অশান্ত মন

 ঘরের তাপমাত্রা টা দেখল সাকিল। সত্তরের কোঠায়। সাকিলের কাছে মনে হচ্ছিল পঞ্চাশের নিচে। সোয়াটারের উপর একটা চাদর চাপিয়ে নিলো। জ্বর আসছে বলে মনে হোল না। তবুও থার্মোমিটার টা বের করল। বাহিরের  রৌদ্রে তাপ আছে বলে মনে হোল না সাকিলের কাছে।

একটা ঘুঘু পাখি অলস ভাবে বসে আছে গাছের ডালে। মাঝে মাঝে ঠোঁট দিয়ে গা টা চুলকাচ্ছে।

সাকিল জানালার কাছ থেকে সড়ে এলো। হাতের ঘড়িটার দিকে তাকাল। দরকার ছিল না সময় দেখার। কোথাও যাওয়ার নেই। কাউকে কল করারও নেই।

না, একজন এখনও আছে। তামান্না। অথচ ওকেই সে অবহেলা করত সবচেয়ে বেশি।

সেই দিন গুলো। শরীরের রক্তে তখন প্রবল উন্মাদনা। সাকিলের বন্ধুর চেয়ে বান্ধবীর সংখ্যাই বেশি। ওর কথার মধ্যে ছিল মাদকতা। সাকিল কথা বলতে ভালোবাসতো। ভালোবাসতো শুনতে। কথার মাঝে কথা বলতো না। শুধু মাথা নেড়ে নেড়ে ওদের কথা শুনত। সাকিল শিখা, সন্ধ্যা, সাকী, মতীন, পরে এসে যোগ দিয়েছিল তামান্না। কথা কম বলত সে। কাজেই  সাকিলের সাথে অত বেশি বন্ধুত্ব হয়ে উঠেনি।

কফি শপে বসে  আলোচনা হচ্ছিল বিভিন্ন বিষয়ের উপর। হঠাৎ মতীন বলে উঠল, আচ্ছা তোদের কি মত, একটা ছেলে আর মেয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ত কি গড়ে উঠতে পারে সেক্স ছাড়া।  

হঠাৎ এই ধরেনের প্রশ্নে, একটু ইতস্ত করল সবাই।

সাকিল চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, আমি বিশ্বাস করি ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ত হতে পারে উইদাউট সেক্স।

হাত তুলে ভোট নিয়ে দেখা গেলো, সেক্সের দিকে পাল্লা ভারী।

-হেরে গেলে বন্ধু, হাসতে হাসতে বলল মহি।  

-তাহলে এই যে এখানে বসে আছে শিখা, সন্ধ্যা, তামান্না এরা আমাদের বন্ধু নয়? বেশ উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল সাকিল।

-বন্ধু, তবে ঘনিষ্ঠ বন্ধু নয় । তোমার আর সন্ধ্যার বন্ধুত্ব যদি বন্ধুত্ব ছেড়ে অন্য দিকে মোড় নেয় সেখানে আজ না হয় কাল সেক্স আসবে। মতীন বেশ জোড় গলায় বলল।

সাকিল মানতে রাজী না।

হঠাৎ সাকিলের মাথায় ভুত চেপেছিল কিনা কে জানে, হয়ত প্রমান করতে চেয়েছিল ওরা ভুল।  

তামান্নার দিকে তাকিয়ে বলল, যাবে তুমি আমার সাথে ব্যাংককে?

আমি? আমতা আমতা করে বলল সে। আচমকা এই প্রশ্নের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না।

-আমি যাবো, বলে শিখা চেয়ার টা টেনে এনে সাকিলের পাশে বসল। আমি তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাই না? কবে যেতে চাও? সাকিলের চোখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করল।

সবাই একটু নড়েচড়ে বসলো। কি ঘটতে যাচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সবার চোখ সাকিল আর শিখার দিকে।

-তা তুমি কিসে বিশ্বাসী? সেক্স না নো সেক্স। সাকিলের প্রশ্ন।

-পরিস্থিতির উপর। সব নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর। তুমি এই মুহূর্তে আমার বন্ধু, প্রেমিক নও।

– তোমার মতে প্রেমিক প্রেমিকা হলে, ওটা হতে পারে। সাকিল জিজ্ঞাসা করলো।

-ঐ যে বললাম, সব নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর। তুমি প্রমান করবে বন্ধুত্ত টাই বড়, অন্য কিছু নয়। এখন বলও কবে  যাবে?

