সাত গঞ্জের বাস স্ট্যান্ড থেকে বাঁয়ে মোড় নিলে যে রাস্তা সেই রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা দোকান। পান থেকে আরম্ভ করে সব কিছুই পাওয়া যায় এই দোকানে। শুধু চাল আর ডাল ছাড়া। ছোট ছোট কাচের বয়ামে কোনটার মধ্যে বিস্কিট কোনটার মধ্যে লেবেঞ্চুস। পাশে বাঁশের ছাউনী দেওয়া জাগাটায় চা র সরঞ্জাম। দুটো তিনটা বেঞ্চ পাতা দোকানের সামনে। এক জন উঠলেই আর একজন এসে বসে পড়ছে।
মধুর দোকানের চা খায়নি এমন লোক এই তল্লাটে নেই। সকাল সন্ধ্যে আড্ডা বসে এই দোকানের সামনে।
চা র অর্ডার আসে একের পর এক। কেউ নগত টাকা দেয় কেউ বা বাকি রাখে। মধু চেনে সবাই কে। শুধু খাতায় নাম টা লিখে রাখে। কেউ দুই চার দিন পর আসে দিয়ে যায়। কেউ বা ভুলে যায়। ইচ্ছা করে কিনা বলা মুশকিল।
মধুকে কেউ কোন দিন রাগ করতে দেখেনি।
এই তো সেদিন, বদনের মা বদনকে দিয়ে পাঠিয়েছিল বতল টা। তেল ফুরিয়ে গেছে। রান্না বন্ধ। বদন এসে বলেছিল, মধু চাচা মা তেল দিতে বলেছে, টাকা এখন নেই পরে দেবে।
মধু বতল টা ভরে দিয়ে দিতেই মহীন মধুর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কিরে মধু এই করলে ব্যাবসা চলবে? এই টাকা কি কোনদিন পাবি?
-কি যে বলিস, সবার দোয়াতেই তো আমার দোকান এখনও টীকে আছে। দুই পয়সা না হয় চলেই গেলো, আর একজনের পেট টা তো ভরল।
বিয়ে শাদী করেনি মধু। বয়স চল্লিশের কাছে। বাসাতে আছে শুধু মা। কত বার বলেছে, বাবা এবার বিয়ে কর। আমি আর কদিন। নাতি পুঁতি দেখতে ইচ্ছে করে।
মধু মাতে নি। হাসতে হাসতে গামছা টা নিয়ে বেড়িয়ে গেছে পুকুর পাড়ের দিকে।
কতদিন এই সান বাঁধানো পুকুর পাড়ে বসে ফিরে গেছে অতীতের সেই দিনগুলোতে।
রজত, জগদীস, শম্ভু, নারায়ন। ছোট বেলার বন্ধু এরা।
আর ধোপা পাড়ার সেই মেয়ে টা, যার মুখ দিয়ে শুধু কথার ফুলঝুরি ঝরত।
অনু।
স্কুল শেষে বাঁশের ঝারের মাঝ দিয়ে যে পায়ে চলার পথ, পাড় হয়ে গেছে ধোপা পাড়ার উপর দিয়ে, সেই পথ দিয়ে ওরা পাচজন এসে দাঁড়াত রাখাল পাড়ায়।
ওখানে হাঁ ডু ডু খেলছে বড়রা।
মনে পরে, ডু ডু করতে করতে নওশের ভাই এগিয়ে চলেছে, ছুঁতে যাবে একজন কে অমনি বাদল ভাই জাপটে ধরল নওশের ভাইএঁর পা।
দম ছাড়েনি নওশের ভাই। টানতে টানতে এগিয়ে চলেছে নিজের কোর্টে। চারিদিক থেকে সবাই চিৎকার করছে। শম্ভু পাড়লে দৌড়িয়ে যায় নওশের ভাই কে সাহায্য করতে।
না পাড়লও না। দম ফুরিয়ে গেলো।
সে কি উত্তেজনা।
কতবার নারায়ন বলেছে মহি ভাইকে ওকে খেলায় নিতে। মাথায় একটা আস্তে করে চাপড় মেরে বলেছে, তোর এই ছোট পা টা ভেঙ্গে যাবে। আর একটু বড় হ।
সেই দশ বছর বয়স টা পিছনে চলে গেলো।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। কাঞ্চনপুরে যাওয়ার বাস টা এসে দাঁড়ালো। দুই চারজন লোক নামলো। বাসটা ছাড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কন্ডাক্টর, রোককে, বলে থাপ্পড় মারল বাসের দরজায়।
বাসটা থেমে গেলো।
এক মহিলা নেমে এলো। হাতে সুটকেস। সবাই তাকাল ঐ দিকে।
সূর্য ডুবেছে, লাল আভা টা এখনও ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। সেই আলোতে মহিলার মুখ টা দেখতে পেলো মধু।
-বিদিশা তুমি?
