(আগের পর্বেঃ
Operating room.
চারিদিকে তাকাল শেখর।
পাশের দেওয়ালে বিরাট সাদা পর্দার উপরে ওর MRI এর ছবি। যেখানে সার্জেন কাঁটা ছেড়া করবে।
ডাক্তার ম্যেনডেলবাম কে কোথাও দেখল না শেখর।
একটা নার্স এগিয়ে এলো শেখরের কাছে, জিজ্ঞাসা করল নাম, জন্ম তারিখ। কেমন ফিল করছে। আরও সব কথা, যার কোন মানে নেই। শেখর কথা বলতে চাইছে, কিন্তু কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
তারপর।
তারপর, শেখর আর কিছু জানে না। )
চোখ মেলে চাইল শেখর। মনে করতে চাইল কতক্ষন সে ঘুমিয়ে ছিল।
সেই নার্সটা। কি যেন বলছিল।
তারপর সব হারিয়ে গেল। কোথায় সে এখন? চারিদিক পর্দা দিয়ে ঘেরা। স্যালাইনের ব্যাগ টা এখনো ঝুলছে।
-How do you feel?
পাশ ফিরে তাকালও শেখর।
-আমি কামিনী । আবারও জিজ্ঞাসা করল, How do you feel?
-ভালোই মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে। কতক্ষণ আমি এইখানে? শেখর জানতে চাইল।
-প্রায় ঘণ্টা খানেক। আর একটু পরে তোমাকে নিয়ে যাবো তোমার প্রথম জায়গাতে। কিছু খাবে? অনেকক্ষণ তো না খেয়ে আছো।
শেখর কি যেন বলতে চাইল, না বলে সে কামিনীর চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে রইল, কার চোখের সাথে যেন মিল আছে। মনে করতে চাইল শেখর। ওর কণ্ঠস্বরে কেমন যেন এক মাদকতা।
-হ্যালো? কি দেখছ?
– খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
-তাই? হয়ত বা। একি কন্টীনেন্টের ? তাই না? এখন বলও, কি খাবে? এগ স্যান্ডউইচ?
-মন্দ না। কফি হবে কি? শেখর জানতে চাইল।
কামিনী উঠে গেল।
শেখর উঠে বসতে চাইল। মাথা টা ঘুরে গেলো।
কামিনী এলো কফি আর স্যান্ডউইচ নিয়ে।
-ওঠো।
-উঠতে চেয়ে ছিলাম, মাথা ঘুরে গেলো।
-Are you out of your mind? Never do it. পড়ে গেলে সব শেষ। কফি আর স্যান্ডউইচ টা রাখতে রাখতে বলল কামিনী।
-I know, লজ্জিত স্বরে বললও শেখর।
কামিনীর হাত ধরে উঠে বসল শেখর। বিছানা টাকে সোজা করে পিছনে বালিশ দিয়ে দিলো কামিনী।
-Make sure don’t try to do any advanturous thing. I will be right back.বলে হাসতে হাসতে বেড়িয়ে গেলো কামিনী।
স্যান্ডউইচ টা শেষ করে কফিতে চুমুক দিলো শেখর। নাহ, চিনির পরিমাণ টা একটু কম।
ঠোঁট পোড়ান গরম কফি খেয়ে অভ্যাস শেখরের। সে রকম নয়। তবুও এই মুহূর্তে ওটাই অমৃত মনে হোলও।
চলো, কামিনী নিয়ে এলো শেখর কে সেই cubicle রুমে। প্রথম দেখা নার্স. অপেক্ষা করছিল শেখরের জন্য।
এবার ফিরে যাবে বাসাতে।
শেখর, ফোন টা দেখল। কোন কল আছে কি না।
কল করলো তনুজাকে।
-হাফ এন আওয়ার লাগবে।বলল তনুজা।
-ঠিক আছে।
চারিদিকে তাকালও শেখর। আস্তে আস্তে নেমে এলো বেড থেকে। নার্সের হাত ধরে হাঁটল কিছুক্ষণ। মাথাটা টলকায় কিনা দেখতে চাইলো নার্স।
