টুনি পাগলি

“এই টুনি তুই মেয়ে পেলি কনে”, চিৎকার করে বলতাম আর ওর পিছনে পিছনে হাঁটতাম।

আমার মতো তিন চার জন, বয়স ছয়, সাত। টুনি ওর মেয়েটাকে কোলে করে ফিরে চাইত আমাদের দিকে। চোখে আগুনের হল্কা। মাঝে মাঝে বলত,

-যা, তোদের মা কে যেয়ে জিজ্ঞাসা কর। 

কেন বলতাম, এর মানেই বা কি কিছুই বুঝতাম না। সবাই বলতো, আমরাও বলতাম।

বয়স টা যখন চোদ্দর কোঠায় পৌছাল তখন কথার মানে টা বুঝতে পারলাম, আমরা তখন আর ওর পিছনে যাই না। সেই জায়গায় এসেছে অন্য আরেক দল।

দেখতে দেখতে অনেক গুলো বছর পেড়িয়ে গেলো। আসা যাওয়ার পথে টুনি কে দেখি। আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। আমি লজ্জায় মুখ নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। ভাবি ওকি আমার সেই ছয় সাত বছরের চেহারা টা মনে রেখেছে?

 ছোট্ট শহর, সবাই তো সবাই কে চেনে। লজ্জাটা আমার সেই জন্য।  মেয়েটা এখন আর কোলে নেই, হাত ধরে হাটে।  

তারপর আমি এই শহর ছেড়ে চলে গেছি।

বহু দূরে।

অনেক দিন পর ফিরে এলাম দেশে। এলাম আমার সেই হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট শহরে। উঠলাম আমার এক বন্ধুর বাসায়। পিছনে ফেলে আসা দিন গুলো মনের পর্দাতে ভেসে উঠল। আলাপে আলাপে প্রসঙ্গ এলো টুনি পাগলির কথা।

-কোথায় সে? জিজ্ঞাসা করলাম।

-চলে গেছে এই ধরাধাম থেকে। বলল আমার বন্ধুটি।  

-ওর সেই মেয়েটা?

-আছে, এই তো দুই মাইল দূরে, থাকে সাকোর পাড় গ্রামে । বলল বন্ধু টি।

-যাওয়া যায় সেখানে? হঠাৎ প্রশ্ন করলাম আমি।

-যাওয়া যায়। তবে ওর বাসা আমি চিনি না। খোঁজ নিয়ে বের করতে হবে।

-ওঠ চল, আমি এখনি যাবো। বলে তাকালাম ওর দিকে।  

 কেনও জানি টুনির চেহারা টা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। রাগান্বিত নয়। অসম্মানে কুচকিয়ে যাওয়া চেহারা। যার জন্য দায়ি আমরা।

 ছোট বেলার অনেক স্মৃতি ভোলা যায়না। ফিরে ফিরে আসে। হয়ত আমার অবচেতন মনে ফেলে আসা টুনির চেহারা টা দাগ কেটে ছিল। ওর প্রসঙ্গ উঠতেই আমার মনে হোল ওর উপর যে অন্যায় আমরা করেছিলাম তার প্রায়শ্চিত্ত করতে যাবো আজ তার মেয়ের কাছে, বলব, আমি দুঃখিত।     

রিক্সা ডেকে উঠে পড়লাম আমরা দুজন। সাকোর পাড় গ্রামের ভিতরে রিক্সা যেতে পারলো না।

 পায়ে চলা পথ। নেমে পড়লাম।

 বন্ধুটি অনেক খোঁজ নিয়ে বের করলো বাসাটা। উঠানে দাড়িয়ে জোরে বলল, কেউ আছে বাসাতে?

