জন্মদিন

 

সকালে পিনাট বাটার আর জেলির প্রলেপ দেওয়া টোস্ট রুটি টা টেবিলে রেখে কফির মগ টা মাইক্রওয়েব থেকে বের করতে যাবো ঠিক সেই সময় ফোন টা বেজে উঠল।
মেয়ে ফোন করেছে।
এতো ভোরে তার ফোন করার কথা নয়। সচরাচর করে না। তারপর আজ ছুটির দিন। স্বাভাবিক সময়ের বাহিরে কিছু হলে বুকের ভিতরে টা ধক করে উঠে। আজও তার ব্যাতীক্রম হোল না। ভাল চিন্তার পরিবর্তে খারাপ চিন্তাটা আসে আগে।
হন্তদন্ত হয়ে ফোনটা উঠিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, সব খবর ভাল তো।
হ্যা, ভাল। আজ তোমার জন্মদিন, মনে আছে?
ও হ্যা তাই তো। জন্মদিন। মনে যে খুব একটা দোলা দেয় এই দিনটাতে তা নয়। কারন কোনদিন পালন করা হয়নি, সেটাই ছিল স্বাভাবিক। জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী বাবা দের আমলে উদযাপন করা হতো বলে মনে পড়েনা।
পরের প্রশ্নটা আমার মেয়ের ছিল, এটা তোমার আসল না নকল জন্মদিন, আব্বু?
বললাম কি জানি মা, আসল না নকল তাতো জানিনা। তবে তোমার দাদা যেদিন আমাকে স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে গিয়েছিল, সেদিন এই তারিখ টাই ভর্তির ফর্মে লিখেছিল। এখনকার মতো সেই যুগে বার্থ সার্টিফিকেট বলে কিছু ছিল না।
কাজে আমি জানি এই তারিখ টাই আমার জন্মদিন।
ওর সন্দেহ অহেতুক নয়। এই রকম আমাদের দেশে হয়। হয় যে না তাতো নয়।

