পিকু তুই কোথায়?

পিকু তুই কোথায়? তোকে অনেক খুঁজেছি আমি, আজও খুজে চলেছি। ফেসবুকে তোকে খুঁজেছি। ভেবেছি হয়তো একদিন দেখতে পাবো তোর ছবি।
চিনতে পারব কি?
সেই ছেলেবেলার তোর আমার সাদাকালো ছবিটা আজও আছে আমার এ্যালবামে। এইতো সেদিন এ্যালবাম গুলো বাক্সবন্দি করতে যেয়ে ঝরঝর করে কতোগুলো ছবি মেঝেতে পড়ে গেলো। উঠাতে যেয়ে ঐ ছবিটা দেখতে পেলাম। কত কত কত আগের সেই ছবি। ওটাকে কুড়িয়ে নিয়ে আমি এসে বসলাম আমার ছোট্ট ড্রয়াইং রুমে।

ফিরে গেলাম আমি অনেক অনেক পেছনে। তোর সাথে তখনো আমার বন্ধুত্ব হয়নি। তুই একটু মুখচোরা ছিলি। আর আমি ছিলাম তার উল্টো।
মনে পড়ে কি সেই দিনের কথা?
তোদের বাসার পাশে বড় আম গাছটার নিচে আমরা চারজন মধু, মহি, সন্তোষ আর আমি মার্বেল নিয়ে খেলা করছিলাম। তুই দাড়িয়ে ছিলি পাশে। মার্বেল খেলায় আমি সিদ্ধহস্ত। হার জিতের মাঝে জিতের সংখ্যাই আমার বেশি।
তুই বড় বড় চোখ করে খেলা দেখছিলি। হঠাৎ ই আমার চোখ পড়লো তোর উপর।
বললাম, খেলবে?
মনে হোল তুই কিছুই বুঝতে পারলিনা।
আবারও বললাম। খেলবে? এই নাও চার টি মার্বেল।
তুই ভয়ার্ত মুখ করে বলেছিলি, না, বাবা বকবে।
মহি তোর মাথায় একটা চাট্টি দিয়ে বলেছিল, তাহলে এখানে দাড়িয়ে কেনও, বাসায় যাও।
তুই আস্তে আস্তে মাথা নিচু করে বাসার দিকে চলে গেলি।
আমি মহি কে বলেছিলাম, ওকে মারলি কেন?
মারি নি তো, শুধু একটা চাট্টি দিয়েছি, বলে হাসতে লাগল।
খেলা শেষ করতে হোল। স্কুলে যেতে হবে।

আচ্ছা বলতো তখন আমাদের বয়স কত? ক্লাস ফাইভে পড়ি। তাই না?
সেইদিন স্কুলে এসে তোকে দেখলাম আমাদের ক্লাসে। আগেও তুই এসেছিস। কিন্তু আমি খেয়াল করিনি। অন্য বন্ধুদের সাথে ক্লাস শেষে খেলায় মত্ত ছিলাম। তোরা কেবল নতুন এসেছিস এই পাড়ায়।
তোর বাবা বদলি হয়ে এসেছে এই খানে। আমাদের বাসার ঠিক পিছনেই তোদের বাসা।

আমি তোর কাছে যেয়ে বলেছিলাম, মহি ওই রকমই। তুই আজ বিকেলে আমাদের বাসার সামনের মাঠে চলে আসিস, ফুটবল খেলব।
তুই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলি আমার দিকে। বন্ধু বলতে সেই মুহূর্তে আমিই। হয়ত তাই ভাবছিলি।
কিরে ? বাবা মানা করেছে ফুটবল খেলতে। বলে হাসতে হাসতে ওর ঘাড়ে একটা থাপ্পর দিলাম। অবশ্য আস্তে।
না, বাবা মানা করেনি, আসব।

জাম্বুরাকে ফুটবল বানিয়ে আমাদের খেলা।
আজ এইক্ষণে ফেলে আসা ঘটনা গুলো মনে পড়ছে, মনে হচ্ছে এইতো সেদিন সেই দিনগুলো। চলে গেলো কত তাড়াতাড়ি।
তুই ছিলি গোলকিপার। নাদুস নুদুস, বাবা মার আদরের ছেলে। দৌড়ানোর অভ্যাস ছিল বলে মনে হয় না। তাই তোকে আমরা গোলকিপার বানিয়ে ছিলাম। দেখা গেলো তুই তাতেও আনাড়ি।
খেলা শেষে তুই জাম্বুরাটাকে হাতে নিয়ে বলেছিলি, চলো, তোমাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাবো।
আমি আবার তোকে থাপ্পর দিয়ে বলেছিলাম, ধ্যাত, কি তুমি তুমি করছিস।
সেই ময়লা পা, ময়লা জামা নিয়ে চলে এলাম তোদের বাড়ীতে।
তোর মা (পরে খালাম্মা বলে ডাকতাম) কি যেন ভাজছিল।
-দেখো মা, কাকে নিয়ে এসেছি? আমার বন্ধু, ঐ বাসাতে থাকে। আমরা এক ক্লাসে পড়ি। এই জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলছিলাম।
তোমার নাম কি? বলে খালাম্মা উননের দিকে নজর দিল।
নান্টু।
তোমার বাবা কি করে?
বললাম বাবার কথা।
ও হা তোমার খালু বলছিল তোমার বাবার কথা। তোমরা তো অনেক দিন এখানে আছো।
যাক ভালই হোল, পিকু একটা বন্ধু পেলো। ওর বন্ধু পাতাতে অনেক দিন লাগে।
তারপর তোর মা রুটির মধ্যে কি যেন দিয়ে গোল করে আমার হাতে দিয়ে বলল, খেয়ে নাও।
আমি ওই ময়লা হাতে সেটাকে গবগব করে খেয়ে ফেললাম।
ভীষণ খিদে পেয়েছিল।

সব কোথায় হারিয়ে গেলো, তাই না রে?
আজ লিখতে বসে চোখ টা ভিজে আসছে। আজ তুই কোথায়, জানিনা, আজ আমি কোথায় তুই ও জানিস না। হয়তো তুই আছিস, হয়তো নেই, আমি জানিনা।