 ওর গলার স্বর সব সময় উচুতে খেলা করে।

বেড়িয়ে এলো পাতলা গড়নের একটি মেয়ে। বয়স বোঝা যায় না। এক পেচে পড়া শাড়ী।

কাকে চাই? জিজ্ঞাসা তার।

তুমি কি টুনির মেয়ে? বন্ধুটির প্রশ্ন

-হাঁ। বলে অবাক দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে।

এবার আমি এগিয়ে গেলাম। বললাম, তোমার মাকে আমি চিনতাম। ছোট বেলায় খুবই খারাপ ব্যবহার করেছি তার সাথে। তাকে তো পেলাম না। বলতে পারো ক্ষমা চাইতেই এসেছিলাম। 

সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।

অবশেষে বলল, শুধু আপনি নয়, আমার মা কে অনেকেই খুব খারাপ কথা বলেছে রাস্তা ঘাটে। কোন কিছু না জেনে। আমি তখন ছোট বুঝতে পারিনি কি বলছে ওরা, আপনারা। 

কেন? বলতে পারেন, কেনও এতো খারাপ কথা বলতেন?

ওর প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারিনি। শুধু এই টুকুই মনে হোল , ওর মার কাছে আমি অপরাধী রয়ে গেলাম সাড়া জীবনের জন্য।

বললাম, তোমার মা থাকলে তার কাছে ক্ষমা চাইতাম, তা যখন হলনা পারলে তুমি ক্ষমা কর।

সে ঘরের ভিতর চলে গেলো, ফিরে এলো একটা মাদুর নিয়ে। পেতে দিয়ে বলল, বসেন, সব বলব আজ আপনাদের কে।

মা আমাকে সব বলে গেছে। সব ঘটনা। কেন মা কে বাড়ী থেকে বেড়িয়ে যেতে হয়ে ছিল।

শোনেন।

বলো। বলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

নানা  ছিল গাদনপুরের চেয়ারম্যান। প্রতিপত্তি ছিল। লোকে যেমন সামনে সম্মান করতো, পিছনে তেমনি ভেংচি কাটত। শত্রুর তার অভাব ছিলনা। গদী রাখতে হলে অনেক ভাল মন্দ লোক কে পুষতে হয়। নানাও পুষেছিল অনেক কে। ওই গদী টিকিয়ে রাখতে যেয়ে সে মা কে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক মদখোরের কাছে বিয়ে দেয়। নানী বাধা দিয়ে ছিল। কিন্তু পারেনি। মা ছিল নানার একমাত্র মেয়ে। এই গদীর লোভ বড় ভয়ঙ্কর। 

আমি ঐ মদখোরের মেয়ে।

কোন এক সময়ে নানার সাথে আমার বাপের টাকা পয়সা নিয়ে মনোমালিন্য হয়। নানা তার লোকজন দিয়ে চেম্বার থেকে বের করে দিয়েছিল ঐ মদখোর কে। 

এই বলে থামল সে।

আমি পিছন ফিরে চাইতেই দেখলাম লুঙ্গি পাঞ্জাবি পড়া একজন দাড়িয়ে।

টুনির মেয়ে বলল, আমার স্বামী। এখানকার পাঠশালাতে মাস্টারি করে।

এগিয়ে আসতেই আমার উঠে দাঁড়ালাম।

আমার নাম কছম আলী, এখানে কি ব্যাপারে?

কিছু বলার আগেই টুনির মেয়ে বিস্তারিত সব বলল।

কছম আলী শুধু একটা কথাই বলল, অনেক কাঁদিয়ে ছিলেন আমার শাশুড়িকে। বলে ঘরের ভিতর চলে গেলো।

আমরা বসলাম। কিছুক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই।

আমিই  মৌনতা ভাঙলাম, জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর?

 সেই সময় আমার মা অন্তঃসত্ত্বা। একদিন বাবা নানার উপর প্রতিশোধ নিতে যেয়ে  মা কে বের করে দিলো বাসা থেকে মিথ্যা দোষারোপ দিয়ে। অস্বীকার করলো আমার অস্তিত্ব। বলল সে আমার পিতা নয়।

বলেছিল, আমার মা কুলাঙ্গার।

মা এসে উঠল নানার বাসায়। কিন্তু সেখানে সে থাকতে পারলনা। আমার বাবা,  মার নামে মিথ্যে সব ঘটনা রটনা করতে থাকল। বিষিয়ে উঠল বাসার পরিবেশ।

এক রাতে মা এক কাপড়ে বেড়িয়ে পড়ল।  চলে এলো বহু দূরে। আশ্রয় নিলো  এক দুঃসম্পর্কের খালার বাসায়।

