এসো, আবার মিলিত হই- ৩

(আগের পর্বেঃ 

Operating room.

চারিদিকে তাকাল শেখর।

পাশের দেওয়ালে বিরাট সাদা পর্দার উপরে ওর MRI এর ছবি। যেখানে সার্জেন কাঁটা ছেড়া করবে।

ডাক্তার ম্যেনডেলবাম কে কোথাও দেখল না শেখর।

একটা নার্স এগিয়ে এলো শেখরের কাছে, জিজ্ঞাসা করল নাম, জন্ম তারিখ। কেমন ফিল করছে। আরও সব কথা, যার কোন মানে নেই। শেখর কথা বলতে চাইছে, কিন্তু কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে।

তারপর।

তারপর, শেখর আর কিছু জানে না। )

      চোখ মেলে চাইল শেখর। মনে করতে চাইল কতক্ষন সে ঘুমিয়ে ছিল।

সেই নার্সটা। কি যেন বলছিল।

তারপর সব হারিয়ে গেল। কোথায় সে এখন? চারিদিক পর্দা দিয়ে ঘেরা। স্যালাইনের ব্যাগ টা এখনো ঝুলছে।

-How do you feel?

পাশ ফিরে তাকালও শেখর।  

-আমি কামিনী । আবারও জিজ্ঞাসা করল, How do you feel?

-ভালোই মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে। কতক্ষণ আমি এইখানে? শেখর জানতে চাইল।

-প্রায় ঘণ্টা খানেক। আর একটু পরে তোমাকে নিয়ে যাবো তোমার প্রথম জায়গাতে। কিছু খাবে? অনেকক্ষণ তো না খেয়ে আছো।

শেখর কি যেন বলতে চাইল, না বলে সে কামিনীর চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে রইল, কার চোখের সাথে যেন মিল আছে। মনে করতে চাইল শেখর। ওর কণ্ঠস্বরে কেমন যেন এক মাদকতা।   

-হ্যালো? কি দেখছ?

– খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে।

-তাই? হয়ত বা। একি কন্টীনেন্টের ? তাই না? এখন বলও, কি খাবে? এগ স্যান্ডউইচ?

-মন্দ না। কফি হবে কি? শেখর জানতে চাইল।

কামিনী উঠে গেল।

শেখর উঠে বসতে চাইল। মাথা টা ঘুরে গেলো।

কামিনী এলো কফি আর স্যান্ডউইচ নিয়ে।

-ওঠো।

-উঠতে চেয়ে ছিলাম, মাথা ঘুরে গেলো।

-Are you out of your mind? Never do it. পড়ে গেলে সব শেষ। কফি আর স্যান্ডউইচ টা রাখতে রাখতে বলল কামিনী।

-I know, লজ্জিত স্বরে বললও শেখর।

কামিনীর হাত ধরে উঠে বসল শেখর। বিছানা টাকে সোজা করে পিছনে বালিশ দিয়ে দিলো কামিনী।

-Make sure don’t try to do any advanturous thing. I will be right back.বলে হাসতে হাসতে বেড়িয়ে গেলো কামিনী।

স্যান্ডউইচ টা শেষ করে কফিতে চুমুক দিলো শেখর। নাহ, চিনির পরিমাণ টা একটু কম।

ঠোঁট পোড়ান গরম কফি খেয়ে অভ্যাস শেখরের। সে রকম নয়। তবুও এই মুহূর্তে ওটাই অমৃত মনে হোলও।

চলো, কামিনী নিয়ে এলো শেখর কে সেই cubicle রুমে। প্রথম দেখা নার্স. অপেক্ষা করছিল শেখরের জন্য।

এবার ফিরে যাবে বাসাতে।

 শেখর, ফোন টা দেখল। কোন কল আছে কি না।

কল করলো তনুজাকে।

-হাফ এন আওয়ার লাগবে।বলল তনুজা।

-ঠিক আছে।

চারিদিকে তাকালও শেখর। আস্তে আস্তে নেমে এলো বেড থেকে। নার্সের হাত ধরে হাঁটল কিছুক্ষণ। মাথাটা টলকায় কিনা দেখতে চাইলো নার্স।