মনে পরে কি, দুপুর বেলার সেই বাঁদরামি গুলো। স্কুল থেকে এসে, বই গুলো ছুড়ে ফেলে, দৌড়ে চলে আসতাম তোদের বাড়ীতে। তুই আমি আর কি যেন ওর নাম, ও হাঁ, সন্তু, মিলে ঝোপে ঘেরা পুকুর পাড়ে বসতাম।
ওই ঝোপ ঝারে বসে থাকতো, দয়েল, ঘুঘু, শালিক। আমার হাতে গুলতি। পকেটে মার্বেল।
তুই বলতি, ঐ ঐ দেখ, ঐ শালিক টাকে মার।
আমি গুলতি টাকে টেনে, নিরিখ করে, ছেড়ে দেতাম মার্বেল টা।
আমার আনন্দ ওটাকে বধ করা, তোর আনন্দ দেখে।
বলতাম, এবার পুকুরে ঝাপ দেবো। সন্তু গায়ের জামা খুলে প্রস্তুত। তুই বলতি, না না আমি যাবো না।
সাঁতার জানিস না?
না
তুই একটা হদ্দ। সিঁড়ি বেয়ে গলা জলে দাড়িয়ে থাকিস। আমরা সাঁতার দিয়ে ওপারে যাবো।
ভিজা প্যান্টে বাড়ী গেলে মা মারবে।
এই চাতালে শুয়ে থাকবি, তাহলে রোদেই শুকিয়ে যাবে।
আর চোখ লাল হয়ে থাকলে?
ঐ যে গাছটা দেখছিস ওর পাতা চোখের উপরে দিয়ে শুয়ে থাকবি, তা হলে চোখের লাল চলে যাবে।
তুই ঠিক বলছিস তো?
তোর ভয় কাটে না। পরে অবশ্য কেটেছিল।
এই ভাবে বাঁদরামি করে করে আমাদের অনেক গুলো বছর কেটে গিয়ে ছিল।
মনে পরে তুই বলেছিলি, আচ্ছা, এতো সব করেও তুই ক্লাসে ভাল রেজাল্ট করিস কি ভাবে?
বলেছিলাম, জানিনা।

তোদের বাসার পাশ দিয়ে, পায়ে চলার পথের রাস্তা টা, দুপাশে বাঁশের ঝার, তার মাঝ দিয়ে পথ এসে থেমে ছিল ধোপাদের বাসায়। তার পাশেই ছিল একটা মাঠ।
মনে পরে কি?
সেই মাঠে খেলা হতো কাবাডি।
তুই আর আমি বিকেলে বসে বসে ঐ কাবাডি খেলা দেখতাম।
খুব খেলতে ইচ্ছা করত। একদিন রাখালকে বলেছিলাম, আমাকে নেবে।
-তুই বাচ্চা। পা ভেঙ্গে যাবে।
-আমি অনেক দম রাখতে পাড়ি, নিয়েই দেখনা।
নিয়েছিল ওরা আমাকে।
তোকে বলেছিলাম, খেলবি?
না, আমি পারবো না। আমার পা ভেঙ্গে যাবে। বলে ভয় ভয় চোখ করে চেয়ে রইলি।
তুই অনেক ভীতু ছিলি।

সেই ছোটবেলা থেকে আজ। মাঝে অনেক টা পথ পেড়িয়ে গেছে।
জানিস কোথায় যেন পড়েছিলাম, নদী যেমন সোজাসুজি সমুদ্রে বাক খায় না, নানা বাঁক করে তারপর মোহনায় পৌছায়, মানুষের জীবনটাও তাই। সোজা পথে চলতে চলতে কখন যে বাঁক নেবে তা তুই ও জানিস না আমিও না।
অনেক সময় অঙ্ক মেলে না।
কি যা তা বকছি।
যাক যা বলছিলাম—
মনে আছে কি, চুয়াডাঙ্গা রাস্তা ধরে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেলে বা দিকে বড় বড় দুটো গাছের মাঝ দিয়ে যে ঢাল নেমে গেছে, ওটা ধরে একটু এগিয়ে গেলে বনের মাঝে ছোট্ট একটা লাল ঘর। ওটা কে বলে মড়া কাঁটা ঘর।
শুনেছিলাম ওখানে নাকি মানুষ কে কাঁটা হয়।
কেনও? তখনও তা জানার বয়স হয়নি।
তুই, আমি, সন্তু আর সেলিম একদিন আখের বাগান থেকে আখ নিয়ে পরিমল দের বাসার পাশের মেঠো পথ ধরে হাটতে হাটতে আসার পথে বললাম, যাবি মড়া কাঁটা ঘরে।
তুই ভয়জড়িত কণ্ঠে বললি, না না আমি যাবো না। ওখানে ভুত থাকে।
ধ্যাত, কিছু থাকে না।
সন্তু সেলিম রাজি।
তুই অবশ্য পরে রাজি হয়েছিলি। তোর মুখ টা ফ্যাকাসে ফ্যাকাসে লাগছিল।

লালা ঘর টা দেখা গেলো। আমার ভিতরে অজান্তে একটা ভয় আকুপাকু করছেল। তোদের সামনে প্রকাশ করিনি।
ঝোপ ঝারে ভরা চারিদিক। কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে তারপরে দরজা। তালা লাগানো। পাশের দালানের উপরে একটা ছোট্ট জানালা। আমাদের নাগালের বাহিরে।
সন্তু বলল, আমার ভয় করছে, চল চলে যাই।
ঠিক সেই সময় কোথা থেকে বিশাল কালো এক লোক, গায়ে ছেড়া জামা, পরনে লুঙ্গি, কাছা মারা। আমার জামাটা টেনে ধরল। আমি চিৎকার করে উঠলাম।
নেহি ছরেঙ্গা আজ। বলে হুঙ্কার দিল লোক টা।
সেলিম কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি কিছু জানিনা, নান্টু নিয়ে এসেছে।
কহী বাত নেহি, সব কো ভী ঘর কা ভিতর তালা বন্দ করকে রাখে গা।
বলে চাবি টা দেখালও লুঙ্গির কোছা থেকে।
আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম, ছেড়ে দাও, আর কোনদিন আসবো না।
নেহি ছরেঙ্গা আজ। বলে আবারও হুঙ্কার দিল।
সন্তু এবার হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল।
হয়তো সন্তুর কান্না দেখে লোকটা আমার জামাটা ছেড়ে দিল। তোর দিকে তাকানোর মতো অবস্থা আমার নেই।
সবাই ভয়ে কাঁপছি।
ঠিক হ্যায়, কহী বাত নেহি, আজ ছোঁড় দেতা হ্যায়, ইধাঁর পর মাত আনা, সাপ খোপ হ্যায় ইধাঁর পর। সামাল কে জানা।
বলে লোক টা উধাও হয়ে গেলো।
আমরা তরী কি মরি করে দৌড়।
সেই দিন আমরা সবাই ভয় পেয়েছিলাম। সারাটা পথ তুই কথা বলিস নি। আমিও না।
আহা রে সেইদিন গুলো ছিল নিষ্পাপে ভরা, তাই না?

