তৌফিক হাটতে বেড়িয়েছিল। প্রতিদিনই বের হয়। দুই থেকে তিন মাইল হাটা তার অভ্যাস। শরীর টাকে ঠিক রাখা। অনেকে বলে বয়সটা তার নাকি চেহারায় ফুটে ওঠেনা।
তৌফিকের বয়স শুনে অনেকে হাঁ হাঁ করে উঠে।
– মাশাআল্লাহ! বলে।
তৌফিক বলে, উপরে দেখে কি সব কিছু বোঝা যায়। ভিতরে তো উইপোকা খেয়ে ঝরঝরে করে ফেলেছে। শুধু একটা ধাক্কা। তখন লোকে বলবে, আহ, চলে গেলো, তবে শরীর টা মজবুদ ছিল। এই কথা বলেই হাঁ হাঁ করে হেসে উঠে।
অন্যান্যরা যোগ দেয় ওর হাসির সাথে।
তা সেইদিন কি হোল, এক পাক দিয়ে দুই পাকের মাথায় হার্টবিট টা বাড়তে আরম্ভ করলো। তৌফিকের মনে হোল ওর বুকে কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। ধপ ধপ শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে। একটা গাছে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইল।
না, হার্টবিট টা থামছে না। বাসাটা বেশি দুরে নয়। সে ভাবল, আস্তে আস্তে হেটে বাসাতে যেতে হবে। রাস্তায় কিছু হলে সর্বনাশ।
ধীরে ধীরে পা ফেলে সে বাসাতে এলো। শুয়ে পড়লো সোফা তে। এরকম তো আগে কখনো হয়নি। এই মুহূর্তে কি করনীয় সেটা সে ভাবতে লাগলো। ভাবল, কারডিওলজিস্টকে কল দিয়ে দেখা যাক। ও ভাবেনি তাকে দুই ঘণ্টার মধ্যে আসতে বলবে। সে ভাবল স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক কিছু হয়নি। হলে সে এতক্ষণে ধরাশায়ী হয়ে পড়তো।
ডাক্তার চেক করলো তৌফিক কে। একোকারডিওগ্রাম থেকে আরম্ভ করে সব রকম টেস্ট করে বলল, সাবধানে থাকতে। আবারও হতে পারে। এঁকে বলে আরটারীয়াল ফাইব্রিলেশন। এর কোন সমাধান নেই।
একটা ঔষধ লেখে দিলো, সবসময় সাথে রাখতে।
সেই রাতটা তৌফিকের ভালো কাটেনি। অজানা একটা ভয় তাকে কুড়ে কুড়ে খেতে থাকলো।
মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলো। মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিলো, একদিন না একদিন তো যেতেই হবে।
পরদিন বন্ধু ফারহান কে কল করলো।
সবকিছু শুনে সে বলল, এইবার একটা বিয়ে করে ফেল। কিছু হলে তোকে দেখাশুনা করতে পারবে। নার্সিং হোমে গেলে কি হবে তা তো জানিস। তোকে একটা ভিডিও পাঠাচ্ছি ওটা দেখলে বুঝতে পারবি তোর বাজার দর এখন অনেকের চেয়ে বেশি।
-বাজে কথা রাখ? যারা আসবে বা আসতে চায়, তারা এই শেষ প্রান্তে পৌছে যাওয়া লোকের সেবা শুশ্রূষা করতে আসবে না। তবে কেউ বান্ধবী হতে রাজি হলে আমাকে জানাস। কথা বলে সময় কাটানো যাবে।
-ওই গুড়ে বালি। ফরহান হাসতে হাসতে বললও কথাটা।
-তোর সাথে পরে কথা হবে একটা জরুরী কল এসেছে, ধরতে হবে। বলে অন্য কলটা ধরলও তৌফিক।
পরমারা ফোন।
সকালেই তো কথা হয়েছিল। আবার কল করলো কেনও?
