সনীতা

                          সনীতা           

অস্তগামী সূর্যের শেষ ক্ষীণ রোশনি টা এসে পড়েছে অনীকের ড্রয়াইং রুমে। আলো টা জ্বালাতে মন চাইছে না। অলসতা নয়। অন্ধকারটা ভাল লাগছে। অস্থির মনটা অন্ধকারে পাক খাচ্ছে। চোখ বুজে পিছনে ফেলে আসা কয়েকটা দিনের স্মৃতি ভাবতে যেয়ে অনিকের মনে হচ্ছে কি যেন সে ফেলে এসেছে সেই প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে।

মনে পড়ে। প্লেনে উঠার আগে সনীতা বলেছিল, পারলে প্লেনে একটু ঘুমিয়ে নিও। শরিফ হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ব্রাদার, প্রতিটা দিনকে ভাগ করে নিও, কখন কি করবে, তাহলে একাকীত্ব হয়তো কিছুটা ঘুজবে।

ক্লান্ত শরীর টাকে সোফার উপর এলিয়ে দিয়ে অনীকের মনটা চলে গেলো বেশ কিছু পেছনে। সেই কাক ডাকা ভোরে যে ফোন টা এসেছিল। সেই মিহি মিষ্টি কণ্ঠস্বর।
অনীক?
এই কণ্ঠস্বরের সাথে অনীক পরিচিত নয়।
কে বলছেন?
চিনতে পারলে না তো। অবশ্য চিনতে না পারারই কথা। কি ভাবে তোমার ফোন নাম্বার টা পেলাম সে কথা পড়ে আসবে।
মনে পড়ে কি সনীতার কথা। প্রশ্নটা করে কিছুক্ষণ চুপ করেছিল।
সনীতা, সনীতা, অনীক চেষ্টা করল স্মৃতির পাতা গুলো উল্টিয়ে কোথায়, কখন এই কণ্ঠস্বর সে শুনেছিল। স্মৃতির দুয়ার খুলে ভেসে উঠলো সেই হাস্যজ্জল মুখটা। স্মৃতির ভাজে ভাজে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো ভেসে উঠলো অনীকের চোখে।

পরিচয় হয়েছিল কবীরের বাসায়।
ঘরে ঢুকতেই চোখাচোখি হয়েছিল। সদ্য পা দিয়েছে এই দেশে অনীক। লজ্জা টা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
চোখ নামাতেই, শুনতে পেলো সেই মিষ্টি কণ্ঠস্বর, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না। নতুন বুঝি?
হাঁ।
আমার নাম সনীতা।
অনীক আমতা আমতা করে বলেছিল তার নামটা।
কবীর বুঝি আপনার বন্ধু?
জি।
কবীর আমার চাচাতো ভাই।
ঠিক সেই সময়ে কবীর এসে বাঁচিয়ে ছিল অনীককে।
পরিচয় হয়েছে তোদের?
হয়েছে, বলে সনীতা অনীক কে বলেছিল, চলেন আমার সাথে, আড্ডা দেবো সবাই মিলে।
সেই আড্ডা তে অনীকের সাথে পরিচয় হয়েছিল কণার সাথে। সে তো আজ অনেক অনেক আগের কথা।

সনীতাও একদিন হারিয়ে গেলো। শরিফকে বিয়ে করে সেও পাড়ি দিল দূরদেশে।
আজ সেই কণ্ঠস্বর বেজে উঠলো অনীকের কানে, সেই চোখ, সেই মুখ, সেই ডোরা কাঁটা নীল রঙ এর শাড়ী।

একটু দেরী হোল চিনতে, মনে কিছু করো না।
মনে করবো, পাগল, তোমাকে অনেক খুঁজেছি। কবীর কে জিজ্ঞাসা করেছি। সেও জানেনা তোমার খবর।
নিজেকে গুটিয়ে ফেললে কেন, বলতো? আজ যখন তোমার খবর পেলাম, বলি কি, এসো আমার এখানে।
কোথায়?
সানফ্রানসিসকো তে। আসবে বলও। অনেক কথা আছে তোমার সাথে।
অনীক কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
আজ থেকে তিরিশ বছর আগে একবার সে গিয়েছিল সানফ্রানসিসকো তে। সবাই মিলে। আজ সব ভেঙ্গে চুরে খানখান।

