পাহাড়ের চুড়ায় বাংলোটা

     -কি সাঁজা শেষ হোল? রবীন ডাক দিলো রুবীনা কে।

-এই তো, হোল বলে। দুটো মিনিট সময় দাও। বলে রুবীনা কপালের টিপটা খুলে ফেলল। ওটা যেন মানাচ্ছে না শাড়ীর রংএর সঙ্গে।

-বেশি সাজগোজ করো না। নতুন বস আবার ব্যাচালার কিনা। পরে না খুইয়ে আসি তোমাকে। বলে হাসতে থাকলো রবীন।

-ফাজলামি করো না। কোন টিপই আমার পছন্দ হচ্ছে না। একটু হেলপ করবে। দেখতও কোন টিপ টা যায় শাড়ীর রং এর সাথে।

রবীন বৈঠকখানায় বসে  একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ও আমার দাড়া হবেনা।

তা যে হবে না সেটা রুবীনা ভালকরেই জানে। রুবীনার সাঁজার ব্যাপারে রবীন সব সময় উদাসীন। আজ পর্যন্ত কোনদিন মুখ ফুটে বলে নি, তোমাকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে।

অথচ সুমিতার স্বামী সুমিতার কাপড় পর্যন্ত ইস্ত্রী করে দেয়। কোন শাড়ী টা পড়বে সেটাও দেখিয়ে দেয়। সব সময় যে সুমিতা সেটাই পড়ে তা নয়। তবুও– । হঠাৎ এইসব চিন্তা রুবীনার মাথায় খেলে গেলো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দপ করে উঠলো রাগে।

একবার ভাবল যাবে না সে পার্টিতে। দরকার হয় রবীন একাই যাক।

পড়ে ভাবল থাক, সিন ক্রীয়েট করে লাভ নেই। রবীন কেন সে রাগ করছে সেটাও বুঝতে পারবে না।

আজকের অনুষ্ঠান টা চা বাগানের নতুন CEO আবির আহমেদের আগমন উপলক্ষে। রবীন এই চা বাগানের ম্যানেজার।

এই অনুষ্ঠান টা সুন্দর ভাবে পরিচালনা করার দায়িত্ব তার উপর। তাই একটু আগে আগে যাওয়ার চিন্তা করছিল। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যনেজার কামাল কল করেছিল দু বার। বলেছিল CEO সাহেব পথে, কিচ্ছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়বে।

-আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। বলে অস্থির ভাবে পায়চারি করতে থাকল।

– কি? হোল তোমার? ওদিকে তো CEO সাহেব এসে পড়লো বলে।

রুবীনা ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো। ইন্ডীয়া থেকে আনা সত্যপালের শাড়ি তার গায়ে অসম্ভব সুন্দর লাগছিল। রবীন কিন্তু অতটা  নজর দিলোনা। নজর দিলো না তার কপালে ছোট্ট লাল টিপ টা।

গাড়ী এসে ঢুকল কনভেনশন হলের গাড়ী বারান্দায়। লোকজন প্রায় সবাই এসে গেছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যনেজার কামাল এগিয়ে এসে বলল, উনি পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসে পড়বেন। আপনি একবার স্টেজ টা ভালো করে দেখে  নেন।

-উনাকে ফুলের তোরা কে দেবে ঠিক করেছেন? বলে তাকালও প্লান্ট ম্যানেজার শুভ ইসলামের দিকে।

-হ্যাঁ, আমাদের ফুড ডিপার্টমেন্টের বশীর উদ্দিনের মেয়ে মিলি, পাঁচ বছর বয়স, ওকে বলেছি। চটপটে মেয়ে।

-ঠিক আছে। বলে প্লান্ট ম্যানেজার শুভ ইসলামের সাথে করমর্দন করে, দুজনে কোথা বলতে বলতে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেলো।

রুবীনা এসে বসলো প্রথম সারিতে অনন্যাও ম্যানেজারের  বৌ দের সাথে। রুবীনার বান্ধবী শিমুল, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যনেজারের কামালের বৌ। ওর সাথেই রুবীনার বন্ধুত্ত বেশি।

