তৃষ্ণার্ত মন

-আমি বাইরে যাচ্ছি। বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো শিপলা।

ইমন জানে কোথায় যাচ্ছে শিপলা, কার সাথে। কাজেই জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই, তাতে কথাই বাড়বে, তিক্ততার সৃষ্টি হবে।

ইমন তাকালও না, বই টার থেকে মাথা তুললও না। 

দরজা বন্ধের শব্দ হোলও।

শিপলা ফিরবে অনেক রাতে। সোজা চলে যাবে তার ঘরে। কাপড় ছেড়ে যাবে মুখের প্রসাধন ওঠাতে।

তারপর বিছানা। ইমন জেগে থাকে তার ঘরে।

এমন তো ছিলনা।

সদ্য পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার সে। মহসীন স্যারের জন্যই চাকরিটা পেয়েছিল হারুন বিল্ডার্স লিমিটেডে।

রশিদ হারুন।

সাদাসিধা যে কিশোর বড় হয়েছে পাঁচগুলিয়া গ্রামে, আজ তিনি দেশের অন্যতম উদ্যোক্তা ও শিল্পপতি। জাপানের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে বাস, ট্রাক, মিনিবাস প্রভৃতি মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশ সংযোজনের সাথে জড়িত।

পাশাপাশি তিনি পরিবেশবান্ধব ব্যাটারি উৎপাদনের কারখানা নির্মাণের কাজও শুরু করতে যাচ্ছেন। এ মুহূর্তে প্রায় দুই হাজার কর্মচারী-কর্মকর্তা রয়েছেন তার প্রতিষ্ঠানগুলোয়। বর্তমানে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।

সব শুনেছে ইমন মহসীন স্যারের কাছ থেকে।

হারুন বিল্ডার্স  নাম এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। হাই রাইজ বিল্ডিং উঠছে এই শহরের চারিদিকে। কোম্পানির হাতে নতুন অনেক গুলো প্রোজেক্ট। কোম্পানিতে কাজ করে রাজীব, সাদি, রোকেয়া,শিপলা। পরিচয় হয়েছিল।

শিপলা কাজ করে ফ্রন্ট অফিসে।  আসতে যেতে শিপলার সাথে দেখা হলে হাই, হ্যালো, কেমন আছেন এই পর্যন্ত।

কাজ নিয়েই ব্যাস্ত থাকতো ইমন।

নতুন শহর গড়ে উঠছে আসল শহর থেকে বিশ মাইল দুরে। নাম প্রগতি। সেখানে হারুন বিল্ডার্স গড়ে তুলবে এক বিশাল মল। সেই প্রোজেক্টের দায়িত্ব পড়েছে ইমনের উপর। কেন হারুন সাহেব অনেক সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার থাকতে ইমনের উপর দায়িত্ব দিয়েছিল তা সে আজও জানে না।

একদিন সন্ধ্যা গড়িয়ে যাওয়ার পরও অফিসে কতগুলো দরকারি কাগজ পত্র দেখছিল। আগামীকাল ইনেস্পেকশনে আসবে সরকারি কর্মকর্তারা।

-কি ব্যাপার এখনো অফিসে?

মুখ তুলে চাইল ইমন। হারুন সাহেব দাঁড়ানো।

দুই একটা কথা বার্তার পর হারুন সাহেবই বললেন,

-হাতীর বাগানে আমাদের যে বিল্ডিং আছে তার ছয় তালায় একটা এপার্টমেন্ট খালি। আপনি চাইলে নিতে পারেন। বলে হারুন সাহেব উত্তরের অপেক্ষায় তাকাল ইমনের দিকে।

-অত দাম দিয়ে আমার পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। বলল ইমন।

– দামদর পরে, আগে পছন্দ হয় কিনা দেখেন। এই কথা বলে চলে গিয়েছিলন।

ইমন দেখেছিল। পছন্দ হয়েছিল। আর হারুন সাহেব পানির দরে ওকে দিয়েছিল। কেন? আজও জানে না।

সেদিন শনিবার, রাজীব কল করে বলেছিল ওর বাসাতে কয়েকজন কে বলেছে, ইমন যদি আসে তবে সে খুব আনন্দিত হবে।

সবে মিলে সাতজন। ইমন ফুলের তোঁড়া টা রাজীবের স্ত্রী সাহানার হাতে দিয়ে চারিদিকে তাকাল। দুজন কে চিনতে পারলো না। রাজীব এগিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিল না চেনা দুইজনের সাথে।

শিপলার পাশের জায়গা টা খালি। ইমন বসতে বসতে বলল, কেমন আছেন?

-ভালো। আপনি?

