ছাব্বিশে অক্টোবর

    আজ কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই নন্টুর। অনেক বছর আগে হলে, দুজনে হাত ধরাধরি করে বেড়িয়ে পড়তো। কোন একটা ভাল রেস্টুরেন্টে দুটো সিট আগের থেকেই রিজার্ভ করে রাখতো। মাঝ রাতে উঠে যে কার্ড টা আগের দিন কিনে রেখেছিল সেটা বিছানার পাশের টেবিলে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতো। সাথে এক গোছা লাল গোলাপ। 

আজ তার পরিবর্তে সে এসে বসলো সোফাতে। সামনে স্তূপ করা পুরানো চিঠি।
যে গুলো সে লিখেছিল আর প্রতি উত্তরে পেয়েছিল বিয়ের আগে।
সে গুলো পড়তে যেয়ে চশমাটা ঝাপসা হয়ে এলো নন্টুর। চিঠির মাঝে ভেসে এলো সাদাটে ফ্রেমের চশমা পড়া মুখটা। যেন সে নিজেই পড়ে পড়ে শুনাচ্ছে। বলছে, এক সাথে পড়বো ভেবেছিলাম তা আর হয়ে উঠলো না।
দেখো, দেখো কি ছেলেমানুষি কথা লিখেছি এই চিঠি টা তে। বলে যেন সে হাসছে।
চিঠির তারিখ গুলো দেখেছ?
দেখেছি। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে লেখা।
এখনো রেখে দিয়েছ কেনও?
অন্য সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছি। এটা আমার। এক মাত্রই আমার। তাই।
আজ এলে যে। বলে নন্টু নাক টা ঝেড়ে নিলো।
না এসে পারি। আজ যে ছাব্বিশে অক্টোবর। আমার বাবা আমাকে শপে দিয়েছিল তোমার হাতে।
বলেছিল, সুখে দুঃখে তুমি ওর পাশে থাকবে। ও আমার বড় আদরের মেয়ে। কিন্তু বাবা বেশিদিন দেখে যেতে পারলো না আমার সুখ টা।
গতকাল ঐ এ্যালবাম টা দেখছিলাম। বলল নন্টু।
কোনটা?
ছাব্বিশে অক্টোবর, উনিশ শো —– টা
চুয়াল্লিশ বছর হয়ে গেলো। কি সুন্দর করেই না তুমি রেখে দিয়েছ। কাজের ভিড়ে যখন ছিলাম তখন আর ওই গুলো দেখা হয়ে উঠেনি। শুধু তোমার সাথে ঘুরেই বেড়াতাম। আজও কি ঐখানেই আছে ঐগুলো ?
না সেখানে নেই। ছোট্ট দুটো কামরা নিয়ে আছি। একটা ঘরে রেখেছি তোমার সব ছবির এ্যালবাম গুলো।
বলে নন্টু উঠে কয়েকটা ন্যাপকীন নিয়ে এলো।

জানো মনে হয় এইতো সেদিন ছিল আমাদের একসাথের সুখের দিন গুলো।
বেশ কিছু বছর কেটে গেলো তুমি নাই, কি ভাবে বোঝাই বলও, I miss you.
মনে হয় তুমি আবার আসবে, আমরা আবার আগের মত হাসবো।
এ জনমে নয় পরের জনমে আমরা আবার একসাথে হবো।
মৃত্যু আমাদের ভালবাসা কে ছিনিয়ে নিতে পারেনি, আমরা আজ দুজনে দুই জাগায়, তবু তুমি আছো আমার মাঝে।
যে স্মৃতি আমরা দুইজনে গড়ে তুলে ছিলাম আজ আমার মনের মাঝে তা চির জাগ্রত।
তুমি স্বর্গে আছো শান্তিতে, মুক্ত বিহঙ্গের মত।
যখন আমার ডাক আসবে দেখা হবে তোমার সাথে Pearly Gate এ। হবে তো ?
হবে।

নন্টু তাকালও চারিদিকে ঝাপসা চোখে। ঘরটা অন্ধকার। আলো জ্বালানো হয়নি।
অন্ধকারে চিঠি গুলো ভাজ করল। রাখল পাশে।
দাঁড়াল যেয়ে জানালার সামনে। বাহিরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।

