থর থর করে কাঁপছে শম্ভু। কি সে জিনিস যা কিনা রাখতে হবে দরজার সামনে। শম্ভু কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। একবার ভাবল পুলিশের কাছে যাবে কিনা। না, তাতে আরও জড়িয়ে যাবে। পুলিশে ছুলে আঠারো ঘা।
তাহলে?
গাড়ীটা স্টার্ট দিলো। হাত কাঁপছে। হৃদপিণ্ডের কাঁপনি বেড়েই চলেছে। ভাবল ঐ নাম্বারে কল করে বলবে, সে কিছুই জানেনা। কি তারা চাইছে।
তারাই বা কারা। কাঁপা হাতে ফোনটা উঠালো। না, বলছে এই নাম্বার ঠিক নাম্বার নয়।
মনে পড়লো লম্বা ঐ লোকটার কথা। সে কি ঐ দলের লোক? ওর চেহারাটা দেখে গেলো লাইটার নেওয়ার ভান করে?
অনেক ভয়ার্ত ভাবনা মাথার মধ্যে ঘুরছে।
কি চাইছে তাঁরা? ওরা কি দেখেছে ছেলেটা ওর বাসায় ঢুকেছিল। তা নাহলে ওকেই বা টার্গেট করবে কেনও?
গাড়ীটা পার্ক করল শম্ভু। এবারও বেশ কয়েকটা বাড়ি পরে। স্ট্রীট লাইটের আলো। খুব উজ্জ্বল তাও নয়। এতদিন সে এসব নিয়ে চিন্তা করেনি। আজ মনে হোল আলোর চেয়ে অন্ধকার টাই বেশি। চারিদিকে তাকিয়ে দ্রুত হাটতে থাকলো।
ঘেউ ঘেউ করে পাশের বাসা থেকে একটা বিরাট কুকুর দৌড়ে এলো।
গেটে পা দিয়ে আঁচড়াতে থাকলো।
শম্ভুর মনে হোলও কুকুর টা এখনি লাফ দিয়ে ওর ঘাড়ে কামড় দেবে। কোন দিকে না তাকিয়ে দৌড় দিল শম্ভু।
হাপাতে হাপাতে এসে পৌছাল ওর বাসার দরজায়।
দরজা খুলতে যেয়ে মনে হোলও কে যেন দাড়িয়ে ওর পিছনে।
পিছন ফিরে তাকাতে পারছে না সে, আজ তার শেষ দিন, শম্পাকে কিছুই বলে যেতে পারবে না। লোকটা বোধহয় পিস্তল টা বের করেছে। এইবার গুলিটা বিঁধবে, বেড়িয়ে যাবে হৃদপিণ্ড কে ঝাঁজরা করে।
না, এখনো গুলিটা বেঁধে নি। একটু সাহস সঞ্চয় করে পিছনে তাকাল শম্ভু।
আলো আধার থেকে বেড়িয়ে এলো লোকটা। সুট পরা।
এই রাতে কে এই লোকটা? শম্ভু চিন্তা করে পেলো না। লোকটার চোখে মুখে হিংস্রতা নেই।
এগিয়ে এলো, হাত বাড়ীয়ে দিয়ে বললও, আমি ডেভিড ফক্স, ডিটেকটিভ। কিছু প্রশ্ন আছে।
ডিটেকটিভ শুনে শম্ভু মনে মনে ভাবল, ওকে শান্ত থাকতে হবে। ডিটেকটিভরা চোখ মুখ দেখেই বুঝে ফেলতে পারে ওর মনের কথা। মনে মনে ঠিক করল বলা যাবে না ছেলে টা এসেছিল ওর বাসাতে।
– এইখানে একটা খুন হয়েছে জানেন নিশ্চয়?
-হ্যাঁ, জানি। বলল শম্ভু।যত টুকু শান্ত থেকে বলা যায়।
-কোন গুলীর শব্দ বা গাড়ীর আওয়াজ শুনেছেন কি?