সেখানেই আমার জন্ম। বাবার কোন সন্ধান না থাকাতে লোকে মার নামে মিথ্যা অপবাদ দিতে থাকল। সেই অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে, ভিক্ষা করে মা আমাকে তিলেতিলে মানুষ করেছিল। 

আমার মা নষ্টা নয়। আমার কাছে আমার মা দেবী, আপনাদের মার মতই সেও একজন মা। সারা জীবন শুধু অপবাদই পেয়ে গেল।

এই বলে একটু থামতেই চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি বেড়িয়ে এলো। আমি আমার হাতের রুমাল টা এগিয়ে দিলাম।  

আমার বন্ধু উঠে উঠানের এককোণে যেয়ে দাড়িয়ে রইল।

জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার নানা খোঁজ নেই নি?

-না, জানিনা সে বেচে আছে কিনা। তিক্ততা মেশানো গলার স্বর। 

বললাম, আমি আবারও ক্ষমা চাইছি। ছোট বেলার ঐ খেলা বড় নিষ্ঠুর খেলা ছিল। আজ তা বুজতে পারছি।

বলে তাকালাম ওর দিকে।  সে চেয়ে রইল দূরে, দুর আকাশের কোনে।

আমার চোখের কোণটা যে ভেজেনি তা নয়।

উঠে দাঁড়ালাম।

সে শাড়ীর আচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘরের ভিতর চলে গেলো।

Continue Reading

আজ সেই দিন

       শফিক কেক টা এনে রাখল টেবিলের উপর। সুন্দর করে লেখা কেকের উপর ——।  

রাত বারোটার পরে কাটবে।

ঘরটা অন্ধকার করে দিল শফিক। ছোট্ট একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখল।

 কনা চোখ ধাঁধাঁ নো আলো পছন্দ করে না।

অন্ধকার ঘরে বসে শফিক কনার গায়ের গন্ধটা অনুভব করতে চাইল। ঐ গন্ধে মাদকতা ছিল। বলেছিল কনা কে।

-পারফিউম টার নাম কি? আলতো করে কনার থুতনিতে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করেছিল শফিক ।

– পারফিউম তো আমি ব্যাবহার করি না কখনো।

-তাহলে এই গন্ধ কিসের?

-আমি কি করে বলব বলও। বলে মিটমিট করে হেসেছিল কনা।

শফিক চোখটা বন্ধ করলো। অনেক পুরানো স্মৃতি মনে এলো।

সাদা শাড়ী, কালো পাড়ে ওকে মানায়। বলেছিল শফিক।

তখনো ওরা আংটি বদল করে নি।

আংটি বদলের দিন ওকে যে কি সুন্দরই না লাগছিল, সেইক্ষণে বলতে পারেনি। 

দুপাশে মেয়েদের দল। আর কনা বসে আছে মাথা নিচু করে।

আচ্ছা, শফিকের মনে হোলও, আজকাল তো বর কনে আর ওভাবে মাথা নিচু করে বসে থাকে না।

সময় পালটিয়ে গেছে।

কত কত বছর চলে গেছে পিছনে।

ও এলো, জীবনটা পূর্ণতায় ভরে গেলো।

দৈনন্দিন জীবনে কত না ঠোকাঠুকি লাগে। ভাংচুর হয়।

তাতো হলনা।

প্রতিটা দিনকে কিভাবে আনন্দময় করে তুলতে হয় তা জানা ছিল কনার।

নতুন দিনকে নতুন করে সাঁজা তো সে।

শফিকের মনে হোল ওকে নিয়ে ছাইভস্ম কিছু লিখেছিল সে।

এক রাতে রান্না ঘর ঘুচিয়ে যখন এলো, ওকে জড়িয়ে ধরে শফিক বলেছিল,

-তোমাকে একটা লেখা পড়ে শুনাবো।

-কার লেখা? 

-আমার।

-তোমার? বিয়ের আগে প্রেমপত্র লেখার পর আর কিছু লিখেছ বলে তো আমার মনে পড়ে না।

– লিখেছি তোমার রান্না করার সময় তোমার মুখটা দেখে।

-বাহ, আমাকে ছাড়, তা না হলে পড়ে শুনাবে কি ভাবে?

-তবে শোন। বলও হাসবে না?