Continue Reading

কান্না

                                           কান্না             

মা, বাবা কে হারিয়ে যখন ছোট্ট তপুর দায়িত্ব আমার উপর এলো তখন সবে মাত্র আমি চাকরি তে ঢুকেছি।
তপু আমার ছোট্ট ভাই। শেষ বয়সের মা বাবার নাড়ী পোঁছা ছেলে। দাদা বলতে অজ্ঞান। সব সময় আমার পিছনে ঘুর ঘুর করে বেড়াত।
বাবা চলে গিয়েছিল অনেক আগে।
কান্সারে আক্রান্ত জর্জরিত শরীর নিয়ে একদিন মা আমাকে ডেকে বলেছিল, সানু, আমার সময় বোধ হয় এলো। তুই তপু কে দেখিস। তোর কাছে রেখে গেলাম। ওর সব দায়িত্ব তোর।
কথা দিয়ে ছিলাম মা কে।

এক রাতে মা চলে গেলো। তপুর চোখে জল আমি দেখিনি। শুধু আমার দিকে ভাষাহীন চোখে চেয়েছিল।
সব কৃত্যকর্ম শেষ করে যখন বাসায় ফিরে এলাম তখন অনেক বন্ধু বান্ধব এলো সহানুভূতি জানাতে।
নিয়ে এলো খাবার।
বসলো পাশে।
জহীর বলেছিল, দরকার পড়লে আমাকে ডাকিস।
অনেক বন্ধুর মাঝে সেই আমার একান্ত প্রিয়। সময়ে অসময়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
আস্তে আস্তে বাসাটা খালি হয়ে গেলো। সবাই চলে গেলো। শুধু রইলাম আমি আর তপু।
বাস্তবতার সামনে দাড়িয়ে মনে হোল পারবো কি? পারবো কি মা কে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে।

সেই দিন তপু এসে আমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়েছিল। একটা কথাও বলে নি।
আমি ওর চুলের মাঝে হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিলাম, ভাবিস নে তপু, আমি তো আছি।
সে কি বুজেছিল জানি না।
কিছুদিন কেটে গেলো। আস্তে আস্তে সয়ে এলো নির্জনতা।
একদিন জহীরকে আসতে বললাম। ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করার জন্য।

ও এলো।
কফির পানি বসিয়ে দিয়ে এসে বসলাম সোফাতে।
জহীর জিজ্ঞাসা করল, কিছু ভেবেছিস কি?
না। তবে এইটুকু জানি তপুর মনে যেন কোনদিন কোনক্রমে এই ভাবনা না আসে যে সে মা বাবা হারা।
বুজেছি। বলে জহীর চুপ করে রইল।
বললাম, একটা ছক কেটেছি।
কি?
আমার আয় দিয়ে সংসার টা চালাতে একটু কষ্ট হবে । তাই ভাবছি, বাড়ীর উপরের অংশ টা ভাড়া দিয়ে দেবো। আমরা দুজনা নিচের দুটো ঘর নিয়ে থাকবো। কি বলিস?
মন্দ না। তবে একটু ছোট হয়ে গেলো না কি?
তা বটে। তবে মানিয়ে নিতে পারবো মনে হয়।

উপরের টা ভাড়া দিয়ে নিচে চলে এলাম আমরা দুজনে। ছোট্ট দুটো ঘর। এক চিলতে বসার জায়গা। তপু কে বললাম, একটু অসুবিধা হবে তাই না?
সে বলল, না দাদা, কোন অসুবিধা হবে না।
সমস্যা দেখা দিলো খাওয়া দাওয়ার। জীবনে কোন দিন রান্না ঘরে ঢুকিনি। মার বর্তমানে কেই বা আসে রান্না ঘরে। ফলে ডিম ভাজী ছাড়া আর কিছু আমার আয়ত্তে নেই।
বাহিরের থেকে কিনে খাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
অপু কিছুই বলে না। তবে বুঝতে পারি বাহিরের ওই তেলের উপরে ভাসা তরকারি গুলো ওর পছন্দ নয়।

সাধন দা আর বৌদি। আমার উপর তালার ভাড়াটে। নিতান্তই ভাগ্য ক্রমে এত ভাল একটা ভাড়াটে পেয়েছিলাম। বয়স ষাটের উপরে হবে সাধন দা র। ছেলে মেয়ে নেই। একটা কোম্পানি তে আইটি ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। বৌদি বাসাতেই থাকে।
এটা ওটা ভাল কিছু রান্না হলে পাঠায়ে দেয়।
সাধন দা একদিন বলেছিল, তোমাদের যদি ধর্মীয় কোন কারনে আপত্তি না থাকে তবে এসো, মাঝে মধ্যে এক সাথে বসে রাতের আহার খাওয়া যাবে। আর গল্পও করা যাবে।