তারপর এলো সেই দিন টা।
যে দিন তুই আমাকে এসে বললি, আমরা চলে যাবো এখান থেকে। বাবা বদলি হয়ে গেছে।
আমার খুব খারাপ লেগেছিল। আমার অনেক বন্ধু, কিন্তু তুই ছিলি আমার সব চেয়ে কাছের।
জানিস আমি সেই রাতে ঘুমাতে পারিনি। মা কে বলেছিলাম। মা বলেছিল, খুব দুরে তো যাচ্ছে না, এইখান থেকে যশর।
মাত্র দুই ঘণ্টার পথ।
আমার মনে হচ্ছিল তুই অনেক অনেক দুরে চলে যাচ্ছিস।
তখন আমরা কোন ক্লাসে? ক্লাস সেভেন এ।

আমি এলাম তোদের বাসায়। খালাম্মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, বাবা, তুমি তোমার মা কে নিয়ে এসো আমাদের নতুন জাগায়। শুনেছি তোমার বাবা প্রায় যায় অফিসের কাজে।

বাসার সামনে ট্রাক টা দাঁড়ানো। মালপত্র উঠানো হচ্ছে। আমি আর তুই সেলিম দের বাসার সিঁড়িতে বসে দেখছি। খালু তদারকি করছে। তোর বড় বোন, আজ নামটা ভুলে গেছি, ডাক দিল, বলল, তোরা দুজন আয় খেয়ে নে। তোদের বাসার বাড়া ভাত কত দিন যে আমি খেয়েছি তার কি কোন হিসেব আছে?
দুপুর গড়িয়ে বিকেল এলো। সব ঠিক। এবার যাওয়ার পালা। খালু যাবে ট্রাকের সাথে। তোদের জন্য এসেছে আর একটা গাড়ী।
ট্রাক টা চলে গেলো। ঘর টা শূন্য।
তুই আর আমি কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলাম পাশাপাশি। তোর চোখে কি পানি ছিল?
খালাম্মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, কাঁদিস নে।
আমি কি কাঁদছিলাম? জানিনা। মনের অগোচরে কান্না এসেছিল।
গাড়ীর পিছনে পিছনে আমি হেটে ছিলাম। আস্তে আস্তে গাড়ীটা মিলিয়ে গেলো।
জানিস আমি আর কোনদিন ফিরে আসিনি তোদের ঐ বাসায়।
তোর সাথে সেই আমার শেষ দেখা। দুই ঘণ্টার পথ, কিন্তু দুই বছরেও যাওয়া হোল না।

আস্তে আস্তে আমার দুরন্তপনা মিলিয়ে গেলো। আমি একের পর এক ক্লাস পাড় হয়ে শেষ বর্ষে এসে পৌছালাম।
আমি তখন স্কুলের ফুটবল টীমের ক্যাপ্টেন। আমাদের টিম গিয়েছিল তোদের জেলা স্কুলের সাথে ফাইনাল ম্যাচ খেলতে।
তখনো টিমটিম করে তোর স্মৃতি টা মনের মাঝে ভাসছে। একেই বলে চোখের আড়াল তো মনের আড়াল।
আমি তোদের টীমের ক্যাপ্টেন কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তোর কথা।
বলেছিল, ওরা তো নেই এখানে, গত বছর চলে গেছে এখান থেকে।

তোর খোঁজ আর পেলাম না।

জানিস মাঝে মাঝে ভাবি যদি একটা বার কয়েক ঘণ্টার জন্য ফিরে যেতে পারতাম ঐ ছোটবেলা আর মাঝবেলা তে।
দেখতে পেতাম তোকে, দেখতে পেতাম আমার প্রিয় আর একজন কে।
তা হবার নয়।
আশায় রইলাম, হয়তো একদিন দেখা হবে তোর সাথে। সেদিন তুই চিনতে পারবি তো?

Continue Reading

দিন যায় স্মৃতি থাকে

দুদিন আগেও যে বাড়ী ছিল হৈ হুল্লোড় ভরপুর আজ এই নীস্তবততা কানে বাজে।
আমি এসে পা দিলাম বাহিরের সিঁড়িতে।
সকাল ১০ টা।
ফিরে তাকালাম শূন্য গাড়ী বারান্দা টার দিকে। সুহাই এঁর গায়ে হলুদের দিন এইখানেই লাবু ভাই গরম গরম জিলেপি ভেজে সবাই কে ডেকেছিল।
আসুন গরম গরম জিলেপি খান। সেই সাথে ঝাল মুড়ি আরও মুখরোচক খাদ্য।
আজ শূন্য বারান্দা।
আমি বেল টিপতেই দরজা খুলে দাঁড়াল চয়ন আপা।
সকালের নাস্তার দাওয়াত আমার। শফিক ফোন করে বলেছিল, কি করেন শফি ভাই? ঘুম ভাঙালাম?
না, ঘুম ছুটে গেছে অনেক আগে। শুয়ে শুয়ে আড়া মোড়া কাটছি।
চয়ন আপা আপনাকে আসতে বলেছে, একসাথে নাস্তা করব।
তথাস্তু।
সেই সুবাদেই এই সাতসকালে আমার আগমন।
ঢুকতেই দেখলাম ইলোরা ব্যাস্ত পরোটা ভাজায়। রতু বিয়ান ব্যস্ত ডিমের সরঞ্জাম নিয়ে।
আর সবাই কোথায়? বলে তাকালাম চারিদিকে।
মহারানীরা আস্তে আস্তে নামবে উপর থেকে। বলে হাসল চয়ন আপা।
জীবু চলে গেছে, ওর তাড়া আছে।