-কি ব্যাপার, কোন সমস্যা। তৌফিক উৎকণ্ঠার সাথে জিজ্ঞাসা করলো।
-আমি হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে। তাড়াতাড়ি এসো। কথাটা বলে পরমা তৌফিকের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোন টা রেখে দিলো।
তৌফিক কোন রকমে প্যান্ট সার্ট পড়ে বেড়িয়ে পড়লো।
তৌফিকের সাথে পরমার দেখা হয়েছিল বন্ধু রসুলের বাসায়।
কোন এক বৃষ্টি ঝরা দিনে রসুলের বাসাতে আড্ডা দিতে বসেছিল ওরা পাঁচ জন। সাথে যার যার বৌ। একমাত্র তৌফিকই একা। যে কারনেই হোক ঐ পথে তার যাওয়া হয়নি। কেন যায়নি সে রহস্য বের করতে বন্ধুরা অনেক চেস্টা করেছে, সফল হয়নি।
নীলুফারের হাতের মুড়ি ভাজা সকলের কাছেই প্রিয়। বৃষ্টির দিনে মুড়ি ভাজা, সেই সাথে পাকোড়া আর কফি আড্ডাটাকে আরও জমিয়ে তুলল।
রাতে না খেয়ে যেতে দিলো না নীলুফার। রান্নায় সে পারদর্শী। ওটা তার হবি বলা যেতে পারে।
খেতে বসে তৌফিক দেখল হরেক রকমের আয়োজন। মুড়ি ঘন্ট, ইলিশ ভাজা, ছিমের ভর্তা সেই সাথে জলপাই এর আচার।
এইসব খাওয়া তৌফিকের ভাগ্যে জোটে না সহজে।
-এই জলপাই এর আচার কোথায় পেয়েছ, ভাবী? পাতের পাশে নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করল সাকিল।
-দেশ থেকে মা পাঠিয়েছে। তুমি কি কিছুটা নিয়ে যাবে। জিজ্ঞাসা করতেই সাকিল বলল, না, না লাগবে না।
-ও তোমাদের কে তো বলাই হয়নি, আমার এক নতুন বান্ধবী হয়েছে। গতমাসে ও মুভ করে এখানে এসেছে। একটা বাচ্চা আছে। আজ আসতে বলেছি।
খাওয়া শেষে বন্ধুরা সব লিভিং রুমে যেয়ে বসলো।
মহিলারা রান্না ঘরে।
পান খাওয়ার নেশা নীলুফারের। ওর সাথে যোগ দিয়েছে শিউলি। ফারহানের বৌ। দুজনেরই ঠোট লাল। পানের গুনে।
কিছুক্ষণ পরে দরজায় ঘন্টা বাজলো।
-ঐ পরমা এলো মনে হয়। বলে নীলুফার এগিয়ে গেলো দরজার দিকে।
-এসো। নীলুফার নিয়ে এলো পরমা কে।
সাকিলের বৌ শম্পা নিজেই এগিয়ে যেয়ে পরিচয় করে নিলো।
হো, হো করে হাসির শব্দ আসছিলো রান্না ঘর থেকে।
তৌফিক উঠে দাঁড়ালো, বলল, যাই দেখে আসি এত হাসি কিসের। আর সেই সুবাদে নতুন আগন্তুক কে দেখে আসি।
-একমাত্র তোর পক্ষেই সম্ভব। বলে সাকিল টিপ্পনী কাটল।
রান্না ঘরের আইল্যান্ডে গোল করে সব বৌরা বসা।
-তোমাদের হাসির শব্দে টিকতে না পেরে এলাম দেখতে। আর— কথা শেষ হলনা তৌফিকের।
চোখে চোখ পড়ল পরমার সাথে।
মুখ দিয়ে বেড়িয়ে গেলো, তুমি?