বৌদি উপর থেকে ডাক দিতো। ও ঠাকুরপোরা, এসো তোমার দাদা এসেছে। গল্প করবে, একটু পরে টেবিল সাজাবো।
তপু তার লেখাপড়া নিয়ে ব্যাস্ত থাকাতে পরে এসে যোগ দিত।
এই ভাবে দিনগুলো ভালই কেটে যাচ্ছিল।
একদিন, রাত এগারটা। সবে মাত্র বিছানায় গেছি।
বৌদি চিৎকার করে ডাকদিল। ঠাকুরপৌ তাড়াতাড়ি আসবে।
তড়িঘড়ি করে আমি আর তপু দৌড়িয়ে গেলাম।
কি হয়েছে? বলেই সাধন দার দিকে তাকাতেই বুঝলাম উনার নিশ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে।
দেরী না করে ৯১১ কল করলাম।
বৌদি অঝোরে কাঁদছে।
এ্যাম্বুলেন্স তাড়াতাড়ি এলো। ওরা সাধন দা কে নেওয়ার আগে জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে মনে হয়?
হার্ট অ্যাটাক।
বৌদি সাধন দাকে নিয়ে পিছনে বসলো। আমি সামনে ড্রাইভারের সাথে।
হাসপাতাল খুব একটা দুরে নয়। ওখানে আসতেই EMS এর লোকেরা দ্রুত সাধন দা কে নিয়ে গেলো কার্ডিয়াক অপারেটিং রুমে।
আমি আর বৌদি বসে রইলাম বাহিরে, ওয়েটিং রুমে।
সময় যেন যেতে চায় না।
বৌদি কে জিজ্ঞাসা করলাম, কফি খাবে?
না। আমার ভয় করছে।
ভয় কিসের, ইদানীং এইসব সার্জারি, ডালভাত।
বৌদি যে খুব একটা ভরসা পেলো মনে হোল না। ।
কয়েক ঘণ্টা পড়ে ডাক্তার বেড়িয়ে এলো।
জিজ্ঞাসা করতেই বলল, এই মুহূর্তে বলতে পারব না। আটচল্লিশ ঘণ্টা গেলে বুঝতে পারবো। হার্ট অ্যাটাক নয়। স্ট্রোক হয়েছে।
সাধন দা কে ইনটেনশিভ কেয়ারে নিয়ে যাওয়া হোল। দেখতে গেলাম। নানা রকম যন্ত্রপাতি লাগানো। বৌদি একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে। কি বলে সান্ত্বনা দেবো বুঝে পেলাম না।
সকাল হয়ে এলো। জানি আজকে আর কাজে যাওয়া হবে না। বৌদি কে বললাম, চল বাসায় যেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে আসব।
যাবার পথে জহীরকে জানিয়ে রাখলাম। এসে দেখি তপু স্কুলে চলে গেছে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বলতে পারবনা। জহীরের টেলিফোনে ঘুম ভাঙ্গলো।
দরজাটা খোল, আমি তো বাহিরে দাঁড়ান। কখন থেকে বেল বাজাচ্ছি।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বিকেল চারটা। বৌদিকে বলেছিলাম হাসপাতালে নিয়ে যাবো।
ডাক দিলাম, নেমে এলো। চোখ জবা ফুলের মত লালা। সারাক্ষন বোধহয় কান্না করেছে।
জহীরকে বললাম,চল, তোকে আর বাসায় ঢুকতে হবে না। হাসপাতালে যেতে যেতে কথা হবে। বলে গাড়ীতে উঠলাম।
কথা যে খুব একটা হোল তা নয়।
শুধু বৌদি একবার বললও, ঠাকুরপো, তোমার দাদা ভাল হবে তো? না হলে আমাদের কি হবে আমি ভাবতে পারছিনা, ঠাকুরপো। বলেই অঝোরে কাঁদতে লাগলো।
কি বলে সান্ত্বনা দেবো বুঝতে পারলাম না।
জহীর বলল, ভাবছেন কেনও ভাবী, আমরা তো আছি।