-মধু দা। কেমন আছো?
বেঞ্চে বসে থাকা লোকেরা এ ওর মুখের দিকে চাইছে।
-অনেক দিন পরে এলে।
-তা পাঁচ বছর তো হয়ে গেলো।
-দাড়াও এই ভর সন্ধ্যায় চিনে যেতে পারবে না তোমার ভাই এর বাসায়।
এই বলে মধু ডাক দিলো পাশে সাইকেল নিয়ে দাড়িয়ে থাকা ছেলে টাকে।
-এই পলটুঁ, ওকে রিক্সা দিয়ে তোর নারায়ন কাকার বাসায় নামিয়ে দিয়ে আয়।
আর শোন ভিতরে না ঢোকা পর্যন্ত দাড়িয়ে থাকবি।
-তুমি একদম পাল্টাও নি মধু দা। বলে রিক্সায় উঠল সে।
আড্ডা টা আবার জমে উঠল। দুই একজন এসে যোগ দেয়, দুই একজন চলে যায়। মধু মাতে না ওদের সাথে। শুধু শোনে। চা র পেয়ালা হাতে হাতে।
মতলব মিয়াঁর ভাণ্ডারে আছে সব রকমের খবর। কাঠের আড়ত আছে মতলব মিয়াঁর। পয়সা আছে। ইটের দোতালা বাড়ি। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়ীতে শুধু সে আর তাঁর গিন্নি। প্রতি সন্ধ্যায় হাতে একটা ছড়ী নিয়ে মধুর দোকানে এসে হাজির হয়। মধু জানে চা র সাথে আর কি কি খাবে মতলব মিয়াঁ। জমির কে ডেকে বলে দেয়।
জমির ছেলে টা ভালো। কর্মঠ। ছোট্ট এই শহরে সবাই সবাই কে চেনে। জমিরের মা একদিন বলেছিল মধুকে,
বাবা, আমার ছেলে টাকে তোমার এখানে যে কোন কাজে লাগিয়ে দেও। তা না হলে ও বেপথে চলে যাবে। দেখছ তো চারিদিকে, ওর বন্ধুরা নেশায় মত্ত।
মধু কথা রেখেছিল। কাজ শিখে উঠতেই মাসের শেষে কিছু টাকা হাতে দেয়। জমির মার সাথে ভাগ করে ঐ টাকা।
চা আর খাবারের প্লেট টা জমির এগিয়ে দিলো মতলব মিয়াঁ কে। হাতের ছরী টা পাশে রেখে চা তে চুমুক দিয়ে খবর দিলো, চেয়ারম্যান সাহেব নাকি আগামী ইলেকশনে দাঁড়াবে না।
-কেন কেন? উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো শমশের।
-গম্ভীর ভাবে, চারিদিকে চেয়ে, আস্তে আস্তে বলল, টাকা তো কম খায়নি, আর কত। এবার হজ করতে যাওয়ার পালা।
কথা চলতে থাকে।
কাঞ্চনপুরে যাওয়ার শেষ বাসটা এসে দাড়ায় রাত আটটা পনের তে। এর পর রাস্তা খালি হতে থাকে। মধুও দোকানের ঝাপ নামায়।
হাটতে হাটতে বাসার সামনে এসে দাঁড়াল মধু। জানে মা বসে আছে খাবার সামনে নিয়ে। অপেক্ষা করছে ওর জন্য।
আজ খেতে মন চাইছে না মধুর। তবুও বসলো মার সাথে।