-চেনও নাকি? দুচোখে বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো নীলুফার।
উত্তর দিতে একটু দেরী হয়েছিল তার।
-কি ব্যাপার তৌফিক ভাই উত্তর দিচ্ছেন না যে। নীলুফার আবারও জিজ্ঞাসা করল।
– হাঁ, চিনি, তবে এভাবে দেখা হবে ভাবিনি কখন।
পরমারও বিস্ময়ের সীমা নেই। শুধু তাকিয়ে রইল তৌফিকের দিকে।
– তৌফিক ভাই, খুলে বলুন। রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। নীলুফার হাতে তালি দিতে দিতে বলল।
তৌফিক উত্তর না দিয়ে তাকালও নয় দশ বছরের ছেলেটার দিকে। কোঁকড়ানো চুল। শ্যামলা।
-পরিতোষ, আঙ্কেল কে নমস্কার করো। বলল, পরমা। তাকালও আবারও তৌফিকের দিকে।
পরিতোষ কাছে এগিয়ে এসে নমস্কার করেই সাকিলের ছেলের হাত ধরে চলে গেলো অন্য ঘরে।
-কি ব্যাপার, পরমা তুমিই বলও, বলল নীলুফার।
-সে অনেক অনেক ঘটনা ভাবী। এই গল্প এক রাতে শেষ হবার নয়। বলে পরমা আবারও তাকালও তৌফিকের দিকে।
সত্যি এক রাতে এই গল্প শেষ হওয়ার নয়।
ফিরে যাই সেই সময়ে। যখন তৌফিক স্কুলে পড়ে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে ছিল পরিমল। ওর বাসাতেই যাতায়াত ছিল বেশি। মুসলমানের ছেলে বলে যে ওদের বাসাতে পাত পড়েনি তা নয়। পরিমলের মা কে মাসীমা বলে ডাকত। ওরই বোন পরমা। ফোর ফাইবে পড়ে। তৌফিক আর পরিমল পড়তো ক্লাস এইটে।
ঈদের দিনে পরিমল আসতো তৌফিকের বাসায় ,পূজাতে তৌফিক যেতো পরিমলের বাসায়।
দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা বছর পাড় হয়ে গেলো।
তৌফিক স্কুল শেষে কলেজে অনার্সে ঢুকেছে। সাইন্সের ছাত্র সে। লেখা পড়ায় বেশ ভালোই ছিল।
একদিন পরিমলই বলল ওকে, তোর কি সময় হবে আমার এই মাথা মোটা বোন টাকে কোচিং করা।
-মানে? বুঝতে একটু দেরী হোল তৌফিকের।
-মানে হচ্ছে পরমার ফিজিক্স আর অংকে যে মাথা তাতে সে পাশ করতে পারবে বলে মনে হয় না। এই মাথা নিয়ে কেনও যে সাইন্স পড়তে গেলো। বেশ রাগান্বিত মনে হোল পরিমল কে।
-ঠিক আছে। সন্ধ্যায় যাবো।
চার দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিল অন্যান্য বন্ধুদের সাথে তৌফিক। সন্ধ্যা হয় হয়। হঠাৎ মনে হোল ওকে যেতে হবে পরিমলের বাসায়।
উঠে পড়লো।
পরিমলদের বাসা চৌরাস্তার মোড় থেকে একটু দুরে। হাটা পথ। রাস্তায় কিছু পরপর বিজলী বাতির আলো। তারই আলোয় হাটতে হাটতে এসে পৌছাল পরিমলের বাসায়।
দরজায় টোকা দিতেই মাসীমা এসে দরজা খুলে দিলো।
-পরিমল বলেছে তুমি আসবে, ওর আসতে দেরী হবে, গেছে ওর বাবার দোকানে। কিছু জিনিষ কেনাকাটার আছে। এই বলে সে ডাক দিল পরমা কে।
যে এলো তাকে দেখে মনে হোল যেন নুতন দেখছে তাকে। ফুলফুল কামিজের সাথে ম্যাচ করে সালওয়ার, ওড়না টা গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে।