হাটতে অসুবিধা হচ্ছে না এই মুহূর্তে। তবে এনেসথেসিয়ার action আস্তে আস্তে চলে গেলে ব্যথা ফিরে আসবে. বলেছে ডাক্তার।
নেই সেই মরন কামড়ানো ব্যথা টা।
তনুজার কল এলো।
হুইল চেয়ারে বসিয়ে শেখর কে বাহিরে নিয়ে এলো নার্সটা।
গাড়ীতে উঠতে অসুবিধা হলনা।
-কেমন ফিল করছ বাবা। জিজ্ঞাসা করল তনুজা।
-আগের থেকে তো ভালো। বলে ফোন টার দিকে তাকাল শেখর।
ফেভারেটের তালিকা থেকে নামটা বেছে নিলো।
কল করতেই,
-কোথায় তুমি? অপারেশন হয়ে গিয়েছে? ওপাশ থেকে উৎকণ্ঠা স্বরে জিজ্ঞাসা করল।
-গাড়ীতে, বাসার দিকে যাচ্ছি। বলে পাশ ফিরে জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকাল, মাজায় একটু ব্যথা অনুভব করলো শেখর।
-মেজর সার্জারি, সাবধানে থাকবে। তুমি তো আবার—-, শোন, একেবারে রেস্টে থাকবে। কেমন আছো টেস্ট করে জানিও। বেশি কথা বলা উচিৎ হবে না। উপদেশ দিলো ফোনের অপর প্রান্ত থেকে।
-নেও ঠেলা, এক ডাক্তার ছেড়ে আরেক ডাক্তারের পাল্লায় পড়লাম। হাসতে হাসতে বলল শেখর। হাসতে গেলে একটু ব্যথা লাগছে মনে হোল। সেটা আর শেখর প্রকাশ করলনা।
-এখন রাখি।
-আচ্ছা বলে শেখর ফোনটা রেখে দিলো।
একটার পর একটা টেক্সট আসছে। বন্ধু বান্ধবের অভাব নেই শেখরের। সবাই শুভকামনা করেছিল আসার আগে। বলেছিল, অপারেশন সাকসেসফুল হোক এই কামনা করি। দুই একটার উত্তর দিতে যেয়ে চোখ টা জড়িয়ে এলো।
না, এখন আর নয়, ফোন টা বন্ধ করে দিল শেখর।
বাসায় এসে টিভি টা খুলে বসল, চারিদিকে মিছিল, George Floyd এর মৃত্যু কে কেন্দ্র করে।
Minneapolis পুলিশের হাতে George Floyd এর মৃত্যু।
George Floyd কৃষ্ণাঙ্গ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে বর্ণ বৈষম্য এবং সহিংসতার ইতিহাস বেশ পুরানো।
বড় বড় সিটি গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। শেখর বসে বসে সেই খবর দেখছিল। ভাবছিল, গায়ের রং নিয়ে মানুষের মনে এতো বিদ্বেষ কেন?
স্রষ্টা তো এক জন। বৈষম্য নীতি তো সেখানে নেই। সাদা বলে অগ্রাধিকার পাবেনা।
করোনাভাইরাস, কারফেউ, লুটপাট, বন্দুকের গুলি, টিয়ার গ্যাস। পৃথিবী যেন ধ্বংসের পথে।
অনেক কিছুই মাথার মধ্যে এলো, গেলো শেখরের।
এনেসথেসিয়ার action আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে। কাজেই মনোযোগ দিয়ে সংবাদ গুলো শুনতে, দেখতে চাইলেও মনটা চাইছে না। মেরুদণ্ডের শেষ প্রান্ত থেকে এঁকে বেকে ব্যথা টা নিজের খুশিমত বেয়ে চলেছে পায়ের শেষ প্রান্তে। মাঝে মাঝে কামড় দিয়ে যাচ্ছে মাংসপেশীতে।
Spine এর শেষ প্রান্তে দুই ইঞ্চি কেটে ভিতরের নার্ভের জায়গাটাকে পরিষ্কার করে দিয়েছে, যাতে নার্ভের উপর আর চাপ না পড়ে। অপারেশনের পড়ে কিছুদিন ব্যথা থাকবে বলেছিল নিওরও সার্জেন।
সেই কিছুদিন কতদিন?