-টায়ার্ড। বলল ইমন।

-আপনার উপর তো বিরাট প্রোজেক্টের –

শিপলার কথা শেষের আগেই ইমনের হাতের কোকের গ্লাসটা এই হাত থেকে ওই হাতে নিতে যেয়ে ছোঁয়া লাগলো শিপলার হাতে।

-সরি বলে ইমন একটু সরে বসার চেষ্টা করল। যদিও খুব একটা জায়গা নেই।

শিপলা একটু হাসল।

-মামা, টেবিলে খাবার দেবো? জিজ্ঞাসা করলো আমেনা।

ইমন ফিরে এলো পিছনে ফেলে আসা দিন গুলো থাকে।

-হ্যাঁ, দে, তোকে তো ফিরে যেতে হবে।

আমেনা আসে সকালে, সেই রান্না করে। সকালের নাস্তা টা সেই দেয় ইমনকে। তখনো শিপলা ঘুমায়

আমেনাই ঔষধ গুলো এনে রাখে ইমনের সামনে। কোনটা ফুরিয়ে গেলে সেই মনে করিয়ে দেয়।

খাওয়া শেষে আমেনা কে বিদায় দিয়ে দরজা টা বন্ধ করে দিল ইমন।

বাহিরে আকাশ গুরুগুরু করে ডাকছে। বৃষ্টি নামবে। গুমোট গরম। বৃষ্টি নামলে হয়তো কিছুটা ঠাণ্ডা হবে।

ব্যালকনিতে এসে বসলো ইমন। বিদ্যুৎ চমকানো দেখতে ভালই লাগছে।

 বৃষ্টি নামলো। গুমোট গরম শেষে স্বস্তির বৃষ্টি।

আমেনা কি ভিজতে ভিজতে গেলো? ভাবল ইমন।

সেদিনও বৃষ্টি ছিল। গা ছমছমে দুপুর।  ইমন আর অনু, দুজনে হাটতে হাটতে গিয়েছিল ধোপা পাড়ায়।

 ইমন ষোল, অনু চোদ্দ।

হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টি নামলো তো নামলোই, আর থামাথামির কোনো নামগন্ধ নেই। এমন বৃষ্টিকে বলে মুষলধারে বৃষ্টি

দৌড়ে এসে ওরা দাঁড়ালো বিরাট বট গাছটার নিচে।

ছোট্ট কালে দুজনে এক্কা দক্কা খেলেছে। পাড়ার পর পাড়া ঘুরে বাড়িয়েছে।

কখন যে বড় হয়েছে। বুজতে পারেনি।

 বুজতে পেরেছিল সেদিন, যেদিন ইমন ডাকতে গিয়েছিল অনুকে। বড় মাঠে ফুটবল খেলা আছে। ওদের স্কুলের সাথে ভবানীপুর স্কুলের।

-না বাবা ও তো যেতে পারবে না। বলেছিল অনুর মা।

-কেন? কি হয়েছে? অসুখ করেছে?

-না, অসুখ করেনি। তোমরা এখন বড় হয়েছ। একসাথে ঘোরা ফেরা টা ভালো দেখায় না। বলেছিল অনুর মা।

তারপরও ওরা পালিয়ে পালিয়ে একসাথে মিলেছে। হাটতে হাটতে গেছে অনেক দুর।

সেই হারং ব্রিজে।

আঁখের ক্ষেত থেকে আঁখ ভেঙ্গে খেয়েছে ব্রিজের নিচে বসে।

বটের পাতাতে আটকালও না বৃষ্টির জল। আস্তে আস্তে দুজনেরই কাপড় ভিজিয়ে দিলো।  

বৃষ্টির ঝাপটা এসে পড়ল অনুর গায়ে। অনু জড়িয়ে ধরল ইমন কে। 

 কেন জানি সেদিন হঠাৎ করে অনু কে অন্য অনু মনে হোলও ইমনের কাছে।

ইমনের মাথাটা নুয়ে এলো, ওর ঠোঁট টা ছুলো অনুর ঠোঁটে।  

সেই ছোট্ট শহর ছেড়ে বড় শহরে আসার দিন অনু বলেছিল,

-আবার কবে আসবে ইমন ভাই?

-খুব তাড়াতাড়ি। দেখিস, ভুলে যাসনে যেন আমাকে।

না, অনু ভোলে নি। পথ চেয়ে থাকতো।

 ইমনও ভুলে যায়নি অনুকে। তবে ফিরে আর যাওয়া হয়নি।  

জীবন যুদ্ধে অনেক উপরে উঠে গেছে ইমন। অনেক লোকের জীবিকা আজ নির্ভর করছে তার নিজস্ব ফার্মের উপর।

ষোল তালার উপরে তার এপার্টমেন্ট। ব্যালকনি তে দাঁড়ালে দেখা যায় লেক।

গাছ দিয়ে সাজানো চারিদিক। অনেকে এসে বসে থাকে লেকের পাড়ে।

সবই ছিল তার। তবে পেলো না শুধু মনের মত সঙ্গিনী।

প্রথম দিকে যে ছিল না তা নয়।

 তখনও সে চাকুরীজীবী। ইনকাম মন্দনয়।একটা রিকন্ডিশন গাড়ীও কিনেছিল।

একদিন অফিস থেকে বের হতে যেয়ে দেখে বাহিরে ভীষণ বৃষ্টি। শিপলা দাড়িয়ে। রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছে।