আজ যে ২৪ শে এপ্রিল। এই রাতে সে যায় ঐ দুরের শ্মশানে। পনের বছর কোন ব্যতীক্রম হয়নি। অনুর দেওয়া বাঁশিটা নিয়ে এসে বসে নিম গাছ টার নিচে। রাতের অন্ধকারে করুন সুরে বাজে বাঁশিটা।
অনু, ধোপা পাড়ার মেয়ে। কত বার ঐ ধোপা পাড়া দিয়ে পাড় হয়েছে ওরা পাঁচ বন্ধু। মধু বাজাতো বাঁশি।
মাঝে মাঝে ফ্রক পড়া মেয়েটা এসে দাঁড়াত সামনে। রজত ধমক দিতো।
সেই মেয়ে ফ্রক ছেড়ে একদিন শাড়ী ধরল। চুলে দুই বেনী করল।
একদিন একা একা হেটে আসা পথের সামনে এসে দাঁড়াল সে।
-বাজাও না বাঁশি টা। বলেছিল সুর্মা দিয়ে আঁকা চোখ টা উঠিয়ে।
মধু তাকিয়ে ছিল। আগে দেখেছে, চোখে লাগেনি, আজ চোখ সড়াতে পাড়লও না।
কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল আজ তা মনে নেই।
শুধু বলেছিল, বাসাতে এসো, শোনাব।
এসেছিল সে। বসেছিল মধুর ঘরে। মধু শুনিয়েছিল অনেক গুলো গান।
তারপর কেটে গেলো দিন, কেটে গেলো মাস, কেউ বুঝতে পারলো না, অনু আর মধু এক হয়ে গেছে।
অনু বলেছিল, মধু দা, তোমার কি মনে হয় আমরা কোনদিন এক হতে পারবো।
-কেন হবো না? বলেছিল মধু।
-তা তুমি ভালো করেই জানো। মুখটা ঘুরিয়ে কান্না ভরা গলায় বলেছিল অনু।
– আমার মা,বাবা ওসব কিছুর ধাঁর ধারে না। উচ্চ কণ্ঠে বলেছিল মধু।
তার প্রমান মধু দিতে পারেনি। তার আগেই সব শেষ হয়ে গেলো।
কে জানতো ঐ বিষাক্ত গোক্ষুর সাপ টা বাসা বেধেছিল অনুর ঘরের মাটির নিচে।
দাউ দাউ করে চিতায় আগুন জ্বলল। কাঁদলও অনুর মা, কাঁদলও বাবা।
মধু বাঁশি টা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে ছিল পাঁথরের মূর্তির মত।
রজত চলে গেছে বিদেশে। জগদীশ মারা গেছে আজ বছর দুই হোল। শম্ভু চলে গেছে কোলকাতায়। থাকার মধ্যে আছে শুধু নারায়ন। সেও ব্যাস্ত তার ব্যবসা নিয়ে।
কিছুদিন আগে নারায়ন এসেছিল দোকানে। অনেক দিন পর। চা খেতে খেতে বলেছিল, আয় একদিন আমার বাসায়। আড্ডা দেওয়া যাবে। বিদিশাও তোর কথা বলছিল।
দুপুরে লোকের ভিড় কম। কি ভেবে জমির কে বলে সে বেড়িয়ে পড়লো। নারায়নের বাসার দরজায় টুক টুক করে শব্দ করলো। দরজা খুলে দাঁড়ালো বিদিশা।
-নারায়ন নেই?