হাটতে অসুবিধা হচ্ছে না এই মুহূর্তে। তবে এনেসথেসিয়ার action আস্তে আস্তে চলে গেলে ব্যথা ফিরে আসবে. বলেছে ডাক্তার।

নেই সেই মরন কামড়ানো ব্যথা টা।  

তনুজার কল এলো।

হুইল চেয়ারে বসিয়ে শেখর কে বাহিরে নিয়ে এলো নার্সটা।  

গাড়ীতে উঠতে অসুবিধা হলনা।

-কেমন ফিল করছ বাবা। জিজ্ঞাসা করল তনুজা।

-আগের থেকে তো ভালো। বলে ফোন টার দিকে তাকাল শেখর।

ফেভারেটের তালিকা থেকে নামটা বেছে নিলো।

কল করতেই, 

-কোথায় তুমি? অপারেশন হয়ে গিয়েছে? ওপাশ থেকে উৎকণ্ঠা স্বরে জিজ্ঞাসা করল।

-গাড়ীতে, বাসার দিকে যাচ্ছি। বলে পাশ ফিরে জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকাল, মাজায় একটু ব্যথা অনুভব করলো শেখর।

-মেজর সার্জারি, সাবধানে থাকবে। তুমি তো আবার—-, শোন, একেবারে রেস্টে থাকবে। কেমন আছো টেস্ট করে জানিও। বেশি কথা বলা উচিৎ হবে না। উপদেশ দিলো ফোনের অপর প্রান্ত থেকে।

-নেও ঠেলা, এক ডাক্তার ছেড়ে আরেক ডাক্তারের পাল্লায় পড়লাম। হাসতে হাসতে বলল শেখর। হাসতে গেলে একটু ব্যথা লাগছে মনে হোল। সেটা আর শেখর প্রকাশ করলনা।

-এখন রাখি।

-আচ্ছা বলে শেখর ফোনটা রেখে দিলো।

একটার পর একটা টেক্সট আসছে। বন্ধু বান্ধবের অভাব নেই শেখরের। সবাই শুভকামনা করেছিল আসার আগে। বলেছিল, অপারেশন সাকসেসফুল হোক এই কামনা করি। দুই একটার উত্তর দিতে যেয়ে চোখ টা জড়িয়ে এলো।

না, এখন আর নয়, ফোন টা বন্ধ করে দিল শেখর।

বাসায় এসে টিভি টা খুলে বসল, চারিদিকে মিছিল, George Floyd এর মৃত্যু কে কেন্দ্র করে।

Minneapolis পুলিশের হাতে George Floyd এর মৃত্যু।

George Floyd কৃষ্ণাঙ্গ।  

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে বর্ণ বৈষম্য এবং সহিংসতার ইতিহাস বেশ পুরানো।

বড় বড় সিটি গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। শেখর বসে বসে সেই খবর দেখছিল। ভাবছিল, গায়ের রং নিয়ে মানুষের মনে এতো বিদ্বেষ কেন?

স্রষ্টা তো এক জন। বৈষম্য নীতি তো সেখানে নেই। সাদা বলে অগ্রাধিকার পাবেনা।

করোনাভাইরাস, কারফেউ, লুটপাট, বন্দুকের গুলি, টিয়ার গ্যাস। পৃথিবী যেন ধ্বংসের পথে।

অনেক কিছুই মাথার মধ্যে এলো, গেলো শেখরের।

এনেসথেসিয়ার action আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে। কাজেই মনোযোগ দিয়ে সংবাদ গুলো শুনতে, দেখতে চাইলেও মনটা চাইছে না। মেরুদণ্ডের শেষ প্রান্ত থেকে এঁকে বেকে ব্যথা টা নিজের খুশিমত বেয়ে চলেছে পায়ের শেষ প্রান্তে। মাঝে মাঝে কামড় দিয়ে যাচ্ছে মাংসপেশীতে।

Spine এর শেষ প্রান্তে দুই ইঞ্চি কেটে ভিতরের নার্ভের জায়গাটাকে পরিষ্কার করে দিয়েছে, যাতে নার্ভের উপর আর চাপ না পড়ে। অপারেশনের পড়ে কিছুদিন ব্যথা থাকবে বলেছিল নিওরও সার্জেন।

সেই কিছুদিন কতদিন?