-না, হাসবো না। কথা দিলাম।

“ছাত্রীহলের গেট দিয়ে যখন সে বেরিয়ে আসতো,   

পরনে সাদা শাড়ি কালো পাড়

বলতাম, তুমি এলে পাশের অন্যরা এতো ম্লান হয়ে যায় কেন?

সে বলত, এতো তোমার চোখে আমাকে দেখো তাই।

বলতাম, বিধাতা বুঝি একজনকেই বানিয়েছে এই ধরাধামে

এতো সুন্দর করে?

সে বলতো এতো তোমার চোখে আমাকে দেখো

বলতাম চশমাটা খুলবে কি?

বলত কেন ?

তোমার কাজলে আঁকা চোখটা দেখবো।

এতো সুন্দর করে কাজল দিয়ে আঁকো কি ভাবে?

বলত, এতো তোমার চোখে আমাকে দেখা।

বলতাম, তোমার হাসিতে মুক্ত ঝড়ে জানো কি তা তুমি ?

বলত, তাতো জানিনা, এ ঝরা শুধু তুমিই দেখো,

এতো তোমার চোখে আমাকে দেখা।

এই নিটোল হাতে টুং টাং চুড়ির শব্দ আর কারো কানে বাজে কি?

তুমি বলতে, বাজে, তুমি শুনতে পাওনা।

তুমিতো দেখো আমার হাতটা তোমার চোখে।

যখন তুমি বেণী বেঁধে আস্তে পায়ে আসতে,

আর আমি চোখ ভরে তাকিয়ে থাকতাম,

সে দুটো বেণী আবার বাঁধবে কি?

বলত না, ওটা থাক তোমার মনের ভেতর গাঁথা,

যে চোখ দিয়ে সেদিন তুমি আমাকে দেখেছিলে।

তুমি জানো, টিপ পরলে তোমাকে কত সুন্দর দেখায়?

বলত, তাই কি? এতো তোমার চোখে আমাকে দেখা।

আচ্ছা বলো তো তোমার নাকফুলটা এতো জ্বলজ্বল করে কেন ?

বলত, তাতো জানিনা?

আমি বলতাম ওটা নাকফুলের বাহাদুরি নয়, সৌন্দয ঐ সুন্দর নাকটার

যেখানে ওটা শোভা পাচ্ছে।

বলতাম চলো হেঁটে আসি,

বলত, কেন?

দেখবো তোমার পায়ে চলার পথে কাঠবিড়ালিটা থমকে দাড়ায় কিনা?

বলত, কি আবোল তাবোল বকো।

বলতাম তুমি যখন রান্না করো আগুনের তাপে লাল হয়ে আসা তোমার

মুখটা কি অপূর্ব লাগে তা কি তুমি জানো?”

এই পর্যন্ত লিখেছি। বলেছিল শফিক ।  

-বাহ, অপূর্ব। শেষে এই কথা টি যোগ কর,

তোমার হাতেই যেনও শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে পারি।

ঢং করে বড় ঘড়িটাতে শব্দ হোলও।

রাত বারটা।

শফিক চোখ মেলে চাইল।  

মোমবাতিটা পুড়ে পুড়ে শেষের পথে।

সে এসে দাঁড়াল কেক টার কাছে।

আজ ছাব্বিশে অক্টোবর।

পঁয়তাল্লিশ বছর আগে এই দিনে ওরা আংটি বদল করেছিল।

ঝাপসা চোখে শফিক তাকাল চারিধারে।

মোমবাতি নিভে গেলো, রইল শুধু অন্ধকার।  

Continue Reading

দায়ী কে?

  -না, ছুয়োনা আমাকে। লালা ডগডগে চোখে ধমকের সুরে বলল আসমা।

আবু দুই পা এগিয়ে যেয়ে আবার পিছিয়ে এলো। এমন যে আগে বলেনি তা নয়। প্রায় প্রতিদিনই অফিসে যাওয়ার আগে এমন হয়। ঔষধ গুলো খাওয়াতে গেলে ছুড়ে ফেলে দেয়।

-ঐ ছাই ভস্ম কেনও আনো আমার সামনে? বলেছি না আমি খাবনা। বলে দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকে।

