অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি

 -জহীর, জহীর বলে ডাক দিলো অনির্বাণ।

-জি, মামা। জহীর আসে দাঁড়ালো অনির্বাণের পাশে। কিছু লাগবে মামা? বলে অনির্বাণের পায়ের কাছে পরে থাকা চাদরটা উঠিয়ে পা টা ঢেকে দিলো।

-টেবিলের উপর থেকে ব্যাথার ঔষধ টা এনে দে। চা য়ের কাপ টা চেয়ারের পাশে ছোট্ট টেবিল টা তে রাখতে রাখতে বলল অনির্বাণ।

-তুমি তো কয়েক ঘণ্টা খানেক আগেই খেয়েছ দুটো ট্যাবলেট। ডাক্তার না করে দিয়েছে ঐ ঔষধ বেশি খেতে।

-বেশি বকিস না, যা বলছি তাই কর। ডাক্তার কি জানে? ব্যাথা তার না আমার। বলে একটা ধমক দিলো অনির্বাণ। 

আমার হয়েছে যত জ্বালা, বলে জহীর বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলো চায়ের কাপ টা নিয়ে।

বাহিরে শীত নয়, শীতের একটা আমেজ আছে।

 প্রতিদিন সন্ধ্যায় জহীর বাহিরের বারান্দায় অনির্বাণকে এনে বসিয়ে দেয় এই চেয়ার টাতে। 

কাজ শেষে জহীর এসে বসে মেঝেতে অনির্বাণের পাশে। সাথে বাঁশি টা। সুর তোলে। বিষাদের।

সুন্দর বাজায় সে। কোথায় শিখেছিল জানতে চায়নি অনির্বাণ।

একদিন জহীর বলেছিল এবার একটা সিনেমার গান বাজাই, মামা।

-না, চটুল গান আমার ভাললাগে না।

আর কোনদিন এই গানের কথা বলেনি জহীর।

 আজ আর জহীর এসে পাশে বসলো না। বারান্দার এক কোণে বসে রইল। বার বার তাকাচ্ছিল অনির্বাণের দিকে।

জহীরের মনে পরে , প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল অনির্বাণের সাথে।

ছোট্ট শহর গোপালগঞ্জ। সেই শহরে নতুন কলেজ খুলেছে। সেই কলেজের  ইংলিশের টিচার অনির্বাণ। অনির্বাণ আর তিন বন্ধু প্রতিদিন কলেজ শেষে এসে বসতো মতীনের চা র দোকানে। সেই দোকানে মাঝে মধ্যে চেয়ার টেবিল পরিষ্কার করতো জহীর। বয়স তখন তাঁর দশ পেরিয়েছে।

সেদিন টেবিলটা পরিষ্কার করছিলো সে। কি ভেবে তাকালও ওদের দিকে। চোখে চোখ হোল অনির্বাণের সাথে।

-নাম কি তোর? জিজ্ঞাসা করেছিল অনির্বাণ।

-জহীর।

-থাকিস কোথায়।

-রাস্তায়।

অনির্বাণের কাছে মনে হয়েছিল ছেলেটা বকাটে।

-মা, বাবা আছে? জিজ্ঞাসা করেছিল অনির্বাণ

-মারা গেছে।

-কি ভাবে?

– কি একটা রোগ হয়েছিল, জানিনা সবকিছু।

-আমার বাসায় থাকবি?

কিছুক্ষণ সে চেয়ে ছিল অনির্বাণের দিকে, কোন কথা বলে নি।

-ঠিক আছে,যা কাজ কর।

জহীর চলে যেতেই সাবীর বলেছিল, আর উ সিরিয়াস?

-কেনও না? উত্তরে অনির্বাণ চোখ তুলে বলেছিল।

-না মানে, চেনা জানা নেই। কি রকম ছেলে তা তো তুই জানিস না। থাকিস একলা।

-তাতে কি হয়েছে? জন্মানর সময় কি লেখা থাকে সে ভালো না খারাপ। ভাল খারাপ তো হয় অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। ওকে যদি চান্সই না দেই তা হলে বুঝবো কি ভাবে সে খারাপ না ভালো?

-তোর সাথে তর্ক করে লাভ নেই। তুই যা ভালো বুঝিস তাই কর। বলে সাবীর চা র কাপ টা টেনে নিলো কাছে।

পরেরদিন কলেজ শেষে জহীরকে নিয়ে এসেছিল বাসায়।

জহীরের মনে পরে, তার হাতে ছিল একটা ময়লা জামা আর চটের একটা ছালা, যেটা ফুটপাতে বিছায়ে শুত।

অনির্বাণ একবার তাকিয়েছিল ওগুলোর দিকে, কিছু বলে নি।

জহীর আজও ভুলেনি সেই মধুর ডাক টা।

-পারুলের মা, দরজা খোলো, দেখো কাকে নিয়ে এসেছি।

পারুলের মা দরজা খুলে তাকালও জহীরের দিকে।

-এটা কে?

