বস্তীরাম

                                                 

   বস্তীরাম, তোমার সাথে হয়ত আমার আর দেখা হবে না। তাই বলে তোমাকে আমি ভুলবো না, ভুলবো না তোমার হাসি টা। ভুলবো না সেই কথা গুলো,” চিন্তা মাত করো”।

চিন্তা আমি ,আমরা কেউ আর করিনি।

দিল্লীর এয়ার পোর্ট থেকে বের হয়ে দেখা হোলও সুনীলের সাথে। ওকে অনুসরণ করে আমরা এলাম বাহিরে। গাড়ী দাড়িয়ে আছে। নয় সিটারের গাড়ী। গাড়ী থেকে নেমে এলো ড্রাইভার।

সুনীল বলল, স্যার, এ হচ্ছে বস্তীরাম, ১৩ দিন সে আপনাদের সাথে থাকবে।

তাকালাম বস্তীরামের দিকে। লম্বা, পাঁচ ফিট সাত ইঞ্চি হবে। দোহারা গঠন। প্যান্ট সার্টের উপরে হাফ হাতা সোয়াটার পড়া। একটু ঝুকে সামনে দাড়িয়ে নমস্কার দিয়ে বলল,   চিন্তা মাত করো, যা যা দেখানো সব দেখিয়ে দেবো।

ইংরাজিতে সে অতটা পারদর্শী নয় , হিন্দিতে কথা বার্তা।

আমার হিন্দি আসে না, তবুও বুঝতে এবং বোঝাতে অসুবিধা হোলও না।

দা রয়েল প্লাজা হোটেলে। বস্তীরাম তার স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে আমাদের কে নামিয়ে দিয়ে বলল, স্যার কাল সকাল নয়টায় আসব।

বললাম, ঠিক আছে, আমরা সবাই নিচে এই লবিতে থাকব।

কাউন্টারে দাড়িয়ে রুমের ব্যাপারে কথা বার্তা বলছিলাম।

স্যার!

ঘাড় ফিরিয়ে দেখি বস্তীরাম।

কি ব্যাপার? কোন কথা আছে?

রাতে বের হলে এক সাথে বের হবেন।  নতুন জায়গা কিনা, তাই বলতে এলাম।

আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর কি যায় আসে আমাদের খারাপ কিছু হলে। অথচ কয়েক ঘণ্টার পরিচয়ে সে আমাদের কে বুঝিয়ে দিলো, এদেশে আমরা নতুন,  আমাদের ভালোমন্দ, সব কিছুর  দায়িত্ব তার।

সকাল ঠিক নয়টায় বস্তীরাম দাঁড়ান লবিতে।

স্যার, ঘুম হয়েছিল? নতুন জায়গা, তবে হোটেল টা নাম করা হোটেল।

ইউসুফ বলে উঠল, না না, কোন অসুবিধা হয়নি। itinerary অনুসারে—-

কথা শেষ করতে পারলো না ইউসুফ,

Itinerary আমার মুখস্থ। প্রথমে যাবো, বলে সে গড় গড় করে বলে গেলো কোথায় কোথায় যাবো আজ।

জামে মসজিদ দেখা শেষে, চাঁদনী চক। গাড়ী যাবে না। ছোট রাস্তা।  রিক্সা করে যেতে হবে। তিন টা রিক্সা ঠিক করে, বার বার রিক্সাওয়ালা দেরকে বলে দিল, বাবুদের যেন কোন অসুবিধা না হয়। আস্তে চালাবে। তিনটে রিক্সা পর পর থাকবে।

