সাদা চাদর দিয়ে ডেকে দাওয়া হয়েছে। ডাক্তার হারুন বাহিরে এসে দাঁড়ালো। সেখানে দাঁড়ানো সাধন, রফিক আর পার্থ। তিনজন তাকাল ডাক্তার হারুনের দিকে।
একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডাকছে নিচে। এই মুহূর্তে শব্দ টা অসহ্য লাগছে ওদের।
ভর দুপুর।
রৌদের তাপ টাও বেড়েছে।
ঘামছে ওরা।
মুখটা রুমাল দিয়ে মুছে পার্থের কাঁধে হাত রেখে বলল ডাক্তার হারুন , ডেথ সার্টিফিকেট টা আমার চেম্বার থেকে নিয়ে যেয়েন। আর যা যা করার সব ব্যবস্থা করুন।
সেই মুহূর্তে ওরা উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠল।
-আপনাদের মধ্যে রফিক কে?
ওরা তাকাল মহিলার দিকে।
-আমি, বলল রফিক।
-আমিই আপনাকে খবর দিয়েছিলাম। পাশের ফ্লাটটা থাকি। চাচা বলে ডাকতাম। এই চিঠি টা আপনাকে দিতে বলেছিল।
হাত বাড়িয়ে চিঠি টা নিলো রফিক।
খামের উপর টা সাদা।
খুলতে যেয়েও খুলল না। পকেটে রেখে দিলো।
-সাহেব, আমি উনার রান্না করে দিতাম। ওদের পাশে এসে বলল এক জরাজীর্ণ কাপড় পড়া মহিলা। এই মসের টাকাটা উনি দিয়ে যান নি।
-কত? জিজ্ঞাসা করল সাধন।
টাকাটা দিতে গেলো রফিক। বাঁধা দিল পার্থ।
টাকাটা হাতে নিয়ে মহিলা এসে দাঁড়ালো বিছানার পাশে। বিড়বিড় করে কি যেন পড়ল। তারপর চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো।
আত্মা টা চলে গেলে তখন নাম ধরে কেউ ডাকে না। ওটা হয়ে যায় লাশ। সেই লাশ টা বিছানায় পড়ে আছে। কেউ নেই পাশে। ওরা তিনজন বাহিরে দাঁড়ানো।
কবর দিতে হবে। ওরা ব্যস্থ হয়ে উঠল।
সব কাজ সেরে ওরা ফিরে এলো ঐ ফ্লাটে। সন্ধ্যা হয় হয়।
পাশের ফ্লাটের মহিলাকে বলল রফিক, ওর ঘরে তালা দিয়ে গেলাম। আমাদের কে আজই ফিরে যেতে হবে।
আমি ফিরব সাতদিন পরে।
-ঘুমাতে এসো। রফিকের পাশে দাড়িয়ে বলল আলেয়া।
-তুমি যাও আমি আসছি। বলে ড্রয়ার থেকে চিঠি টা বের করলো রফিক।
কাঁপা হাতের লেখা।
কোন সম্বোধন নেই।
এই চিঠি যখন তোর হাতে পৌছাবে তখন আমি অনেক অনেক দুরে চলে গেছি।
তুই, আমি, সাধন, পার্থ।
এক সাথে বড় হয়েছি। তুই ছিলি আমার সব চেয়ে নিকট তম বন্ধু। তাই এই চিঠি টা তোকেই দিয়ে গেলাম। পড়া শেষে ছিড়ে ফেলে দিস।
ভাবতে অবাক লাগে আজ কি ভাবে কি ভাবে তোদের সাথে আমার বন্ধুত্ত হয়ে গেলো।
বাস ড্রাইভারের ছেলে আমি, আর তোরা–। স্কুল শেষে তোরা কলেজে চলে গেলি আর আমি পড়া শেষে বাপের চাকরি টা হাতে নিলাম।
বাবার হাঁপানি রোগ ছিল। ক্রমেই ওটা খারাপের দিকে চলল। বাবা বলে ছিল, তুই কলেজে যা বাবা।
না আমি পারিনি। একমাত্র ছেলে আমি। সংসারের হাল ধরতে হবে।
বেশ তো ভালোই চলছিল। কাজের শেষে আমি এসে বসে থাকতাম কলেজের সামনে। মা র হাতের তৈরী গজা দিতাম তোদের কে । হাটতে হাটতে যেতাম দুর ব্রিজের কাছে। মনে কি পড়ে ?