আবুর কোন কথা শুনতে চায় না আসমা। আবুকে কেনও জানি সহ্য করতে পারে না।

অনু কে ডাক দিলো আবু।

আঠারো উনিশ বছরের মেয়ে। মামা মামী বলে ডাকে আবু আর আসমা কে। বন্ধু আনিসের বাসাতে কাজ করতো। বিয়ে হওয়ার পরে চলে গিয়েছিল স্বামীর সাথে। বিয়েটা টেকে নি। বৌ পেটানও স্বামী। ওকে ছেড়ে চলে এসেছিল আবার আনিসের বাসাতে। বলেছিল, মামা জাগা হবে তোমার এখানে? দরকার ছিলনা আনিসের। তবুও বলেছিল, থাক কয়দিন, এর মধ্যে একটা ব্যবস্থা হবে তোর।  আর ঠিক সেই মুহূর্তে আবুর কল এসেছিল।

তাও তো একবছর হয়ে গেলো অনু দেখা শোনা করে। ঘরের কাজ পুরো টাই তার হাতে। সকালে নাস্তা দেওয়া থেকে আরম্ভ করে রাতের খাওয়া পর্যন্ত। আবু আসমা বেড়িয়ে যেতো কাজে। ফিরে এলে চা বিস্কিট এগিয়ে দিতো।

আসমার সাথে এক নিবির বন্ধন সৃস্টি হোলও। ওর কথা শোনে আসমা।

-মামী এসো, তোমার চুলটা আঁচড়িয়ে দেই। বলে আবুকে ইশারা করে চলে যেতে বলল।

আবু এসে দাঁড়ালো ব্যালকনি তে। ধোয়াটে চারিদিক। তার ভেতর দিয়ে সূর্যের এলো এসে পড়েছে সামনের টবে রাখা ফুল গাছ গুলোর উপর।

আজ রোববার।

 নিচের রাস্তায় গাড়ীর সংখ্যা কম। তবুও প্যে পু শব্দ শোনা যাচ্ছে। দুরে এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ। রাস্তায় লাইট পোস্টের তারের উপর বসা অনেক গুলো কাক হঠাৎ করে কা কা করে উড়ে গেলো। ওরা খুজে বেড়াচ্ছে আবর্জনা।

আসমার পছন্দে কেনা এই ফ্লাট।

বিয়ের পরে ভাড়া বাড়ীতে ছিল বেশ কয়েক বছর। প্রতিদিন কিছু না কিছু সমস্যা লেগেই ছিল। বাড়িওয়ালাকে বললে একই উত্তর। অসুবিধা হলে অন্য বাসা দেখতে পারেন। আবুর মনে হয় আসমা ওর ঘরের লক্ষ্মী।

ও জীবনে আসার পর তড়তড় করে একটার পর একটা উন্নতি। এই ফ্লাটটা, তাও তো ওরই জন্য। তা না হলে সেদিন বসুন্ধরা মলে তার যাওয়ার কথা নয়।

আসমা বলেছিল, চলো মলে যাই, একটু কেনাকাটা আছে।

-না, আজ থাক। বলেছিল আবু।

-প্লীজ, চলো না। গলা জড়িয়ে ধরে আবদার করেছিল আসমা।

অগত্যা রাজি হোলও , একটা বেবী ট্যাক্সি ডেকে এসে নামলো বসুন্ধরা মলে।

আর ঠিক সেই দিনে, সেই ক্ষণে দেখা হয়েছিল আকমলের সাথে।

 কাঁধের উপর হাত পড়তেই চমকে পিছনে তাকিয়ে ছিল আবু,

-কি রে চিনতে পারছিস?

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, বলল, আকমল না?

-চিনতে পেরেছিস তাহলে। আকমল কথা শেষ করে তাকাল আসমার দিকে।

-ওহ পরিচয় করিয়ে দেই। আমার অর্ধাঙ্গিনী। আসমা।

-সালাম, ভাবী, এই হতচ্ছাড়ার সাথে একই কলেজে পড়াশুনা করেছি। কলেজ শেষে ও চলে গেলো ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আর আমি চলে এলাম ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে । বলে হেসে উঠল আকমল।

-তা আছিস কোথায়? কি করছিস? জিজ্ঞাসা করলো আবু।

-এই তো বাড়ি ঘর বানাই, আর বিক্রি করি। হাসতে হাসতে বললও আকমল।

-তার মানে রিয়েলস্টেটের ব্যাপসা।

-বলতে পারিস। তা তুই আছিস কোথায়?

