অস্তগামী সূর্যের লাল রশ্মি টা এসে পড়েছে তৌফিকের ড্রয়াইং রুমে। মনে হচ্ছে যেন আলো আধারের খেলা চলছে। একটু পড়ে সন্ধ্যা নামবে। দুরের আকাশ টা লালচে রঙে ছেয়ে যাবে। প্রতিদিন এই সময়টা তৌফিক বড় জানালাটার কাছে দাড়িয়ে দুর পানে চেয়ে থাকে। আস্তে আস্তে অন্ধকারে ছেয়ে যায় চারিদিক।
অন্যদিন তৌফিক টিভি টা চালিয়ে এক কাপ কফি নিয়ে বসতো। আজ আর তা করলো না।
গতকালের ঘটনা গুলো মনে করার চেষ্টা করলো।
শোভা আপার বাসায় ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যেতে হয়েছিল লাঞ্চ খেতে। সাথে ছিল সাধনা আর প্রতিমা।
তৌফিকের বান্ধবী। অনেকদিনের পরিচয়। অনেকে অনেক কথা বলে সাধনা আর তৌফিককে ঘিরে। তৌফিক পাত্তা দেয় না। ব্যচেলার থাকার এই একটা উটকো ঝামেলা, মনে করে তৌফিক।
এক গানের অনুষ্ঠানে সাধনা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তৌফিক কে।
“ এই তৌফিক, এদিকে এসো”।
প্রথমে ডাক টা শুনতে পায়নি তৌফিক। গান চলছে। একটু হট্টগোল।
দ্বিতীয় বারের ডাকে তাকাতেই হাত দিয়ে ইশারা করলো সাধনা। একজন কে ঘিরে দুই তিন জন।
কাছে আসতেই সাধনা বলল, চেন উনাকে? সামনে দাঁড়ানো মহিলা কে হাত দিয়ে দেখালও।
না চিনলাম না।
শোভা আপা। দেশে আমাদের বাসা আর উনাদের বাসা পাশাপাশি ছিল। সেই থেকে পরিচয়। আজ অনেকদিন পরে দেখা।
অনেকেই চেনে উনাকে। খুব পপুলার।
তুমিতো আমাকে লজ্জায় ফেলে দিলে উনাকে চিনতে না পারাতে। বলে তৌফিক মৃদু হাসল।
মাফ করবেন, হয়তো দেখেছি কোথাও এইক্ষণে মনে করতে পারছি না।
না না তা কেন। একদিন আসেন আমার বাসায়। সাধনা কে নিয়ে। আমিই কল করে জানাবো।
অবশ্যই।
শোভা আপা কল করেছিল। আসতে বলেছিল। বয়সে দুই এক বছরের ছোট হতে পারে বলে মনে হোলও তৌফিকের।
নতুন পরিচয়ে নাম ধরে ডাকাটা শোভনীয় নয় বলে আপা শব্দ টা যোগ থাকলো।
ঘরে ঢুকতেই, তৌফিক দেখল বেশ কিছু পরিচিত লোকজন। যাক, তাহলে সে একা নয়। একটু স্বস্তি পেলো তৌফিক।
ফুলের তোড়া টা এগিয়ে দিতেই শোভা আপা বলল, কি ব্যাপার, একলা না সাথে কেউ আছে?
আছে, একজন নয়, দুজন। হাসতে হাসতে বলল তৌফিক।
আপনার সাথে আমার কথা আছে।
আমার সাথে? আপনি তো আমাকে চিন্তায় ফেলে দিলেন।
আমি আসছি, বলে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো শোভা আপা।
তৌফিক টেবিলের উপর থেকে কয়েকটা বাদাম উঠিয়ে নিয়ে আসতেই আসমা ভাবী ডাক দিল।
লেখা টা পড়লাম। খুব ভালো লাগলো।
আপনিই আমার একমাত্র পাঠক। তৌফিক হেসে বলল।
দেশের বাহিরে কি যাওয়া হবে।
এই মুহূর্তে না। নেক্সট ইয়ারে।
শোভা আপা ফিরে এলো। হাতে একটা ছবি।
তৌফিকের হাতে দিয়ে বললও, দেখেন তো চিনতে পারেন কিনা?