-ভিতরে যেয়ে বলছি।

পারুলের মা প্রতিদিন সকালে আসে। রান্না করে, ঘরদোর গুলো পরিষ্কার করে রাখে।

-ওর নাম জহীর। আজ থেকে এখানে থাকবে, তোমাকে সাহায্য করবে। ঐ পাশের ঘর টা ঠিক করে দিও ওর জন্য।

আর শোন তোমার ছেলে কামাল কে বলও আমার সাথে যেন দেখা করে।

জহীর জামার শেষ প্রান্তটা দিয়ে চোখ টা মুছলও। নিজের অজান্তেই চোখে পানি এলো।

সেই নতুন জামা,নতুন প্যান্টের কথা মনে পড়ল।

কামালের সাথে গিয়ে কিনেছিল। কবে নতুন জামা গায়ে দিয়েছে মনে করতে পারেনা। একটা জামা ছিল, সেটাকে কখন কখন কোন পুকুরের পাশে বসে পানিতে ভিজিয়ে শুকাতে দিয়েছে।

আজ সেই কথা মনে করে চোখে পানি না এসে পারে।

-জহীর জহীর ডাক দিল অনির্বাণ।

হাতড়ে বেড়ানো অতীতের স্মৃতি পাশে রেখে বাস্তবে ফিরে এলো সে।

-মামা, বলও।

-আমাকে ভিতরে নিয়ে চল, কেন জানি ঠাণ্ডা লাগছে। বলে উঠে দাঁড়ালো অনির্বাণ।

জহীর নিয়ে এলো ভিতরে, বসিয়ে দিলো ইজিচেয়ারে।

-এক কাপ চা বানিয়ে আনতো। খুব খেতে ইচ্ছে করছে।

-চা খেলে তো তোমার ঘুম হবে না।

-তা নাহলে না হোক।

জহীর কথা বাড়ায় নি। শুধু ওর হাত টা অনির্বাণের কপালে ঠেকিয়ে দেখল জ্বর আছে কিনা।

চা এর পানিটা বসিয়ে দিয়ে আবারও ফিরে গেলো অতীতে।

সেদিন বিকালে, পারুলের মা বাসায় চলে গেছে।

দরজায় ঠকঠক শব্দ।

জহীর খুলল দরজা টা। এক ভদ্রমহিলা।

-কাকে চাই।

-অনির্বাণ আছে?

-আছে, আসুন, বলে বসার ঘরে নিয়ে এলো। চেয়ার টা দেখিয়ে বলল, এখানে বসুন।

অনির্বাণের সাথে চলতে চলতে সে আদব কায়দা বেশ রপ্ত করেছে।

দরজার কাছে যেতে যেতে ফিরে তাকাল মহিলার দিকে। কোন দিন এই বাসায় কোন মহিলা আসেনি ওর মামার খোজে।

-মামা, বলে দরজায় টোকা দিল।

-কি হয়েছে, দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলো অনির্বাণ।

-তোমার কাছে এক মহিলা এসেছে দেখা করতে।

-মহিলা? যেন আকাশ থেকে পড়লো অনির্বাণ।

বসার ঘরে ঢুকল অনির্বাণ।

অবাক হয়ে শুধু বলল, তৃষ্ণা তুমি?

-কেনও আসতে নেই।

জহীর রান্না ঘর থেকে শুনতে পেলো ওদের কথা ওদের হাসির শব্দ। আনন্দের হাসি।

কিছুক্ষণ পরে জহীরের ডাক পড়লো।

-দুই কাপ চা র ব্যবস্থা কর। আর কিছু আছে?

-আছে মামা, কালকের আনা মিষ্টি আর টোস্ট। জহীরের মনে হোল ও একটা বিরাট কিছু করতে চলেছে।

-এই সেই জহীর। মহিলা জহীরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো অনির্বাণ কে।

-হাঁ, ওর হাতের চা খেলে তুমি অন্য কোথাও চা খেতে চাইবে না। বলে হাসল অনির্বাণ।

এর পরে আরও কয়েকবার তৃষ্ণা এসেছে এই বাসায়। একদিন জহীর বলেছিল, তোমাকে কে কি আমি মামি বলে ডাকব?

-না, অনির্বাণ বাঁধা দিয়েছিল।

-কেন দোষ কি বলতে, ও আমাকে মামি বলেই ডাকবে।

অনির্বাণ আর কিছু বলেনি।

-কিরে তোর চা হোল? অনির্বাণের ডাক শুনতে পেলো জহীর।

আজ যেন কি হয়েছে জহীরের। বার বার ফিরে যাচ্ছে সে অতীতে।

তৃষ্ণা ছিল অনির্বাণের কলিগ। সে এসে কলেজে জয়েন করেছিল বেশ কয়েক বছর পর। অনির্বাণদের তিনবন্ধুর জোটের মধ্যে সেও এসে যোগ দিয়েছিল। ওরা হোল চার জন। আড্ডা দিতো। তৃষ্ণার অবর্তমানে তিনজন বাজি ধরত কে প্রথম প্রেম করবে তৃষ্ণার সাথে।

সেদিনের ঘটনা।

মতীনের দোকানে অনির্বাণ একা। তখনো কেউ এসে পৌঁছায়নি। প্রথমে এলো তৃষ্ণা। বসলো অনির্বাণের মুখোমুখি।

কোন ভূমিকা না করেই বলল, আচ্ছা অনির্বাণ, প্রেম করেছ কোনদিন?

একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, না করিনি। কেন বলতো।

-করবে? চাঁছাছোলা জিজ্ঞাসা।

-তোমার হাতে আছে নাকি কেউ?

-আছে।

-কে? হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলো অনির্বাণ।

-আমি। চোখেচোখ রেখে বলল তৃষ্ণা।

অবাক দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইল সে তৃষ্ণার দিকে।

একটু সময় নিয়ে বলল, ইয়ার্কি মারছ।

-না সত্যি বলছি। বাকিটা তোমার উপর। বলে মাথা নিচু করে রইল।

জহীরের মনে পরে, সে নতুন জামা, নতুন প্যান্ট পড়েছিল বিয়ের দিন। কি ধুমধাম করেই না হয়েছিল বিয়েটা।

নদীর পাড়ের হলঘর টা ভাড়া করেছিল অনির্বাণ। সাজানো হয়েছিল ফুল দিয়ে। অনেক লোক এসেছিল।

তৃষ্ণা যখন এলো এই ছোট্ট বাসা টায়, জহীরের আনন্দ ধরে না। ওরা ছুটি নিয়েছিল। বাসাতেই ছিল।

জহীর ওর মামি কে আসতে দেয়নি রান্না ঘরে। পারুলের মা আর ও নিজে সব রান্না করেছে।

টেবিলে খাবার এনে ওদেরকে ডাক দিয়েছে।

ওরা হাসতে হাসতে বেড়িয়ে এসেছে আলুথালু বেশে।

কয়েকটা বছর ছিল আনন্দ মুখর।

একদিন ডিনারে বসে অনির্বাণ বলল, আমার চোখে সব কিছু ঝাপসা লাগছে।

বলে চোখ দুটো কচলালও।

ঝাপসা গেলনা।

-কি বলছও? জিজ্ঞাসা করেছিল তৃষ্ণা। হয়তো ছানি পড়েছে। কাল ডাক্তার সাকীলের কাছে যাও। বলে ওর পাতে ভাত বেড়ে দিলো।

ডাক্তার সাকীল দেখে বলেছিল, একটা ভালো চোখের ডাক্তার দেখানো দরকার। তুমি ঢাকা তে যাও। ডাক্তার মুর্তজা কে দেখাও। আমি চিনি ওনাকে। একটা চিঠি দিয়ে দিচ্ছি। দেরী করোনা।

পরের দিন রওয়ানা দিয়েছিল ঢাকার দিকে।

ডক্টর মুর্তজা দেখে জিজ্ঞাসা করেছিল অনির্বাণকে, কোনদিন চোখে ব্যাথা পেয়েছিলে?

-হাঁ, বল এসে লেগেছিল চোখে, হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল সপ্তাহ খানেক।

– ফলো আপ টা ঠিক মত করা হয়নি। ইট ইজ টু লেট। বলে একটা ওষুধ লেখে দিয়েছিল।

কাজ হয়নি।

 আস্তে আস্তে চোখের দৃষ্টি হারিয়ে গেলো অনির্বাণের। কলেজের চাকরি টা ছেড়ে দিতে হোল।

সাবীর আর লতীফ আসতো ওর বাসায়। কি নিয়ে কথা বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারতো না। জহীর ঘরের কোণে বসে  কাঁদত।

ক্রমে ক্রমে জহীর দেখল ওর মামি আর আগের মত মামা কে সময় দেয় না। বেশির ভাগ সময় থাকে ফোনে।

 হাঁ হাঁ করে হাসে। বাসার কাজে মন নেই।

একদিন জহীর শুনল  মামা মামির মধ্যে কি নিয়ে যেন ঝগড়া হচ্ছে। শুধু একটা কথা কানে এলো।

মামি বলছে, আর আমি পেরে উঠছি না, কলেজের কাজ তাঁর উপর বাসায় এসে তোমার সেবা শুশ্রূষা।

মামার গলা শুনতে পায়নি জহীর।

এইভাবে চলেছিল বছর খানেক। তারপর আর চলল না। মামি বিদায় চেয়েছিল মামার কাছ থেকে। মামা সই করে দিয়েছিল কোর্টের কাগজে। 

যাওয়ার সময় মামি কে বলেছিল, তুমি সুখী হও।

চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়লো। কেন জানি আজ আর ঠেকাতে পারলো না। 

ওর মামা ডাকল।

-আসছি মামা, বলে চোখ টা মুছলও।

এক গ্লাস দুধ গরম করে হাতে নিলো।

-কেনও ডাকছিলে। এই নাও দুধ টা খেয়ে নাও।

Continue Reading