নেমে এলো লাজ, এলো মুন্না এলো শুকলা বিয়ান। শেষে নেমে এলো সিলভা।
নাস্তার টেবিলে ছোট ছোট কথা। যার কোন মানে নেই। যাকে বলে টেবিল টক।

সিলভার চেহারাতে উদ্বিগ্নতা লক্ষণীয়। মাঝেমাঝে হারিয়ে যাচ্ছে কথার মাঝ থেকে।
কি ভাবছ?
আচ্ছা শফি ভাই আপনার কি কোন প্রোগ্রাম আছে বৃহস্পতি বারে?
কেনও বলত?
ঐ দিনটা আমার ফিরে যাওয়ার দিন। নামিয়ে দিতে পারবেন JFK AIRPORT এ? ভীষণ ভয় করছে একা একা যেতে।
শাহিন চলে গেছে ওর দুই মেয়েদের কে নিয়ে। কাজের থেকে ছুটি পাই নি।
সিলভা থেকে গিয়েছিল আরও কয়েক দিন। আবার কবে আসবে কে জানে। বোনদের সাথে আরও কিছুদিন কাটান, বিয়ে বাড়ীর শেষে রেশ টুকু সে উপভোগ করতে চায়।
বললাম, আমার কোন আপত্তি নেই। অঢেল সময় আমার।
একটা কিন্তু আছে। বলে তাকালও সে
পরোটার কিছু অংশ আলু ভাজীর সাথে মিশিয়ে মুখে দিতে দিতে বললাম, কিন্তু টা কি?
আপনাকে থাকতে হবে সীকুরীটী চেক না হওয়া পর্যন্ত।
হাসতে হাসতে বললাম, কোন ভয় নেই তোমার, শুধু সীকুরীটী চেক নয়, আমি থাকবো সেই পর্যন্ত যেই পর্যন্ত তুমি গেটের কাছে যেয়ে আমাকে কল না কর। হোল তো? এইবার নাস্তা করতে বস।
একটু স্বস্তি পেলো সে।
একটু হেসে বলল, জানেন শফি ভাই কতবার এসেছি নিউইয়র্কে আজ পর্যন্ত Statue of Liberty দেখা হয়নি।
তাহলে আর দেরী কেনও? কাল সকালেই আমরা বেড়িয়ে পড়ব।
ওর দৃষ্টি আমার চোখে। সেখানে অবিশ্বাসের ছায়া।
বললাম তোমার কোন আপত্তি না থাকলে আমার কোন আপত্তি নেই। তবে ভেবে দেখো। You and I against the world. বুঝেছ তো আমি কি বলতে চাইছি।
না আমার আপত্তি নেই। শাহিন অনেক উদার। ওকে আমি চিনি, ওকে আমি জানি। আমার খুব আনন্দ লাগছে। কখন পিক করবেন।
ঠিক সকাল সাড়ে দশ টায়।

আরও কিছুক্ষণ বসে আমি উঠে পড়লাম। যেতে হবে Asotria তে।

পরদিন সকালে এলাম তপুর বাসার সামনে। সিলভা ওখানে। গাড়ীতে থেকে নামতেই ও বেড়িয়ে এলো। চোখে সানগ্লাস। পড়নে গোলাপি টপসের উপর গোলাপি, সাদা, কালো চেকের জামা। ফেডেড জিন। কাঁধে বড় ব্যাগ।

এই গোলাপ ফুল গাছের কাছে আমার ফটো তোল, বলে পোজ দিয়ে দাঁড়াল।
বললাম, মাথাটা একটু বা দিকে ফিরে, আমার দিকে তাকাও।
ও তাকাল।
আপনি থেকে তুমি তে এসেছে শুনে ভাল লাগল। আমিও ওই ডাকে বিশ্বাসী।
ফটো উঠাতে আমার যেমন আনন্দ, ফটো উঠতে সেই পরিমাণ আনন্দ ওর মাঝে, শুনেছি ওর বোনদের কাছে।
আরও কয়েক টা বিভিন্ন পজে ফটো উঠিয়ে বললাম, এবার চলো। দেরী হয়ে যাবে। অনেক কিছু আমাদের কভার করতে হবে।
এগার টা বেজে গেলো।
শান্তনুর বাসার কাছে গাড়ী পার্ক করে সাবওয়ে নিয়ে আমরা যাবো। অনেক দিন হয়ে গেলো পাতাল রেলে চড়ে কোথাও যাইনি। সাবওয়ের ম্যাপ টা দেখে নিয়েছি, লোড করে নিয়েছি Iphone এ।
N ট্রেন ধরে নামতে হবে ৫৯ স্ট্রীটে, সেখান থেকে ৫ নম্বর ট্রেন নিয়ে সোজা বওলিং গ্রীন। উপরে উঠলেই Statue of Liberty।
খুব আনন্দ লাগছে, বলে তাকাল সিলভা।
গাড়ী যখন পার্ক করলাম তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগার পেড়িয়ে গেছে।
বললাম হাটতে পারবে তো ? ট্রেন ষ্টেশনে যেতে পনের মিনিট লেগে যাবে কিন্তু।
পারবো, হেটে আমার অভ্যাস আছে।
প্রথম কিছুটা পথ হিলি, পরে সমতল রাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। আমার কাঁধে ব্যাগপাক। নিয়েছি কয়েকটা পানির বোতল। সাথে আছে মুড়ি ভাজা, চানাচুর, কলা। পথের জন্য।
আবহাওয়া টা আজ আমাদের অনুকুলে। না গরম না ঠাণ্ডা। উজ্জ্বল আকাশ। নীল মেঘ খেলা করছে সূর্যের আলোর সাথে।