শেখরের আর কিছুই ভালো লাগছে না।

 অনেকদিন হোলও বন্ধুদের সাথে দেখা নেই। ফোনেই শুধু কুশল সংবাদ দেওয়া নেওয়া চলছে।

এখনকার অবস্থা ভালো থাকলে এই সময়ে তার থাকার কথা মায়ামিতে। এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। সবাই মিলে হৈ হৈ করে যাওয়ার কথা ছিল। বারো, তেরো জন থাকবে এক জায়গায়। কতই না মজা হবে। সানফ্রানসিসকোর থেকে সিলভার আসার কথা। বছর দেড়েক হয়ে গেলো ওর সাথে দেখা হয়েছিল। অনেক আনন্দ করেছিল শেখর সেইখানে।

সব গেলো বেহেশতে।

কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল শেখরের মনে নেই। তনুজার ডাকে উঠল।

সন্ধ্যা  হয়ে এসেছে।

-এই নাও তোমার কফি, খেলে ভালো লাগবে। আর তোমার ফোন তো বেজে চলেছে।

বাংলায় নাম লেখা। বলে কাপটা এগিয়ে দিলো।

শেখর দেখল নামটা।

দেখা হয়েছিল হাই স্পীড ট্রেনে। মস্কো থেকেসেন্ট পিটার্সবার্গ যাওয়ার পথে। কফির পিপাসা পেয়েছিল শেখরের অনেকক্ষণ। উঠে একজন কে জিজ্ঞাসা করতেই বলল, চার, পাঁচ টা রুমের পরেই কফির ব্যবস্থা আছে।

ধন্যবাদ বলে, এগিয়ে গেলো শেখর।

সব কটা টেবিলেই লোক, শুধু একটা টেবিলে একটা চেয়ার খালি, এক ভদ্রমহিলা বসে আছে। কাজই কফি আর একটা স্যান্ডউইচ নিয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে খাওয়ার চেষ্টা করছিল।

-কিছু যদি মনে না করেন এই চেয়ার টায় বসতে পারেন। ভদ্রমহিলা শেখরের দিকে তাকিয়ে বলল কথাটা।

স্যান্ডউইচ আর কফি টা নিয়ে ধন্যবাদ বলে চেয়ার টা টেনে বসলো।

-আমি শেখর বলে হাত টা বাড়িয়ে দিলো।

কোন রকম দ্বিধা না করে ভদ্রমহিলা হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমার নাম—-

চোখে চোখ রেখে, কফি তে চুমুক দিতে দিতে অনেক কথা হোলও। ভদ্রমহিলা একাই এসেছে, সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে যাবে মস্কো তে, সেখান থেকে ফিরে যাবে নিউইয়র্কে।

 -বাহ, আমারও ডেসটিনেশন নিউইয়র্কে। তবে আমি ফিরে যাবো এখান থেকে। সময় টা ভালোই কেটে গেলো, কি বলেন?

– অবশ্যই।

– নিউইয়র্কে কি দেখা হওয়ার সম্ভবনা আছে? প্রশ্ন টা করেছিল শেখর।

-কেন হবে না? বলে ফোন নাম্বার টা একটা ন্যাপকিনের উপর লিখে শেখরের হাতে দিলো।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে ট্রেন সেন্ট পিটার্সবার্গ ষ্টেশনে পৌছাবে।

উঠে দাঁড়াল দুজনে।

ভদ্রমহিলা তার ব্যাগ টা কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো।

আবারও হাতে হাত মিলালো দুজনে।

দেখা হবে নিউইয়র্কে,বলে ভদ্রমহিলা এগিয়ে গেলো।  

সেই পুরানো ঘটনা টা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।

মনে মনে হেসে ডায়েল করলো শেখর।

[চলবে]