না করতে পারলো না অনীক। সনীতার ডাকের মাঝে যে আন্তরিকতা তাকে অবহেলা করে পাশে ঠেলে দিতে পারলো না অনীক।
বলল, কবে আসতে বলও?
থাঙ্কসগিভীং এর ছুটিতে চলে আসো। অনেক মজা হবে। শফিককে বলব বেশ কিছুদিনের জন্য ছুটি নিতে।
আসবে তো?
আসব।
কথা শেষে অনেকক্ষণ চোখ বুজে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করছিল অনীক।
ফোনটা বেজে উঠলো আবার।
সনীতা আনন্দ মেশানো স্বরে বলল, শোন, ওকল্যান্ড এয়ারপোর্টে নামবে। ওটা আমাদের বাসার কাছে।
ঠিক আছে। বলে অনীক একটু হাসল।

জীবনের একঘেয়েমি অনীককে বাতীব্যাস্ত করে তুলেছিল। নিরানন্দ দিনগুলো ওকে যেন পাগল করে তুলেছিল। সেইক্ষণে এই প্রস্তাব।
সনীতার সাথে শেষ দেখা স্ট্যাচু অফ লিবার্টির নিচে। সনীতা বলেছিল, তোমার সাথে আজকের দিন টা এতো সুন্দর কাটল সারা জীবন মনে থাকবে অনীক।
অনীক ও ভোলেনি।

ফেলে আসা দিনগুলোর কথা পড়ে ভাবা যাবে ভেবে অনীক উঠে পড়ল। টিকিট কাটতে হবে। ছন্নছাড়া জীবনের কোথায় কি পড়ে আছে সেগুলো গুছিয়ে নিতে হবে। সপ্তাহ খানেকের জন্য মনটাকে সজীব করতে পারলে মন্দ কি?

সনীতাকে জানিয়ে দিল সে আসছে Thanksgiving এর তিনদিন আগে।
সনীতার আনন্দ ধরে না।
কি কি খাবে বলও? উচ্ছ্বাসিত আনন্দে ভরপুর সনীতা।
ওর এই উচ্ছাস অনীক কে আগেও আনন্দ দিয়েছে।
তুমি যা রাঁধবে তাই খাবো। তাই হবে অম্মৃত। হাসতে হাসতে বলেছিল অনীক।

রাত এগারটায় অনীকের প্লেন ল্যান্ড করল ওকল্যান্ড এয়ারপোর্টে। গেট দিয়ে বাড়িয়ে আসতেই দেখতে পেলো সনীতা আর শফিক কে। সনীতা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল অনীককে।
শফিক হাতটা এগিয়ে দিল। চিরকালই ও একটু সলজ প্রকৃতির।
জানো, আমি হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম, যে তোমার সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হবে। তুমি দেখতে সেই রকমই আছো।
আচ্ছা, তোমরা কি এইখানে দাড়িয়ে সারা বছরের কথা শেষ করবে, নাকি বাসার জন্য কিছু রাখবে? শফিক কৃএিম রাগান্বিত স্বরে বলল।
সনীতা, শফিক থাকে ফ্রীমন্ট, Silicon Valley তে। শফিক ইঞ্জিনিয়ার। কাজকরে একটা নাম করা কোম্পানিতে। দুই মেয়ে। আন্তারা আর আনুসা।
কথায় কথায় শফিক বলল, এই রাস্তা গুলো বড় করেছে এই কয়েক বছর হোল। জনসংখ্যা বাড়ছে। অনেক নতুন নতুন কোম্পানি এসেছে এই দিকে। শফিকের চোখের সামনে গড়ে উঠা এই শহর।
তিরিশ মিনিটের পথ। এয়ারপোর্ট থেকে বাসা।