যাহোক, ওসব নিয়ে ওর মাথা ব্যাথা নেই। আজ তার বাবার জন্মদিন এটাই তার কাছে বড়।
বলল, চলো আমি খুব সুন্দর একটা সিফুড রেস্টুরেন্টে লাঞ্চের জন্য বুক করেছি। সমুদ্রের পাশে। ওখানে তোমার বার্থডে সেলিবারেট করব। তৈরী হয়ে থেকো। আমি ঠিক বারটায় তোমাকে পিক করব।
ক্লোজেটা খুলে ওরই দেওয়া পলো টি সার্ট টা বেছে নিলাম।
কিছুদিন আগে নিয়ে এসেছিল। দেখিয়ে বলেছিল, দেখতও আব্বু পছন্দ হয় কিনা।
কালো রং আমার সবসময় পছন্দ। তার উপর সে আমার নামের প্রথম অক্ষর গুলো embroidery করে এনেছে। পছন্দ না হয়ে পারে?
ওটাই বেছে নিলাম।
ঠিক সময় মতো এসে হাজির। ঘরে ঢুকে প্রথম জিজ্ঞাসা, দিনের, রাতের খাবার আছে?
রেফ্রিজারেটর খুলে দেখে নিলো আছে কিনা।
-আছে। আর তাছাড়া ইদানিং এক ভদ্রমহিলার কাছ থেকে সপ্তাহের খাবার অর্ডার দিয়ে নিয়ে আসি। উনি ক্যাটারিং করে। ভাল রাঁধে।
-তাহলে তো খুবই ভাল। একথা বলোনি তো?
হয়ত ভুলে গেছি।
চলো, বেড়িয়ে পড়ি।
রেজোয়ান এলো না?
না, আজ তুমি আর আমি, ফাদার ডটার ডে। তোমার সাথে পুরো দিন কাটাব। বলে জড়িয়ে ধরল।
চোখের কোণ টা ভিজে উঠল। বুঝতে দেই নি। পাছে ওর মনটা ভেঙ্গে পরে।
সমুদ্রের কোল ঘেঁসে রেস্টুরেন্ট। সূর্যের আলোতে সমুদ্রের পানি ঝলমল করছে। তাপমাত্রায় গরমের ভাব টা কম। সেই সাথে মৃদু হওয়া। হিউমিডিটি নেই বললেই চলে। সব মিলিয়ে বলতে হয় পারফেক্ট ডে।
বাহিরে ছাতার তলে বসলাম।
ঘাটে বাঁধা অনেক বোঁট। বড়লোক দের। মাঝে মাঝে তারা বেড়িয়ে পরে দুর পাল্লায়। এইখান থেকে অনেকে বোটে চড়ে যায় ফায়ার আইল্যান্ডে।
ওয়াটার মেন্যু দিয়ে গেলো। বেশির ভাগ সময় মেন্যু আমি খুলে দেখিনা। ওদের কে বলি যেটা ভাল মনে করো সেটা অর্ডার দিয়ে দাও।
আমার জন্য ওয়াটার কে বলল, shrimp filled with crabstaff। সাথে সুপ।
ওয়াটার অর্ডার নিয়ে চলে গেলো।
কিছুক্ষনের জন্য হয়ত অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম, মেয়ের ডাকে ফিরে এলাম।
কি কিছু ভাবছ?
কই নাতো?
জানো তোমার জন্য Toms এর জুতো অর্ডার দিয়েছি। সাইজ কত? সাড়ে আট, তাই না? বলে তাকাল আমার দিকে।
হাঁ, তাই, তবে—
কথা শেষ হতে দিলো না সে, বলল, জানো আব্বু আমি চেয়েছিলাম, তুমি আমার সাথে থাকো। অসুবিধা কি? থাকলে আমারও ভাল লাগতো। জানি তুমি স্বাধীন চেতা, কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা তোমার কুষ্ঠিতে লেখা নেই। থাকবে?
না মা, এই তো বেশ আছি। তুমি তো প্রতিদিনই খোঁজ নিচ্ছ। না চাইতেই অনেক কিছু নিয়ে হাজির হও। এর চেয়ে বড় আর কি আছে বলও।
তুমি চাইবে? কারো কাছে ? বলে হাসল সে।
ওর মুখ টার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হোল যেন খোদাই করে ওর মার মুখ টা কেউ বসিয়ে দিয়েছে। চোখের তারায় ভালবাসার ছোঁয়া। আমায় নিয়ে ভাবনা তার। হারাতে চায় না। দেখতে চায় হাঁঠছি, চলছি ওর সামনে।

shrimp filled with crabstaff কোথায় রাখবো? ওয়েটার মৃদু কণ্ঠে বলল।
দেখিয়ে দিলাম কোথায় রাখতে হবে। জিজ্ঞাসা করলো, কোন ড্রিঙ্কস?
জীঞ্জারেল।
ও চলে গেলো।