Continue Reading

এসো, আবার মিলিত হই- ২

       বৃষ্টি আস্তে আস্তে থেমে এলো। শেখর তখনো দাড়িয়ে জানালার পাশে।

-আব্বু কফি বানিয়েছি, খাবে এসো। বলে ডাক দিলো তনুজা।

শরীর টাকে বাকিয়ে ফিরতে যেয়ে ব্যাথায় টনটনিয়ে উঠল পা টা। পড়ে যেতে যেয়ে পাশের সোফাটা আঁকড়িয়ে ধরল। সোজা হয়ে দাঁড়াল শেখর। সে জানে একবার যদি পড়ে যায় তাহলেই শেষ। বয়স কালের এই দোষ। মাজার হাড় আস্তে আস্তে খয়ে গেছে। যতই ক্যালসিয়াম আর হাড়ের ডেনসিটি বাড়ানোর ঔষধ খাওনা কেনও যা চলে গেছে তা আর ফিরে আসবেনা। কাজেই ওসবের ধাঁর ধারে না সে।

-আসছি মা, বলে  পা টা টেনে টেনে এসে টেবিলে বসলো।

অনেক কিছু বানিয়েছে তনুজা। পিঁয়াজু, পাকোড়া, ছোলা ভাজী,বেগুনী, আর সাথে মুড়ি তো আছেই।

 রোজা চলছে।

রেজোয়ান প্রতিটি রোজাই রাখছে।  

শেখর রেখেছিল তিনটা, প্রতি বছরই সে সব কটা রাখে, এবার পাড়লও না।

দুই মিনিট এখনও বাকি সন্ধ্যা হতে।

কফিটা ঢালতে ঢালতে তনুজা বলল, আর একটা সপ্তাহ তারপরেই তো  তোমার সার্জারি। ডাক্তার তো বলেছে তুমি আবার আগের মতো হাটতে পারবে। সব ব্যাথা চলে যাবে।

-সেই আশাতেই তো আছি। কফিতে দুধটা ঢালতে ঢালতে বলল শেখর। সময় হয়েছে কি রোজা ভাঙ্গার। রেজোয়ানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল।

যদিও সে রোজা রাখেনি তবুও নিয়ম কিছুটা মানতে হয়।

-হাঁ বাবা।

পিঁয়াজুতে কামড় দিয়ে, কফির কাপ টা মুখের কাছে উঠিয়ে আনল শেখর।

ফোনটা বেজে উঠল। শেখর এক নজর দেখে উঠিয়ে নিলো ফোন টা।

নামের তালিকাতে বাংলায় লেখা নাম।

-কফি নিয়ে বসেছ? ওপাড়ের কণ্ঠস্বর শেখরের চেনা। 

-শুধু কফি নয়, সাথে অনন্যাও অনেক মুখরচক খাবার। তনুজা বানিয়েছে, বলে তাকাল শেখর।

-তনুজার গুনের অন্ত নেই। ব্যথাটা কেমন? ওপাশ থেকে জিজ্ঞাসা করল।

শেখর হেড ফোন টা কানে লাগিয়ে বলল, গতকাল যা শুনেছিলে তার চেয়ে বেড়েছে।

-ধৈর্য ধর, সব ঠিক হয়ে যাবে। আর তো কটা দিন। এখন ওদের সাথে সময় দাও, আমি এখন রাখি, নামাজ পড়তে হবে। পরে কথা হবে।  

 শেখর কান থেকে হেড ফোন টা খুলে টেবিলে রেখে দিয়ে একটা বেগুনী উঠিয়ে নিলো।

তনুজা কি যেন বলতে যেয়ে থেমে গেলো।

এবারের ঈদের নাম দিয়েছে করোনাভাইরাস ঈদ। ঈদের নামাজ হবে যার যার ঘরে। কোলাকুলি নেই, নেই হাত মিলানো। ওটাই তো ছিল ঈদের আনন্দ। যাওয়া হবে না কারো ঘরে, আসবে না কেউ।