– না, ঘুমিয়ে ছিলাম।
– ও! ঠিক আছে, এই আমার কার্ড। কোন কিছু মনে পড়লে ফোন করতে ভুলবেন না। বলে কার্ড টা এগিয়ে দিল।
-সিওর। বলে কার্ড টা হাতে নিয়ে পকেটে রেখে দিল শম্ভু।
গুড নাইট বলে মিস্টার ফক্স যেতে যেয়ে আবার পিছন ফিরে তাকালও। কিছু বলতে যেয়ে, না বলে এগিয়ে গেলো গেটের দিকে।
দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেলো একটা কাগজ। কেউ দরজার ফাঁক দিয়ে ভিতরে ফেলেছে।
কোন কিছু লেখা নাই। শুধু একটা পাখির ছবি। মড়া। বেলী আপ।
সকালে হয়ে এলো। ঘুম আসেনি। উঠে পড়ল শম্ভু। কফিটা বানাতে দিয়ে, সাওয়ার নিতে গেলো। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। ওরা বলেছে বাসার সামনে জিনিস টা রাখতে। জিনিসই নাই, কি রাখবে সে।
শম্ভু কাজ করে একটা অ্যাডভারটাইজমেনট কোম্পানিতে। আজ একটা বড় ক্লায়েন্টর সাথে অ্যাপএন্টমেন্ট আছে।
এই অস্থির মন নিয়ে কতটুকু কি করতে পারবে বুঝতে পারছে না। অথচ এই কাজ টা যে করে হোক ধরতেই হবে।
ম্যানেজার তার উপর অনেক আশা করে আছে।
কফিটা নিয়ে জানালার কাছে বসল। বাহিরে তাকালও। আগন্তুক কাউকে দেখতে পেলো না।
সকাল নয় টা।
দরজাটা বন্ধ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো। গেটটা খুলে রাস্তায় নামলো। হেটে এলো গাড়ীটার কাছে। গাড়ীতে ঢুকে স্টার্ট দিতে যেয়ে চিৎকার করে উঠল। গাড়ীর কাঁচে উপর দুটো মরা পাখি।
মাথাটা ঝিমঝিম করছে। অফিসে ঢুকতেই ম্যানেজার অ্যান্ডারসন ঢেকে পাঠালও শম্ভুকে।
-Everything alright? You look like a — anyway. Hope you are going to get this son of a bitch. We need his advertisement.
-I will get it.
যদিও অনেক সাহস নিয়ে বলল, কিন্তু মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে অন্য কিছু।
মরা পাখি, লম্বা লোক, কালো গাড়ী।
SoonHo কোম্পানি ওকে আশ্বাস দিয়েছে। অ্যাডভারটাইজমেনটা দেবে মনে হয়। এই কাজ টা নিতে পারলে ওর একটা প্রোমোশন হওয়ার সম্ভবনা আছে। এই ভাবনাতে মাঝে মাঝে মন টা উৎফুল্ল হচ্ছে আবার মনে পড়ছে ঐ লোকটার কথা। আজ একটু আগেই বেড়িয়ে পড়ল অফিস থেকে। সোজা বাসা।
বাসার কাছেই আজ গাড়ীর পারকীং টা পেয়েছে শম্ভু।
গেটটা খুলে সিঁড়িতে পা দিয়ে মনে হোলও দরজাটা ঠিক মতো লাগানো না। একটু খোলা। মনে করার চেষ্টা করলো সে অফিসে যাওয়ার আগে বন্ধও করে ছিল কি না।
ভয়ে ভয়ে ধাক্কা দিলো। খুলে গেলো দরজাটা।
ঢুকতে যাওয়ার আগে চিন্তা করল, কেউ ভিতরে আছে কিনা। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকলো। ভয়ে সারা শরীর হীম হয়ে যাচ্ছে। সাহস সঞ্চয় করে এক পা ভিতরে দিলো শম্ভু। লিভিং রুমের চেয়ার পত্র চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। একটা চেয়ারের হাতল ভাঙ্গা। যেনও ঝড় বয়ে গেছে।
