোন নাম্বার টা তাকে দেওয়া হয়নি।
তাহলে তো সব কর্মের অবসান এইখানে। বলি কি ঐ যে দেখছ মিস ললিতা, যার দুর্বলতা আছে তোমার উপর, তাকে তনয়া মনে করতে আপত্তি কি?
ওর মাঝে আমি দেখতে পাইনা তনয়ার চোখের গভীরতা। শুনতে পাইনা আমার ভাষায় গুনগুণ করে মধুর স্বরে গাওয়া গান গুলো।
তা তোমাকে টেগোরের গান না শুনিয়ে যদি সেক্সপীয়ারের মাকবেথ আবৃতি করে তাতে দোষ কি?
দোষের কিছু নয়। ওর সাথে আমি দুই এক বার যে বের হয়নি তা নয়।
অবাক হয়ে ডেভিড কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। বের হয়েছিলে? কবে? আমাকে তো বলোনি?
বলার মতো কিছু ঘটে নি, তাই।
ব্যাখ্যা কর?
একদিন কাজের শেষে ললিতা এসে বলেছিল, খুব তাড়া আছে কি তোমার?
বললাম, না, কেনও বলতো?
তাহলে একসাথে কোথাও বসে বিকেল টা উপভোগ করতাম।
বললাম, কোন স্পট তোমার জানা আছে কি? মনে মনে ভাবছিলাম উল্টো টা হওয়ারই তো কথা? ছেলেরাই তো প্রস্তাব দেয়।
যাক, ঐ ভাবনা বাদ দিয়ে এসে বসলাম দুই ব্লক দুরে স্টারবাকসে।
ও অর্ডার দিলো Ice coffee with milk, আমি নিলাম টল কফি।
নিতান্তই সাদা মাটা কথা দিয়ে শুরু। বললও, আগে ছিল ক্লিভল্যান্ডে, মন টেকে নি। এখানেও বন্ধু বান্ধবী খুব একটা কেও নেই। কাজের পরে সময় কাটতে চায় না। আমিও কি একা? প্রশ্ন করেছিল সে।
একা শুনে বলেছিল তাহলেই কি আমরা এঁকে অপরের সান্নিধ্যে সময় কাটাতে পারিনা?
তোমার উত্তর? ডেভিডের প্রশ্ন।
তুমি তো জানো। অনেক না হলেও বেশ কিছু বান্ধবী আমার আছে। তাড়া শুধু বান্ধবীই। এর বেশি নয়। কিন্তু সেদিন ললিতার চোখে আমি শুধু বন্ধু নই, অন্য কিছুর আভাস আমি পেয়েছিলাম। তাই আমি ওর দ্বিতীয় দিনের প্রস্তাব রাখতে পারিনি।
তাহলে আমি কি মনে করবো তুমি মানে তুমি—
বুজেছি কি বলতে চাইছ। না, আমি তা নই। তনয়া কি তাহলে আমাকে আকৃষ্ট করতো?
তা হলে এখন কি করবে?
উপায় আছে,
কি?
জানো সেদিন ও ড্রাইভার কে বলেছিল ঠিকানাটা, ওটা আমার মনে আছে।
তাহলে তো সোনায় সোহাগা। আর দেরী কেনও।

এই মুহূর্তে আমি এয়ারপোর্টে। ট্যাক্সি ওয়ালাকে বললাম ঠিকানা টা।
সে বললও, যাবে তবে দশ ইউরো বেশি লাগবে। শহরের বাহিরে কিনা?

শহরের বাহিরে, হট্টগোল নেই, পরিপাটি, ছিমছাম। তনয়ার মত। আমার মনটা উচ্ছলতায় ভরে উঠলো। হঠাৎ করে দেখবে যখন, কি ভাববে সে? এখন সকাল আটটা। কাজে যাই নি? হয়তো গোসলে। হয়তো বা গোসল সেরে ভিজে চুল এলিয়ে দিয়েছে খোলা পিঠের পরে। হয়তোবা চোখের কোনের শেষ তুলীর টান টা শেষ করলো সে। হয়তো গুনগুণ করে গাইছে,
“ তোমার হোল শুরু, আমার হোল সারা”।
না এ গান নয়। সবে তো শুরু।