সকালে নাস্তা করে বের হয়নি, শফি ভাই। বলে কাচু মাচু করে তাকাল আমার দিকে সিলভা।
বাহ, তা আগে বলবে না? বলে তাকালাম চারিদিকে।
ঐ যে ডানকিন ডোনাট। ওখানে নাস্তা করে নেবো।
দেরী হয়ে যাবে নাতো?
আমাদের আজ তাড়া নেই। অফুরন্ত সময় আছে। চিন্তা করোনা। বলে ডানকিন ডোনাটে এসে বসলাম।
নাস্তা শেষে ট্রেন ষ্টেশনে এসে দেখলাম ট্রেন দাড়িয়ে আছে।
উঠে পড়লাম।
একটা ছবি তোল। আমরা দুজনে বসে আছি ট্রেনের ভিতর। ঐ লোকটাকে দেও। বলল সে।
আগে সেলফী টা উঠাই, তারপর দিচ্ছি ওকে। বলে কয়েকটা ছবি ক্যামেরাতে ধরে রাখা হোল।
কোনটা সানগ্লাস পরে, কোনটা সানগ্লাস ছাড়া। বিভিন্ন ভঙ্গিতে।
ট্রেনে বসে টুকি টাকি গল্প। বলল সে, ছাব্বিশ বছর বিয়ে হয়েছে। কোথা দিয়ে সময় চলে গেলো বুজতে পারলাম না।

চলো এসে গেছি। বওলিং গ্রীন। এই ষ্টেশনে নামব আমরা।
উঠে এলাম পাতাল থেকে রাস্তায়।
ঐ দেখো Statue of Liberty ।
তাকিয়ে দেখে বলল, এবার আমার নিউইয়র্কে আসাটা সার্থক হোল।
টিকিট কেটে ফেরীতে উঠলাম।
চলো উপর তালাতে। ওখান থেকে ছবি উঠাব।বলল সে
ভীষণ বাতাস। সিলভার ঘাড় পর্যন্ত এলানো চুল গুলো হওয়ায় উড়ছে। সূর্যের তাপে মুখমণ্ডলে লালচে আভা।
ঐ দিক থেকে উঠাও। বলে সে তাকাল ক্যামেরার দিকে।
অনেক গুলো ছবি বিভিন্ন ভাবে উঠিয়ে বললাম, জানো কত গুলো উঠিয়েছি।
আমার না ছবি উঠাতে অনেক ভাল লাগে।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি।
ফেরী এসে ভিড়ল Liberty Island এ।
সামনে বিরাট মূর্তি টা দাড়িয়ে। অনেক লোকের আগমন আজ। হয়তো প্রতিদিনই এই পরিমাণ লোক আসে।
জিজ্ঞাসা করলাম এর ইতিহাস জানো কি?
না, বলতো?
এই কপার স্ট্যাচু টা a gift from the people of France to the people of the United States.
স্ট্যাচু টা ডীজাইন করে ছিল ফ্রান্স স্কাল্পটর Frédéric Auguste Bartholdi। আর তৈরী করেছিল Gustave Eiffel.
এই robed woman মূর্তি টা রিপ্রেজণ্ট করে Libertas, a Roman liberty goddess।
ঐ যে দেখছ ডান হাতে টর্চ মাথা ছাড়িয়ে গেছে, আর বা হাতে যেটা দেখছ, ওটা কে বলে, tabula ansata ওর মাঝে লেখা আছে July 4, 1776, the date of U.S. Declaration of Independence.
আর পায়ে দেখছ ভাঙ্গা চেন, ওর মানে হচ্ছে ফ্রীডম। Freedom of United States.

অনেক শেখা হোল। এবার ওটাকে পিছনে রেখে আমার একা এবং তোমার সাথে অনেক গুলো ছবি উঠাও।
উঠিয়ে ছিলাম, অনেক অনেক ছবি।

এবার বিশ্রামের দরকার কি বলও। পেটে কিছু দিতে হবে না?
ফিস এন্ড চিপস কিনে এসে বসলাম ছায়ার নিচে টেবিল চেয়ারে।
খেতে খেতে দুই তিনটা সেলফী উঠালে কেমন হয়, বলতো।
মন্দ বলোনি।
দুই তিনটা নয় আরও অনেক উঠিয়ে বললাম, মন ভরেছে?

খাওয়া শেষে ঘড়ি দেখলাম। চারটা বাজে।
বললাম, আরও তো দেখার বাকি। ফ্রীডম টাওয়ার দেখবে না? যেখানে ছিল Twin Tower।

ফিরে এলাম Statue of Liberty দেখে। সিলভার মুখে শুধু এক কথা। কি সুন্দর আজ দিন টা কাটছে। এমন আশা করিনি আগে।
ফ্রীডম টাওয়ার এসে পৌছালাম পাঁচটার পর। ভিতরে যাওয়া হোল না। বাহিরের থেকে ছবি উঠিয়ে এলাম টাইম স্কোয়ারে।
বললাম, টাইম স্কোয়ার দেখতে হয় রাতে। ঝলমল করে চারিদিক। না দেখলে বুজতে পারবে না। তবুও দেখো চারিদিক তাকিয়ে। মন ভোলানো দৃশ্য। তাই না?
সময় কেটে গেলো ছবি উঠিয়ে।
ক্লান্ত আমি। ক্লান্ত সে।
এবার ফেরার পালা।
ফেরার পথে ট্রেনে বসে সিলভা ছবি গুলো দেখছিল।
–এই ছবি গুলো আমাকে পাঠিয়ে দিও। সুন্দর সময় কাটল তোমার সাথে। মনে থাকবে অনন্ত অনন্ত কাল ধরে।
হঠাৎ ই ফোন টা বেজে উঠল।
শান্তনু কল করেছে।
–কোথায় তোমরা?
–এইতো ট্রেনে। কুঈন্স বোরো প্লাজা সামনে।
–আমি তোমাদের আগের ট্রেনে। তোমাদের জন্য অপেক্ষা করব। এক সাথে ডিনার করব। তাসমিয়া কে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওরাও এসে জয়েন করবে। নাম করা SeaFood রেস্টুরেন্টে বসব।
রাজি হয়ে গেলাম। গাড়ী ওর বাসার সামনে।
নেমে দেখলাম ও দাড়িয়ে।
জীবু, তাসমিয়ে, টেগোর এসে জয়েন করল আমাদের সাথে।