শফিক বায়ে টার্ন নিয়ে ওদের বাড়ীর রাস্তায় ঢুকল। পাশাপাশি দুই তালা বাড়ীর সাড়ি। নতুন তৈঁরি। রাতের আলোতে অপূর্ব লাগছিল। সনীতাদের বাড়ীর সামনে গোলাপের ঝার। সুন্দর করে ছাটা।
অনীকের খুব ভাল লাগল।
আমি প্রথম দেখাতেই তোমাদের এই বাড়ীটাকে ভালোবেসে ফেললাম, সনীতা। বলে হাতের ক্যরীওন টাকে টেনে উপরে নিয়ে এলো অনীক।
জানো, তুমি আসবে বলে আমার দুই মেয়ে বাড়ীটাকে আলোর মালা দিয়ে ডেকোরেট করেছে। দেখবে চলো তোমার রুমটা। আলো বাতির ঝারী দিয়ে ঝলমল। সনীতার খুশি যেন উপছে পড়ছে।
আন্তারা আর অনুসা এসে দাঁড়াল। হেসে বলল, আসতে কষ্ট হয়নি তো আঙ্কেল।
ঠিক ওর মায়ের ধারা। হাসি খসে পড়ছে।

যাও হাতমুখ দুয়ে এসো। আমি খাবার টেবিলে বাড়ছি। শুধু তাই না শফিক নিজে হাতে রান্না করেছে বিরয়ানী টা।
এতো রাতে খাবো? আমতা আমতা করে অনীক বলতে চাইল।
আপনার বান্ধবী কে তো আপনি চেনেন, কথা বাড়িয়ে লাভ হবে না। আর আমার নিজের হাতের রান্না , একটু চেখে তো দেখতে হবে। বলে শফিক বিরিয়ানির পাত্র টা মাইক্রোওয়েভে দিল গরম করতে।

শফিককে অনেক কাছের বলে মনে হোল অনীকের। জীবনের ভাঙ্গা তরী বাইতে বাইতে হাঁপিয়ে উঠেছিল অনীক।
সেই ক্ষণে ওরা দুজন এলো। অনীকের দুমড়ে কুচকে যাওয়া মনটা আবার সজীব হয়ে উঠল ওদের সান্নিধ্যে।

কি ভাবছ?
তোমাদের কথা। কতদিন পরে দেখা। অথচ মনে হচ্ছে প্রতিদিন আমি তোমার সাথে কথা বলতাম। আবার যে তোমার দেখা পাবো, ভাবিনি।
আমিও ভাবিনি। তবে অনেক খুঁজেছি তোমাকে, আমি শফিক দুজনে। এই বলে সনীতা ভাতের প্লেট টা এগিয়ে দিল অনীকের দিকে।

খেতে খেতে শফিক বলল, সনীতা কি বলেছে আপনাকে Thanksgiving Party হবে আমার বন্ধু টিটুর বাসায়। খুব ভাল লাগবে আপনার। অনেক বন্ধুরা আসবে। পরিচয় হবে। বলে শফিক একটু থামল। তাকাল সনীতার দিকে।

সুন্দর পরিপাটি করা ঘরে ঘুম আসবে কিনা অনীক জানেনা। রাত অনেক। শুভরাত্রি বলে দরজাটা ভেজিয়ে দিল অনীক।

টুংটাং শব্দ। চোখ মেলে চাইল অনীক। নয়টা বাজে। উঠে পড়ল। প্যেরাকেট পাখির ব্রুব্রু আওয়াজ কানে এলো অনীকের। আন্তারা আর অনুসার প্রিয় পাখি। উড়ে উড়ে সবার হাতে, মাথায় বসে।

উঠে এলো অনীক। শফিক নাস্তা বানানোতে ব্যাস্ত। পরোটা, আলুভাজী, ডিম। অনীক ভাবছিল, সে শফিকের ঠিক উল্টো। শুধু ডিম টাই ভাজতে পারে। সবাই কে দিয়ে তোঁ সব কিছু হয় না। কনা তাকে কোনদিন কোন কিছু করতে দেইনি। অবশ্য তার কোন চেষ্টাও ছিল না।
সনীতা এলো, ফীকে হলদে টপস এর সাথে সাদা পাজামা। সকালে উঠে হাল্কা একটু প্রলেপ মুখে লাগানো। বেশ লাগছে দেখতে।
বাহিরে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। পেঁজা পেঁজা নীল মেঘ হেসে খেলে ভেসে বেড়াচ্ছে। জানালার কাছে এসে দাঁড়াল অনীক। এমন দিনে কেন জানি অনীকের মন টা অনেক দুরে হারিয়ে যায়। কে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে।