রুবীনার রুপের প্রশংসা এই মহলের সবারই জানা। তা নিয়ে রুবীনার কোন গর্ব নেই। বরং কেউ কোন পার্টিতে এই বিষয় উঠালে সে লজ্জিত হওয়ার সাথে সাথে কথার মোড় অন্যদিকে নেয়ে যাওয়ার চেস্টা করে।

CEO আবির আহমেদের গাড়ী এসে দাঁড়ালো গাড়ী বারান্দায়। রবীন, শুভ ও অন্যান্য রা এগিয়ে গেলো।  

গাড়ী থেকে নেমে এলো আবির আহমেদ।

রবীন একে একে পরিচয় করিয়ে দিলো বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের কর্তাদের সাথে।  

মেয়েদের সারি থেকে দেখা যাচ্ছিলো না আবির আহমেদ কে। উচ্চতায় খুব একটা উচু নয়। আর রবীন দাঁড়িয়েছে ঠিক ওর সামনে। রবীনের উচ্চতা অনেক বেশি হওয়াতে আবির আহমেদ ওর আবডালে রয়ে গেলো।

শিমুল রুবীনার হাতে চিমটি কেটে বলল, ভাই, বলও না তোমার কর্তা কে একটু সরে দাড়াতে। আমরা একটু দেখি। শুনেছি খুব হ্যান্ডসাম নাকি দেখতে?

-তা হ্যান্ডসাম হলেই বা তোমার কি এসে গেলো। তোমার তোঁ ওই প্যাঁচা নিয়েই থাকতে হবে। আর দুধের স্বাদ ঘলে মেটাতে হবে। বলে রুবীনা একটু জোড়ে হেসে উঠলো।  

হাসির শব্দ আবিরের কানে পৌছাতেই সে রবীনের ডানদিকে সরে এসে তাকালও যেখান থেকে হাসি টা এলো সেই দিকে।

চোখে চোখ হোল রুবীনার সাথে। মুহূর্তের মধ্যে রুবীনার মনে হোল তার সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে। সে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। আবিরও আর তাকালও না ওই দিকে।

কামাল রবীনের কানে কানে বলল, উনাকে কি লেডিস দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন?

এই প্রস্তাব টা কামালের নিজের মাথা থেকে আসেনি, এসেছে শিমুলের কাছ থেকে।

বাসা থেকে বের হবার  আগে শিমুল বলেছিল, যদি পারো তোমাদের ওই বস কে পরিচয় করিয়ে দিও আমার সাথে।

-কেন? আমি তো আছি।

-তুমি তো ঘরের, সে তো বাহিরের। হিংসে হচ্ছে বুঝি। মিটি মিটি করে হেসে বলেছিল।

-না হিংসে হবার নয়। জানি মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত।

এরকম কথা বার্তা ওদের মধ্যে হয়। দুজন দুজনকে জানে,চেনে। ওরা জানে ওদের বন্ধনে ফাটল ধরবে না।

একটু ইতস্তত করে রবীন বলল, আসুন স্যার আমাদের অর্ধাঙ্গিনীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। এই বনজঙ্গলে কর্মসম্পাদনের জন্য ওরাই তো আমাদের অন্তরের শক্তি। বলতে পারেন ঐশ বা দৈব শক্তি।

-বাহ, লেখালেখি করেন নাকি? বলে হাসলও আবির আহমেদ।

-না, ওসব আমার দাড়া হয় না। বলে রবীন এঁকে এঁকে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকল।

-এই, আমার হাতের তালু ঘামছে। কি করবো বলতো। বলে শিমুল রুবীনাকে ঠেলা দিলো। 

রুবীনা কিছু বললও না।

রুবীনার সাথে পরিচয় হোল আবিরের। আবির একটু হেসে মাথাটা দোলালও। রুবীনা মাথাটা একবার উঠিয়ে আবার মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।