তোরা কলেজ শেষ করে চলে গেলি দুরে। উচ্চ শিক্ষারতে। আমি রয়ে গেলাম।
চলে যাওয়ার আগের দিন আমরা চারজন বসেছিলাম মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। শেষ কথা কি বলেছিলি মনে আছে?
-আবার দেখা হবে দোস্ত।
-বলেছিলাম, সেদিন চিনতে পারবি তো এই বাস ড্রাইভার কে?
চিঠি আসতো তোর কাছ থেকে। কার সাথে যেন ইয়েটিয়ে করছিস। হাসতাম আমি।
আস্তে আস্তে চিঠি আসা কমে এলো। আমিও ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। মালিক আগের রুট পালটিয়ে অন্য রুটে আমাকে দিলো।
সে অনেক দূরপাল্লার রুট। মাঝে মাঝে বাসাতে ফিরতাম দুদিন পরে।
মা মাথার পাশে বসে বাতাস করতো। বলত, তোর বাবার শরীর টা ভাল যাচ্ছে না। বুঝতাম মা কাঁদছে।
পাশের ঘর থেকে বাবার কাশির শব্দ শুনতাম।
এই ভাবেই দিনগুলো কাটছিল। হঠাৎ একদিন কি হোলও জানিস।
সেদিন শেষ ট্রিপ আমার। বাসে মাত্র কয়েকজন লোক। এঁকে এঁকে সবাই মেনে গেলো যার যার স্থানে। রইল দুইজন। মনে হোলও স্বামী স্ত্রী। কথায় কথায় লোক টা বকছে মেয়েটা কে। মাঝে মাঝে থাপ্পড় দিচ্ছে গালে। মেজাজ টা টং হয়ে গেলো।
কিন্তু কিছু করার নেই।
ওরা নামলো আমার বাসের শেষ স্টপে।
নেমে যাওয়ার সময় কেনও জানি রাগ সামলাতে পারলাম না। শুধু বললাম, লজ্জা করে না মেয়েদের উপর হাত তুলতে?
লোক টা ঘুরে আমাকে চড় মারতে চাইলো।
পারলো না। তার আগে ওর হাত টা ধরে এক লাথি দিয়ে বাস থেকে নিচে ফেলে দিলাম। লোকজন জড় হয়ে গেলো।
ও বলল, আমি নাকি ওর জেনানার হাত ধরতে চেয়েছিলাম, তাই সে চড় মারতে চেয়ে ছিল। মেয়ে টা দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছিল। আর কাঁদছিল।
আমাকে থানায় নিয়ে গেলো। একরাত কাটানোর পরে ছেড়ে দিলো।
বাসায় ফিরে এসে দেখলাম বাবার কাশি বেড়ে গেছে। নিশ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে। দৌড়ে গেলাম ডাক্তার আনতে।
তুই তো জমির ডাক্তার কে চিনতিস।
সে এলো। ততক্ষণে সব শেষ।
বাবা চলে গেলো।
মনে হোলও আমার মাথার উপরের ছাউনী কে যেন সরিয়ে দিলো। এতদিন বাবার ছায়াতেই ছিলাম। যদিও বাবা কিছুই করছে না। তবুও সে যেন একটা বিরাট খুঁটি। ওটা ধরেই আমরা ঘুরছিলাম।
ঐদিন নিজেকে বড় অসহায় মনে হোলও।