শেখরের আর কিছুই ভালো লাগছে না।
অনেকদিন হোলও বন্ধুদের সাথে দেখা নেই। ফোনেই শুধু কুশল সংবাদ দেওয়া নেওয়া চলছে।
এখনকার অবস্থা ভালো থাকলে এই সময়ে তার থাকার কথা মায়ামিতে। এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। সবাই মিলে হৈ হৈ করে যাওয়ার কথা ছিল। বারো, তেরো জন থাকবে এক জায়গায়। কতই না মজা হবে। সানফ্রানসিসকোর থেকে সিলভার আসার কথা। বছর দেড়েক হয়ে গেলো ওর সাথে দেখা হয়েছিল। অনেক আনন্দ করেছিল শেখর সেইখানে।
সব গেলো বেহেশতে।
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল শেখরের মনে নেই। তনুজার ডাকে উঠল।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।
-এই নাও তোমার কফি, খেলে ভালো লাগবে। আর তোমার ফোন তো বেজে চলেছে।
বাংলায় নাম লেখা। বলে কাপটা এগিয়ে দিলো।
শেখর দেখল নামটা।
দেখা হয়েছিল হাই স্পীড ট্রেনে। মস্কো থেকেসেন্ট পিটার্সবার্গ যাওয়ার পথে। কফির পিপাসা পেয়েছিল শেখরের অনেকক্ষণ। উঠে একজন কে জিজ্ঞাসা করতেই বলল, চার, পাঁচ টা রুমের পরেই কফির ব্যবস্থা আছে।
ধন্যবাদ বলে, এগিয়ে গেলো শেখর।
সব কটা টেবিলেই লোক, শুধু একটা টেবিলে একটা চেয়ার খালি, এক ভদ্রমহিলা বসে আছে। কাজই কফি আর একটা স্যান্ডউইচ নিয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে খাওয়ার চেষ্টা করছিল।
-কিছু যদি মনে না করেন এই চেয়ার টায় বসতে পারেন। ভদ্রমহিলা শেখরের দিকে তাকিয়ে বলল কথাটা।
স্যান্ডউইচ আর কফি টা নিয়ে ধন্যবাদ বলে চেয়ার টা টেনে বসলো।
-আমি শেখর বলে হাত টা বাড়িয়ে দিলো।
কোন রকম দ্বিধা না করে ভদ্রমহিলা হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমার নাম—-
চোখে চোখ রেখে, কফি তে চুমুক দিতে দিতে অনেক কথা হোলও। ভদ্রমহিলা একাই এসেছে, সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে যাবে মস্কো তে, সেখান থেকে ফিরে যাবে নিউইয়র্কে।
-বাহ, আমারও ডেসটিনেশন নিউইয়র্কে। তবে আমি ফিরে যাবো এখান থেকে। সময় টা ভালোই কেটে গেলো, কি বলেন?
– অবশ্যই।
– নিউইয়র্কে কি দেখা হওয়ার সম্ভবনা আছে? প্রশ্ন টা করেছিল শেখর।
-কেন হবে না? বলে ফোন নাম্বার টা একটা ন্যাপকিনের উপর লিখে শেখরের হাতে দিলো।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে ট্রেন সেন্ট পিটার্সবার্গ ষ্টেশনে পৌছাবে।
উঠে দাঁড়াল দুজনে।
ভদ্রমহিলা তার ব্যাগ টা কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো।
আবারও হাতে হাত মিলালো দুজনে।
দেখা হবে নিউইয়র্কে,বলে ভদ্রমহিলা এগিয়ে গেলো।
সেই পুরানো ঘটনা টা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
মনে মনে হেসে ডায়েল করলো শেখর।
[চলবে]