ওর যে ওড়না পড়ার বয়স হয়ে গিয়েছে সেটা তৌফিকের মনেই আসেনি।
-বসও। শুনলাম অংকে আর ফিজিক্স এ নাকি জাহাজ।
-আগে তো তুই বলে বলতে, আজ তুমি করে বলছ যে।
-তোমাকে দেখে, এত বড় হয়ে গেছো বুঝতে পারিনি। যাক, কথা না বলে বই গুলো বের করো। বলেছিল তৌফিক।
মাসিমা সেই রাতে না খেয়ে যেতে দেয়নি।
এরপর প্রতিদিনই কি এক অদৃশ্য সুতার টানে চলে এসেছে তৌফিক। অংক আর ফিজিক্স বোঝাতে বোঝাতে অনেক কিছুই
তারা বুঝে ফেলেছে।
মাঝে মাঝে হাতের থেকে পেন টা নিতে যেয়ে হাতটা ধরে ফেলেছে। এক ঘণ্টার জাগায় তিন ঘণ্টা কেটে গেছে।
এ সেই বাল্যকালের প্রেম।
স্কুল শেষ করে পরমা এলো কলেজে। সেই কলেজে শিক্ষক হয়ে যোগ দিল তৌফিক। আড়ালে আবডালে দেখা হয় দুজনের।
পরমা বলে এখানে নয়, বাসায় এসো।
পরিমলের সাথে অনেকদিন দেখা হয়না। ও ব্যস্ত বাবার দোকান নিয়ে। কলেজ শেষ করে সে আর অন্য কোথাও কাজ নেইনি। ওর বাবার বয়স হয়েছে।
অন্যদিনের মত সেদিনও তৌফিক এসেছিল। দরজায় টোকা দিতে পরিমলই খুলে দিল দরজাটা।
-তোর তো ইদানীং দেখাই পাওয়া যায় না। বলল তৌফিক।
-ব্যস্ত দোকান নিয়ে। পরমা বলছিল তুই আসবি। চল কোথাও যেয়ে চা খাই।
তৌফিকের মনে হোল পরিমল কিছু বলতে চায়।
ওরা এসে বসলো বাসার কাছে এক চা এর দোকানে।
দুজনেই চুপচাপ।
-কিছু বলবি, মৌনতা ভাঙ্গল তৌফিক।
-বলছিলাম কি, ভেবেছিস কি কোন পথে এগোচ্ছিস তোরা। তেলে জলে কি মিশ খাবে। এই কথা বলে পরিমল তাকালও তৌফিকের দিকে।
-আমার দিক থেকে তো কোন আপত্তি নেই। তুই তো আমাকে চিনিস। জাত বেজাত নিয়ে আমি ভাবিনা।
-তুই না মানতে পারিস, তোর বাবা,মা কি বলবে তা তুই জানিস না। আর তাছাড়া আমার বাবা মা কি বলবে তাও পরমা জানে না। সেকি পারবে সব তুচ্ছ করে বেড়িয়ে যেতে? চিন্তা করে দেখ। পরমাকেও বুঝতে দে, সে পারবে কিনা এত বড় একটা রিক্স নিতে।
কথা শেষে চুপ পড়ে রইল দুজন।
পরিমলই বলল, চল।
দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল পরমা। পরিমল আর তৌফিক ভিতরে এলো হাসতে হাসতে। কাউকে বুঝতে দিলোনা ওদের মধ্যে কি কথা হয়েছে।
-তোরা দুজন কথা বল, আমি বাহিরে যাচ্ছি, আসতে দেরী হবে। বলে বেড়িয়ে গেলো পরিমল।
সেদিন অনেক কথা বলেছিল ওরা দুজনে। সংকল্প করেছিল যত বাঁধা-বিপত্তি আসুক না কেনও ওরা অটল থাকবে ওদের জীবন গড়া নিয়ে।
উপরওয়ালার কল কাঠি কি কেউ বুজতে পারে, না জানতে পারে।
অনেক দিন আগে থেকেই সবাই বুঝতে পারছিল দেশে একটা বড় সড় পরিবর্তন হতে চলেছে। এই পরিবর্তন যে এত ভয়াবহ আকার ধারণ করবে কেউ বুঝতে পারানি।
রাতের অন্ধকারে আর্মি নামলো রাস্তায়। রাজধানীর রাস্তায় যত্রতত্র গুলি বর্ষণ হতে থাকলো। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হোল দোকানপাট।