কোন রিক্সাই যেতে রাজি নয়।

-যদি কিছু মনে না করেন আমি পৌছে দিতে পাড়ি।

শিপলা কিছু মনে করেনি।

তারপর আস্তে আস্তে দুজনে কাছে এসেছে। বসেছে নির্জনে। হাতে হাত। ঠোঁটে ঠোঁট।

একদিন মা,বাবা, বন্ধু বান্ধব আর হারুন সাহেব কে নিয়ে ধুমধাম করে বিবাহ পর্ব টা শেষ হোলও।

শিপলা সংসার টা সুন্দর করে গুছিয়ে নিলো।

কোলে এলো নবনী।

ইমনের মনে হোলও ও তার ছোট্ট ছোট্ট হাত পা ছুড়ে যেন বলছে, আমি তোমার মা, আমি এসেছি তোমার ভাগ্য খুলতে।

সেই থেকে ইমনের উন্নতি।

হারুন সাহেবের সাহায্যে গড়ে তুলল নিজস্ব  ফার্ম। নাম দিল নবনী- শিপলা ইন্ডাস্ট্রি।

নবনী বড় হোলও। দেশের বাহিরে চলে গেলো উচ্চশিক্ষার্থে।

 টাকা এলো, সুখ চলে গেলো।

শিপলা মেতে উঠলো পার্টি নিয়ে। মাঝে মাঝে ইমন যেতো। কোনদিন সে পার্টির পাগল ছিল না। তবুও যেতে হতো।

ইমন একদিন বলেছিল শিপলা কে, প্রতিদিন পার্টিতে কি না গেলেই নয়।

উত্তরে শিপলা বলেছিল, তোমার মত বেরসিকের সাথে বাসায় বসে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব।

উত্তর দিয়ে কোন লাভ নেই ভেবে, সেদিন কোন উত্তর দেই নি।

মাঝে মাঝে ফেসটাইম করে মেয়ের সাথে কথা বলে। ওটাই তার মনের খোরাক। 

বৃষ্টি টা থেমে এলো। ইমন ভাবছিল, আজ যদি শিপলার পরিবর্তে অনু হতো ওর জীবন সঙ্গিনী তাহলে কি অন্য রকম হতো ওর জীবন টা। কেন জানি মনে হয় সব আছে তবুও কি যেন নেই।

ঘড়িটা দেখল ইমন। রাত দেড়টা।

দরজা খোলার শব্দ পেলো। ব্যালকনির দরজাটা বন্ধ করে এগিয়ে এলো।

শিপলা জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলবে?

মুখের গন্ধটা একটু উগ্র।

-হ্যাঁ, কাল আমি একটু বাহিরে যাবো। ফিরতে কয়েকদিন দেরী হবে।

কোনকিছু জিজ্ঞাসা না করেই শিপলা চলে গেলো তার ঘরে।

-আচ্ছা ভাই, এখানে একটা গলি ছিল, এখন তো দেখছি পাকা রাস্তা। ফজলুল হক নামে একজন থাকতেন। অনেকদিন পরে এসেছি, কিছুই চিনতে পারছি না।

-হ্যাঁ, থাকতেন, ওই যে, ওই বাসাটা। 

বাসাটা চেনার উপায় নেই। দোতালা বাড়ী।

কড়া নাড়তেই এক ভদ্রমহিলা এসে দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলেন, কাকে খুজছেন?

ইমন নাম টা বলল।

না, সে চেনে না। বলে দরজা টা বন্ধ করে দিলো।

ইমনের মনে পড়লো সাবুর কথা। একই ক্লাসে পড়তো।

একটা রিক্সা ডেকে উঠে পড়ল। চিনে যেতে পারবে কিনা মনে মনে ভাবল সে। সবই অচেনা মনে হচ্ছে।

যাক অবশেষে পাওয়া গেলো বাসাটা। খুব একটা পরিবর্তন হয়নি বাসাটার।

দরজায় টুকটুক করে শব্দ করলো। দরজা খুলে দিলো ছোট্ট একটা মেয়ে।

-সাবু আছে।

নানা তোমার কাছে এসেছে, বলে দৌড়ে চলে গেলো।

লাঠিতে ভর করে যে এসে দাঁড়ালো, সে তার নামটা না বললে চিনতে অসুবিধা  হতো ।

-ইমন না? বলে জড়িয়ে ধরলও সাবু। এতদিন পরে কি মনে করে?

-ঘুরতে ঘুরতে, তবে, একটু থেমে ইমন জিজ্ঞাসা করলো, আচ্ছা, তোর মনে আছে, ওই পাড়ায় আমাদের বাসার কাছে ফজলুল হক বলে একজন ছিলেন।

-হ্যাঁ, কেন? তারা তো কবেই চলে গেছে এখান থেকে।

-অনু বলে উনার এক মেয়ে ছিল, তুই কি জানিস, কোথায় সে?

-তার বিয়ে হয়েছিল এক ব্যাবসায়ীর সাথে, থাকে গোপালগঞ্জে।

-ওর স্বামীর নাম কি? জিজ্ঞাসা করল ইমন।

-কি ব্যাপার। মতলব ভালো তো?