এটা একটা উপরি পাওনা।
খাওয়া শেষে হেটে হেটে এলাম শান্তনুর বাসার সামনে। ওদের কে বিদায় দিয়ে গাড়ীতে এসে বসলাম।
শরীর ভেঙ্গে এলো। ক্লান্ত দুজন।

রাত দশটায় সিলভাকে নামিয়ে দিলাম যেখান থেকে ওকে উঠিয়ে ছিলাম।
বললাম মনে থাকবে তোমার সান্নিধ্য।
নামতে যেয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, কবে আসবে আমাদের ওখানে, সানফ্রান্সীস্কতে।
একটু নাটকীয়তা করে বললাম, “সময় যে দিন আসিবে সেদিন যাইবও তোমার কুঞ্জে”।
বলল, বাহ, তুমিতো গানের সুরে কথা বলছ।
বলে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে।

Continue Reading

শান্তির নীড়

Can you give me a glass of water। মারগারেটের ডাক শুনে আহমেদ উঠে এলো। ড্রয়াইং রুমে বসে সদ্য আসা একটা মেডিক্যাল জার্নালের পাতা উল্টাচ্ছিল। যদিও ডাক্তারি প্রাকটিস ছেড়ে দিয়েছে আজ অনেক বছর হোল। তবুও এই জার্নাল গুলো পড়তে ভালই লাগে।
পানির গ্লাস টা এগিয়ে দিলো মারগারেটের হাতে। হাতটা ছোঁয়ালও কপালে। জ্বর দেখতে নয়, আদরের ভঙ্গিতে। মারগারেট ওর বা হাতটা দিয়ে চেপে ধরলও আহমেদের হাতটা। ঝাপসা চোখে বলল, আর কতদিন এইভাবে করে যাবে।
ও কথা বলতে নেই। ঠাণ্ডা লাগছে নাতো? বলে চাদরটা পায়ের উপরে আর একটু উঠিয়ে দিল।
ফেলীসীয়াকে চলে যেতে বলেছি। ও কাল সকাল আটটায় আসবে। তোমাকে একটু পরে দুধ টা গরম করে এনে দেবো। এই বলে আহমেদ ড্রয়াইং রুমে এসে বসলো।
জার্নাল টা আবারও উল্টাল কিন্তু মন বসলো না।

ড্রয়াইং রুমের দেয়ালে টাঙ্গানো অনেক আগে মারগারেটের সাথে তোলা ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিল আহমেদ। বয়স তখন কতো? তিরিশের কাছা কাছি। মিশিগানের এক হসপিটালে Residency করে আহমেদ।
ষাটের দশকের শেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে সেরা ছাত্র হয়ে বেড়িয়ে এসেছিল আহমেদ। আহমেদের মামা ছিল ডাক্তার। সেই খোঁজ নিতে বলেছিল। বলেছিল USIS(United States Information Services) যেয়ে জানতে কিভাবে আমেরিকান হসপিটালে কাজ নিয়ে যাওয়া যায়।
খোঁজ নিয়ে জেনে ছিল ECFMG দিতে হবে। দিয়ে ছিল। ভাল রেজাল্ট করে চলে এসেছিল মিশিগানের ঐ হাসপাতালে Residency নিয়ে। ঐখানেই পরিচয় মারগারেটের সাথে।

মারগারেট নার্স। একই ওয়ার্ডে দুজনের ডিউটি।
একদিন কাজের ফাকে আহমেদ ঘুমিয়ে পড়েছিল সোফাতে। মারগারেটের ছোট্ট একটা ধাক্কায় চোখ মেলে তাকাল আহমেদ। প্রতিদিন আঠারো ঘণ্টা করে ডিউটি করে শরীর ক্লান্ত হয়ে এসেছিল আহমেদের। ভেবে ছিল একটু চোখ টা বুজে নেই। একশো দশ নম্বর রুমের রোগী টাকে এই মুহূর্তে দেখতে হবে না। শেষ চার্ট টা সে দেখে এসেছে। নতুন কোন ওষুধ যোগ করতে হবে না। তাই ডাক্তারদের ওয়েটিং রুমে এসে চোখটা বুজেছিল।
ছুটি পাবে ভোর সাতটায়। তাও চার ঘণ্টার জন্য।

মারগারেটের ডাকে ধড়মড় করে উঠে বসল আহমেদ। মারগারেটের কথায় একশো চোদ্দ নম্বরের রোগীর শ্বাস নিতে অসুবেধা হচ্ছে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। রাতে ডাক্তার থাকে না। রেসিডেন্ট দিয়ে রাত টা কাভার করে।
রোগীকে দেখে অক্সিজেন মাস্ক আর লেসীক্সের পরিমাণ টা বাড়িয়ে দিতে বলে বেড়িয়ে এলো আহমেদ।
বাহিরের কর্নারের জানালার কাছে এসে দাঁড়াল সে।
বাহিরে জ্যোৎস্নার আলো।

ফিরে গেলো বহু পিছনে, মনে পড়ল একসময় ছাত্র থাকা কালিন হঠাৎ করেই একদিন অনন্যাকে দেখেছিল করিডোরে দাড়িয়ে থাকতে। এমন করে কোন মেয়েকে দেখেনি সে।
কি জানি কি হয়েছিল সেদিন। অনন্যার চেহারা সে ভুলতে পারেনি। রুমমেট কে বলেছিল।
রুমমেট প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি। আহমেদ করবে প্রেম। অবিশ্বাস।
বলেছিল, বন্ধু, হৃদয়ে দুব্বা গাছ জন্মেছে তাহলে। হাওয়া বইতে শুরু করেছে।