-কাজ না বাসার কথা বলছিস। প্রশ্ন ছিল আবুর।

-দুটোই।

-চাকরি করি একটা ফার্মে। আর থাকি শান্তিনগরে।

-শোন, এই আমার বিজনেস কার্ড। সময় করে কল দিস। গল্প করা যাবে।

আকমল চলে গেলো দরজা পেড়িয়ে। ওরাও এসে ঢুকল এক শাড়ীর দোকানে।

-কেমন আছেন আকমল ভাই? অনেক দিন পরে আসলেন। আসফু জিজ্ঞাসা করলো। দোকানের কর্মচারী।  ওর কাছ থেকেই বিয়ের সব শাড়ীগুলো কিনেছিল। তাও তো আজ অনেক বছর আগের কথা। মাঝে মধ্যে আকমল আর আসমা আসে, আসফুই ওদের কে দেখাশোনা করে।

বাসায় ফিরে এসে আসমা বলেছিল, তোমার ঐ বন্ধুকে বলও না একটা এপার্টমেন্টের কথা।

-ভাড়া নেবে নাকি কিনবে? উৎসুক নয়নে আসমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল আবু।

-দেখাই যাক না। জিজ্ঞাসা করতে তো কোন ক্ষতি নেই।

তিন চার দিন পর আবু কল দিয়েছিল আকমল কে। গুলশানের এক নম্বরে ওর বাসা।

বলেছিল, চলে আয়। ডিনার করব এক সাথে।

সাত তালায় ওর ফ্লাট। ফ্লাট নয়, স্যুইট। সুন্দর করে সাজানো। আকমলের রুচি আছে। ঘরের চারিদিকে চোখ দিলেই বোঝা যায়। লিভিং রুমের এক পাশে বেশ বড় অ্যাকোয়ারিয়াম। লাল নীল মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে।

-বল কি খাবি এই মুহূর্তে। ঠাণ্ডা না গরম।

-হার্ড কোর ড্রিংকসের কথা বলছিস? আবু জানতে চাইল।

– তা যেটা তুই চাস। চা, কফি, লাল পানি। হাসতে হাসতে আকমল তাকালও আসমার দিকে।

-কফি চলবে। উত্তরে বলল আবু।

-ভাবী আপনার জন্য-?

– কফিতে আপত্তি নেই। একটু চুপ করে আসমা বললও, এই বাসাতে আপনি একলা থাকেন?

-বাহ, অসাধারন, সরাসরি বৌ আছে কিনা জিজ্ঞাসা না করে কি সুন্দর জানতে চাইলেন। না, নেই। আমি একেলা।

ছিল এক সময় কিন্তু কপালে টিকলো না। কলীম বলে একজন আছে আমার ড্রাইভার সেই বাজার ঘাট করে দিয়ে যায় আর পেয়ারার মা, রান্না করে।

আসমা আর কথা বাড়াল না। শুধু উসখুস করতে লাগল কখন আবু কথা টা পারবে।

খাওয়ার টেবিলে আবু জিজ্ঞাসা করলো, কোন ফ্লাট আছে কিনা ভাড়া বা কেনার জন্য।

-আছে, তবেঁ একটা সমস্যা আছে।

-কি? অতি দ্রুত জানতে চাইল আসমা।

-এক ভদ্রলোক বায়না দিয়েছে, তারপর তার আর কোন পাত্তা নেই। এক সপ্তাহ পরে ওর বায়নার মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে। যদি সে না কেনে তা হলে তোকে দিতে পারবো। অবশ্য যদি তোদের পছন্দ হয়। ফ্লাটটা এই বিল্ডিংএর পাঁচ তালায়।

যদি চাস তবে খাওয়ার পরে দেখাতে পারব বলে পেয়ারার মা কে ডাক দিল।

-কি রকম দাম হতে পারে আকমল ভাই। আসমা জিজ্ঞাসা করল।

-তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আগে দেখেন।

পছন্দ হয়ে ছিল আসমার। আকমল বন্ধুর বন্ধুত্ত রক্ষা করেছিল। আবু আসমা কিনতে পেরেছিল ফ্লাট টা।

-মামা তাড়াতাড়ি আসেন। ভয়ার্ত স্বরে ডাক দিল অনু।

-কি হয়েছে?