কি ভাবছ? বলে পাশে এসে দাঁড়াল সনীতা। মিষ্টি পারফীউমের গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়ে।
ভাবছি এই কদিনের আনন্দের পর ফিরে গেলে কেমন লাগবে।
থেকে যাও এখানে, তুমি তোঁ হাত পা ঝারা।
হাসল অনীক।
শফিক বলে উঠলো, তোমাদের এই ছোট ছোট কথা বার্তা বাদ দিয়ে এসো নাস্তা খেতে। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
Monterey তে যেতে দুই ঘণ্টার বেশি লাগবে। তোমাদের যত কথা পরে আছে ওখানে সমুদ্রের ধারে বসে শেষ করো।
অনীকের মনে হোল শফিক উদার চেতা। সংকীর্ণতা তার কাছে ঘেঁসতে পারেনি, যেটা কি না অনীক দেখেছে অনেকের মাঝে যে খানে তার বাস সেইখানে।

সমুদ্রের পাড় ঘেঁসে আঁকা বাকা রাস্তা। নিচে বিশাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বীচে। নীল আকাশ নেমে গেছে দুরে। মিশে গেছে সমুদ্রের সাথে।
শফিক গাড়ী থামাল। এখান থেকে নিচে নেমে গেছে চিকন রাস্তা। শেষ প্রান্তে বীচ।

আমি এখানে গাড়ীতে থাকবো, তোমরা নিচে নেমে যাও। বলে দরজা টা খুলে দিল শফিক।
কত ছবি সনীতা আর অনীক উঠিয়েছিল তার হিসাব নেই।
সনীতা বলেছিল অনীক কে, তোমার মতো একটা বন্ধু পেয়ে আমি যে কি খুশি তোমাকে বুঝাতে পারবো না অনীক।
তোমার কাছে প্রান খুলে আমি সব কথা বলে পারি।
সময় কোথা দিয়ে চলে গেলো অনীক জানে না। বন্ধন টা দৃঢ় হোল সনীতা, শফিকের সাথে। এ ভাঙবার নয়। হারিয়ে যাওয়া সনীতা শফিক কে নতুন করে ফিরে পেলো অনীক।

এয়ারপোর্টে বসে ভাবছিল অনীক, টিটু ভাই এর কথা। বিশাল বাড়ীতে Thanksgiving party. অনীকের মনে হয়নি ও ওদের একজন নয়। খাওয়া শেষে গানের পার্টি।
অনীক কে জোড় করে দাড় করিয়ে দিয়েছিল ডুয়েট গাইতে।
নিঃশব্দে অনীক হাসল।
ছোট ছোট ঘটনা, কত মধুর।
খাবার প্লেটে জোড় করে সনীতার উঠিয়ে দেওয়া মাছ। ব্যস্ততার মধ্যেও শফিকের সাত দিন ছুটি নেওয়া শুধু তার জন্য।
শফিকের আপ্যায়ন, সনীতার উচ্ছলতা।
সব কিছু কেন অনীকের মনে এসে দোলা দিল অনীক জানেনা।
অনীক জানে না, যা সে পেলো, তার কতোটুকু সে দিতে পারলো ওদের কে ।
হঠাৎ তার মনে কাব্যের সঞ্চার হোল।
সে লিখল সনীতাকে,
যেতে নাহি চাই, তবু চলে যেতে হয়।
এলাম,
তোমরা আমাকে বরন করলে মনপ্রান উজাড় করে।
আজ যাবার বেলায় শুধু তোমাদের কথাই মনে পড়ছে।
পাওয়ার খাতা আমার পূর্ণ।
শুধু বলি কি, মনে রেখো আমাকে।
বিদায়।

Continue Reading