বস্তীরাম আস্তে আস্তে আমার মনের মাঝে জায়গা করে নিলো।

আজ আমি আমাদের ভ্রমণ কাহিনী লিখতে বসিনি। সেই লেখা শেষ হয়েছিল বেশকিছু দিন আগে।

বস্তীরাম আজ আমার লেখার নায়ক।

Jaisalmer এ শেষ রাত।

এখান থেকে আমরা চলে যাব মুম্বাইতে। বস্তীরাম ফিরে যাবে তার ঘরে। চারদিন তার ছুটি।

১৩ টা দিন সে আমাদের কে নিয়ে বেড়িয়েছে। নিয়ে গেছে সেই রেস্তোরায় যেখানে খেলে আমরা তৃপ্তির সাথে খেতে পারব।

পথে থামতে হয়েছে, বাথরুমে যেতে হবে। নিয়ে গেছে সেই খানে যেখানে নাক ছিটকে ফিরে আসবো না।

বলেছি, বস্তীরাম, চল একসাথে খেয়ে নেই।

বলেছে, অনেক ধন্যবাদ স্যার, নিয়ম নেই একসাথে খাওয়া।

সন্ধ্যা নেমে এসেছে Thar Desert এ। বস্তীরাম হেটে বেড়াচ্ছিল। আস্তে আস্তে আমি এগিয়ে গেলাম ওর কাছে। হয়তো সে ভেবেছিল আমার কোন কিছুর দরকার। তাড়াতাড়ি কাছে আসে বলল, কিছু লাগবে স্যার।

না, বস্তীরাম। চল। ওই চেয়ার টাতে বসি, তুমি তোমার গল্প বলবে। তোমার কথা, তোমার বিবির কথা, ছেলে মেয়ের কথা।

এসে বসলাম আমরা।

কি বলব স্যার, বাবা মার একমাত্র সন্তান আমি। বাবা কাজ করতো এক কারখানায়। মা সামলাতও ঘর। পড়াশুনায় যে আমি খুব একটা খারাপ ছিলাম তা না। কিন্তু পড়াশুনা আর শেষ করতে পাড়লাম না।

বাবা একদিন বাসায় এসে বলল, শরীরটা  ভালো লাগছে না। খুস খুস করে কাশতে লাগলো।

পরদিন অর্ধেক কাজ করে ফিরে এলো। কাশি টা বাড়তে থাকলো।

বাথরুমে যেয়ে ডাক দিলো মা কে। মেঝে তে তাজা রক্ত।

যত টুকু আমাদের চেষ্টা করার করেছিলাম। কিন্তু না, পাড়লাম না বাবা কে ধরে রাখতে। সে চলে গেলো।

আমার বয়স তখন ষোল।

লেখা পড়ায় স্থগিত দিয়ে চাকরি নিলাম বাসের কন্ডাক্টার হিসাবে। সংসার চালাতে হবে।

মালিক টা খুবই ভালছিল। আস্তে আস্তে সে আমাকে গাড়ী চালানো শিখিয়ে ছিল। মঝে মাঝে আমি চালাতাম সে পাশে বসে থাকত। ড্রাইভিং লাইসেন্স ও একদিন পেয়ে গেলাম।

তারপর?

একদিন মা বলল, বস্তী এবার একটা বিয়ে কর। অনেক বছর তো হয়ে গেল তোর বাবা চলে গেছে। বাসাতে আমি একলা থাকি। কখন কি হয়। বৌ টা দেখে যাই।

তাহলে মার কথা শুনেছিলে।

হাঁ স্যার। আপনাকে দেখাই বৌ এর ছবি টা।

এই বলে পকেট থেকে ছবি টা বের করে দেখালও।

কবে কার ছবি এটা?

এই তো মাস দুই এক আগে তোলা।

বাহ, খুব সুন্দর দেখতে।

হাঁ স্যার বয়স হয়েছে, তবে বোঝা যায় না।

তাই তো মনে হচ্ছে, তোমার বয়স কত?