গল্প লেখার চেষ্টা করেছিল। চেষ্টা করেছিল অনন্যা কে নিয়ে লিখতে। দুই একটা কবিতার বই পড়ে সে ভেবে ছিল সাহিত্যিক হয়ে গেছে।
জীবনানন্দ দাশকে কোট করে,
“ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার- রাঙা আপেলের মতো লাল যার গাল, চুল তার শাওনের মেঘ—আর আঁখি গোধূলীর মতো গোলাপী রঙ্গীন, আমি দেখিয়াছি তারে ঘুম পথে- স্বপ্নে- কতদিন”। সাথে আরও কিছু নিজস্ব লেখা। সব মিলিয়ে একটা চিরকুট তৈরী করেছিল।
ছুরি কাচি চালাতে যার হাত কাপেনি, আর আজ ছোট্ট একটা চিরকুট দিতে হাতের কাপন থামানো দায়। তবুও ক্লাস শেষে বের হয়ে দেখল অনন্যা দাড়িয়ে আছে দুই বান্ধবীর সাথে। আহমেদ এগিয়ে আসতেই অন্য দুই বান্ধবী বাই বলে চলে গেলো।
মেয়েদের সাথে কথা বলতে আহমেদ মোটেই তুখর নয়। সে আছে লেখাপড়া, বিভিন্ন দেশের খবরাখবর নিয়ে ব্যাস্ত।
শিক্ষকদের প্রিয় পাত্র সে। প্রেমের ব্যাপারে নিতান্তই অনভিজ্ঞ।

আহমেদ এগিয়ে আসতেই অনন্যাই প্রথমে বলেছিল, কেমন আছেন আহমেদ ভাই। বলে অনন্যা আরও এগিয়ে এলো আহমেদের কাছে।
আহমেদ পরিচিত সবার কাছে। পরিচিত অসাধারণ মেধাবী ছাত্র হিসাবে।
আহমেদের কপালে কুচিকুচি ঘামের রেখা। হাতে ধরা চিরকুট টার পাশ টা ভিজে গেছে।
আপনাকে খুব নার্ভাস লাগছে আহমেদ ভাই। সব ভালত?
একটু নার্ভাস, সামনে পরীক্ষা কি না। তাই।
এই পর্যন্ত। চিঠি টা আর দেওয়া হয়ে ওঠেনি। প্রেমের সমাধি সেখানে।

“ কফি টা খাও, ভাল লাগবে”।
ফিরে তাকালও আহমেদ। মারগারেটের হাতে কফির কাপ। তাকাল মারগারেটের চোখের দিকে। অনেকদুরে যার চোখের মাঝে খুজতে চেয়েছিল নিজেকে। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। হয়ে ওঠেনি তার নিজের ভীরুতার জন্য। আজ যেন তাই খুজে পেলো
মারগারেটের চোখে।
অনেকদিনই তো সে মারগারেটের সাথে কাজ করেছে। কিন্তু এমন ভাবে তো দেখেনি তাকে। দেখেনি তার সোনালী চুল, নীল চোখ। এসব সবই তো আগেও দেখেছে, আজ কেন তা ভিন্ন মনে হোল। কেন তার হাতের ছোঁয়ায় সমস্ত শরীর বীনার ঝংকারে ঝংকৃত হোল।
কফিটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে রইল মারগারেটের দিকে।
কিছু বলবে?
“আজ তোমাকে অন্য রকম লাগছে ম্যাগ”। এমন ধরণের কথা সে কখন বলেনি কাউকে। আজ কেনও? তবে কি? নিজের মনেই প্রশ্ন করল সে।
কি রকম লাগছে? আগলি?
না তা নয়। কি যেন দেখছি তোমার মাঝে যা আগে কখন দেখেনি। — এই বাচালতা কেনো এলো তার মাঝে। কথার ফুলঝুরি আগে তো ফোটেনি। তবে আজ কেনও?

পরদিন মারগারেট কে না দেখে জিজ্ঞাসা করেছিল লিজ কে। শুনল তার আজ ছুটি। কেমন যেন একটা অস্থিরতা মনের মধ্যে বিচরণ করতে লাগল। আজ পাঁচটায় সে বেড়িয়ে যাবে হাসপাতাল থেকে। ম্যাগের সাথে বসে কফি খেলে মন্দ হতো না ভেবে লিজের কাছ থেকে ফোন নাম্বারটা নিলো। কয়েক বার ডায়েল করতে যেয়ে রেখে দিল।
দ্বিধা, দন্দের মাঝে সে। ম্যাগের নীল চোখ টা ভেসে ওঠে তার মনে। ফোনটা বের করলো আহমেদ। আর দ্বিধা নয়।
ফোন করা হলনা। শুনতে পেলো মাইক্রোফোন বলছে, ডক্টর আহমেদ পিক আপ এক্সটেনশন ২০৫৪।
হ্যালো,
এতো মেঘ না চাইতেই জল। ওপাশে ম্যাগের কণ্ঠস্বর।
“ তোমার তো আজ পাঁচটা পর্যন্ত কাজ তাই না?”
হাঁ, কেনও?
আহমেদ তার নিজের দুর্বলতা কে এই মুহূর্তে প্রকাশ করতে চাইল না। হঠাৎ করে সে এতো সুন্দর খেলা কবে থেকে খেলতে শিখল তা নিজেই ভেবে পেলোনা।
–কাজের শেষে আসবে কি মেইন ষ্ট্রীটের কফি শপে। বিকেল ছয়টায়। কিছুক্ষণ সময় কাটান যাবে। অবশ্য তুমি যদি ব্যস্ত না থাকো।
আহমেদ ভেবে পেলনা কি ভাবে মারগারেট তার মনের খবর পেলো। তাকে আর এগিয়ে যেতে হোল না, সেই তোঁ এসে ধরা দিল।
আসব। ঠিক ছয়টায়। বলে ফোন টা রেখে এগিয়ে গেলো একশো বারো নম্বর রুমের রোগী কে দেখতে।

ঠিক ছয় টায় কফি ডিলাক্সের সামনে এসে দেখল মারগারেট দাড়িয়ে আছে। লাল স্কারটের সাথে গাড় নীল টপস। সোনালী চুল গুলো উঁচু করে বাঁধা। গলায় সাধা পার্লের নেকলেস। মনে হোল এতো সেই মারগারেট নয়, যাকে সে প্রতিদিন দেখে।
হাই! বলতেই মারগারেট এসে আহমেদের ডান গালে চুম দিলো।
ইয়াং ছাত্র দের আড্ডা খানা এই কফি ডিলাক্স। কোনায় একটা টেবিল নিয়ে বসলো ওরা দুজন। কথা আর খাওয়ার মাঝে মারগারেট আহমেদের হাতের উপর হাত রেখে তাকাল ওর দিকে। আহমেদ ওর আর একটা হাত টেনে নিলো ওর হাতের উপর।
সেই শুরু।
দুটো বছর কোথা দিয়ে কেটে গেলো দুজনের কেউ বুজতে পারলো না। একে অন্যনের মাঝে মিশে গিয়েছিল।
আহমেদর Residency শেষ। পরীক্ষা দিয়ে সে এখন ডাক্তার। নামের শেষে এমডি।