মৃত্যুর খবর আসতে থাকলো। স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে গেলো । শোনা গেলো পাকসেনারা যে কোনদিন এসে পড়তে পারে এই শহরে।
তৌফিক এলো পরিমলদের বাসায়। মাসিমা বলল, বাবা আমাদের বোধহয় চলে যেতে হবে এই শহর ছেড়ে।
-কোথায় যাবেন? উৎকণ্ঠিত স্বরে জানতে চাইলো তৌফিক। দরজার কোনে দাঁড়ান পরমা। মুখটা ফ্যাঁকাসে।
-কলকাতায়। আমার এক পিসতুতো বোন থাকে ঐখানে। দোকান আর বাড়ী টা বশীর দেখবে। অনেকদিন ধরে সে কাজ করে এই দোকানে। বিশ্বস্ত।
পরিমল হন্তদন্ত হয়ে এলো বাহিরের থেকে। চেহারায় ভীতির চিহ্ন।
-মা, দুই একদিনের মধ্যে ওরা এসে পড়বে। দেরী করা বোধহয় উচিৎ হবে না।
বলে তৌফিকের হাত ধরে বলল, আয় ভিতরে আয় কথা আছে।
আসলে কোন কথা নয়, পরমার সামনে ওকে দিয়ে বলল, আমি চান টা সেরে আসি।
-এই দেখাই কি শেষ দেখা। জিজ্ঞাসা করেছিল তৌফিক। সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছিলনা কি করবে।
-আমি আবার ফিরে আসব এইখানে। এই শহরে। তুমি যেওনা কোথাও। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল পরমা।
তৌফিক থাকেনি এই শহরে। যোগ দিয়েছিল মুক্তি বাহিনী তে। ওর বাবা মা চলে এসেছিল রাজধানীতে।
নয় মাস পরে তৌফিক ফিরে এসেছিল এই শহরে। দেশ তখন মুক্ত।
এসে দাঁড়িয়েছিল পরিমলদের বাসার সামনে। দরজায় টোকা দিতে এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করেছিল কি চায় সে।
পরিমলের বাবা মোহনলালের কথা জিজ্ঞাসা করতেই মহিলা বলেছিল, ওরা উনার কাছ থেকে কিনে নিয়েছে এই বাড়ী আর দোকান। জানেনা ওরা এখন কোথায় থাকে।
তৌফিক খুজে বের করেছিল বশীর কে। কলকাতার ঠিকানা জানতে চেয়েছিল।
সেও জানে না।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তৌফিকে চলে এসেছিল বিদেশে। আস্তানা গেরে ছিল এইখানে। বন্ধু বান্ধব জুটেছিল।
রাতের অন্ধকারে একটা কাঁটা ঘা সব সময় জ্বলত ওর বুকে। জানতে দেই নি কাউকে।
সেই রাতে নীলুফারের বাসা থেকে আস্তে আস্তে সবাই উঠে পড়লো।
পরমাও চলে গেলো। শুধু রইল তৌফিক। নীলুফারের কাছ থেকে পরমার ঠিকানা নিয়ে এলো সে ওর বাসার সামনে।
দরজায় নক করলো।
দরজা খুলল পরমা, অবাক হলনা। শুধু বলল, জানি তুমি আসবে। আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
-তুমি বস। আমি আসছি। বলে পাশে রুমে গেলো।
সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো বৈঠকখানা। পরমা আর পরিতোষের ছবি দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। অন্য কারো ছবি সে দেখতে পেলো না। পরমা এলো শাড়ীটা পাল্টিয়ে। হাল্কা হলুদ রঙের। এই রং টা তৌফিকের প্রিয়। পরমা তা জানতো।