-ঠাঠামি ছাড়। নামটা বল।

-মতলেবুর রহমান।

কিছুক্ষণ বসে উঠে পড়ল ইমন। একটা ইস্কুটার ভাড়া করে গেলো সে গোপালগঞ্জে।

ছোটছোট দোকান পাট। রাস্তায় বসে কেউ বা সিগারেট টানছে, কেউ বা গল্প করছে।

জিজ্ঞাসা করতেই দেখিয়ে দিলো কি ভাবে যেতে হবে বাড়ীতে।

মাটির রাস্তা, চওড়া বেশি নয়। দুপাশে খাল। ইটের পাকা বাড়ীটা দেখা যাচ্ছে।

ইমন ভাবল, অনু ওকে দেখে চিনতে পারবে কি? কেমন যেন শিরশির করছে বুকের মাঝে।

– দরজা খুলে কাকে চাই বলে, তাকিয়ে রইল ইমনের দিকে। চোখে পলক পড়ছে না। ইমন ভাই, তুমি?

-হ্যাঁ, চিনতে পেরেছিস তাহলে ? তা, দরজায় দাড় করিয়ে রাখবি, না কি ভিতরে যেতে দিবি। 

অনুর মনে হোলও সে এই জগতে নেই।  সে স্বপ্ন দেখছে। অনুর চোখ বিশ্বাস করতে চাইছে না।

-এসো।

ড্রয়াইং রুমে দুটো চেয়ার পাতা। পাশে একটা পরিপাটি করে সাজানো বিছানা। ছোট্ট একটা টেবিল কর্নারে রাখা।

-ভর দুপুরে এলে, খিদে পেয়েছে নিশ্চয়? যা আছে তাই দিয়ে খাবে। চলো হাত মুখ টা ধুয়ে নেবে। এতগুলো কথা একসাথে বলে গেলো অনু।

-তুই বস, আমি তোকে দেখি।

-কি আর দেখবে আমাকে বলও। যে অনুকে তুমি শেষ দেখে গিয়েছিলে সেই অনু আজ আর নেই। আজ আমি তিন ছেলে মেয়ের মা। বলেছিলে আসবে আবার, এই তোমার আসার সময় হোলও। বলে চোখ টা মুছল শাড়ীর আচল দিয়ে।

দাড়াও আমি আসছি। বলে ভিতরে চলে গেলো। হয়তো কান্না থামাতে।

নিয়ে এলো, প্লেট, ভাত, ভাজি, ডাল।

ইমন বসলো প্লেটটা টেনে। মনে হোলও অনেকদিন সে অভুক্ত। অনু সামনে বসে পাতে উঠিয়ে দিলো ভাত।

কবে শিপলা ওর পাতে ভাত উঠিয়ে দিয়েছিল মনে করতে পারে না।

-ভাজি আর একটু দেই, তুমি কিন্তু অনেক কম খাও ইমন ভাই।

এমন কথা কি এখনো খাবার টেবিলে বলা হয়। ইমন ভাবতে চেষ্টা করল।

-তোর কর্তা কোথায়?

-শহরে গেছে। আসতে একটু দেরী হবে। তুমি কি আজই ফিরে যাবে?

-হ্যাঁ, সন্ধ্যা ছয়টায় আমার প্লেন।

-জানো ইমন ভাই, তোমাকে নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি। পরে মনকে সান্ত্বনা দিয়েছি এই বলে, তুমি হয়তো অনেক ব্যাস্ত,সময় পাওনা এইদিকে আসার। কেন এলে ইমন ভাই। আবার তো মনে পরে গেলো ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। ইমন ভাই তোমার সেই দিনটার কথা মনে আছে? সেই বট গাছ, মুষল ধারে বৃষ্টি—।

-মনে থাকবে না কেন? তোর যে মনে আছে সেটাই আশ্চর্যের।

-জানো ইমন ভাই, সেদিন, যে তীব্র আনন্দ পেয়েছিলাম, তার কোন তুলনা হয় না।

হঠাৎ কি অনুর গলায় কান্না এসে গেলো?  দ্রুত পায়ে চলে গেলো ভিতরে।

সেই বট গাছ, বৃষ্টি, পর পর তিনটা চুমু খেয়েছিল সে। অনু অবাক হয়নি, প্রথমবারের পর, পাখির বাচ্চা যেমন পাখী-মায়ের সামনে ঠোঁট ফাঁক করে থাকে, সেইভাবে অনু এগিয়ে দিয়েছিল ঠোঁট।

তাদের দুজনের সেই প্রথম অভিজ্ঞতা।

তারপর নদী দিয়ে কত জল গড়িয়ে গেছে। অনেক কিছু বদলে গেছে। তবু অনু যে আজ বলল, সেই তীব্রতা আর তার জীবনে আসেনি।  সেই কথা বলতে অনুর চোখে জল এলো, এই স্মৃতি নিয়ে ফিরে যাবে ইমন।

Continue Reading

অন্নপূর্ণা

      কাস্টমসের ধকল শেষ করে পাঁচ নম্বর carousel এর সামনে এসে দাঁড়ালাম। তখনও সুটকেস এসে পৌঁছায়নি।  যখন পেলাম তখন বেশ কিছু সময় পেড়িয়ে গেছে।