আজ বলতে বাঁধা নেই, সেদিন তোর কথা অনেক মনে হয়েছিল। সান্ত্বনা পাবার জন্য।
দিন তো বসে থাকে না। তার নিজের নিয়মে সে চলবে। শোক কাটিয়ে আমিও বাসের স্টিয়ারিং হুইলে হাত দিলাম।
মাস পেড়িয়ে বছর এলো। মা প্রায় তাগীদা দেয়, বলে এবার বিয়ে কর। আমার তো বয়স হোলও। তোকে কারো হাতে দিয়ে গেলে আমি শান্তি পাবো।
ওসব কথায় কান দেইনি।
চলছিল ভালোই।
একদিন এক স্টপ থেকে উঠল এক মহিলা। দেখে মনে হোলও কোথায় যেন দেখেছি।
-তুমি কি ঘুমাতে আসবে? অনেক রাত হোলও। আলেয়া ধমকের সুরে জানালো রফিক কে।
-একটু পরে আসছি। বলে রফিক চিঠি টা পড়তে শুরু করলো।
মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে পিছনে যেয়ে বসলো। আমি আমার স্মৃতির পাতা উল্টাতে থাকলাম। খুজে পেলাম না। মহিলা দুই স্টপ পরে নেমে যাওয়ার আগে তাকাল, হাসল, নেমে গেলো।
পরের দিনও একই ঘটনা। এলো, হাসল, নেমে গেলো।
তৃতীয় দিন, বাসে আর কেউ নেই, তাই সাহস করে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাকে চেনা চেনা লাগছে।
নামতে যেয়ে ফিরে তাকাল, বলল, অনেক অনেক দিন আগে আমার স্বামী কে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন। মনে পরে? বলে নেমে গেলো।
কেন জানি ওর চেহারা টা আমি আমার মন থেকে মুছতে পারলাম না।
এরপর, প্রতিদিন ও ওঠে, নেমে যাওয়ার আগে এসে দাড়ায় দরজার কাছে। কথা হয়।
জানলাম, ওর স্বামী মারা গেছে। থাকে এই গ্রামে।
কোনদিন যদি দেখি সে আসেনি, মন টা বিগড়িয়ে যায়।
এর মাঝে একদিন ঘটলো এক মর্মান্তিক ঘটনা। প্রতিদিন সকালে মা আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেয়।
ঐ দিন মা এলো না। আমি ঘুম থেকে উঠে কোন সারা শব্দ পেলাম। বাহিরে এলাম। মা র ঘর বন্ধ।
আস্তে আস্তে দরজা তে ধাক্কা দিলাম। খুলে গেলো। দেখলাম মা শুয়ে আছে। মনে হোলও ঘুমাচ্ছে। কাছে যেয়ে গায়ে হাত দিতেই মনে হোলও মা র সারা শরীর ঠাণ্ডা।
পাশ ফেরাতেই হাত টা ঝুলে পড়লো।
মা চলে গেছে।
কতক্ষণ পাশে বসে কেঁদেছিলাম বলতে পারবো না।
আমি একেলা হয়ে গেলাম।
চার পাঁচ দিন পর কাজে ফিরে এলাম। সেই স্টপ, মহিলা উঠলো। নামার আগে পাশে এসে দাঁড়ালো, জিজ্ঞাসা করল, এতদিন কোথায় ছিলেন?