-আগামী সপ্তাহের প্রথমে। বলল সাকিল।

যেই কথা, সেই কাজ।

ওরা এলো ব্যাংককে।

যেদিন ব্যাংকক এয়ারপোর্টে এসে পৌছাল, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। বাহিরে এসে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এলো এম্বেসেডর হোটেলে। আগের থেকে বুক করা ছিল। দুটো রুম। পাশাপাশি। দুই রুমের সাথে সংযোগ মধ্যের দরজাটা।

-ওটা খোলাই থাক। কি বলও? মৃদু হেসে শিখা বলল।

ওরা একে অপরকে চেনে আজ অনেক অনেক বছর হয়ে গেল। পড়াশুনা শেষে দুজনেই চাকরিরত। ভালো একটা ফার্মে কাজ করে শিখা। আর সাকিল ইউনিভারসিটিতে অধ্যাপক হিসাবে জয়েন করেছিল। বন্ধুরা প্রতি সপ্তাহে বন্ধের দিন মিলিত হয়। আড্ডা হয়, কথা কাটাকাটি চলে।

গোসল টা সেরে মাঝের খোলা দরজার কাছে এসে ডাক দিল শিখা। মাথার চুলটা জড়িয়ে নিয়েছে সাদা তোয়ালে দিয়ে।

-আসবো? ভদ্রোচিত অবস্থায় আছো তো? হাসতে হাসতে বলল,

-এসো।

বিছানার উপরে বসে পড়ল শিখা।

-মাত্র তো তিনদিনের জন্য আসা। প্রোগ্রাম টা কি বল? বালিশ টা মাথার কাছে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো শিখা।

-প্রথম দিন দেখব গ্র্যান্ড প্যালেস, যাবো চায়না টাউনে। দেখব Reclining Buddha Statue  খাবো The Sixth এ।

-তুমি তো ভালোই স্টাডি করে এসেছ। বলে বালিশটা টেনে বুকের কাছে নিয়ে এলো শিখা।

তিনটা দিন কোথা দিয়ে কেটে গেলো ওরা নিজেরাও বুঝতে পারলো না।

সব রকম কথাই হোল। সন্ধ্যায় সমুদ্র সৈকতে হাত ধরাধরি করে হাঁটল দুজনে। রাতে জ্যোৎস্নার আলোতে মাখা সুইমিং পুলের পাশে বসে গল্প করলো। কেউ নেই। শুধু ওরা দুজন।

শিখা জিজ্ঞাসা করেছিল, আচ্ছা সাকিল, তোমার মন টাকে কি তুমি বোঝো, না বুঝতে চাওনা।

– সাকিল আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ভয় হয়।

শিখা বলেছিল এই তিনটা দিন আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন।  গেঁথে রইল মনের মাঝে। হয়তো আবার আসব এখানে, হয়তো বা অন্য কারো সাথে, সেই দুইয়ের আসা যাওয়ার মাঝে থাকবে অনেক ব্যবধান।

সাকিল কোন কথা বললও না, শুধু শুনল।

শিখা বলল, তুমি অতি ভদ্র, মাঝের দরজাটা খোলাই রয়ে গেলো।

জানালার কাছ থেকে সরে এলো সাকিল। ঠাণ্ডা টা শরীরের ভিতরে সুঁই ফোটাচ্ছে। কফির মেশিন টা চালিয়ে দিলো।

মনে পড়ল, সেই দিনটার কথা।

সন্ধ্যায় আড্ডা দেবে বলে সবাই এসে বসেছিল রেস্তোরায়। এসেছে সবাই, আসেনি শিখা। শিখার দেরী দেখে সাকিলই জিজ্ঞাসা করলো, কি রে একটা কল দে শিখা কে, কোথায় গেলো সে।  

শিখা এলো। একলা নয়। সাথে আর একজনকে নিয়ে। সবাই তাকিয়ে রইল ওদের দিকে। সাকিলের মুখের রেখার কোন পরিবর্তন এলো না।