 এয়ারপোর্টের বাহিরে এসে দাড়িয়ে চারিদিকে তাকালাম। আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক আসার কথা। কিন্তু চেনা পরিচিত কাউকে দেখলাম না।

আমাকে ঘিরে বেশ কিছু লোক। তারা চাইছে কে আমার সুটকেসটা নেবে। আমাকে পৌছিয়ে দেবে আমার গন্তব্য স্থানে।

যতবার বলছি, আমার লোক আছে, তোমাদের গাড়ী আমার লাগবে না, কিন্তু কে কার কথা শোনে।

একজন তো আমার হাত থেকে সুটকেসটা প্রায় নিয়ে নিয়েছিল, ঠিক সেই সময় শুনতে পেলাম উচু গলায় এক মেয়ের কণ্ঠস্বর, এই সড়ে যাও। ধমক দিলো ওদের কে।

আমি তাকালাম ওর দিকে। চিনতে পারলাম না।

কোন কথা বলার আগেই আমার হাত থেকে সুটকেস টা নিয়ে বলল,

– ছোট মামা অ্যান্টি পাঠিয়েছে আমাকে। বাসায় কেউ নেই যে আসবে তোমাকে নিতে। আমাকে তোমার একটা ফটো দিয়ে অ্যান্টি বলেছে চিনে নিতে। তা তুমি যে আবার দাড়ি রেখেছ তা তো জানিনা। সেই জন্যই তো একটু দেরী হয়ে গেলো খুজে পেতে। এক সাথে এতগুলো কথা বলে বলল, তাড়াতাড়ি পা চালাও। গাড়ীতে বসে কথা হবে।

সেই প্রথম দেখা তার সাথে। ইউনিভারসিটির শেষ বর্ষের ছাত্রী। এই বাসাতে যাতায়েত আছে।

আমার মন টা জয় করে নিতে খুব একটা সময় লাগেনি তার। মনে হোলও যেন সে আমার অনেক দিনের চেনা।

যতদিন ছিলাম সেই নিয়ে গিয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। বইয়ের দোকান থেকে আরম্ভ করে নতুন চশমা বানানোর দোকান পর্যন্ত। করিৎকর্মা মেয়ে। ওর অ্যান্টি কে মাঝে মধ্যে সাহায্য করে।

সুতীর শাড়ী, সুতীর সালওয়ার কামিজ ছাড়া অন্য কিছু পড়তে দেখিনি তাকে।

ভালো গান গায়। নিজেদের বাড়ীতে গানের চর্চা হয়।

যত দিন গেলো দেখলাম তার কুকুর, বেড়ালের উপর মায়া। ওদেরকে ভালবাসে।

মনে পড়ে গেলো আমার শৈশবে ছোট্ট একটা ছেলে আমার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল একই ভাবে।

আমাদের বাসাতে কাজ করত আয়েশা। তার ছেলে বিলটু। ঘুরঘুর করতো আমার আশেপাশে।

আমার পড়ার টেবিলের পাশে চুপকরে বসে থাকতো।

মা র লুকিয়ে রাখা বিস্কিটের বাক্স থেকে বিস্কিট এনে ওকে দিতাম।

ও চোখ বড়বড় করে চারিদিকে চেয়ে ছোট্ট ছোট্ট দাঁত দিয়ে টুসটুস করে কামড়িয়ে খেতও।

ওর মা মাঝে মাঝে ডাক দিয়ে বলত, এই বিলটু, মামা কে বিরক্ত করিস নে।

না, সে বিরক্ত করতো না, শুধু চেয়ে থাকতো আমার দিকে। মায়াময় চেহারা।

স্কুল থেকে এসে ওকে নিয়ে যেতাম মাঠে। ও বসে থাকতো। আমরা ফুটবল খেলতাম।

একদিন সে চলে গেলো। চলে গেলো অনেক দুরে।

ওর মা র বিয়ে হোলও। দুরের এক গ্রামে।

গরুর গাড়ী এলো। ওরা উঠে বসলো। ওর মা কাঁদছে।

ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কি যেন বলতে চাইছে।

চোখের পানি মুছে ওকে যেয়ে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, তোকে আমি নিয়ে আসবো ওই গ্রাম থেকে।

না, আর আনা হয়নি। আর দেখা হয়নি।

এখনো সেই ছোট্ট দাঁত দিয়ে কুচকুচ করে বিস্কিট খাওয়া আমার চোখের সামনে ভাসে।

এতদিনে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে বিলটু। আমার কথা হয়ত তার আর মনে নেই।   

  -মামা, কি ভাবছ? তোমার না রেডি হয়ে থাকার কথা।  নৃত্যাঞ্চল গোষ্ঠীর নাচের অনুষ্ঠান দেখতে যাবো?