 চেয়ারে বসে ঈদের নামাজ শেষে, তাকিয়ে ছিল জয়পুর থেকে আনা

লক্ষ্ণৌ স্টীচের কাজ করা পাঞ্জাবী তার দিকে।

  এইতো কিছুদিন আগেই না ওরা গিয়েছিল ইন্ডিয়াতে। সতেরো দিন ঘুরে বেড়িয়েছিল রাজস্থানের বিভিন্ন শহরে। জয়পুর, উদয়পুর, আরও কত শহর।

 তখন কি ভেবেছিল যে পা দুটো দিয়ে সে উঠেছে পাহাড়ে, হেঁটেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই পা দুটো আর পারবেনা এই ভর সইতে।  

-বাবা কবরস্থানে যেতে হবে, তৈরী হয়ে নাও, তনুজার ডাক শুনে উঠিয়ে নিলো পাঞ্জাবিটা।

দাড়িয়ে উঠে পড়তে যেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কষ্ট টা কিছুটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করলো শেখর।

ফোন টা কাঁপছে। শেখর তাকালও ফোনটার দিকে।

হ্যালো!

-কাপড় পড়তে নিশ্চয় অসুবিধা হয়েছে?

-বুঝলে কি ভাবে?

-এইটুকু বুঝতে পারার মত বয়স আমার অনেক আগেই হয়েছে।  বলে হাসল ফোনের ওপর পারের সেই জন। ও, বলতেই তোঁ ভুলে গেছি, ঈদ মোবারক।
– ঈদ মোবারক। শেখর এই ব্যাথার মাঝেও যেন একটু শান্তি খুজে পেলো।

-আজকের প্রোগ্রাম কি তোমার? 

– কবরস্থানে যাবো, সেখান থেকে যেতে হবে তনুজার শ্বশুর বাড়ি। বলেছে, সোশ্যাল ডিসটেনস রেখে বসবো সবাই।  শেখরের কথা শেষ হতে না হতে তনুজা আবার ডাক দিল।

– তোমার মেয়ে ডাকছে । পরে কথা হবে, বলে ফোনটা রেখে দিল ওপর পারের সেই জন।

রৌদে ঝলমল দুপুর। সবাই এসেছে তাদের আপনজনের কবর যিয়ারত করতে।

শেখর তাকাল চারিদিকে। উচু ঢিপের সংখ্যা অনেক। করোনাভাইরাসের প্রতিফলন কিনা কে জানে। জানাশোনা অনেকেই চলে গেছে ওপারে।

তাকাল মাটির দিকে, যেখানে শুয়ে আছে তার আপনজন।

আঙ্কেল?

ডাক শুনে তাকাল পাশে। সাজীদ দাড়িয়ে কিছু দূরে ।ওর তার দেড় মাসের বাচ্চা টা শুয়ে আছে কিছু দূরে।

-ঈদ মোবারক। আঙ্কেল।  

-ঈদ মোবারক।

এসেছে কিরণ,জসীম, অরুন, রতন, সেন্টু। শেখর চেনে এদের কে। পরিচয় হয়েছিল অনেক আগে। এক সময় দহরম মহরম ছিল, আজ তা ভাটার টানে।  এখন আর দেখা সাক্ষাৎ হয় না বললেই চলে। 

-কেমন আছেন? রতন জিজ্ঞাসা করল।

হাটতে হাটতে উত্তর দেওয়ার আগেই আবারও জিজ্ঞাসা করল রতন, ও ভাবে পা টেনে হাঁটছেন কেন?

শেখরের এই মুহূর্তে এর বিশ্লেষণ করার মানসিকতা নেই, ঈদের আনন্দ টাকে মাটি করতে চায়না। বলল,

-না ভালোই আছি। বলে অনেক কষ্টে গাড়ীতে উঠে পড়লো।

-বাবা, তোমার কি বেশি কষ্ট হচ্ছে? উৎকণ্ঠা ভরা কণ্ঠ তনুজার।

-না, মা, এইটুকু তো হবেই।  

তনুজা যদি তাকাত  শেখরের মুখের দিকে, দেখতে পেতো, শেখরের মুখের পেশী গুলো যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আছে, দেখতে পেতো কপালে ঘাম, আর শুনতে পেতো  দ্রুত নিশ্বাসের শব্দ। সেই শব্দ মিলিয়ে গেলো খোলা জানালা দিয়ে বাহিরের বাতাসের মাঝে।