পা দিয়ে সরিয়ে আস্তে আস্তে শোয়ার ঘরে এলো সে। বিছানা টা ছুরি দিয়ে কেটে তছনছ করে গেছে।
শম্ভু বুঝতে পারলো না কি তাঁরা চায়। কি খুজছে।
একটা চেয়ার উঠিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো।
এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। অচেনা নাম্বার।
হ্যালো, বলতেই ভারী গলায় একজন বলল, খেলা করার জায়গা পাচ্ছনা। তোমার দিন ঘনিয়ে এসেছে। তোমাকে তিন ঘণ্টা সময় দিলাম। জিনিস টা কেন্ট আর লকাস্ট রোডের কর্নারে যে বাক্সটা আছে তার পাশে কালো ব্যাগের মধ্যে করে রেখে দেবে। নচেৎ তুমি শেষ। বিশ মিনিট পড়ে আমি আবার কল করবো।
লাইন কেটে গেলো।
শম্ভু কি করবে বুঝতে পারছে না। পেটের ভিতর কামড় দিচ্ছে। মনে হচ্ছে বমি করতে পারলে ভালো হতো। তিন ঘণ্টা মানে বিকেল ছয় টা।
মনে পড়লো ডিটেকটিভ ফক্সের কথা। ওকে না বললেই নয়। ও জড়িয়ে গেছে এক ভীষণ ফাদে।
কল করলো শম্ভু।
হ্যালো, মিস্টার ফক্সের গলা।
-আমি শম্ভু ঐ খুনের ব্যাপারে। কথা শেষ হওয়ার আগেই মিস্টার ফক্স বলল, আমি এখনি আসছি।
দশ মিনিটের মধ্যে মিস্টার ফক্স এলো। ঘরে ঢুকেই তাকালও চারিদিকে।
-তাহলে সেদিন তুমি আমাকে সব কথা বলোনি। কথা টা বলে এগিয়ে যেয়ে ফ্লোর থেকে পড়ে থাকা পেন্সিল টা উঠিয়ে নিলো।
শম্ভু বললও সেই রাতের কথা। বলল, এর বেশি সে কিছুঁই জানিনা। ছেলে টা এসেছিল, আবার দৌড়ে চলে গিয়েছিল, বলল, মরা পাখির কথা, বলল সেদিনের গাড়ী ফলো করার কথা।
তারপর আজকের এই ফোন কল।
-বিশ মিনিট পড়ে কল করবে বলেছে? জিজ্ঞাসা করল মিস্টার ফক্স
-হ্যাঁ
-ঠিক আছে, আমি ব্যবস্থা করছি। এখনো হাতে দুই ঘণ্টা সময় আছে।
দেখতে দেখতে কয়েকটা পুলিশের গাড়ী ওর বাসার সামনে এসে হাজির।
ঠিক বিশ মিনিট। ফোনটা বেজে উঠলো। মিস্টার ফক্স ইশারা করে বলল স্পীকারে দিতে।
-হ্যালো, কাঁপা কাঁপা স্বর শম্ভুর।
-পুলিশের সাহায্য নিলে দেখছ ছবিটা,এক একটা অঙ্গ কেটে পাঠাবো তোমার কাছে।
শম্ভু দেখল ম্যসেজে পাঠানো ছবি টা।
এতো শম্পার ছবি।
আঁতকে উঠলো শম্ভু।
মিস্টার ফক্স কাগজে লিখে ধরলও শম্ভুর সামনে। লেখা আছে ঠিক সময় মত আমি ওই টা রেখে আসবো।
আর কেউ থাকবে না।
-ঠিক পাঁচ টা তিরিশ মিনিট। ব্যাগ টা রেখে সোজা হেটে যাবে। পিছনে তাকাবে না। আমার লোক চারিদিকে। বলে ফোন টা কেটে দিলো।
শম্ভু কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, শম্পার কি হবে? আমি কিছুই ভাবতে পারছি না।
-শম্পা কে কল কর।
শম্পা ফোন ধরছে না। ভয়েস মেল।
মাথায় হাত দিয়ে পায়চারি করতে থাকল শম্ভু।