-মামী যেনও কেমন করছে।

আসমা জানালার শিক ধরে ঝাঁকি দিচ্ছে। চোখ মুখে ঘৃনা আর বিদ্বেষের ছাপ। চিৎকার করছে আর বলছে, ওরা আসবে, ওরা আবার আসবে।

-না কেউ আসবে না, আমি তো আছি তোমার কাছে। আসমা কে জড়িয়ে ধরতে চাইল আবু।

ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিল ওর হাত।

-তুমি কিচ্ছু করতে পারবে না। বলে ঘরের কোণে যেয়ে বসে রইল।

আবু তাড়াতাড়ি ডাক্তার কে কল দিলো। ওরই বন্ধু।

পরিমল এলো সন্ধ্যায়। তখন আসমা ঘুমাচ্ছে। প্রথম থেকেই আসমা পরিমলের চিকিৎসাধীন আছে। ঘুমিয়ে আছে তবু যেনও চেহারাতে ভয়ের ছাপ।

ওরা দুজন এসে বসল ব্যালকনি তে।।

-কি মনে হয় তোর? জিজ্ঞাসা করল আবু।

-ওর মনের ভিতরের জট টা না ছুটানো পর্যন্ত কিছু হবে বলে মনে হয় না। না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আরও হিংস্রতা বাড়ছে। বাসাতে না রেখে অন্য কোথাও দিতে চাস। পরিমল জানতে চাইল।

-তার মানে তুই বলতে চাস পাগলা গারদে।

-ও ভাবে বলছিস কেন? তুই একা সামলাতে পারবি? তোকে তো কাজেও যেতে হয়।

-তা হয়, তবুও আমার সামনে ওকে রাখতে চাই। চোখের সামনে, দুরে নয়।  

বলে দুরে তাকিয়ে থাকল আবু।

-কি ভাবছিস? পরিমল জানতে চাইল।

– মনে পরে কি, তোর বিয়েতেই আসমা কে প্রথম দেখেছিলাম।

-পরে বৈকি। তুই আমার পাশে এসে জিজ্ঞাসা করেছিলি, আমার বৌ এর পাশে ঐ মেয়ে টা কে?

পরে আমার বৌ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ওর বান্ধবীর সাথে,

– হু, তারপর ছয়মাস যেতে না যেতেই ওকে ঘরে উঠিয়ে এনেছিলাম। তারপর প্রতিটি মুহূর্ত এক সাথে কাটিয়েছি। আস্তে আস্তে পনেরো টা বছর পাড় করে দিয়েছি। ঘরে আর কেউ এলো না বলে মন খারাপ করিনি। তুই কি মনে করিস ওটা একটা কারন?

-না সেটা কারন নয়। কারন যে কোন টা তা তুই ও জানিস আমি ও জানি। বলে থামলো পরিমল।

দুজনেই চুপ।

পরিমল নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলও। বলল, ঘুমের ঔষধ টা বাড়ীয়ে দিচ্ছি। সময় করে আনিয়ে রাখিস।

ওকে বিদায় দিয়ে আবু আবারও এসে বসল ব্যালকনিতে।
 তাকালও রাস্তার দিকে, নিঃসঙ্গ একটা লোক একাকী পথে হেঁটে চলেছে। আবুর মনে হোলও ও  ঐ  লোকটির মত, নিঃসঙ্গ।

না, সে নিঃসঙ্গ ছিল না। সপ্তাহে দুই তিন দিন বাহিরে যেতো ডিনার করতে। আবু নিজেই গাড়ী চালাত। আসমার ডান হাতের আঙ্গুল গুলো আবুর চুলে বিলি কাটত।