স্যার এসে গেছি। ড্রাইভেরের কথায় ফিরে এলাম আমার কল্পনার জগত থেকে। ছোট একতালা বাড়ী। চারিদিকের পরিবেশ আমার মনের মাঝে আকা পরিবেশের সাথে মিল নেই।
নেমে এলাম। সাথে আছে একটা ব্যাগপ্যাক।
দরজায় কড়া নাড়াতেই খুলে দাঁড়াল এক মহিলা। ভাবলাম ভুল ঠিকানা শুনেছিলাম সেদিন আমি।
সরি, এই ঠিকানা নয়। বলে এক পা পেছতেই মহিলা বলল, কাকে চান?
নাম বলতে, বলল এই নামে তো এখানে কেউ থাকে না।
হঠাৎ ই মনে পড়লো সেলফী তুলে ছিলাম লীসবন এয়ারপোর্টে।
ফটো টা দেখাতেই বলল, ও টিয়ারা?
টিয়ারা? ভাবলাম তনয়া হয়ে গেছে টিয়ারা।
সে তো আমার রুমমেট ছিল। মাস খানেক হোল চলে গেছে এখান থেকে। কতো দিনের পরিচয়?
সে কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ঠিকানা টা দিতে পারবে?
ঠিকানা দিতে নিষেধ করে দিয়াছে।
ফোন নাম্বার টা। নাকি সেটাও দেওয়া নিষেধ?
হাঁ। তবে যেখানে কাজ করে সেখান কার ঠিকানা দিতে পারি।
তবে তাই দাও। বলতেই মহিলা ভিতরে চলে গেলো।
ঠিকানাটা হাতে দিয়ে বলল, এই নাও। তুমি কি ওর ক্লাইণ্ট?
মানে?
মানে ওর কাজের সাথে তুমি জড়িত কিনা।
না জড়িত নই, বলে ধন্যবাদ দিয়ে পিছন ফিরতেই। মহিলা বলল, এখন ওর কাজের জাগায় গেলে ওকে পাবে না। রাতে যেও।
রাতে কেনও? ওর অফিস কি রাতেও খোলা থাকে?
হাঁ। নতুন কাজ নিয়েছে নাইট শিফটে। কোন হোটেলে উঠেছেন?
এখনো হোটেলে উঠিনি?
ভাল একটা হোটেলের নাম দিতে পারি। ওখানে উঠে এই ঠিকানা দেখালে ওরা সব ব্যবস্থা করে দেবে।

ট্যাক্সি টা তখনো দাড়িয়ে ছিল। বললাম, চলো এই ঠিকানায়।

স্বপ্নের পর্দা টা হঠাৎ করেই সরে গেলো। আর স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছা করছে না। স্বপ্নের বেড়াজাল ছিড়ে মনে হচ্ছে কখন আসবে সন্ধ্যা। দেখা হবে? চমকে উঠবে?
কেন সে রাতের চাকরি নিলো? দিনে কাজের চাপ বেশি। হয়তো বা তাই।

ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, জানিনা। হঠাৎ ই ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আলো ঝলমল প্যারিসে সন্ধ্যা বোঝা দায়।
ঘড়িতে দেখি রাত আটটা।
নেমে এলাম। কাউন্টারে ঠিকানা টা দেখাতেই লোকটা তাকালও আমার দিকে। বলল, আপনি রুমে যান আমি সব ব্যবস্থা করছি।
What do you mean? কি ব্যবস্থা করবে? এটাতো একটা অফিসের ঠিকানা?
না, এটা একটা Escort Service এর ঠিকানা। আপনার যদি particular কোন পছন্দ থাকে বলতে পারেন, তাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। চাঁছা ছোলা কথা।
হঠাৎ মনে হোল দেখিই না খেলা করে। এ খেলার শেষ কোথায়।
বললাম টিয়ারা, টিয়ারা কে চাই।

এলাম আমার রুমে। হৃদপিণ্ডের শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি। ওটা কাঁপছে।
এক দুই তিন করে এক ঘণ্টা কেটে গেলো। আমি জানি এই চিন্তা আমার ভুল। এ হতে পারে না। এ হবে না।
এমনি সময় টুক টুক, দুটো টোকা।
আমি এগিয়ে যেয়ে দু পা পিছিয়ে এলাম দরজা থেকে।
আবারও টুক টুক টুক।
দরজা খুললাম।
সামনে দাঁড়ান যে তার পরনে কচি কলাপাতা রঙের লো কাট ব্লাউজ, কালো স্কারট। হাত খোপা বাঁধা চুল। কাজল টানা চোখ টা দেখে মনে হোল অনেক আগে দেখাছিলাম। সেই চোখ, সেই চিকন ভুরু। শুধু হাসি টা নেই।
শুদ্ধ ভাষায় শুধু একটা কথা সে বলল,
তুমি?

Continue Reading