লেকচার শেষ। খাওয়া পর্ব শুরু। শহর থেকে নাম করা বাবুর্চি এনে রান্না করা হয়েছে বিভিন্ন ধরণের খাবার। খাবারের মান উন্নত। প্রশংসা শোনা যাচ্ছে চারিদিকে।

কিন্তু রুবীনার মুখে রুচি নাই। একটু খেয়ে পুরো প্লাট টা সরিয়ে দিলো সামনের থেকে। পাশে বসা শিমুলকে বললও,

মাথা টা ভীষণ ধরেছে, বমিবমি লাগছে। রবীন কে বলতে, সে বাসায় চলে গেছে। রবীন যেন চিন্তা না করে।

-কি বলছো? এর পরে তো গানের অনুষ্ঠান আছে। নাম করা শিল্পী এসেছে। অনেক কাকুতি মিনতি করল সে রুবীনা কে থাকার জন্য।

না সে থাকলো না। বাহিরে এসে দাঁড়ালো রুবীনা। ভাবল ড্রাইভার মাসুম বোধহয় খেতে বসেছে। ওকে এই মুহূর্তে বিরক্ত করাটা ঠিক হবে কিনা, বুঝতে পারছে না সে।

– ম্যাডাম, কিছু খুজছেন? দারোয়ান হাবীব জিজ্ঞাসা করলো।

-বাসায় যাবো, ড্রাইভার কে খুজছিলাম।

-আমি দেখছি, ম্যাডাম । বলে হাবীব চলে গেলো।

বাহিরে ঝিরঝির বাতাস বইছে। ঠাণ্ডা নয়। কিন্তু রুবীনার কেনও জানি ঠাণ্ডা লাগছে। সারা শরীর মনে হচ্ছে হীম হয়ে আসছে।

– ম্যাডাম, বাসায় যাবেন? শরীর ভালো তো? মাসুম ডাকতেই সে তাকালও ওর দিকে।

-তোমার কোন অসুবিধা হবে না তো মাসুম। আমাকে দিয়েই তুমি চলে এসো।

-না ম্যাডাম । চলেন।

খাওয়ার সাথে সাথে চা বাগানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করছিলো আবির। আর মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে চারিদিকে তাকাচ্ছিল। কি যেন খুঁজছিল সে।

বাসায় এসে ঘরের জানালা গুলো খুলে দিলো রুবীনা। এক কাপ কফি এনে বাহিরের চেয়ারে বসলো। তাকিয়ে ছিল সুন্দর করে ছাঁটা লনের দিকে। দুরে উচু পাহাড় টা আজ আর দেখতে ভালো লাগলো না।

যেদিন রবীন এসে বলেছিল ওদের বড় সাহেব আসবে, নাম তার আবির আহমেদ, সেদিন ঘুণাক্ষরেতো মনে আসেনি এই সেই আবির যার সাথে চার চার টা বছর হাতে হাত ধরে ঘুরেছিল। কত স্বপ্ন এঁকেছিল।

আবির পড়তো সয়েল সাইন্সে। রুবীনা ছিল বোটানিতে। দেখা হয়েছিল সাইন্স ক্যফেটেরীয়াতে।

কফি আর কেক অর্ডার দিয়ে পকেটে হাত দিয়ে আবির দেখে মানিব্যাগ পকেটে নেই। অগত্যা অর্ডারটা ফিরিয়ে নিতে বলল।

পিছনে দাড়িয়ে ছিল রুবীনা। আবির পাশ ফিরে চলে যাবার উপক্রম করতেই রুবীনা বলেছিল, কিছু যদি মনে না করেন আমার কাছে কিছু বাড়তি টাকা আছে। ওটা কাজে লাগানো যেতে পারে। পরে দিয়ে দেবেন।

সেই শুরু।

দুজনে পাশ করে বেড়িয়ে গেলো। আবির চাকরির সন্ধানে রেজুমি পাঠালও বহু জাগায়। কাজ হোল না। বেকার সে। রুবীনার কাছ থেকে তাগাদা আসতে আরম্ভ করলো বিয়ে করার।

বাস্তবের করাঘাতে আবির বুঝতে পারলো না কি করবে। বিয়ে করে বৌ কে খাওয়া বে কি?