-তাইতো? বলে তাড়াতাড়ি হাতের কাছে যা পেলাম পড়ে নিলাম।

-একি? এই বেশে যাবে নাকি তুমি? পাঞ্জাবি নাই? বলে তাকালও আমার দিকে।

– পাঞ্জাবি আনবো কেনও এখানে। আমি কি বিয়ে বাড়ীতে যাবার জন্য এসেছি নাকি?  হাসতে হাসতে বললাম তাকে।

বেরিয়ে গেলো সে ঘর থেকে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো একটা পাঞ্জাবি নিয়ে। লালের উপর কাজ করা।

-এই কটকটে লাল আমাকে মানাবে না। আমার বয়স টা কত তা তুই জানিস? বললাম,

কিন্তু কে কার কথা শোনে। অগত্যা ওটা পড়েই রওয়ানা দিলাম।

সুন্দর একটা অনুষ্ঠান দেখে যখন বের হলাম তখন সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই।

অনেক কে সে চেনে, তাই হাই, হ্যালো বলতে বলতে আরও কিছুটা সময় ব্যায় হোলও।

-তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমাকে এক বন্ধুর বাসাতে যেতে হবে। বলে সে রিক্সার উদ্দেশে হাত উঠালো।

আমি একাই চলে যেতে পারবো বলতেই সে ধমকের সুরে বলল, জানো, এখানে কতকিছু ঘটছে ইদানীং?

আমার আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগলো। বললাম, এখানে আমার জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছি তা জানিস।

অগত্যা সে একটা রিক্সা ঠিক করে দিল। বলল, পৌছিয়েই যেন আমি তাকে কল করি।

রিক্সা ডিমে তেতালে চলেছে। আমারও তাড়া নেই। চারিদিকে তাকিয়ে দেখছি। যে শহর ছেড়ে গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছে এই শহর সেই শহর নয়। অনেক নতুন নতুন রাস্তা, নতুন নতুন দোকান পাঠ। চেনা শহর অপরিচিত মনে হচ্ছে।

বড় রাস্তা থেকে রিক্সাটা ঢুকে গেলো এক গলিতে। ছোট,চিপা রাস্তা। দুদিকে নর্দমা।  এ কোথায় এলাম। কোথা দিয়ে সে নিচ্ছে আমাকে। জিজ্ঞাসা করতে যেয়ে থেমে গেলাম। পাছে সে বুঝতে পাড়ে আমি এখানকার বাসিন্দা না।

মনে পড়ল, কে যেন বলেছিল, অনেক কিছু ঘটতে পাড়ে, Ransom, খুন খারাবি।

সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞাসা করলাম, ঐ বড় রাস্তা ছেড়ে এই গলিতে ঢুকলে কেন?

-ওই দিকে রাস্তা বন্ধ স্যার। আপনি হুড টা উঠিয়ে শক্ত করে ধরে রাখেন। সামনে আবার ঐ মানে—

ঠিক সেই সময় ফোন টা বেজে উঠল। অনীকা কল করেছে।

-মামা কোথায় তুমি?

-জানিনা।

-জানিনা মানে? উৎকণ্ঠা জড়িত স্বরে জানতে চাইল।

-ইংরাজি তে বললাম, গলিতে? যাতে রিকশাওয়ালা বুঝতে না পাড়ে আমার মনে ভয়ের সঞ্চারের হয়ছে। 

-গলিতে? ঠিক আছে তুমি কথা বলতে থাকো। আর চারিদিকে নজর রাখো।

আমি তাই করলাম। হঠাৎ পাশের দোকান থেকে দুটো লোক দৌড়ে এলো। সামনে এগিয়ে যেয়ে পিছনে ফিরে তাকালও।

– এই এই এখনি ওরা আমাকে ধরবে। গলা দিয়ে যেন স্বর বের হচ্ছে না।

-কারা তোমাকে ধরতে যাচ্ছে? তুমি কি—

ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই রিকশাওয়ালা বললও,

– স্যার, এই জাগাটা সুবিধার না। বলে একবার পিছনে ফিরে তাকাল সে।

আমার আত্মা তখন গলার কাছে।  

ঝম করে শব্দ হোলও। আমি চিৎকার করে পড়ে যেতে যেতে সীটের পাশটাকে জোড়ে চেপে ধরলাম।

-আমি বলেছিলাম না স্যার এই জাগাটা সুবিধার নয়। গর্ত আছে।  সেই জন্য আপনাকে বলেছিলাম শক্ত করে ধরতে।

ঐ যে, ঐ যে, আমরা বড় রাস্তায় এসে গেছি স্যার। বাঁক নিলেই আপনার বাসা।

ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল আমার।

ফিরে এসেছি আমি। এয়ারপোর্টে সেই এসেছিল আমাকে বিদায় দিতে। বলেছিল, ছোটমামা আবার কবে আসবে।

-জানিনা।

ওর চোখ টা ছলছল করে ছিল হয়ত। প্রকাশ করতে দেইনি।

প্রায় ম্যাসেঞ্জারে কথা হয়। ভালোই আছে। ব্যাস্ত। সামনে পরীক্ষা।

এলো করোনাভাইরাস। দেশে দোকান পাঠ, ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেলো। দিন আনে দিন খায় যারা তাদের ঘরে নাই চাল, নাই ডাল। বেরাল,কুকুর রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, খাবার পায় না।