আবারও কল করলো শম্ভু। আবারও ভয়েস মেল।
কোথায় কাজ করে সে? জিজ্ঞাসা করলো মিস্টার ফক্স।
-এম এম জি ব্যাঙ্কে। ফীথ অ্যাভিনিউ এন্ড ২১ স্ট্রীট।
মিস্টার ফক্স কোথায় যেনও কল করলো।
-কালো ব্যাগ আছে? জিজ্ঞাসা করলো মিস্টার ফক্স
-আছে বলে নিয়ে এলো শম্ভু
মিস্টার ফক্স বলল এটা নিয়ে ঠিক ৫;৩০ মিনিটে ওই জায়গায় রাখবে। বাদ বাকি কাজ আমার।
এই সময় ফোন বেজে উঠলো মিস্টার ফক্সের।
-কি বললে সে বেড়িয়ে গেছে এক ঘণ্টা আগে? একজনের সাথে? মিস্টার ফক্স ফোনটা রেখে শম্ভুর দিকে তাকাল। শম্ভুর মুখ ফ্যাঁকাসে।
পাঁচ টা তিরিশ।
শম্ভু গাড়ী থেকে নেমে এলো। এগিয়ে গেলো। দেখল বড় একটা বাক্স পড়ে আছে। রাস্তার উল্টো দিকে একটা ভাঙ্গা বাড়ি।
নির্জন রাস্তা । পাশে একটা পার্ক মনে হোলও। গাছ পালায় ঢাকা। পারফেক্ট গেটওয়ে। মিস্টার ফক্স কি আরেঞ্জমেন্ট করেছে শম্ভু জানেনা। জানে এই ব্যাগে কিছু নাই, শুধু একটা ছেড়া কাপড়।
শম্পার খবর জানে না। সেকি ওদের হাতে? মাথায় এক বোঝা চিন্তা। এরপর কি হবে সে নিজেও জানেনা।
ব্যাগ টা রাখল।
পিছনে তাকানো নিষেধ। এক পা এগোতেই মনে হোলও কে যেন একটা জিনিষ ওর পিঠে ঠেকালও।
-সামনে এগিয়ে চলো। কে যেন বলল ওর কানের কাছে।
শম্ভুর মনে হোলও আজ এইখানেই শেষ। মিস্টার ফক্স কোথায়?
ঠিক সেই মুহূর্তে পার্কের ভিতর থেকে তিন জন বেড়িয়ে এলো। বুকে বুলেট প্রুফ ভেস্ট। দুজনের হাতে পিস্তল একজনের হাতে রাইফেল।
-স্টপ। ড্রপ দা গান। চিৎকার করে বলল একজন।
লোকটা শম্ভুর গলা আঁকড়িয়ে কুইক ঘুরে দাঁড়ালো। শম্ভুকে সামনে রেখে।
হাতের পিস্তল শম্ভুর মাথায় ধরা। ব্যাগ টা কাঁধে।
আস্তে আস্তে পিছিয়ে যাচ্ছে সে।
পুলিশ তিনজন এগিয়ে আসছে। মাঝ খানে শম্ভু।
লোকটা শম্ভু কে টেনে নিয়ে এলো পার্কের পাশে। বন জঙ্গলে ভরা।
হঠাৎ শম্ভুকে ধাক্কা দিয়ে সামনে ফেলে লোকটা দৌড়ে ঢুকে গেলো জঙ্গলের ভিতরে।
আর সেই মুহূর্তে গর্জে উঠলো পিস্তল আর রাইফেল গুলো।
জঙ্গলের ভিতর থেকে এক আর্তনাদ ভেসে এলো।
শম্ভু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকলো।
মিস্টার ফক্স শম্ভুর কাঁধে হাত রাখল।
শম্ভু তাকালও, মিস্টার ফক্সের পাশে শম্পা।
এই ঘটনার দশ পনেরো দিন পরে, প্রীসীলা এসেছে শম্ভুর ঘর পরিষ্কার করতে।
শম্ভু বসে বসে খেলা দেখছিল।
-মিস্টার! প্রীসীলা ডাক দিলো।
-হোয়াট? শম্ভু টিভির থেকে চোখ না সরিয়ে জিজ্ঞাসা করলো।
প্রীসীলা একটা ছোট্ট পার্স শম্ভুর হাতে দিয়ে বলল, এইটা তোমার লন্ড্রির ব্যাগের মধ্যে পেলাম। বলে সে অন্য কাজে লেগে গেলো।
শম্ভু তাকালও পার্সটার দিকে। আগে কখন দেখিনি।
জীপার টা আস্তে আস্তে খুললও।
ভিতরে জ্বলজ্বল করছে কতোগুলো হীরার টুকরা।
–