দিন যেয়ে মাস এলো। সাধন দা বাড়ীতে। বাম পাশটা পুরোপুরি অবশ। কোন অনুভূতি নেই। চেয়ে থাকে, কিন্তু দৃষ্টি যে কোথায় বোঝা যায়না। মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ বের হয়। মনে হয় কি যেন বলতে চাইছে।
আমরা কেউ বুঝতে পারছিনা দেখে, ডান হাত দিয়ে হাতের কাছে যা কিছু আছে ছুড়ে ফেলে দেয়।
বৌদি সবকিছু কুড়িয়ে এনে আবার সামনে রাখে।
ডাক্তারের মতে কোন মিরাকেল ঘটার সম্ভবনা নেই। এইভাবেই চলবে যতটুকু সময় তার আছে।

একমাত্র তপুকে দেখলে চেহারায় উজ্জলতা আসে। তপু পাশে বসে বিভিন্ন গল্পের বই পড়ে শোনায়। তখন সাধন দা চোখ বুজে থাকে। ডান হাতটা দিয়ে তপুর হাতটা নিয়ে খেলা করে। আমি ভাবতে থাকি এ বোধহয় পুত্রস্নেহ। যার সাধ দাদা বৌদি পাইনি।
তপুর জ্ঞান হওয়ার আগেই বাবা চলে গিয়েছিল। তাই বাবার স্নেহ সে পাইনি। এটা বোধ হয় তার কাছেও একটা বড় পাওয়া।
একদিন রাতে তপু উপরে যেয়ে সাথে সাথে ফিরে এলো।
কিরে ফিরে এলি যে?
সাধন দার বোধ হয় শরীর টা ভাল না। বমি করছে।
তাড়াতাড়ি উপরে এলাম।
সাধন দা হুইলচেয়ারে বসা। সামনে বড় একটা পাত্র। কিছুক্ষণ পরপর বমি করছে। আর গোঁ গোঁ করে কি যেন বলার চেষ্টা করছে।

কি করব ঠাকুরপো? হাসপাতালে নিয়ে যাবো কি?
বললাম, দাড়াও, আমার এক ডাক্তার বন্ধুকে কল করি। দেখি সে কি বলে।
দুবারের মাথায় ফোন ধরল সে। বুঝিয়ে বলতেই, বলল, আমি ফার্মেসিতে কল করে দিচ্ছি। তুই যেয়ে ঔষধ টা নিয়ে আয়। আর স্যালাইন ওয়াটার খাওয়াতে থাক। যদি রাতের মধ্যে না থামে তাহলে হাসপাতালে নিয়ে যাবি।
বৌদিকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে ঘরে এসে দেখি তপু বালিশে মাথা গুজে শুয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করতেই বলল, আমার কিছু ভাল লাগছেনা, সাধন দা ভাল হবে তো?
ও যে কখন এতো এটাচট হয়ে গেছে সাধন দার সাথে বুঝতে পারিনি।

দিন দিন সাধন দার শরীর অবনতির দিকে যেতে থাকলো। আমিও ব্যাস্ত কাজ নিয়ে। একটা প্রমোশন হওয়াতে কাজের চাপ আরও বেড়েছে। প্রতিদিনই দেরী করে বাসায় ফিরতে হয়। উপরে যাওয়া হয়ে উঠে না। খবর পাই তপুর কাছ থেকে।

সেদিন ছুটি আমার। সকালে উপরে এলাম। বৌদির দিকে তাকিয়ে মনে হোল, বৌদি অনেক শুকিয়ে গেছে।
আমাকে দেখে বলল, অনেকদিন তুমি আসোনি ঠাকুরপো। গতকাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম।
কি বলল?
কি আর বলবে।
বলল, একটা একটা করে অর্গান গুলোর ক্ষমতা কমে আসছে। আমাকে প্রস্তুত থাকতে বলল।
এ শুধু সময়ের অপেক্ষা ঠাকুরপো। আমার চোখের সামনে আস্তে আস্তে ও নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। আমার হাতে মাথা রেখে ও একদিন চলে যাবে ঠাকুরপো।
আমার চোখে জল এলো। ঠেকাতে যেয়েও ঠেকাতে পারলাম না। ঝরে পড়ল।
বৌদি কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
শুনতে পারলাম নিচের থেকে তপুর কান্নার শব্দ।

Continue Reading