হঠাৎ ই মেয়ে আমার বলে উঠল, আব্বু তোমার ছোটবেলার গল্প বলও।
ছোটবেলা?
হাঁ, মনে পরে?
এখনো জ্বলজ্বল করে মনের পর্দায়। তোমাদের ছোটবেলা আর আমাদের ছোটবেলার মধ্যে পার্থক্য অনেক।
বলও। খুব ইন্টারেস্টিং। তাই না?
তবে শোন।
সুপে চুমক দিতে দিতে বললাম, তুমি তো জানো তোমার কয় ফুফু আর চাচা।
হাঁ, তোমরা সাত ভাই বোন।
আমি পাঁচ নম্বর। শুনেছি আমি নাকি হাংলা পাতলা ছিলাম। পেটে কিছুই সহ্য হতো না।
তুমি হাসছ?
হাঁ, তোমাকে এখন দেখে তো মনে হচ্ছে না তুমি একসময় ঐ যে ওয়ার্ড টা বললে, হাংলা ছিলে।
না এখন অবশ্য বোঝার উপায় নেই। তখন এমনও পরিস্থিতি হয়েছিল আমাকে বাঁচানো দায় হবে বলে সবার মনে হয়েছিল। একথা শুনেছি বড় হয়ে। যাক অনেক চেষ্টা করে আর উপরওয়ালার কৃপায় আমি বেচে গিয়েছিলাম।
বোঝার বয়স হওয়ার পর থেকেই দেখেছি বাসা ভর্তি লোক। তোমার গ্রেট গ্র্যান্ড মা থাকতো আমাদের সাথে। আর সাথে থাকতো তোমার আর এক দাদা। আমার বাবার মেজভাই।
আমাদের রাতের খাওয়ার ভাঁড় ছিল আমার দাদির অর্থাৎ তোমার গ্রেট গ্র্যান্ড মার হাতে।
বাসার বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে হারিকেনের আলোয় আমরা চার ভাই বোন পড়াশুনা করতাম।
হারিকেনের আলো মানে? Electricity নেই?
না মা, সেই পঞ্চাশ দশকে বিদ্যুৎ আসেনি ঐ ছোট্ট শহরে।
তারপর?
তারপর দাদি তার কাজ কর্ম শেষে আমাদের কে ডাক দিতো। আমাদের অপেক্ষার অবসান হতো।
তোমার বন্ধু ছিল না?
বন্ধু? সেলিম, তীতু, টিপু, মহি, গোপাল, আরও অনেক, নাম মনে পড়ছে না। কোন কোন দিন স্কুল থেকে এসে কোন রকমে বই গুলো রেখে, ঘুড়ি, লাটাই নিয়ে বেড়িয়ে পড়তাম। অন্যান্যরা এসে হাজির হতো মাঠে। পল্টূ ছিলও সবার ছোটো। ও দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমাদের ঘুড়ি ওড়ানো দেখত।
মাঝে মাঝে এসে আমাকে বলতো, দাওনা আমাকে লাটাই টা, একটু ধরি।
জানো একদিন কি হয়েছিল?
কি?
ওকে আমি লাটাই টা দিয়ে বললাম, তুই ধরে রাখ, আমি পানি খেয়ে আসি।
ওর মুখের হাসি যদি দেখতে।
এসে দেখি ও কাঁদছে।
জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে?
ওকে আর বলতে হোল না, তাকিয়ে দেখি আমার ঘুড়ি টা ছৌ মেরে নিচে এসে একটা ছোট আমগাছের ডালে আঁটকে গেছে।
তুমি ওর উপর রাগ করেছিলে।
না, বললাম চল, আম গাছে উঠতে হবে।
উঠেছিলে?
হাঁ, ও নিচে দাড়িয়ে রইল, আমি তড় তড় করে উঠে গেলাম, হাত বাড়িয়ে ঘুড়ি টা ধরতে যাবো ঠিক সেই সময় একটা কাটবেড়ালি লাফ দিয়ে আমার ঘাড়ের উপর দিয়ে দৌড়ে গেলো। আমার হাত ছুটে গেলো ডাল থেকে।
ধপাস করে পড়লাম মাটিতে।
তারপর? বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞাসা করলো সু।
তপু, মহি দৌড়ে এলো।
আমি তখন উঠে দাঁড়িয়েছি। মনে হোল কিছু হয়নি। বাড়ীতে চলে এলাম। কাউকে কিছু বললাম না। রাতে হাতে প্রচণ্ড ব্যাথা আরম্ভ হোল। কাঁদছি দেখে দাদি জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে।
বললাম গাছে উঠতে যেয়ে পড়ে গেছি। বাবা কে ডাক দিল। বাবা দেখে বলল, মনে হচ্ছে হাত টা ভেঙ্গেছে।
ভেবে ছিলাম বাবা বকবে। না, বকা দিলোনা।
সেই রাতে বাবা তার এক বন্ধু ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। সে দেখে বলল, কাল সকালে হাসপাতালে নিয়ে যেতে।
ভেঙ্গে ছিল?
হাঁ, পরদিন হাসপাতালের ডাক্তার দেখে হাতে Cast লাগিয়ে দিলো।
ওহ, মাই গড।
আর কোন এডভেঞ্চার আছে তোমার ছোট বেলায়।
হাসতে হাসতে বললাম, একটা? অনেক। একটার কথা বলি।