-না, দাদা তোঁ বারোবাজার গেছে। তা দাড়িয়ে রইলে কেন, ভিতরে এসো। বিদিশার কণ্ঠে আন্তরিকতার সুর।
-দাদা বলছিলও অনেকদিন তুমি এই পথে পা মাড়াও নি।
হাসলও মধু।
পুরানো দিনের কথা তুলে বিদিশা বলল, মনে পরে মধু দা, তুমি আমাকে অংক শেখাতে আসতে।
-হাসতে হাসতে মধু বলল, মনে না থেকে পারে। তোমার মাথায় তো কিছুই ঢুকতো না।
-তা সে কত আগেকার কথা। কাকা মারা যাওয়াতে তুমি তো আর লেখাপড়া করলে না। কাকার দোকান নিয়ে বসলে। শুনেছি তোমাদের বন্ধুদের মধ্যে তোমার মাথা ছিল সবচেয়ে ভালো।
-সংসারের হাল তো একজন কে ধরতে হবে। ভালই তো আছি। মধু বিদিশার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল।
এসো একদিন বাসাতে, কাকীমা কে দেখতে।
-আসব।
কথা শেষে মধু উঠে দাঁড়ালো।
-আবারও আসবে তো মধু দা। বিদিশা খোলা দরাজার পাশে দাড়িয়ে বলেছিল।
মধুর কানে শেষ কথাটা ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে বাজতে থাকলো।
এক রাতে মধু বাসায় ফিরতেই মা বলল, বাবা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবি।
-কেন? কি হয়েছে? অস্থির হয়ে উঠল মধু।
-বুকে বড় চাপ লাগছে। বলে হাপাতে লাগল।
তাড়াতাড়ি রিক্সা ডেকে নিয়ে এলো হাসপাতালে।
ডাক্তার চেনা। অনেক পরীক্ষা করে এসে বলল, মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।
ওষুধ দিয়ে দিলো। সাবধানে থাকতে বলল।
খবর শুনে সকালেই নারায়ন আর বিদিশা এসে হাজির। বিদিশা রয়ে গেলো সারাদিন মধুর মা কে দেখা শুনা করার জন্য।
-তুমি যাও মধু দা। আমি তোঁ আছি। বলে মধুর মার গায়ে চাদর টা টেনে দিলো।
বিদিশার বিয়ে হয়েছিলো। টেকে নি। চলে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়।
নারায়ন বলেছে ও আর ফিরে যাবে না। এখানেই একটা চাকরি নেবে। কোন স্কুলে।
প্রতিদিন বিদিশা আসে। মধু বেড়িয়ে যায়, রাতে মধু এলে ও ফিরে যায়। মধু নামিয়ে দিয়ে আসে।
মাঝে মাঝে বিদিশা বলে, এবার তোমার বিয়ে করার দরকার মধু দা। মা কে দেখার জন্য। তোমাকে দেখার জন্য।
মা বলে, মেয়ে টা বড় ভালো । কি যত্নই না আমাকে করছে।
এক রিক্সায় দুজনে বসে যেতে গেলে গায়ে গায়ে ঘষাঘষি তো লাগবেই।
লাগছে। কেউ কিছু বলছে না।
এক রাতে বিদিশা রিক্সা থেকে নামতেই মধু বলল, মা তো এখন একটু ভালো, তোমার আর না আসলেও চলবে।
বিদিশা চোখে চোখ রেখে বলল, তুমি তো বাসায় থাকো না, আমি জানি উনি কতটুকু ভালো, আর তাছাড়া উনি শুধু তোমার মা না , আমার ও মা। বলে দ্রুত পায়ে চলে গেলো ভিতরে।
পরদিন সকালে মধু বসে রইল, সময় বয়ে যাচ্ছে বিদিশার দেখা নাই।
-কিরে ও আজ আসবে না? মা উৎকণ্ঠ জড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল। তা হলে আমার কি হবে।
-আমি তো আছি। আজ আমি যাবনা দোকানে।
-না তুই ওকে নিয়ে আয়। বলতে বলতে মার চোখে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
ঠিক আছে বলে ঘুরে দাড়াতেই দেখল বিদিশা দাড়িয়ে আছে দরজার কাছে।
-মা, তুমি যেওনা আমাকে ছেড়ে, তুমি চলে গেলে আমি বাঁচবো না। বলে কেঁদে উঠলো মা।
– না, আমি কোথাও যাবো না, এই বাসা আমার বাসা। বলে মধুর মার চোখের পানি নিজের আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিলো বিদিশা।
মধু শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে।
–
–