 আমরাও এখানে বন্দী।

 হঠাৎ ই দেখলাম ফেসবুকে অনীকা আর কয়জন মিলে খুলেছে একটা সংস্থা। দেশের এই পরীস্থীতে গরীব আর পশু প্রানীদের সাহায্যার্থে।

নাম দিয়েছে এক বেলার অন্নপূর্ণা।

ও আমার কাছে চায়নি। আমিই পাঠিয়েছিলাম আমার সাধ্যমত।

প্রতি উত্তরে সে লিখেছিল,

 ধন্যবাদ ছোট মামা! তোমার পাঠানো এই উপহার যে কত মানুষ ও প্রাণির কাজে লেগেছে! তোমার এই উপহার কাজে লেগেছে একজন দিনমজুরের, একজন গাড়ি হেল্পারের, জাহাংগীরনগরের চা ভাই কালাম ভাইয়ের,রাজশাহীর প্রাণিকল্যাণকারী এক গ্রুপের আর এক মায়ের ডায়ালিসিসে।

চোখে জল এলো।

এরা আছে বলেই দেশটা আজও সুন্দর।

মনে মনে বললাম, ভালো থাকিস। সাবধানে থাকিস।

 উপরওয়ালাই তোকে পুরস্কার দেবে।

Continue Reading

এসো, আবার মিলিত হই- শেষ

   সাতদিন পর।

সকাল নয়টা।

 শেখর উপর থেকে নেমে এলো। সেই অসহ্য যন্ত্রনা করা ব্যথাটা নেই। শেখর হাটতে পারছে। কাঁটা ছেড়ার জায়গা টায় এখনো ব্যাথা। না থাকার কথা নয়।

তনুজা বলেছে, আর যাই করো নিজের বাসায় তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা ভেবো না। একটু সুস্থ হয়ে নাও।

ডাক্তার বলেছে, সময় দিতে হবে। আস্তে আস্তে এক পা দুই পা করে এগোতে থাকো।

শেখর নাস্তা শেষে বেড়িয়ে এলো রাস্তায়, করোনার ভয়ে লোকজন খুব একটা রাস্তায় নেই। মুখে মাস্ক পড়ে, মাথায় ক্যাপ লাগিয়ে দুই এক পা যেতেই ফোন টা বেজে উঠলো।

শেখর হেড ফোন টা কানে লাগিয়ে নিলো।

-কোথায় তুমি? জিজ্ঞাসা করল সে

-রাস্তায়।

-রাস্তায়? মানে? আতঙ্কিত স্বরে বলল সে।

-হাটতে বেড়িয়েছি। দেখি কত টুকু পারি।

-এতো তাড়াতাড়ি না বের হলেই কি নয়?

-ঠিক বলেছ, মনে হচ্ছে না আমি এখনো প্রস্তুত। একটু টান লাগছে পা টা তে। বলল শেখর।

কথা বলতে বলতে বাসার সামনে রাখা চেয়ার টা তে বসলো।

কতদিন এইভাবে তাকে চলতে হবে কে জানে।

-ডাক্তারের কাছে কবে যাবে? জিজ্ঞাসা করল ওপাশ থেকে।

-আরও এক সপ্তাহ পড়ে। উত্তর দিল শেখর।

-শোন, আগামীকাল তোমার খোঁজ নেওয়া হবে না। ব্যস্ত থাকব। সাবধানে থেকো। বলে ফোন টা রেখে দিলো সে।

কথা শেষে শেখর বসে বসে ভাবছিল ফেলে আশা দিনগুলোর কথা।

নিউইয়র্কে ফিরে এসে শেখর ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল কাজ নিয়ে। হঠাৎ এক সকালে কল এলো ।

-খবর কিন্তু আমিই নিলাম, চিনতে পারছেন?

– অত্যন্ত লজ্জিত, কল করব করব করে আর করা হয়নি। কথাটা সত্যি না, তাও বলল শেখর।

সেটা বুঝতে ওপাশের ( দুই ভুরুর মাঝে তিল, যেটা কিনা প্রথমে শেখর মনে করেছিল টিপ), সেই ভদ্রমহিলার দেরী হয়নি।

ফোনের ওপর প্রান্তে মৃদু হাসি।

-সত্যি বলতে কি, আপনি না সত্য কথা, সত্য করে বলতে পারেন না। বলে আবারও হাসল সে।

শেখর হেসে বলল, ক্ষমা চাইছি, যদি কিছু মনে না করেন দেখা হবে কি?  