একদিন আমি, তপু, আর সেলিম মেঠো পথ দিয়ে হাটতে হাটতে যাচ্ছিলাম হারানের বাসায়। পথে চোখে পড়ল আঁখের বাগান, আঁখ মানে সুগার ক্যান। সেলিম বলে উঠল, চল কয়েকটা আঁখ ভেঙ্গে নিয়ে আসি। যেই কথা সেই কাজ।
বাগানে ঢুকে কয়েকটা আঁখ ভেঙ্গে যেই বাগান থেকে বের হতে যাবো, দেখি সামনে দাড়িয়ে একজন, হয়তো বাগানের মালিক, হাতে একটা অস্ত্র, আঁখ কাঁটার অস্ত্র।
তারপর?
সবকিছু ফেলে দিয়ে আমরা দিলাম দৌড়। সেও পিছে পিছে দৌড়াচ্ছে, আর গালি গালাজ করছে। হঠাৎ মাটির ঢেলাতে হোঁচট খেয়ে উল্টে পড়লাম মাটিতে। সেলিম আর তপু কিছুটা এগিয়ে যেয়ে আবার ফিরে এলো। দেখলাম লোকটা আর আমাদের পিছনে নাই।
উঠে দাঁড়ালাম। তপু বলল, অ্যাই, তোর কনুই দিয়ে রক্ত পড়ছে।
তাকিয়ে দেখি বেশ কিছুটা জাগা ছেঁচে গেছে মাটিতে গসা লেগে। অগত্যা কি করি। একটু হাটতেই দেখতে পেলাম কয়েকটা কচু গাছ। ওর পাতা ছিরে রস টা লাগিয়ে দিলাম কাঁটা জাগায়। শুনেছি ওটা লাগালে রক্ত পড়া বন্ধ হয়।

আঁখ তো খাওয়া হোল না। হারানের বাসাতেও যাওয়া হলনা। বাড়ী ফিরে এলাম।
দাদি দেখে জিজ্ঞাসা করলো, এই সর্বনাশ কি ভাবে হোল?
বললাম, ফুটবল খেলতে যেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম।
সু হেসে উঠলো হাঁ হাঁ করে। বাহ, বুড়ো দাদি কে বেশ তো বুঝিয়ে ছিলে।
তা ঠিক।
এই রকম আরও কত এডভেঞ্চার আছে সেই ছোট্ট বেলায়। আজ মনে হলে হাসি পায়।
তবে জানো কি মা, এটা একটা অভিজ্ঞতা। ছোট বেলার ছোট ছোট ঘটনা ছোট বেলাতেই মানায়। বড় হয়ে ঐ গুলোর স্মৃতি মন্থন করতে ভালই লাগে।
সত্যি আব্বু, তোমাদের ছোট বেলা, আর আমাদের ছোট বেলার মধ্যে পার্থক্য অনেক। যুগ পাল্টিয়েছে। তাই না?
তাতো বটেই। চল, সূর্য পড়ে এলো। এবার বাসার দিকে যাই।
আব্বু, চলো না আজ আমার সাথে। আমার বাসায় থাকবে।
আজ নয় মা, আর একদিন। আজ বাসায় যেয়ে পুরো দিনটাকে আবার আমি ফিরিয়ে আনবো আমার কল্পনায়। উপভোগ করব নতুন করে, তোমার সাথে কাটান দিন টা। কি বলও?
ঠিক আছে, তুমি যা ভাল মনে করো। চলো, উঠি।

Continue Reading