অনেক পুরানো ছবি। রং ফেড হয়ে গেছে। তবুও চেনা যায়। ছয় জন দাড়িয়ে। একপাশে তৌফিক। তারপর শোভা আপার স্বামী তার পাশে শোভা আপা।
তাহলে আপনি আমাকে চিনতেন? তাই না?
অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। জলজ্যান্ত প্রমান।
আপনাকে দেখেই মনে হয়েছিল কোথায় যেন দেখেছি। বাসায় এসে পুরনো এ্যালবাম গুলো খুলে দেখতে লাগলাম। অবশেষে আমি জয়ী।
আপনিতো রীতিমত সারলক হোমস। বলে হাসতে লাগলো তৌফিক।
নিচে ছেলেদের জন্য জায়গা করা হয়েছে।
আড্ডা বেশ ভালোই জমে উঠলো। মহিই কথা বলছে বেশি।
পলিটিক্স শেষে যার যার ছোট বেলার কৃতি কলাপ। তৌফিক চুপ করে শুনছিল।
এর মাঝে আরম্ভ হোলও ভুত, প্রেত এর জিন এর কথা।
মহি তার জিনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে যাবে সেই সময় ডাক এলো উপর থেকে।
খাওয়া রেডি।
খাওয়া শেষে এবার ফেরার পালা।
সাধনা, প্রতীমাকে নিয়ে বের হতে হতে সন্ধ্যা সাত টা বেজে গেলো তৌফিকের। বাহিরে তখনো অঝোর ধারায় ঝরছে।
তৌফিক বলল, তোমাদের কে নামিয়ে দিয়ে আমি যাবো রফিকের বাসায়। ওর বৌ আগামীকাল দেশে যাবে। দেখা করতে হবে।
তাহলে তো বাসায় ফিরতে তোমার দেরী হবে। রাতে খাবে কোথায়। বাসায় কিছু আছে? সাধনা জিজ্ঞাসা করতেই তৌফিক বলল রফিকের ওখানেই খেয়ে নেবো।
আচ্ছা তৌফিক ভাই আপনি বিয়ে করলেন না কেন? কেউ কি এসেছিল আপনার জীবনে কোন এক সময়।
অকস্মাৎ প্রতিমার এই প্রশ্নে তৌফিক কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও সাথে সাথে সামলে নিয়ে প্রতিমার দিকে তাকাল।
তোকে এতো পার্সোনাল প্রশ্ন করতে কে বলেছে? ধমকের সুরে সাধনা প্রতিমাকে বলল।
গাড়ীতে YouTube ভেসে আসা গান টা বন্ধ করে দিল তৌফিক। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো।
নিস্তব্ধ ভিতরে। বাহিরে বৃষ্টির শব্দ।
সাধনা তাকাল প্রতিমার দিকে। প্রতিমা হাত জোড় করে মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে জানাতে চাইল সে দুঃখিত।
এমনি বরষা ছিল সেদিন— নিস্তব্ধটা ভাঙ্গল তৌফিক।
ইউনিভার্সিটিতে প্রথম বর্ষের ছাত্র আমি। প্রথম বর্ষে যা হয়। অত্যন্ত মনোযোগী পড়াশোনার ব্যাপারে। কাজেই লাইব্রেরিতে ঘনঘন যাতায়েত। এমনি একদিন লাইব্রেরির কাজ শেষ করে বাহিরে এসে দাঁড়ালাম। অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। ছাতা টা খুলতে যাবো সেইক্ষণে, শুনতে পেলাম কে যেন বলছে, শুনছেন?