ঠাণ্ডা মাথায় বলেছিল রুবীনা কে, কিছুদিন অপেক্ষা করো। একটা না একটা কাজ জুটে যাবে। 

রুবীনা সে কথা শুনতে রাজি নয়।  

একদিন ওরা বসে ছিল পাবলিক লাইব্রেরীর মাঠে। কথায় কথায় রুবীনা বলল, তোমার দাড়া কিচ্ছু হবে না। তোমার সাথে আমার গাঁটছড়া বাধার চেস্টা না করাই উচিৎ ছিল।

আবির কোন কিছু বলার আগেই রুবীনা হন হন করে একটা রিক্সা ডেকে চলে গেলো।

আবির ভাবল কটা দিন যাক, রাগটা পরে এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

সাত দিন, দশদিন, চোদ্দ দিন পেড়িয়ে গেলো। রুবীনা এলো না।

আবির গেলো ওদের বাড়ীতে। দারজায় কড়া নাড়ল।

এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলে দাঁড়ালো।

জিজ্ঞাসা করলো আবির রুবীনার কথা।

মহিলা বললেন, সে তো এখানে নেই। ক্যানাডায় গেছে।

আবির কি করবে বুঝতে পারলনা। একটু পরে জিজ্ঞাসা করলো, ঐখানকার ফোন নাম্বার টা পাওয়া যাবে কিনা।

উত্তরে মহিলা বলেছিল, সে জানে না।

সেই শেষ দেখা আবির আর রুবীনার।

গাড়ীর শব্দ শুনে রুবীনা উঠে এলো। রবীন দরজা খুলেই দ্রুত এলো রুবীনার কাছে। হাত টা কপালে দিয়ে দেখতে চাইলো জ্বর আছে কি না।

-কি হয়েছিল? উৎকন্ঠা স্বরে জিজ্ঞাসা করলো।

-কিছু না। মাথা টা ঘুরছিল। তাই চলে এলাম। বলে দরজার দিকে তাকাল রুবীনা।

বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। রুবীনা রবীন কে  জিজ্ঞাসা করবে করবে করেও করতে পারছিলনা, আবিরের কথা। কোথায় সে। চলে গেছে না কি এখনও এখানে। রবীন তো এই ব্যাপারে কিছুই বলে নি তাকে।

শিমুল কে জিজ্ঞাসা করা মানে তো সারা বিশ্বকে জানানো।

হঠাৎ করে মনে হোল একজন জানবে, সে হোল মাসুম। ড্রাইভার।

মাসুম প্রতিদিন রবীন কে কাজে নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলে আসে। যদি ম্যাডামের কোন দরকার পরে। সে বাসার সামনে বসে সিগারেট টানছিল। বাবুর্চি শওকত এসে খবর দিলো ম্যাডাম ডাকছে।

-আমাকে ডাকছেন ম্যাডাম? জিজ্ঞাসা করতেই রুবীনা বললও সে একটু বের হবে। শহরে যাবে কিছু কেনাকাটা করতে।

শহর বেশি দুর নয়, মাইল দশেক পথ। আগে মাটির রাস্তা ছিল। এখন পাকা রাস্তা। দুদিকে সবুজ বড় বড় গাছ। ছায়ায় ঘেরা  রাস্তা। মাঝে মাঝে রুবীনা আর শিমুল হাটতে বের হয়। কিছুদূর গেলেই একটা নদী। নদী না বলে খাল বলা যেতে পারে। মাঝে মাঝে সেইখানে ওরা দুজন এসে বসে একটা ভিটের উপর। শিমুলই একমাত্র এই নির্জনে ওর কাছের মানুষ।

রবীন ব্যাস্থ থাকে ওর কাজ নিয়ে। ও যেন কাছে থেকেও অনেক দুরে মনে হয় রুবীনার কাছে।

রুবীনা থাকে একলা ঘরে। এই একাকীত্ব ওকে বিষণ্ণতার মাঝে ঠেলে দেয়।

বাসায় কাজের লোক আছে, আছে রান্না করার লোক, তাকে বলতে গেলে কিছুই করতে হয়না। এই কিছু করতে হয়না বলেই সময় কাটতে চায়না। মাঝে মধ্যে ভাবে আজ যদি একটা বাচ্চা থাক তো। তাকে ঘিরেই তো তার দিন টা কেটে যেতো।