সব ঘটনা বললাম।
নামতে যেয়ে ফিরে তাকাল। বলল, কাল আমার ছুটি। এই মেঠো পথ ধরে গেলে মনিহরপুর গ্রাম। ওখানে আমি থাকি। চিনতে অসুবিধা হবে না। বিরাট একটা আম গাছ, তার পাশেই আমার কুড়ে ঘর।
ও নেমে গেলো।
পরদিন কাজ শেষে এলাম। মেঠো পথ ধরে পৌছালাম ওর কুড়ে ঘরে। মাটির তৈরী। শোয়ার ঘরের পাশে রান্না ঘর।
বসলাম ওর ঘরে। বলল, রাতে খেয়ে যেতে।
স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একদিন রাতে চলে এসেছিল এই খানে। বাসাটা ছিল ওর দূরসম্পর্কে এক খালার। অনেক দিন পর শুনেছিল ওর স্বামী মারা গেছে। কি ভাবে জানে না।
বলেছিল, বড় উৎপাত করে এখানকার ছেলেরা।
এর পর অনেক বার গিয়েছি ওর বাসায়।
কথা হয়। দুরত্ত বজায় রেখে বসি দুজনে।
এক সন্ধ্যায়, আসতে না আসতেই নামলো বৃষ্টি। বাহিরে আকাশ গজরাচ্ছে। ভিতরে আমি এর ও।
অন্ধকার হয়ে এলো।
হ্যারিকেন টা জ্বালিয়ে উপরে রাখল সে। সেই হ্যারিকেনের আলোটা পড়ল ওর মুখে।
আমি তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে।
শাড়ীর আঁচলটা ঠিক করল।
আমার ভিতরের পশুটা আস্তে আস্তে জেগে উঠল। আমি যেন তখন মানুষ নই, হিংস্র জানোয়ার।
আমি এগিয়ে গেলাম। ও পিছনে সরে গেলো।
আমি ওর হাতটা শক্ত করে ধরলাম।
ও ছাড়িয়ে নিতে চাইলো।
আমি ওর আচল টেনে নিচে নামিয়ে দিলাম।
ও বলে উঠল, না, না।
ও পারলো না। আমি ওর উপরে চেপে বসলাম।
ও কেঁদে কেঁদে বলল, এ কি করলেন আপনি।
আমি বাহিরে এসে দাঁড়ালাম বৃষ্টির মাঝে। মনে মনে বললাম, এ আমি কি করলাম।
দুদিন পরে ফিরে গেলাম ওর বাসায়। ইচ্ছে আমার, ওকে নিয়ে আসবো, ঘর বাধবো।
কিন্তু ঘর তালা মারা। জিজ্ঞাসা করালাম পাশের বাসার মহিলা কে। বলল, সে চলে গেছে এই গ্রাম ছেড়ে।
আর তার দেখা পাইনি। আমিও বাসা ছেড়ে দিয়ে ছোট্ট একটা ফ্লাটে উঠলাম।
বেশ কিছু বছর কেটে গেছে। আমারও বয়স বেড়েছে। প্রতিদিন আর বাস চালাই না। মাঝে মাঝে কাশতে কাশতে দম বন্ধ হয়ে আসে। ডাক্তার দেখিয়েছি। বলেছে, মরণ রোগ। চিকিৎসা করার মত টাকা পয়সা আমার নেই। কাজেই দিন গুনতে থাকলাম।
এমনি একদিন, সেই স্টপ থেকে এক মহিলা, বোরখা পরা, উঠতে যেয়ে দাড়িয়ে রইল, আমার হাতে এক টুকরা কাগজ দিয়ে দ্রুত নেমে গেলো।
আমি কাগজ টা খুললাম। লেখা, আপনার মেয়ে রহীমা এতীম খানায় আছে। ঠিকানা রইল। পারলে দেখতে যাবেন। আমি চললাম, সে আর আমার দেখা পাবেনা।
আমি দ্রুত বাস থেকে নেমে এলাম। কিন্তু মহিলা কে কোথাও দেখতে পেলাম না।
তারপর আমি গিয়েছি সেই এতিম খানায়। সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটার সাথে বসে গল্প করেছি। পরিচয় দেই নি। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ও জিজ্ঞাসা করতো, মা কবে আসবে?
ওকে আমার কাছে আনতে পারিনি। ভেবেছি আমার অবর্তমানে কে দেখবে ওকে?
আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে।
তাই তোকে লিখে যাচ্ছি। যদি পারিস আমার মেয়ে টা কে দেখিস। ও যেন এই পৃথিবীতে হারিয়ে না যায়।
আসি দোস্ত।
ক্ষমা করে দিস আমাকে।
মহি।
চিঠি শেষ। রফিক কাঁদছে।
কখন যে আলেয়া এসে পাশে দাঁড়িয়েছে জানতে পারেনি।
কাঁধে হাত রাখল আলেয়া। রফিক তাকালও ওর দিকে। চিঠি টা দিলো ওর হাতে।
বলল, তৈরী হয়ে নিও।
কাল সকালে যাবো তোমার মেয়ে কে আনতে।
–