-আগামী কাল সন্ধ্যা ছয়টায়। কোন রকম সংকোচ না করেই রেস্টুরেন্টের নাম টা বললও ভদ্রমহিলা।

শেখর একটু আগেই এসেছিল। কর্নারের একটা টেবিল নিয়ে বসলো। ওখান থেকে রাস্তাটা দেখা যায়। আগে কখনও এখানে আসেনি।

শেখর খুব একটা রেস্টুরেন্টে খেতে আসে না। বন্ধু বান্ধব নিয়ে বেশির ভাগ সময় বাসাতেই আড্ডা দেয়।

হাত ঘড়িটা দেখল শেখর। পাঁচ মিনিট পেড়িয়ে গেছে।

-সরি, একটু দেরী হয়ে গেলো।

মুখ তুলে তাকালও শেখর। ট্রেনে দেখা চেহারার সাথে মেলানোর চেষ্টা করল। সেদিনের সেই পটভূমিকাতে ওই রূপটা মানিয়ে ছিল।

আজ ভিন্ন, চুলটা উপরে উঠিয়ে বাঁধা। মার্জিত ভাবে সাঁজা মুখমণ্ডল। দেখে ভালো লাগলো শেখরের। গলায় টপসের সাথে  ম্যাচ করে স্কার্ফ বাঁধা।

-কি ব্যাপার? কি ভাবছেন। চেয়ার টা টেনে বসতে বসতে বলল সে।

-ভাবছি—কথা শেষ হওয়ার আগেই ওয়েটার এসে পাশে দাঁড়ালো।

মেন্যু টা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো কোন ড্রিঙ্কস খাবে কিনা।

-ক্লাব সোডা। বললও সে

শেখর অর্ডার দিলো ডায়েট কোক।

নিতান্তই সাদাসিধে কথা বার্তা দিয়ে শুরু।

শেখর জানে প্রথম পরিচয়ে কারোর পেশা বা কোথায় থাকা হয় এসব নিয়ে আলোচনা নয়।

 আলোচনা করো, মুভি বা নতুন কোন নেটফ্লেক্সে আসা সিরিজ নিয়ে অথবা খেলাধুলা (যদি সে ইনটারেস্টেড হয়)।

কথাবার্তার মোড় ঘুরে গেলো যখন সে শেখর কে জিজ্ঞাসা করলো, তার বাসাতে কে কে আছে।

শেখর বলেছিল, সে একেলা, মেয়ে বড় হয়ে চলে গেছে তার পথে।

কথার প্রসঙ্গে কথা বলতে হয়, তাই জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনার?

-আপনার মতোই একেলা, তবে ঐ পথে পা বাড়াইনি। বলতে পারেন, ক্যারিয়ার নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিলাম যখন চোখ তুলে চাইলাম, দেখলাম, সময় পেড়িয়ে গেছে। 

কতক্ষণ সেদিন বসেছিল আজ শেখর মনে করতে পারল না। 

তারপর প্রতি সপ্তাহে এক দুইবার দেখা হয়েছে। বসেছে কোন নদীর পাড়ে অথবা গাড়ীতে করে চলে গেছে দুরে।  

আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছে।

 ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে।

 একে অপরের খোঁজ নিয়েছে প্রতিদিন। 

তনুজার ডাকে ফিরে তাকালও শেখর। তনুজা বলল ও একটু বাহিরে যাবে, কাজেই শেখর যেন ভিতরে চলে আসে।

ভিতরে আসতেই দেশ থেকে কল এলো। শেখরের বোন। খবর দিল অতি পরিচিত একজন চলে গেলো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। বড় ভাবীর ছোট মামা। দেশে থাকতে শেখরের সাথে কথা হতো। যাওয়া আসা ছিল।

চেহারাটা মনে পড়লো শেখরের। আরও কতজন হয়তো চলে গেছে, সে জানে না।

শেখরের মনে হোলও এবার বাসাতে ফিরে গেলে একটু অসুবিধা হবে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে। অনেকদিন আছে মেয়ের কাছে।

ডিপেনডেন্ট হয়ে পড়েছে সে।

বলেছিল সে, পারবে তো বাসায় যেয়ে সবকিছু করতে। নাকি আমাকে এসে সাহায্য করতে হবে?

তুমি এলে তো মন্দ হয় না। সকালে এসে সন্ধ্যায় চলে গেলে। বলেছিল শেখর হাসতে হাসতে।

-আসবো। বন্ধুর জন্য এইটুকু না করলে চলে। ফোনে বলেছিল।

দুইদিন ওর কোন কল এলো না।

শেখর উদগ্রীব হয়ে কল করলো।

ওর গলার স্বর ভারী। দুই একবার কাশলো।

-কি হয়েছে? কল করনি কেনও? জিজ্ঞাসা করলো শেখর।

– তোমার এই অবস্থায় আমি তোমাকে দেখতে যেতে পাড়লাম না। পাছে কিছু হয় তোমার। আর আজ তোমার ইচ্ছে থাকলেও আমাকে দেখতে আসতে পারবে না।

-কি হয়েছে? ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলো শেখর।

-আমাকে ভর্তি হতে হবে হাসপাতালে। বলল কান্না ভরা গলায়।   

শেখরের মনে হোলও পৃথিবীটা দুলছে।

-আসবো, আমি তোমার বাসাতেই দেখা করতে আসবো। চোখ টা মুছে বলল শেখর।

-তাই যেন হয়।

সেই শেষ কথা হয়েছিল শেখরের সাথে ওর।

Continue Reading