-ম্যাডাম, কোন স্টরে থামবো। মাসুমের ডাকে রুবীনা ফিরে এলো বাস্তবে।

-কিছু শাঁক সবজি কিনবো। আর একটা ফুলের দোকানে দাঁড়াবে।

-ঠিক আছে ম্যাডাম। বলে মাসুম নিয়ে এলো কাচা বাজারে। শাঁক সবজি, ফলমুল সবই আছে।

কেনাকাটা শেষে ফেরার পথে রুবীনা জিজ্ঞাসা করলো, মাসুম, তোমার CEO সাহেব আছেন কোথায়?

-স্যার তো চলে গেছেন। সেদিন রাতেই চলে গেছেন।

রুবীনা আর কিছু বলল না।

ওর মাথায় হিজিবিজি চিন্তা এসে ঘুরপাক খেতে লাগল।

কেন? সে আসতে পারতো না? একটা অজুহাত দিয়ে তো আসতে পারতো রবীনের সাথে। শুনেছে তো আমি অসুস্থ। চলে এসেছি পার্টি থেকে। নাকি চিনতে পারেনি আমাকে?

দেখে তো বেশ ভালই আছে মনে হোল। ব্যাচেলার! বৌ এর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, নাকি অন্য কিছু।

 ছি! কি সব ভাবছে ও? কেন আসবে ? সে নিজেই তো সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে চলে এসেছিল। তাহলে এত বছর পরেও কি ওর অবচেতন মনে আবির রয়ে গেলো।

-ম্যাডাম, বাসায় এসে গেছি। বলে মাসুম গাড়ীর স্টার্ট বন্ধ করলো।

আজ রবীন একটু আগেই চলে এসেছে কাজ থেকে। দুমদাম করে পা ফেলে বেডরুমে যেয়ে সটান শুয়ে পড়ল। রুবীনা ভেবেছিল রবীন বাসায় এলে  বলবে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বাহিরে কোথাও  ঘুরতে যাবে। দুরে নয়তো কাছে কোথাও।

এইতো কয়দিন আগে প্ল্যান্ট ম্যানেজার শুভ আর তার বৌ দুই মেয়ে নিয়ে দার্জিলিং থেকে ঘুরে এলো। আর রুবীনা যত বার বলেছে রবীন ততবার একটা না একটা অজুহাত দেখিয়ে এসেছে।

কিন্তু রবীনের দুমদাম পা ফেলা দেখে সে কথা আর বলা হোল না।

-কি ব্যাপার, শরীর খারাপ লাগছে? বলে ওর কাছে এলো রুবীনা।

-না, যত রাজ্যের ঝামেলা এসে হাজির হচ্ছে। বলে উঠে বসলো রবীন।

-কি ঝামেলা? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলো সে।

-CEO সাহেব আবার আসছেন। এবার একদিনের জন্য নয়। বেশ কিছুদিনের জন্য।

-তাতে তোমার কি? তুমি তোমার মত কাজ করবে। তা কারণ টা কি?  কেন আসছে? থাকবে কতদিন?

ওর যেন ভালোই লাগছে কথাটা শুনে।

কেন? সে নিজেও জানেনা। হয়তো রবীনের কাছ থেকে যা পাওয়ার প্রত্যাশা করেছিল তা না পাওয়ার বেদনা এই অপ্রত্যাশিত খবরটা তার মনে সাড়া দিলো।

আবারও একই  প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলো রুবীনা।

রবীন গায়ের জামাটা খুলতে খুলতে বলল, নতুন এক টা চা বাগান কেনার কথা চলছে। সেই বাবদে এখানে আসা। জানিনা কতদিন থাকবে।

হঠাৎ রুবীনা জিজ্ঞাসা করল রবীন কে, আচ্ছা, তুমি জানো কি, কেন তোমার বস বিয়ে করেনি। নাকি ডিভোর্স?