শিখা পরিচয় করিয়ে দিলো, আনন্দ, আমার বন্ধু বা তার চেয়ে একটু বেশি। বলে তাকালও সাকিলের দিকে।

সেই “একটু বেশি” কথা টা সাকিল শুনতে পেলো কি না বোঝা গেলো না। চেয়ার থেকে উঠে আনন্দ কে বলল, বস এখানে, আমি আর একটা চেয়ার নিয়ে আসছি। বলে উঠে গেলো।

কোথায় যেনও একটা তাল কেটে যাচ্ছে বলে মনে হোল মতীনের। অন্যদিনের মত জমছে না। আনন্দই কি এর কারণ? মতীন ভাবছিল আনন্দের ঐ জায়গাটা মতীনের হতে পারতো। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট টা বের করে উঠে দাঁড়ালো।

-তোরা বস, আমি একটু টান দিয়ে আসি। বলে বাহিরে যেয়ে দাঁড়াল।

ওর মনে পড়ল সেই ফেলে আসা বৃষ্টির রাত টা। আড্ডা সেরে বাহিরে এসে দেখে মাত্র দুটো রিক্সা  দাঁড়ানো।  মতীন আর শিখা থাকে একি দিকে। সাকিলই প্রস্তাবটা দিলো।

-এই মতীন, তুই আর শিখা একটা রিক্সা নিয়ে চলে যা। যাওয়ার পথে শিখাকে নামিয়ে দিবি। বলে রিক্সা কে ডাক দিলো।

মুখচোরা মতীন সাহস করে সেদিন বলতে পারেনি কিছু।

-আপনার কথা শুনেছি শিখার কাছে। আনন্দ কনভারসেশন করার চেষ্টা করল।

-ওসব ভদ্র ভাষায় কথা বলা রাখো, হয় তুমি অথবা তুই দিয়ে কথা বলও। বলে হেসে উঠল।

একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আনন্দ বলল, প্রথম প্রথম কিনা।

আড্ডা ভাঙ্গল। আনন্দ গেলো বাথরুমে।

সাকিল এসে দাঁড়ালো বারান্দায়। শিখা এসে ওর কাঁধে হাত রাখল।

সাকিল তাকালও না ওর দিকে।

-তোমাকেই আমি চেয়ে ছিলাম। বলে সামনে এসে দাঁড়ালো শিখা।

– আমি নিজেও জানি না আমি কি চাই। যদি কিছু ভেবেও থাকো ঐ পদ্মায় তা ভাসিয়ে দিও। হৈ হৈ করে তো অনেক গুলো বছর কাটিয়ে দিলাম। এবার সবারই সময় এসেছে পাখা গুটিয়ে বসার। তুমি বসতে চলেছ, আস্তে আস্তে সবাই বসবে। আমিই হয়ত থেকে যাবো একা।  ঐ যে বললাম আমি নিজেও জানি না আমি কি চাই।

সাকিল জানে তামান্না এখনি কল করবে। তাঁর কুশল সংবাদ নেবে। তারপর তাঁর কি কি করা উচিৎ আর উচিৎ না তাঁর উপর একটা লেকচার দেবে। এই তামান্নার সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল যখন আস্তে আস্তে সবাই চলে গেছে দুরে।

কফি হাউসের সেই আড্ডা আর নেই। অনেকেই আজ সংসারী।

শেষ পর্যন্ত শিখার আংটি বদল হয়েছিল মতীনের সাথে। আনন্দের সাথে নয়।

মনে পড়লো ওরা সবাই এসেছিল শিখার এপার্টমেন্টে। জাস্ট গেট টুঁগেদার।

আসেনি তামান্না। অসুস্থ। সুসংবাদের সাথে দুঃসংবাদও আছে। প্রেগন্যান্ট। ডাক্তার না করে দিয়েছে হাটা চলাফেরা করতে। মিসক্যারেজ হয়ে যেতে পারে।

শিখার বাসার ব্যাল্কনীতে দাড়িয়ে দুরে নিভছে জ্বলছে বাতিগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল সাকিল।