 ডিনার শেষে এসে বসত নির্জন কোথাও, মনে হতো তাঁরা নতুন করে প্রেম করছে।

তারপর সেই রাত টা। গাড়ীর আলোতে দেখতে পেলো সামনে দাঁড়ানো—–

না,না,না চিৎকার করে উঠল আবু।

-কি হয়েছে মামা। দৌড়ে এলো অনু।  

– না কিছু না, তুই যা। কপালটা ঘেমে গেছে।

চোখ সরিয়ে নিলো রাস্তা থেকে।

-মামা, খাবার দিয়েছি টেবিলে, আসেন। বলল অনু।

অনু থাকে আসমার ঘরে। আবু পাশের রুমে। দরজাটা খুলে রাখে। যাতে কোন শব্দ হলে শুনতে পায়। ঘুম আসে না চোখে।

যদিও বা আসে দেখে হিংস্র দানবদের স্বপ্ন। ওরা তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে। কেউ ওদেরকে বাঁধা দেয় না। বাঁধা দেবার কেউ নেই। ওরা তা জানে। আর জানে বলেই ওদের এই তান্ডপ নৃত্য।  

বেশ কিছুদিন ধরে আসমা কে একটু শান্ত দেখাচ্ছে। আগের মত ঔষধ গুলো ছুড়ে ফেলছে না। অনু যা বলে তাই শুনছে। আবু কে দেখলে চিৎকার করছে না। একি ভালো হয়ে যাওয়ার পূর্ব লক্ষন।

অফিসে যাওয়ার আগে পরিমল কে কল দিল আবু।

-মনে হচ্ছে ঔষধ গুলো কাজ দিচ্ছে।

-মানে? জিজ্ঞাসা করলো পরিমল।

– আসমা এখন অনেক শান্ত । দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললও আবু।

-হু, চুপ করে রইল পরিমল, মনে হোলও কিছু ভাবছে সে।

-কিরে চিকিৎসা সার্থক শুনেও আনন্দ পাচ্ছিস না? 

-না, মানে, ঠিক আছে আমি দুই একদিনের মাঝে আসব দেখতে। ওর ঔষধ পত্র গুলো কোথায় থাকে?

-কেন?

– জানতে চাইছি।

-অনুর কাছে, কেন? জিজ্ঞাসা করল আবু।

– না এমনি।

কথা শেষে আবু বেড়িয়ে গেলো।

অনু দরজাটা বন্ধ করে দিলো।

দুদিন পর। আবু বের হয়ে যাওয়ার আগে আসমা ডাক দিলো পিছন থেকে।

সচরাচর এমন হয়না।

আবু ঘাড় ফিরিয়ে তাকালও আসমার দিকে।

-কিছু বলবে?

-তোমার কি আসতে দেরী হবে আজ।

-না, কেনও, কিছু লাগবে। জিজ্ঞাসা করলো আবু। একটু অবাক হোলও, চেহারায় সেই ভাব আসতে দিলো না।

-না, এমনি। বলে ওর ঘরের দরজাটা ভিজিয়ে দিলো।

তখন বাজে দুপুর একটা। আবু ব্যাস্ত কাজ নিয়ে।

অনুর কল।

-মামা, আপনি তাড়াতাড়ি বাসায় আসেন। কান্না কান্না স্বরে অনু বলল।

-কেন? কি হয়েছে? উৎকণ্ঠা আবুর কণ্ঠে।

-আমি দরজায় ধাক্কা দিচ্ছি কিন্তু মামি দরজা খুলছে না। তাড়াতাড়ি আসেন, কাঁদতে কাঁদতে বলল অনু।

আবু বেড়িয়ে এলো অফিস থেকে। কি ভাবে গাড়ী চালিয়েছিল সে নিজেও জানে না।

অনু দরজার সামনে বসে কাঁদছে।

আবু পকেট থেকে চাবি টা বের করলো।

হাত কাঁপছে।

দরজাটা খুলল।

আসমার নিষ্প্রাণ দেহটা ঝুলছে ফ্যানের সাথে।

লোকজন এলো, এলো আকমল, এলো পরিমল । ওরা আবুকে নিয়ে বসাল ব্যালকনি তে।

আবু তাকাল ওদের দিকে। রক্তশূন্য মুখমণ্ডল।

শুধু একটা প্রশ্ন জানতে চাইল সে,

– যারা ওকে সেই রাতে টেনে হেঁচড়ে গাড়ী থেকে নামিয়ে নিয়েছিল, তাঁরা আজও কেনও হেসে খেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বল, কেন? কেন?   

Continue Reading