তৌফিক তাকালও ওর দিকে। কয়েকটা সাদা চুল দেখতে পেলো ওর কানের কাছে।
বয়স হয়েছে। ওর চেয়ে তিন চার বছরেরই না ছোট।
-তোমাদের দুজনের ছবি দেখলাম।
-অন্য কারো ছবি দেখার আশা করেছিলে? একটু ব্যাঙ্গ করে বলল পরমা।
-সেটাই তো স্বাভাবিক।
-না, আর কারো ছবি নেই।
-ডিভোর্স? নাকি—একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করল তৌফিক।
-কোনটাই নয়। চোখে চোখ রেখে বলল পরমা।
-হেঁয়ালি বাদ দিয়ে সোজা ভাবে বলবে কি? অস্থির হয়ে উঠল তৌফিক।
-সে অনেক কথা, রাত শেষ হয়ে যাবে। এখন তুমি বাসায় যাও, রাত অনেক হয়েছে। খুব ধীর স্থির ভাবে বলল পরমা।
– না, না শুনে আমি যাবো না। একগুঁয়েমিতে পেয়ে বসলো তৌফিককে।
-তবে শোন। আমি, বাবা আর দাদা লুকিয়ে এসেছিলাম ওই শহরে। ভেবেছিলাম তোমার দেখা পাবো। কিন্তু পাই নি। দাদা খবর নিয়ে এলো তুমি মুক্তি বাহিনী তে যোগ দিয়েছ। তোমার বাবা মা এই শহর ছেড়ে চলে গেছে।
বাবা এসেছিলো দোকান আর বাড়ীটা বিক্রি করতে। বশীর চাচা অনেক কম দাম বলাতে বাবা অন্যের কাছে বিক্রি করলো।
কলকাতায় ফিরে এসে প্রতিদিন তোমার নামে মানত দিয়েছি মন্দিরে, যেন তুমি ফিরে আসো। বশীর চাচার কাছে কলকাতার ঠিকানা দিয়ে এসেছিলাম। তুমি তো আর ফিরে যাও নি সেই শহরে।
-কি ভাবে জানলে? একটু রেগেই বলল তৌফিক। বশীর চাচাই তো বলল তোমাদের ঠিকানা সে জানেনা।
ফুফিয়ে কেঁদে উঠল পরমা। বলল, বশীর চাচা কেনও এমন করলো। তা নাহলে তো তুমি ঠিকই আসতে কলকাতায়।
সামনে রাখা ন্য্যাপকীন দিয়ে নাক টা পরিষ্কার করলো পরমা।
তাকাল ঘড়িটার দিকে। রাত তিন টা।
-বাসায় যাবে না? গলার স্বর টা ভারী।
– যাবো, সব শুনে। কবে ছাদনা তলায় বসে ছিলে? একটু রুঢ় ভাবে বলল তৌফিক।
শান্ত ভাবে পরমা বলল, ছাদনা তলায় বসার সৌভাগ্য আর হোল কোথায় বলও। যার সাথে বসব ভেবেছিলাম সেতো আর এলোনা।
-তাহলে? পরিতোষ?
-আমার পিসতুত বোনের ছেলে। ওর বাবা,মা গাড়ী এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ায় আমি ওকে দত্তক নিয়েছি। হোল তো। এবার বাসায় যাও। তোমার দেখা যখন পেলাম আজ আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারবো।
তৌফিক উঠে দাঁড়াল।
পরমা কাছে এসে বলল, সাবধানে যেও, তোমার তো চুলে পাঁক ধরেছে দেখছি।
আধা ঘণ্টার উপর লেগে গেলো হাসপাতালে আসতে। সারাটা পথ দুশ্চিন্তাতে কেটেছে। কেন পরমা হাসপাতালে, কার কি হয়েছে কিছু না বলেই ফোন টা রেখে দিয়েছিল।
ইমারজেন্সি রুমে মুখ ডেকে বসে আছে পরমা। তৌফিক আসতেই কাঁদতে কাঁদতে বলল, পরিতোষ-
আবারও কাঁদতে থাকলো।
-কি হয়েছে পরিতোষের? জিজ্ঞাসা করল তৌফিক।
-অভারডোজ।
-হোয়াট ডু উ মিন অভারডোজ? আতঙ্কিত স্বরে জানতে চাইল তৌফিক।
