চলে গেছে কত প্রিয়জন
শমিতের আজ বারবার মনে হচ্ছে মাইকেল মধুসুদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যের সেই লাইন- ‘এ মোর সুন্দরী পুরী! কিন্তু একে একে শুখাইছে ফুল এবে, নিবিছে দেউটি’
“ জম্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে” মাইকেল মধুসুদন দত্তের এ লাইনটির মতোই জীবন।
উনিশ শো পঞ্চাশ থেকে দুই হাজার বিশ সাল। সত্বর টা বছর। পিছনে চলে গেলো।
শমিত তার লিভিং রুমে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল বাহিরের দিকে।
চব্বিশ বছর বয়সে এসে ছিল এই দেশে।
সময় টা বড় দ্রুত চলে গেলো। চোখের পলকে।
সেই মুহূর্তে বাহিরে হলুদ হয়ে যাওয়া গাছের পাতা গুলো দুলছিল বাতাসে। যে কোনো মুহূর্তে ঝরে পড়বে।
দুরের আকাশটা লাল।
সূর্য ডুবছে।
হলুদ হয়ে যাওয়া পাতা গুলোর দিকে তাকিয়ে শমিত ভাবছিল এই পাতার মত সেও ঝরে পড়বে একদিন।
অনেকেই তো ঝরে পড়েছে। কোথায় আজ তামান্না ভাবী, কোথায় আজ শান্তি ভাবী, নেই কাছে লুতফুল, নেই আজ হাকিম।
প্রিয় বন্ধু মইন গিয়েছিল দেশে, ফেরে নি সেখান থেকে।
নিজের প্রিয় সঙ্গীটিই তো ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো।
ছিল ব্যাচেলার। ধীরে ধীরে সবাই নিয়ে এলো সঙ্গিনী। বাসা নিলো কাছাকাছি। দেখা হতো প্রতি সপ্তাহে।
ধুমধাম করে হতো বিবাহ বার্ষিকী।
শমিতের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে এসেছিল অনেকে। বন্ধু বান্ধব ছাড়া এসেছিল বড় ভাইয়েরা। রানু ভাবী অনেক কিছু করে দিয়েছিল।
এক টুকরো জায়গায় কারো বসতে অসুবিধা হয়নি।
তামান্না ভাবী শমিতের বৌ কে বলেছিল, রোস্ট টা আমি বানিয়ে দেবো।
না করেনি, সামন্তী।
রানু ভাবী করেছিল খাসীর বিরয়ানী।
কি আনন্দ না হয়েছিল ওই দিন। সেই সময় বেশির ভাগ বন্ধুরাই ছিল ব্যাচেলার।
হাতে হাতে সবাই গুছিয়ে দিয়েছিল সব কিছু।
এঁকে এঁকে এলো সবার অর্ধাঙ্গিনী। আজ এবাড়ি, কাল ও বাড়ি তে আড্ডা লেগেই থাক তো। সবাই মিলে চলে যেতো দুরে।
বিবাহ বার্ষিকীর পালা শেষ করে এলো সবার কোল জুড়ে ছোট্ট শিশু।
আরম্ভ হোল জন্মদিন করা।
বাচ্চারা আনন্দে ছুটাছুটি করতো। মহা আনন্দ তাদের।
সেই ছোট ছোট শিশু গুলো এঁকে এঁকে বড় হয়ে গেলো। সবাই ব্যাস্ত ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে। ওদের কে মানুষ করে দিয়ে যেতে হবে।
দুই এক বন্ধু বাড়ি কিনে দুরে চলে গেলো। তাই বলে যে আসা যাওয়া বন্ধ হোল তা নয়। বরং আরও মজা হোল। রাত টা কাটাতও সবাই ওই বাড়ীতে। বন্ধুরা মিলে তাস খেলাতো। অল্প পয়সা দিয়ে।
ভাবীরা কি নিয়ে গল্প করতো কে জানে।
শমিত জিজ্ঞাসা করেছিল সামন্তী কে। তোমরা কি নিয়ে গল্প কর।
হেসে বলেছিল, তোমাকে বলব কেনও? ওসব মেয়েলি কথা।
কোথায় গেলো সেই দিনগুলো।
শমিতের মনে পড়লো সেই দিনটার কথা। কাজ থেকে এলো। সামন্তী টেবিলে খাবার দিলো।
শমিতের মনে হোল সামন্তী অন্যদিনের মতো আজ যেনও কথা কম বলছে।
ভাত টা মুখে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল
-কি ব্যাপার? তোমার শরীর ভালো তো?
-আমি ভালো। তুমি কি কিছু শুনেছ?
-কি শুনব? বলে আর একবার হাতটা মুখের কাছে নিতে যেয়ে নামিয়ে রাখল। কোথায় যেনও একটা অশুভ সংকেত।
-পলি ভাবী কল করেছিল। বলে থামল সামন্তী।
-কি বলেছে? একটু তাড়াতাড়ি বলও। ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠল শমিত।
-পলি ভাবীর ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়েছে।
-কি বলছ? উনি তো প্রেগন্যান্ট? বলে পানির গ্লাসটা হাতে নিলো শমিত।
-হ্যাঁ, চেক আপ করতে যেয়ে ধরা পড়েছে।
-তাহলে কি হবে? তরুন তো কিছু বললও না আমাকে। গতকালই তো ওর সাথে কথা হয়েছিল। বলে থামল শমিত।
-ভাবীই কল করে বললও। বলল, এই মুহূর্তে ওরা কিছু করবে না। বাচ্চা হওয়ার পরে যা করার করবে। জানো, ভাবী খুব ভেঙ্গে পড়েছে। তুমি একবার তরুন ভাই কে কল করো।
শমিত কল করেছিল। কি বলে সান্ত্বনা দেবে ? তবুও বলেছিল অনেক ভালো ভালো কথা। শমিত জানে এসব কথা শুধু সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। তরুন কে বলেছিল যেকোন দরকারে আমাকে কল করিস।
তরুন কান্না ভিজানো গলায় বলেছিল, ঠিক আছে।
শমিত উঠে জানালাটা বন্ধ করে দিলো। ঝাপটা বাতাস ঘরটা ঠাণ্ডা করে দিচ্ছে। ঘরের আলো টা জ্বালিয়ে দিলো।
আস্তে আস্তে এলো ছোট্ট ঘরটাতে। যেখানে রয়েছে শমিতের সব এ্যালবাম গুলো।
ফটো উঠানো ছিল শমিতের হবি। সব বন্ধু, ভাবীরা তা জানতো।
কোথাও গেলে তার উপরেই ভার পড়তো ছবি উঠানোর।
একটা এ্যালবাম টেনে বের করলো। এসে বসলো সোফাতে। এক একটা ছবি যেনও জীবন্ত মনে হলে। চল্লিশ বছর আগে তোলা। আছে পিকনিকের ছবি। আছে বাচ্চা দের জন্মদিনের।
এই তো এই ছবিটা, ওয়াশিংটন ডিসিতে বেড়াতে গিয়েছিল। তরুন তখন ওখানে থাকে। ওদের বাসাতে উঠেছিল।
বিকেলে এসে বসেছিল ওয়াশিংটন মেমোরিয়ালের নিচে। পলি ভাবী বসে আছে সামন্তীর পাশে।
মনের জোড় ছিল পলি ভাবীর। প্রত্যেক টা পার্টিতে আসতো তা সে যতো অসুস্থই থাক না কেনও। পোর্টেবল অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে শেষ এসেছিল থ্যাংকস গিভিং পার্টিতে।
পলি ভাবী চলে যাওয়ার কয়েক দিন পরে এলো আরও এক মহা দুঃসংবাদ। শমিত ছিল কাজে। ব্যাস্তই ছিল সেদিন। সানার কলটা প্রথমে ধরবে না ঠিক করেছিল। কি মনে করে ধরলও।
ধরেই বলল, আমি একটু ব্যাস্ত আছি, তরে পরে কল করছি।
-শোন, এক সেকেন্ড। লুতফুল গাড়ী এক্সিডেন্টে মারা গেছে।
-কি বলছিস? ফোনটা আর রাখা হোল না শমিতের। গতকাল রাতে সে আমাকে কল করেছিল। বলল, শমিত। তোকে আমি দুই মিনিট পরে কল করছি। বলে হাতের কাজ গুলো তাড়াতাড়ি সাড়ার চেষ্টা করল শমিত।
কাজ শেষে সেদিন আর বাসাতে যাওয়া হয়নি শমিতের। সামন্তীকে বলেছিল লুতফুলের বাসাতে আসতে।
শমিত এসে দেখল অনেক বন্ধুরা এসে গেছে। সামন্তী আর অন্যান্য ভাবীরা এক পাশে বসা। সবাই কাঁদছে। কাঁদছে অনীকা ভাবী। কে তাকে সান্ত্বনা দেবে। কি সান্ত্বনাই বা দেবে তাকে। বাচ্চা গুলো বসে আছে মাথা নিচু করে। বড় মেয়েটা শমিতের মেয়ের সমান। ওরা গলায় গলায় বন্ধু। ছোট বেলার থেকে একসাথে বড় হয়েছে।
চলে গেলো। অকালেই এই ধরাধাম ত্যাগ করল সে।
প্রিয় শান্তি আপাও যে চলে যাবে তা কি সামন্তী ভাবতে পেরেছিল? ইউনিভারসিটিতে থাকা কালিন একই হলে থাকতো। সেই সুবাদে আপা বলে ডাকতো। শমিতের বন্ধুর সাথে বিয়ে হয়েছিল। এখানে এসেও একই বিল্ডিংএ ছিল অনেক দিন। কাজে যেতো একসাথে। মাঝে মাঝে এটা ওটা রান্না করে দিয়ে যেতো। ঘন্টার ওর ঘণ্টা ওদের ঘরে নচেৎ শমিতেদের ঘরে আড্ডা চলতো।
সেও একদিন এসে সামন্তীকে বলল, আমার বোধহয় সময় হলো যাওয়ার। রাজরোগ ধরা পড়েছে।
সেদিন কি কান্নাই না কেঁদেছিল সামন্তী। অনেক যুদ্ধ করেছিল সামন্তীর শান্তি আপা সেই রাজরোগের সাথে। কিন্তু পারলো না। অবশেষে পরাজয় মেনে নিতে হোল।
শমিতের এ্যালবামের পাতায় পাতায় অনেক ছবি।
বহুকাল আগের। যার যার বৌ এর পিছনে সে সে দাঁড়ানো।
শমিত দেখল তাকিয়ে। এর মাঝে অনেকেই আজ আর নেই। চলে গেছে কোন না কোন ভাবে।
সে নিজে ও আজ একা।
দেখা হয় মাঝে মধ্যে বন্ধুদের সাথে। অনেকে বাসা কিনে চলে গেছে দুরে। আগের মত আর যাওয়া আসা নেই।
সবার ছেলে মেয়েরা বিয়ে শাদী করে যার যার মত আছে। কেউ কাছে কেউ বা দুরে। এটাই তো নিয়ম।
একদিন শমিত বলেছিল মুস্তাক কে, দুরে গেলি কেনও? আজ যদি কাছে থাক তিস তাহলে এই অবসর প্রাপ্ত জীবন টাতে কিছুটা নতুন রসের সঞ্চার করা যেতো।
মুস্তাক হেসে বলেছিল, তোর সাথে আমি একমত। তখন বুঝিনি। আজ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছি।
শমিত উঠে গেলো ঔষধের ডিব্বা টা আনার জন্য। একটা নয় কয়েকটা ঔষধ খেতে হয়। শরীর টা এখন ও টিকে রয়েছে এই ডিব্বার উপরে। বন্ধুদের সাথে কথা হলে ঐ একই কথা, কে কোন ঔষধ খাচ্ছে। কার প্রেসার কততে।
A1C বেড়েছে না কমেছে। মিষ্টি খাওয়া কি ডাক্তার নিষেধ করেছে না করেনি। আরও কত কি?
উঠে দাঁড়ালো শমিত। খুজে বের করলো টিভির রিমোট টা।
অন করলো।
টিভির পর্দায় ভেসে উঠলো কিংবদন্তি ফুটবলার দিয়েগো ম্যারাডোনার ছবি।
মারা গেছে।