চারিদিকে চেয়ে দেখলাম আর কেউ নেই। আছি শুধু আমি আর সে। তবুও বললাম, আমাকে বলছেন?
জি, কোন রিক্সা তো দেখছিনা, যদি কিছু মনে না করেন আমাকে আপনার ছাতা দিয়ে ঐ গেট পর্যন্ত পৌছে দিলে ওখানে রিক্সা পেয়ে যাবো।
আসুন, তবে ছাতা টা খুব একটা বড় না, কিছুটা ভিজতে হবে।
পাছে শরীর স্পর্শ করে তাই অধিকাংশ ছাতাটা ওর দিকে দিয়ে আমি ভিজতে ভিজতে এগিয়ে চললাম। তবুও হাতে হাত লাগলো। শরীর স্পর্শ করলো। আমার তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে খেলে গেলো এক উচ্ছল তোরঙ্গ। কোন মেয়ের সংস্পর্শে আগে কখন আসিনি তো।
বাহ! বড় রোমটিক্টার আভাস পাচ্ছি। প্রতিমা বলে উঠলো।
থামবি তুই? সাধনা ধমক দিলো।
আমার নাম তৌফিক, কেমিস্ট্রি মেজর।
আমি মলি, soil science মেজর। আপনার ডিপার্টমেন্ট থেকে খুব একটা দুরে নয়।
সাদা শাড়ী, কালো পাড় পরনে, দুই ভুরুর মাঝে কালো ফোঁটা। প্রথমে ভেবে ছিলাম ওটা তিল, সুন্দর মানিয়েছে। ওর গায়ের মিষ্টি গন্ধ বৃষ্টির সোঁদা গন্ধকে হার মানালো।
দুজনে ছাতাটাকে ধরতে যেয়ে ওর হাত টা এসে পড়লো আমার হাতের উপর।
ও চকিতে চেয়ে সরিয়ে নিলো।
তারপর? প্রতিমার আবার জিজ্ঞাসা।
গেটে এসে পৌছালাম। ভাবছিলাম, না পৌছালে বেশ হতো।
বৃষ্টি টা আরও জোড়ে কেনও এলোনা। কেন রিক্সা গুলো ওখান থেকে চলে গেলো না।
তাহলে আরও কিছুক্ষণ এক সাথে থাকা যেতো। তা আর হোলও না।
ও রিক্সায় উঠে বসলো।
বলল, অনেক ধন্যবাদ। আপনি তো আমাকে বৃষ্টি থেকে বাচাতে যেয়ে নিজে ভিজে একাকার।
বললাম, আমার হল কাছে, অসুবিধা হবে না।
দেখেন, ঠাণ্ডা যেন না লাগে। আপনি প্রতিদিনই কি লাইব্রেরি তে আসেন।
আসি এবং একই সময়।
জানা থাকলো।
ও চলে গেলো, আর আমার মনে হোলও ছাতাটা বন্ধ করে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমি গাইতে থাকি
,”পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে, পাগল আমার মন জেগে ওঠে’
সাধনা চুপ করে শুনছে, প্রতিমা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো, আবারও দেখা হয়েছিল।
হয়েছিল। সেই জাগায় সেই সময়ে প্রতিদিন।
কোথা দিয়ে দুটো বছর কেটে গেলো বুজতে পারিনি। তখন আমরা দুজনেই তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছাত্রী।
ইউনিভার্সিটি বন্ধ হোলও বেশ কিছুদিনের জন্য। ও চলে গেলো ওর দেশের বাড়ীতে।
সময় চলে গেলো, ও ফিরে এলো। গম্ভীর।
কি হোলও? জিজ্ঞাসা করতেই বলল,
বাবা বিয়ে ঠিক করছে।
লেখা পড়া শেষ হোলও না, বিয়ে ঠিক করছে মানে?