ঠিক সেই সময় দেশ থেকে খবর এলো মার শরীরে খুব খারাপ। এখনি এসো।
মারগারেট কে বলতেই সে বলল, যাওয়ার আগে আমাদের শুভকাজটা সম্পূর্ণ করে গেলে হয় না। আমিও না হয় তোমার সাথে যাবো। দেখবো তোমার মা কে।
এই ভয় টাই সে করছিল। আজও পর্যন্ত সে মা কে জানায় নি। মা সেকেলে। মেনে নেবে কিনা জানে না। বাবা বেচে থাকলে অসুবিধা হতো না।
বলল, থাক না, এই মুহূর্তে তাড়াহুড়া করে নাই বা করলাম।
মারগারেট আর কোন কোথা বলে নি। শুধু জেনে নিয়েছিল এখান থেকে দেশে যাওয়ার রুট কোণটা। কোথায় Lay over.
আহমেদ বলেছিল লন্ডনে বন্ধুর বাসায় দুদিন থেকে তারপর দেশের দিকে পাড়ি দেবে। বন্ধুর ঠিকানা টা মারগারেট নিয়ে রেখেছিল।
যথা সময় বিদায় দিয়ে মারগারেট ফিরে এসেছিল তার বাসায়।

সকালে দুই বন্ধু চার টেবিলে বসে পুরানো দিনের ঘটনার স্মৃতি মন্থন করছিল।
টিং টিং শব্দ। দরজায় কে যেন বেল টিপছে।
মহী এগিয়ে যেয়ে দরজা খুলতেই, মহিলা জিজ্ঞাসা করল, আহমেদ আছে?
আপনি?
মারগারেট।
মারগারেট? মহী জানে মারগারেট কে।
আসুন, আসুন। বলে নিয়ে এলো ডাইনিং রুমে।
আহমেদের কিছুটা সময় লাগল বুঝে উঠতে।
তুমি? এখানে।
হাঁ, এলাম, ভেবে দেখলাম একা থাকা আমার হবে না। তোমার সাথেই আমি দেশে যাবো। ওখানেই আমাদের বিয়ে হবে।
কি বলও?
আহমেদ চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। মাথা ঠিক মত কাজ করছে বলে মনে হোল না।
সমাধান করে দিল মহী।
কোন চিন্তা নেই, এই লন্ডনেই তোমাদের বিয়ে দিয়ে দেবো আমি। এখান থেকে তোমরা স্বামী স্ত্রী হয়ে দেশে নামবে।
তাই হোল। ধুমধাম না হলেও দুই একজন মহীর বন্ধুসহ আহমেদ- মারগারেটের বিয়ে হয়ে গেলো সেইদিনই।
এ যেন এক রুপকথা।

দুরুদুরু বক্ষে মা র সামনে এসে দাড়িয়ে ছিল। মা দুজন কে আশীর্বাদ করেছিল। চলে যাওয়ার সময় শুধু এইটুকুই বলে ছিল। তোমরা এ দেশেই থেকে যাও এই কামনা করি।
আহমেদ আর মারগারেটার আর ফিরে যাওয়া হয়নি। বড় একটা হাসপাতালে আহমেদ চাকরি পেলো। মারগারেট সংসার নিয়ে ব্যস্ত রইল।
বছর ঘুরতেই কোলে এলো ইব্রাহীম। সাদা কালো মিলিয়ে ইব্রাহীম দেখতে হোল এক মিষ্টি সোনার টুকরা। আহমেদের জান। কাজ থেকে এসে ওকে নিয়েই মত্ত থাকে।
দিন যায় রাত আসে এমনি করে অনেক অনেক বছর কেটে গেলো। ইব্রাহীম এখন যুবক।

একদিন আহমেদ হসপিটাল ফিরলে মারগারেট বলল, জানো আমার না কতো দিন থেকে Bowel Movment টা ঠিক মতো হচ্ছে না। সেই সাথে bladder এ প্রবলেম মনে হচ্ছে।
প্রথম প্রথম খুব একটা গুরুত্ত দেই নি আহমেদ।
কিন্তু ক্রমেই মারগারেট বুজতে পারে আগের মতো আর এনার্জি নাই। Mental depreesion। মুখএ শার্প pain অনুভব করে। মাঝে মাঝে চোখে ঝাপসা দেখে।
আহমেদ ডাক্তার, সব শুনে বুজতে পারে এটা স্বাবাভিক নয়।
নিয়ে গিয়েছিল Specialistর কাছে।
অনেক অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার বলল, “It’s a symptoms of MS,” তুমি তো ডাক্তার তুমি জানো এর কোন চিকিৎসা নেই। শুধু সেবা করা ছাড়া।
সেই থেকে আহমেদ সেবা পরে চলেছে মারগারেট কে। বুজতে দেয় না তাকে। ছোট বাচ্চার মতো আগলিয়ে রাখে।

ইব্রাহীমের বিয়ে দিয়ে ছিল ধুমধাম করে। কিন্তু টেকেনি।
আহমেদের বয়স আজ পড়ন্ত বেলায়।
মাঝে মাঝে ভাবে মারগারেট তাকে অনেক দিয়েছিল। সমস্ত সংসারটা সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছিল। কাজ থেকে এলে মনে হতো সে যেনও এলো এক শান্তির নীড়ে। সেই শান্তির নীড় আজও আছে।
শুধু সে বসে আছে হেলান দিয়ে। তাকিয়ে থাকে আহমেদের দিকে। আহমেদ তাকে বই পড়ে শোনায়।
ফেলে আসা দিনের ছবি গুলো দেখে একসাথে। হাতে হাত রাখে।
রাতে ওর ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলে, “ এবার তোমার ঘুমানোর সময় হোল। ম্যাগ।“

Continue Reading