-তা আমি জানবো কি করে? তোমাদের এই মেয়েলি স্বভাব না–। বলে বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিল।

আবির এসেছে বেশ কিছুদিন হোল। রবীন বলে নি, বলেছে শিমুল। তাছাড়া আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে। যে মেয়েরা চা বাগান থেকে চা পাতা তোলে তাদের বাথরুম ছিল দুরে আর মাটির তৈরী। সেটাকে কাছে আনার আর ইটের তৈরী বাথরুমের ব্যবস্থা করার জন্য বলেছে।

-বাহ, ভালোই তো করছে। তা আমার কর্তা তো কিছু বললও না এই ব্যাপারে। রুবীনার কথা শুনে শিমুল হেসে বলল, আমাদের কর্তারা তেতিয়ে আছে। বলছে, দুদিন এসে এদের কে মাথায় উঠিয়ে দিচ্ছে, উনি চলে গেলে ঠ্যালা সামলাতে হবে ওদের।

-কি জানি, বলে ফোনটা রেখে দিয়েছিল রুবীনা।

সেদিন ছিল পূর্ণিমা। আর ছিল রুবীনার জন্মদিন। আশা করেছিল রবীন একগোছা ফুল নিয়ে আসবে। না খালি হাতেই সে ঢুকল বাসাতে। রুবীনা তাকে মনে করিয়ে দিলো না। বরং বলল, চলো আজ হাটতে বের হবো। জ্যোৎস্না রাতে।

-তুমি তো জানো আমার রোমান্টিকতা আসে না। তবুও চলো। বলল রবীন।

-আজ তোমাকে একটা কথা বলব। তোমাকে বলিনি আগে।

-বলও। বলে নিতান্তই নির্লিপ্ত ভাবে হাটতে থাকলো।

-শোন, আমার জীবনে প্রেম এসেছিল। একজন কে আমি ভালোবেসেছিলাম। অথচ সেই প্রেম আমি নিজে হাতে বিসর্জন দিয়েছিলাম শুধু আমার জীবনের নিরাপত্তার জন্য। ওকে অস্থির করে তুলেছিলাম বিয়ে করার জন্য। যদিও সে তখনো পায়ে  দাড়ায় নি। শুধু কিছুটা সময় চেয়েছিল। বলেছিল, আজ যেটা চাইছ, কাল সেটা বিষাক্ত হয়ে উঠবে।

আমি ওকে মেরুদণ্ডহীন মনে করে ছেড়ে চলে এসেছিলাম। এসে তোমাকে দেখলাম বোনের বাসায়। তুমি ইস্টাবিলস্ট। বড় চাকরি কর। আমার জীবন সেট। বলে থামল রুবীনা।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। শুধু বাতাসের শব্দ চারিদিকে।  

-কিছু বলবে। চোখ তুলে রুবীনা চাইলো রবীনের দিকে।

রবীন বলল, তুমি ভালবাসতে জাননা। তুমি জাননা ভালবাসা কি জিনিষ। তুমি সেলফীস। শুধু নিজের টা বোঝো।

আরও কিছু বলতে চাইছিল রবীন, কিন্তু বলা হোল না। দুরে পাহাড়ের উপরে বাংলোটা দেখতে পেলো। আলো জ্বলছে।

বলল, চলো সারপ্রাইজ দিয়ে আসি।

দুজনে উঠে এলো উপরে। কলিং বেল টিপতে যেয়ে দেখল দরজাটা একটু খোলা। ধাক্কা দিলো। খুলে গেলো।

ভিতরে এলো ওরা। কেউ নেই ঘরে। সামনে একটা টেবিল। উপর একটা মোমবাতি জ্বলছে। পাশে হাতে আঁকা বড় ক্যানভাস পেপারের উপর লেখা হ্যাপি বার্থডে।

কোথা থেকে যেন একটা গান ভেসে আসছেঃ

 “ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে—“

Continue Reading