ভালো পাত্র পেয়েছে, বিদেশে থাকে। ইঞ্জিনিয়ার।
আমার তো এখনো কয়েক বছর বাকি পাশ করার। চল, কোর্ট ম্যরেজ করে ফেলি। কোন কিছু চিন্তা না করেই বলে ফেললাম।
পাগল। বলে সে চুপ করে রইল। দেখি, চিন্তা করো না।
দুই তিন মাস কেটে গেলো। হঠাৎ একদিন দেখি আমার ডিপার্টমেন্টের সামনে সে দাড়িয়ে।
কি ব্যাপার?
ওর হাতে ধরা টেলিগ্রাম টা আমাকে দিলো। লেখা, মা ভীষণ অসুস্থ। যত তাড়াতাড়ি পারো চলে এসো।
বলল, আজ রাতের ট্রেনে চলে যাচ্ছি। ফিরে এসে সব বলব।
খুব একটা ভালো মনে হচ্ছে না তৌফিক ভাই।
ঠিক বলেছ,তার আর বলা হয়ে উঠেনি। সেই দেখাই ছিল শেষ দেখা। তার আর খোঁজ আমি পাইনি।
কি বলছেন?
ঠিকই বলছি।
শুনেছিলাম ওর বান্ধবীর কাছ থেকে। সে ক্যানাডায় চলে গিয়েছিল বিয়ে করে। এই পর্যন্তই।
আজ অনেক অনেক বছর হয়ে গেলো। আমিও চলে এলাম এই দেশে। বেশ আছি।
গাড়ী এসে দাঁড়াল সাধনার বাসার সামনে। প্রতিমা কোন কোথা বলল না। কিছুক্ষণ নীস্তব্দ থাকার পর তৌফিকই বলল, আবার এসো তোমরা।
যাবে কি বন্ধুর বাসায়। সাধনা জিজ্ঞাসা করলো।
যাবো।
সাবধানে যেও। বেশি রাত করো না। আর বৃষ্টি তে ভিজো না।
তৌফিক চলে গেলো।
ওখানে দাড়িয়েই প্রতিমা জিজ্ঞাসা করল, তৌফিক ভাই এর কথা একবার ভাববি কি?
না, বন্ধুত্ব টা হারাতে চাই না।
থাঙ্কসগিভীং এসে গেলো। মাত্র কয়েটা দিন বাকি। এমনি এক সকালে ঘুম ভাঙ্গলও সাধনার ফোনের আওয়াজে।
কি ব্যাপার? এতো সকালে ঘুমটা ভাঙলে তো।
সকাল মানে, বাজে দশ টা। শোন, বুবু কল করেছিল মিনিশোটা থেকে। ওখানে থাঙ্কসগিভীং করতে। তোমাকেও যেতে হবে আমার সাথে।
একি অর্ডার না অনুরধ?
দুটোই। আগামী পরশু যাবো। সকালের ফ্লাইট।
অগত্যা তৌফিককে যেতে হোলও। পৌছাল থাঙ্কসগিভীং এর একদিন আগে।
রানু আপা, সাধনার বুবু, অনেক আয়োজন করেছে। জিজ্ঞাসা করতেই বললও, তা প্রায় তিরিশ জনের মতো গেস্ট আসবে।
তৌফিককে কিছু করতে হচ্ছেনা। বসে বসে দেখছে। মাঝে মাঝে এটা ওটা এগিয়ে দেয়।
সময় হয়েছে লোকজন আসার।
টুং করে বেলটা বেজে উঠল। প্রথম অতিথি।
তৌফিক বলল, আমি দেখছি, তোমরা এইদিক টা দেখো।
আবারও টুং করে বাজলো।
তৌফিক খুলে দিলো দরজা টা।
সামনে দাঁড়ান সাদা শাড়ী কালো পাড় পড়া এক ভদ্রমহিলা। শুধু দুই ভুরুর মাঝে কালো ফোঁটাটা নেই।
অবিশ্বাস দৃষ্টিতে দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল।