আমাকে নমস্কার করে সে বলল, আসি! তোমার এই মেয়েকে ভুলনা। সাবধানে থেকো। যদি কোন দিন আসো আমাদের দেশে, দেখা করতে ভুলো না। এই বলে চোখ মুছতে মুছতে ধীরে ধীরে পা ফেলে গাড়ীতে যেয়ে উঠলো।
চরন আর আঁধিরা জড়িয়ে ধরল আমাকে, বলল, ঠিক আসবে তো, নানা ভাই?
চোখ টা মুছে ওদেরকে জড়িয়ে ধরলাম। পকেট থেকে ওদের সাথে তোলা একটা ছবি বের করে চরণের হাতে দিয়ে বললাম, এটা হারিয়ে ও না। এটা দেখলে মনে পড়বে এই নানা ভাইয়ের কথা। চন্দ্রেশ কাছে এসে বলল,অনেক স্মৃতি রইল তোমার সাথে, ভুলব না কোনদিন। দেখলাম, ওর চোখ টা ছলছল করছে।
গাড়ীটা চলতে আরম্ভ করল। আমি সজল নয়নে হাত নাড়িয়ে ওদের কে বিদায় দিলাম।
মন্ত্র পাঠ করে শুরু হতো ওদের সকাল। আমার নিচের তালার বাসিন্দা । প্রথমে যে দিন এসে উঠেছিলাম এই বাসাতে, জিনিষ পত্র ঘুচানো নিয়ে ব্যাস্ত, মধ্যের দরজায় টোকা পড়লো। ঐ দরজা দিয়ে আমার তালায় আসা যায়। বলা যায় দুই তালার সংযোগ পথ।
-আসতে পারি? বলে আস্তে আস্তে সে এসে দাঁড়াল আমার সিঁড়ির কাছে।
লম্বায় ছয় ফুট হবে, নাম বলল চন্দ্রেশ।
-এসো। তোমার কথা শুনেছি বাড়ীর মালিকের কাছে। আমি টিভি রাখার জায়গা টা আমার ছেলেকে দেখিয়ে দিতে দিতে বললাম।
-ইন্টারনেটের জন্য অর্ডার করবে শুনলাম।
-হ্যাঁ, কেন? জিজ্ঞাসা করলাম নিচে পড়ে থাকা একটা ফটো উঠাতে উঠাতে।
-দরকার কি পয়সা খরচ করার। আমার ইন্টারনেট আছে ওটার থেকে আমি তোমাকে লাইন দিয়ে দেবো। বলে টিভি রাখার জায়গাটা দেখল।
-নাহ, এখানে কোন লাইন নেই দেখছি। তোমার বেডরুম টা দেখতে পারি। বলে সে আমার শোবার ঘরে এলো। এইতো, এখানে লাইন আছে, রাওটার টা এখানে বসিয়ে দেবো।
-কিন্তু, বলে ওর দিকে তাকালাম। একটু অস্বস্তি লাগছিলো আমার।
ও আমার কিন্তুর কোন পাত্তা না দিয়ে পুরানো রাওটার টা ঘরের মাঝে বেড়িয়ে আসা তাঁরটার সাথে যোগ করে দিয়ে নিচে চলে গেলো।
কিছুক্ষণ পড়ে ফিরে এসে আমার কম্পিউটার টা নিয়ে বসলো।
দেখি ওয়াইফাই এসে গেছে।
-কোন কিছু লাগলে আমাকে অথবা অর্চনাকে ডাক দিও। বলে সে নিচে চলে গেলো।
বিছানা টা গোছাতে গোছাতে আমার মেয়ে বলল, তোমার আর ভাবনা কি আব্বু, নিচেই তো তোমার ছেলে মেয়েরা রয়েছে।
ওর কথাটা সেদিন চারিদিকে হয়ত প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছিল, তা নাহলে আমি ওদের সাথে এমন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়লাম কেনও।
দিন যেয়ে মাস এলো, আমি প্রতিদিন সকালে শুনি টুংটুং ঘণ্টার শব্দ। শুনি মন্ত্র পাঠ। শুনি চরন আর আঁধিরা গাইছে সাঁ রে গাঁ মা। মাঝে মধ্যে চন্দ্রেশ আসে আমার খোঁজ নিতে।
চন্দ্রেশের বাড়ি চেন্নাই। বাবার ব্যাবসা আছে। দুই ভাই এক বোন। চন্দ্রেশ বড়। এখানে এসেছে চার বছেরের কন্ট্রাক্টে। কয়েকটা হাসপাতালের কম্পিউটার গুলো দেখাশুনা করে। মুখে হাসি লেগে আছে।
আমি যেমন বকলম কম্পিউটারে, আমার সুবিধা হয়েছে। একটু অসুবিধা হলেই ওকে টেক্সট পাঠাই অথবা কল করি।
একদিন বলেছিলাম, অনেক তো করছ আমার জন্য, ঋণ তো বেড়েই চলেছে।
হেসে বলেছিল, এখানে তো আমার কেউ নেই, প্রতিদিন কাজে যাই, মাঝে মধ্যে আসতে দেরী হয়। ওরা থাকে একলা। ভয় হয়। তুমি উপরে আছো, নিচে তোমার মেয়ে আছে, ওদের দিকে খেয়াল রেখো।
অজান্তে জড়িয়ে গেলাম ওদের সাথে।
একদিন নিচের দরজায় ঠুক ঠুক শব্দ। ভাবলাম শুনতে ভুল করেছি। আবারও শব্দ। No God but God বই টা পড়ছিলাম। উঠে এলাম। সিঁড়ি দিয়ে একটু নেমে আসতে দেখতে পেলাম অর্চনা দরজাটা খুলে দাড়িয়ে আছে। হাতে বড় কাঁসার থালা।
-আসব উপরে? জিজ্ঞাসা করল আমাকে।
– অবশ্যই।
থালাটা টেবিলের উপর রেখে বলল, এইমাত্র বানিয়েছি।
দেখলাম থালাতে কয়েকটা দোসা, পাশে সাম্বার। মঝে রাখা বাটীটা দেখিয়ে বললাম, এটা কি?
-ক্ষীর। নারিকেল দেওয়া। গরম থাকতে থাকতে খেয়ে নেও। বলে চলে যেতে যেয়ে ফিরে এলো।
বলল, জানো, তোমাকে দেখে আমার বাবার কথা মনে হয়।
বললাম, তাই, একদিন শুনব তোমার বাবা মার কথা।
সেই একদিন এলো বেশ কিছু দিন পরে।
সকালে নাস্তা শেষে কফি নিয়ে বসেছি। নিচে বাচ্চাদের হাসি কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি, মাঝে মাঝে ওদের মার বকুনি। রান্নার গন্ধ উপরে আসছে।
বাহিরে বাতাস। তবুও দুটো জানালা খুলে দিলাম। ক্রস ভেন্টীলেসন হলে তরকারীর গন্ধটা আটকিয়ে থাকবেনা ঘরের মাঝে।
কফিটা হাতে নিয়ে বেডরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। ওখানে সব জামা কাপড় গুলো সাজানো।
নিচে হৈ হুল্লা বন্ধ হয়ে গেছে। ওই হৈ হুল্লা টা যেন আমার মনের একটা খোরাক। ওটা বন্ধ হয়ে গেলে চারিদিক নীরব হয়ে যায়। ভাললাগে না। অর্চনার উচ্চ গলায় শাসন, আবার কখন কখন হাসির ফোয়ারা নয়ত তিনজন একসাথে গায় গান।
এই সবই যেনও আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে।
আমি এক ঘেয়ে CNN র নিউজ পালটিয়ে বাংলা চেনেল দিলাম।
-আসতে পারি?
শুনে বুঝলাম অর্চনার গলা।
-এসো।
একহাতে কয়েকটা পুরি, অন্য হাতে ছোলার ডাল।
-নাস্তা করেছ?
-সে তো কখন শেষ। বলে ওর দিকে তাকালাম।
-ঠাণ্ডা হলে খেতে ভালো লাগবে না, বলে টেবিলের উপর রাখা ডিসপোজেবল প্লেটে করে পুরি আর ডাল নিয়ে এলো।
-কি দরকার—
বলেছি না, তোমাকে দেখলে আমার বাবার কথা মনে হয়। বলে একটা চেয়ার টেনে এনে পাশে বসল।
-বাবা, মা আছে? জিজ্ঞাসা করলাম।
-মা আছে, বাবা নেই। বলে অন্য দিকে মুখটা ঘুরিয়ে রাখল কিছুক্ষণ।
বুঝলাম চোখের পানিকে সামাল দিচ্ছে।
জানো, আমিই বাবা,মার একমাত্র সন্তান। বাবা ছিল আমার বন্ধুর মত। মা র কাছে অনেক বকুনি শুনেছি, দুই একটা চড় ছাপ্পড় যে খায়নি তা নয়।
মুখ ভাঁড় দেখলে বাবা ডাক দিয়ে বলতো, অরচু মা মনি, মা বুঝি বকেছে? চল বাজার থেকে ঘুরে আসি।
পড়াশুনায় ওতটা ভালো ছিলাম না। বাবার কথাবার্তা শুনে মনে হতো আমি ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল।
মা বলত, এই মেয়ে কে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে বিদায় না করলে তোমার কপালে দুঃখ আছে।
বাবা হাসত। মা কে বলতো, তুমি যাই বলো , আমি শেষ বয়সে আমার মায়ের কাছে যেয়ে থাকবো।
অনেকে বলে, মেয়েরা নাকি বাবার বেশি প্রিয় হয়, আর বাবারাও নাকি মেয়েদের কাছ থেকেই বেশি আদর পায়। কথাটায় যুক্তি হয়তো নেই, কিন্তু খুব একটা ভুলও বোধহয় নেই। এমন মেয়ে খুব কমই আছে, বাবার জন্য যার মনে বিশেষ দুর্বলতা নেই। বাবা যেন তার এক ছোট্ট ছেলে। যাকে সে ভালোবাসে, আবার শাসনও করে। যত্ন নেয়, আবার বকুনিও দেয়। আর বাবারা? মেয়ের জন্য জান-জীবন। মেয়ের সুখই যেন বাবার সুখ।
কোথা থেকে যে বাবার জন্য এত মায়া, এত ভালোবাসা, এত টান তৈরি হয়েছিল বুঝতে পারি না। শুধু বুঝি বাবা আমার পরম প্রিয় বন্ধু। আমার অনুপ্রেরণা। আমার আত্মবিশ্বাস।
বাবা মানে মাথার ওপর শীতল কোমল ছায়া। বাবা মানে ডালপালা মেলা এক বিশাল বটবৃক্ষ।
এই বলে সে একটু থামল। মনে হোল কি যেন বলতে চাইছে, কিন্তু পারছে না।
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
চারিদিকে তাকিয়ে কান্না ভেজা গলায় বলল,
জানো, সেই বাবা একদিন কাজ থেকে ফেরার পথে আর ফিরে এলো না। বাসের ধাক্কায় গুড়িয়ে গেলো তার সব স্বপ্ন।
আমি শুনছিলাম ওর কথা।
-কত বছর তখন তুমি? জিজ্ঞাসা করলাম।
-তেরো বছর।
কয়েক মিনিট কেটে গেলো আমরা দুজনেই চুপচাপ।
হঠাৎ বলল, জানো, এই বাসায় আমি থাকতে চাইনি। চলে যেতে চেয়েছিলাম।
চন্দ্রেশ বলেছিল, বাড়ীটা রাস্তার উপরে নয়, ভিতরে। কত বড় ড্রাইভ ওয়ে। চরন, আঁধিরা নিশ্চিন্তে খেলা করতে পারবে। তুমিও চিন্তা মুক্ত খাকবে। আমিতো বাইরে বাইরে থাকি।
আমি থেকে গেলাম। এটাই ছিল ভগবানের ইচ্ছা।
তুমি এলে। চন্দ্রেশের সাথে প্রথম যেদিন তোমার তালায় এসেছিলাম, তোমাকে দেখেই আমার বাবার কথা মনে হোল। মনে হলও বাবার সেই কথা গুলো,” আমি শেষ বয়সে আমার মায়ের কাছে যেয়ে থাকবো”।
তোমার মাঝে আমি বাবা কে খুজে পেলাম।
বলে সে কেঁদে উঠল।
ন্যপকীন টা এগিয়ে দিলাম। মাথায় হাত দিয়ে বললাম, তুমি তো আমার মেয়েই।
পর কখনো আপন হয় না। কথাটা আমার ডিকশনারির থেকে উঠিয়ে দিলাম।
আমার পায়ের আওয়াজ না পেলে সে উপরে আসতো। দেখত আমি ঠিক আছি কিনা। ভালো মন্দ কিছু বানালেই নিয়ে আসতো।
সময় বয়ে গেলো। চন্দ্রেশের চার বছরের কন্ট্রাক্ট শেষ হয়ে এলো। এবার ওদের ফিরে যাবার পালা।
ওরা এসেছিল আমার কাছে। বসেছিল অনেকক্ষণ। কথা বলার চেয়ে চোখের পানিই ঝরল বেশি। চরন আর আঁধিরা বসল এসে আমার পাশে।
আঁধিরা ওর হাতে আঁকা একটা ছবি আমার হাতে দিয়ে বলল, তুমি একা থাকতে পারবে তো, নানা ভাই।
সেই মুহূর্তে আমার চোখের পানি বাঁধ মানল না।
গাড়ীটা আস্তে আস্তে ড্রাইভওয়ে পেড়িয়ে রাস্তায় পড়ল। আমি এগিয়ে গেলাম রাস্তার দিকে। গাড়ীটা বাঁক নিলো।
ওরা চলে গেলো।
–
–
–