-ড্রাগ অভারডোজ। বেশ কিছুদিন থেকে ওর মধ্যে একটা পরিবর্তন আমি দেখছিলাম কিন্তু বুজতে পারিনি যে ও এই পথে চলেছে। আমি কি করব তৌফিক? এই বলে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল।
তৌফিক কি বলে সান্ত্বনা দেবে বুঝে উঠতে পারছিল না।
ডাক্তার আসতেই ওরা যেয়ে দাঁড়ালো ডাক্তারের পাশে।
-পেসেন্ট কে আই সি উ তে নিয়ে গেছে। বলল ডাক্তার। তোমরা বাসায় যাও। টাইম টু টাইম খবর দেওয়া হবে। এই বলে ডাক্তার চলে গেলো।
পাঁচ দিন পর পরিতোষ বাসায় এলো। চোখের কোনে কালি। চুল আলুথালু। কারোর সাথে কথা বলে না। ঘরের মধ্যে বসে থাকে একা।
ডাক্তার বলে দিয়েছে চোখে চোখে রাখতে। রীহ্যাবে পাঠাতে বলেছে।
একমাস রীহ্যাবে থেকে ফিরে আলো পরিতোষ। আস্তে আস্তে ভালো হয়ে উঠছে মনে হোল। পরমাকে জড়িয়ে ধরে একদিন কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, মা, আমি বাঁচতে চাই।
তৌফিক একদিন বলেছিল, চল, আমরা তিনজন দুরে কোথাও বেড়িয়ে আসি। বাহিরে গেলে ওর ভালো লাগবে। এক জায়গায় থাকতে থাকতে ওর এক ঘেয়েমী এসে গেছে। আর তাছাড়া তোমারও একটু বাহিরে যাওয়ার দরকার।
ভেবো না যেখানেই যাই দুটো রুম নেবো।
ওরা গিয়েছিল কোস্টা রিকা। ছোট একটা আলাদা বাসা ভাড়া করেছিল। পরিতোষ আনন্দে আত্মহারা। এই প্রথম সে বাহিরে
এলো। পরিতোষ কে নিয়ে তৌফিক গিয়েছিল যীপলাইনে।
-আমি পারবো তো আঙ্কেল? ভয়ে ভয়ে বলেছিল মাথায় শক্ত হ্যাট টা পড়ার সময়।
-কোন ভয় নেই। আমি তো আছি। তৌফিক ওকে সাহস দিয়েছিল।
পরমা ভয় পায়। ও যায়নি। বলেছিল, তোমরা এলে আমরা হাটতে হাটতে ঐ পাহারটার কাছে যাব। আর ঐ যে আগ্নেয়গিরি ওটার কাছে যাওয়া যাবে না? জিজ্ঞাসা করেছিল তৌফিক কে।
-যাবো রাতে, জ্বলন্ত লাভা দেখতে পাবে। বলেছিল সে।
যিপলাইন থেকে ফিরে এসে পরিতোষ পরমাকে গল্প করেছিল, বলেছিল, খুব এক্সাইটমেন্ট মা। তুমি মিস করলে।
পরমা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল।
তৌফিকের মনে হয়েছিল ওর এখানে আসাটা সার্থক।
পরিতোষ ঘুমিয়ে পড়লে ওরা দুজন এসে বসলো বারান্দায়। ছোট ছোট অনেকগুলো বাসা ছড়ান ছিটানো। লাল সুরকি দিয়ে তৈরী পায়ে চলা পথ মিশে গেছে এক বাসা থেকে আরেক বাসাতে। দুই পাশে ছোট ছোট ঝাও গাছ। টিমটিম বাতি জ্বলছে গাছ গুলোর ভিতর। এ যেন মায়াপুরী। আলো আঁধারের মাঝে কোথায় যেন একটা ঝি ঝি পোকা ডাকছে। বাতাসে গাছের পাতা গুলো একে পরের উপর ঢলে পড়ছে। ঝিরঝির শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিক।
ওদের কারো মুখে কোন কথা নেই।
তৌফিক হাতটা বাড়িয়ে ছিল পরমার হাত টা ধরবে বলে। কি ভেবে গুটিয়ে নিলো।
পরমা ওর দিকে তাকিয়ে বলল, এই ভালো, কি বলও?
–
–
–
–
–