বাহিরে বসার আয়োজন করেছে সানু ভাই আর নিশাত ভাবী।

অন্যবার এই দিনে ওদের বাসায় তিল ধরনের জায়গা থাক তো না। আসতো নিশাত ভাবীর সব ভাই, আসতো সানু ভাইয়ের বন্ধুরা। আজ শুধু শেখররা তিনজন।

কি কি রান্না করেছ ভাবী? শেখর প্রশ্ন করেই তুলে নিলো একটা জিলাপি। ওটা শেখরের খুব প্রিয়।

বেশি কিছু করিনি? কেউ তো এবার আসবে না। তুমি আগেই জিলাপি খাচ্ছও কেনও? বলে একটা কৃত্রিম ধমক দিলো ভাবী।

অনেক কিছু করেছে ভাবী। শেখর শুধু খাসীর বিরিয়ানি নিয়ে একটু দুরে যেয়ে বসল।

-তোমার অপারেশন যেন কবে? প্রশ্ন করে সানু ভাই এসে বসল দুরত্ত রেখে।

– আগামী সপ্তাহে মনে হয়। আশা করি এই nightmare থেকে মুক্তি পাবো। বিরিয়ানি টা চাবাতে চাবাতে বলল শেখর।

-ইনশাল্লাহ!  

বাসায় যখন ফিরে এলো তখন শেখরের সারা শরীর ব্যথায় ভেঙ্গে পড়ছে। দুটো ব্যথার ঔষধ মুখে পুড়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো।

এক একটা দিন যেন এক একটা মাস মনে হোলও শেখরের কাছে।

শুধু অপেক্ষা।

কবে স্টেফিনি,ডাক্তার ম্যেনডেলবামের সেক্রেটারি, কল করে বলবে তোমার সার্জারির দিন অমুক তারিখে।

সেইদিন টার অপেক্ষায় শেখর।

ক্রীং ক্রীং করে ফোনটা বেজে উঠল। মাহতাবের ফোন।

হ্যালো!

-খবর শুনেছিস? মাহতাব জিজ্ঞাসা করল শেখরকে।

-কি খবর?

– এনাম ভাই মারা গেছে। আর খোকা ভাই ICU তে। অবস্থা ভালো না শুনেছি। মাহতাবের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো শেখর।

দুজনেই শেখরের খুব প্রিয়জন ছিল । এদেশে একই সময়ে এসেছিল ওরা।

একই  ডিপার্টমেন্টে পড়াশুনা করেছে দেশে। এনাম ভাই দুই বছরের আর খোকা ভাই এক বছরের বড় শেখর থেকে।

বয়সের সাথে সাথে বড় ছোট কোন ভেদাভেদ থাকে না। হয়ে যায় বন্ধুর মতো।  

ঠিক এই রকমই হয়েছিল ওরা শেখরের সাথে।

এনাম ভাই চলে গিয়েছিল হিস্টনে। চোখের আড়াল তো মনের আড়াল। হোলও তাই। আস্তে আস্তে যোগাযোগ কমে এলো।

অনেক দিন এনাম ভাইএর খবর শেখর আর পায়নি।

আজ হঠাৎ করে এই খবর নিয়ে এলো মাহতাব।

অফুরন্ত আনন্দের দিন গুলো যেন অনেক দুরে চলে গেছে,  ফুরিয়ে আসছে জীবন, কেন এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলো সময়। ভাবতে অবাক লাগছে শেখরের কাছে।

মনে পড়ল কবি তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় এর সেই উক্তি,

“এই খেদ মোর মনে
ভালবেসে মিটল না আশ- কুলাল না এ জীবনে।
হায়, জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে?”