চল্লিশ পেড়লো। ও আমার থেকে তিন বছরের ছোট।

তুমি তো আমার ছেলের বয়সী।

হাঁ, স্যার, আপনারা সবাই আমার বাবা মার মত। পনের বছর কাজ করছি এই কোম্পানিতে। আপনাদের মত এমন গ্রুপ আর পাইনি। তাই হাটতে হাটতে ভাবছিলাম, আরও কিছুদিন যদি আপনারা থাকতেন। এই কথা বলে মাথাটা বা পাশে ঘুরিয়ে চোখ টা মুছে নিলো।

এবার তোমার কথা বল।

দুই ছেলে মেয়ে। মেয়েটা পড়াশোনায় ভাল। ডাক্তারি পড়বে ভাবছে। ছেলে টার পড়াশোনায় মন নেই। আমি থাকি বাহিরে বাহিরে। ওর মা দেখাশোনা করে। ওর দাদি চলে গেছে আজ দুই বছর হোলও। কোলে পিঠে করে সেই বড় করে দিয়ে গিয়েছিল এই দুটো কে। ওরা ছিল দাদির ন্যাওটা।

ভালই হয়েছিল স্যার। দাদির কাছে ঘুরঘুর করাতে আমার বৌ টা একটু বিশ্রাম নিতে পারতো।

মনে হোলও আগ্রাতে দেখেছি প্রেমের স্মৃতি সৌধ। আর বস্তীরামের প্রেম মনকে দোলা দেয়। বৌ টা একটু বিশ্রাম নিতে পারবে এটাই তার কাছে বড়। এইতো প্রেম।

চারিদিকে অন্ধকার। আকাশে তারার ঝিলিমিলি।

বস্তীরাম তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। হয়তো ভাবছে দুরে ফেলে আসা বৌ, ছেলেমেয়ের কথা। আর কিছুদিন পরে দেখা হবে। তাও মাত্র কয়েক দিনের জন্য।

এখান থেকে কি দিল্লী ফিরে যাবে বস্তীরাম?

না, স্যার, বাড়ী আমার দিল্লী আর জয়পুরের মাঝে। তাও অনেক ঘণ্টার পথ। কাল আপনাদের কাছে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়ব। মাঝ পথে এক রাত থেকে যেতে হবে। বৌ বলেছে, একটানে না যেতে। বিশ্রাম নিয়ে আসতে। পথে যদি কিছু হয় সেই ভয় তার।

ঠিকই বলেছে তোমার বৌ, বস্তীরাম। তা বৌ এর জন্য কিছু নিয়ে যাচ্ছ কি?

হাঁ স্যার। যখন আপনারা শাড়ী কিনছিলেন, তখন ওখান থেকে কম দামে একটা শাড়ী নিয়েছি, স্যার। ওকে বলিনি, সারপ্রাইজ দেবো।

হাঁহ হাঁহ করে হেসে উঠলাম আমি, চমৎকার বস্তীরাম, এই না বলে প্রেম।

আমিতো বাহিরে বাহিরে থাকি, সব কাজ তো তাকেই করতে হয়। এই ছোট্ট একটু উপহার দিলে ওর মনটা যদি ভরে উঠে তাহলেই আমি খুশি।

আমি বস্তীরামের মুখের দিকে চেয়ে ভাবছিলাম, ভালবাসতে, ভালবাসা প্রকাশ করতে অনেক টাকার প্রয়োজন পড়েনা, শুধু চাই মন।  

অনেক তো ঘুরলে আমাদের সাথে বস্তীরাম এরপর কোনদিকে যাবে? রাজস্থানে তো প্রচণ্ড গরম পড়বে।

সিমলার দিকে স্যার।

উঠে দাঁড়ালাম আমি, বললাম, কাল হয়তো শেষ দেখা।

গলার স্বর কান্নায় ভাঙ্গা, বলল, ও কথা বলবেন না,স্যার। আপনি, আপনারা আমার মা বাবার মত। ওরা চলে গেছে, আপনাদের কে তো আমি পেয়েছি। শেষ দেখা, এ কথা বলবেন না স্যার, এ কথা বলবেন না।  

আবার দেখা হবে। আমি পথ চেয়ে থাকবো।

Continue Reading