কাঁধে হাত পড়তেই ফিরে তাকালও। পাশে দাড়িয়ে মতীন।

-কিছু বলবি ? জিজ্ঞাসা করলো সাকিল।

-শিখা তোকে খুঁজছে। আর শোন, যদি কিছু মনে না করিস একটা কথা জিজ্ঞাসা করব।

–ভণিতা না করে জিজ্ঞাসা কর।

-মনে আছে, অনেক দিন আগে তোরা দুজন ব্যাংককে গিয়েছিলি—

কথাটা শেষ করতে দেইনি সাকিল। বেশ দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিল, নিজের বৌ কে চিনতে পারলেনা, বন্ধু।

মতীন আর কথা বাড়ায়নি।

কয়েকদিন পরে খবর এসেছিল, তামান্না বাচ্চা টাকে ধরে রাখতে পারেনি। এটা নিয়ে পর পর দুবার হলও।

আরও খারাপ খবর আসার বাকি ছিল। খবর টা এনেছিল মহি। তামান্নার সাথে ওর স্বামীর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ও কেনও পারছে না বাচ্চা ধরে রাখতে এই ওর অপরাধ।

-ছোটলোক? ঘৃণিত কণ্ঠে বলেছিল সন্ধ্যা।

এক পড়ন্ত বিকেলে, তামান্নার বাসার বেলটা বাজাল সাকিল।

-তুমি কি মনে করে? আশ্চর্য হয়ে তামান্না তাকালও সাকিলের দিকে।

-কিছু মনে করে নয়। একলা বাসায় দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। তাই বেড়িয়ে পড়েছিলাম, কিছু না ভাবেই তোমার বাসায় এসে হাজির হলাম। যদি মনে করো সময় ভালো না তবেঁ এখনি বিদায় নিচ্ছি।

-তোমার এই মন ভুলানো কথা বলার ঢং এখনো রয়ে গেলো সাকিল। এসো ভিতরে। ব লে দরজাটা খুলে এক পাশে দাঁড়ালো।

সেই থেকে দুজনে খোঁজ নেয় দুজনের। মাঝে মাঝে তামান্না এসে রান্না করে দেয়।

দুজনে বসে টিভি দেখে। রাতে তামান্না ফিরে যায়। শুধু বলে যায় কোন খাবার টা কখন খাবে।

-কি বললে? ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছ। বাহিরে রীতিমত গরম। আমি এখনি আসছি।

-না না তোমাকে –, কথা শেষ হতে পারেনি। তামান্না ফোনটা রেখে দিয়েছিল।

যখন সে এলো তখন সাকিলের গায়ের তাপমাত্রা ১০২ ডিগ্রী ফারেনহাইট। বমি করলো কয়েক বার।

তামান্না নিয়ে এলো ওকে হাসপাতালে। 

অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হোল। ফুসফুসে পানি জমেছে। ভাইরাল ইনফেকশন।

দুইদিন পরে বাসায় এলো সাকিল। তামান্নাই নিয়ে এলো।

দুর্বল। পা চলছে না।

লিফট টা বন্ধ। দোতালায় উঠতে হবে।

তামান্নার কাঁধে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে এলো। হাঁপিয়ে উঠলো সাকিল। নিশ্বাস টা বন্ধ হয়ে আসছে মনে হোল। দাড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তামান্না ওকে জড়িয়ে ধরে রাখল।

-পড়ে যেওনা যেন। বলে ওর একটা হাত দিয়ে সাকিলের মাজাটা শক্ত করে ধরল।

ঘরে এসে শুইয়ে দিলো লিভিং রুমে পাতা বিছানাতে।

-তুমি শুয়ে থাক আমি তোমার ঔষধ গুলো সাজিয়ে রাখি। বলে ব্যাগ থেকে ঔষধ গুলো বের করলো।

-এদিকে একটু আসবে? ডাক দিল সাকিল তামান্না কে।

তামান্না এলো কাছে।

-তুমি কি রাতে চলে যাবে? এ যেনও শিশুর কণ্ঠ।

-না, আমি আছি।

সাকিলের চোখের কোণ বেয়ে ঝরা পানিটা মুছিয়ে দিলো তামান্না ওর হাত দিয়ে।  

Continue Reading