আসলেই, এঁকে এঁকে অনেকই তো চলে গেলো। চলে গেছে শেখরের—–,

-বাবা, তোমার চোখে জল কেনও? তনুজা যে কখন ঘরে এসেছে জানতে পারেনি শেখর।

মাহতাবের দেওয়া খবর, নিজের শারীরিক অসুস্থতা, এইসব মিলে মনটা একটু অশ্রু ভরাক্রান্ত হয়েছিল হয়ত।

-আজ আর রাতে খাবো না মা, বলে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল শেখর।

ফোন টা উঠিয়ে ডায়েল করল। বাজতে থাকল ফোন টা। ভয়েসমেল। বন্ধ করে দিল ফোনটা। পাশে রাখা মিশেল ওবামার, Becoming বই টা উঠিয়ে নিলো।

পাতা উলটানোর আগেই ফোনটা বেজে উঠল।

-ভাইএর বাসায়। হৈ, চৈ এর জন্য শুনতে পাইনি। কোথায় কোথায় গেলে? সেই কণ্ঠ।

-শুধু এক বাড়ীতে।

-ব্যথাটা নিশ্চয় বেড়েছে, অনেকক্ষণ গাড়ীতে বসে ছিলে তারজন্য ? প্রশ্ন করলো সে।

-সেই জন্যই তো চলে এলাম।

-তাহলে এখন বিশ্রাম নাও, দেখো কাল সার্জেনের ওখান থেকে কোন খবর আসে কি না।

 শেখর ফোন টা রেখে দিয়ে বই টা উঠিয়ে নিলো হাতে।

অবশেষে স্টেফিনির কল এলো সকাল সাড়ে নয়টায়।

বলল, আগামী পরশু সার্জারি। তবে তার আগে  আগামীকাল Covid-19 এর টেস্ট করতে হবে। যদি নেগেটিভ আসে তবেই সার্জারি হবে, নচেৎ নয়।

যাক শেখরের দুশ্চিন্তা কেটে গেলো। টেস্ট নেগেটিভ।

ভোর ছয়টায় যেতে হবে।

-সার্জারির শেষে সময় করে জানিও। কলের অপেক্ষায় থাকব। বলে ছিল ভোর পাঁচটায়। সেই কণ্ঠ।

-আচ্ছা, বলে শেখর ফোনটা রেখে দিয়েছিল।

পর্দা দিয়ে ঢাকা  Cubicle emergency room.

হাসি দিয়ে বয়স্ক নার্সটা এসে শেখরের বা হাতে একটা পোর্ট তৈরী করলো স্যালাইন দেওয়ার জন্য। ছয় টা washing cloth দেখিয়ে বলল,

-এই পাঁচটা cloth দিয়ে শরীরের সামনে টা মুছে ফেলো, পিছন টা আমি মুছে দেবো, বলে সুন্দর একটা হাসি দিয়ে পর্দা টা টেনে দিলো। 

সব শেষে ওদের দেওয়া গাউন টা পরে শুয়ে রইল শেখর।  

কেটে গেলো কিছু সময়।

“ Mr, Sekhor, now we are taking you to Operating room.” সুন্দরী এক নার্স এসে বলল শেখর কে।

Operating room শব্দটার মাঝে যেন একটা ভয়ার্ত কিছু আছে মনে হয়।

শেখর চোখ বুজে সবার মুখ গুলো মনে করার চেষ্টা করল।

সে ফিরবে তো?

আবার দেখতে পারবে কি ওই মুখ গুলো।

Operating room.

চারিদিকে তাকাল শেখর।

পাশের দেওয়ালে বিরাট সাদা পর্দার উপরে ওর MRI এর ছবি। যেখানে সার্জেন কাঁটা ছেড়া করবে।

ডাক্তার ম্যেনডেলবাম কে কোথাও দেখল না শেখর।

একটা নার্স এগিয়ে এলো শেখরের কাছে, জিজ্ঞাসা করল নাম, জন্ম তারিখ। কেমন ফিল করছে। আরও সব কথা, যার কোন মানে নেই। শেখর কথা বলতে চাইছে, কিন্তু কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে।

তারপর।

তারপর, শেখর আর কিছু জানে না।  

(চলবে)

Continue Reading