তিন বন্ধু। একই শহরে জন্মেছিল, সেই শহরে বড় হয়েছিল। স্কুলের শেষ পরীক্ষা দিয়ে ওরা তিন জন চলে গিয়েছিল তিন দিকে। বছর খানেক যোগাযোগ ছিল। তারপর বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। নিয়মই তাই। যে যেখানে থাকে সেই পরিবেশ টাকেই আঁকড়ে ধরে।
বিংশ শতাব্দী পেড়িয়ে এক বিংশ শতাব্দী চলছে। এর মাঝে ওদের আর দেখা হয়নি, কথা হয়নি। তখন না ছিল সেল ফোন না ছিল ফেসবুক। ওরা ভুলেই গিয়েছিল একে অপরকে।
বিংশ শতাব্দীর শেষে এলো সেল ফোন, এলো ফেসবুক। সেই ফেসবুকের পাতায় হঠাৎ একদিন তৌফিক দেখতে পেলো সুশান্তর চেহারা টা।
পিউপিল উ নো পেজে।
আগের সেই মাথা ভর্তি চুল আর নেই। চেহারাটায় কিছুটা সাদৃশ্য আছে।
প্রোফাইল খুজে দেখল, হাইস্কুলের নাম। মিলে গেলো।
যোগাযোগ হতে দেরী হলনা। ফোন নাম্বার আদান প্রদান হওয়ার সাথে সাথে কল এলো। তারপর জমিয়ে গল্প। আহসান কে খুজে পেতে খুব একটা দেরী হোল না।
ওরা তিনজন ঠিক করলো দুই সপ্তাহর ছুটি নিয়ে আসবে সেই শহরে যে খানে ওরা বড় হয়েছিল।
দিন, তারিখ ঠিক হোল।
গুগুল করে জেনে নিয়েছিল নদীর পাড়ের সেই বাংলো টা আজও আছে কিনা। ভাড়া দেওয়ার রীতি নেই, তবুও দুই সপ্তাহর জন্য দিতে অসুবিধা হবে না, বলেছিল মহীউদ্দীন সরকার। সেই বাংলো টা দেখাশোনা করে। একটু বেশি পয়সা খরচ করতে হবে, এই আর কি।
সুশান্ত এসে পৌছাল প্রথমে। কিছু বাদে এলো আহসান আর তৌফিক। চেহারার খুব একটা পরিবর্তন নেই কারো। শুধু বয়সের রেখা গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মুখমণ্ডলে। চুলে পাঁক এসেছে। আহসানের চোখে চশমা। হ্যাংলা, পাতলা সেই তিনজন আর হ্যাংলা, পাতলা নেই।
জোড়ে হাসি দিয়ে এঁকে অপর কে জড়িয়ে ধরলও।
-কোনদিন আমরা তিনজন আবার একসাথে হবো ভাবিনিরে। বলে তৌফিক তাকাল নদী টির দিকে। এই নদীর পাড় দিয়ে কত হেঁটেছে ওরা। সেই স্মৃতি আজও ভাসে মনের কোণে।
– ছোটবেলায় এই বাংলোর কাছে আসতে ভয় হতো। দুরে থেকে দেখতাম। মাঝে মাঝে সুট কোট পড়া লোকেরা থাকতো, আবার চলে যেতো। মনে পড়ে? বলে সুশান্ত তাকালও সামনের গাছটার নিচে বসে থাকা ছোট ছেলেটার দিকে।
-তা আর পড়েনা, চল বেড়িয়ে পড়ি। হাটতে হাটতে আমি যেতে চাই সেই পুকুর পাড়ের রাস্তাটার কাছে। সেই বাড়ী টা আছে কিনা দেখতে চাই। বলে আহসান উঠে দাঁড়ালো।
-তুই তো যাবিই সেখানে। সেই বাসন্তীর খোজে। তোর স্যান্ডেল টা ছিড়ে গিয়েছিল ছাদের উপর দাড়িয়ে থাকা হলুদ রঙের জামা পড়া মেয়েটার দিকে তাকাতে যেয়ে হোঁচট খেয়ে। বলে হো হো করে হেসে উঠল তৌফিক।
-একটা চিঠি ও তো দিয়েছিলি। আর সেই চিঠি পড়লো যেয়ে ওর বড় ভাইয়ের হাতে। তারপর যেন কি হয়েছিল? বলে মুচকি হাসল সুশান্ত।
-শালা, অনেকদিন ভয়ে ভয়ে কাটিয়ে ছিলাম। না জানি হেডমাস্টারের কাছে বলে দেয়। চল, বসে থাকতে ভালো লাগছে না।
ওরা বেড়িয়ে পড়লো। তৌফিক একটা পাথর কুঁচি উঠিয়ে ছুড়ে মারলও নদীতে। কচুরিপানায় ভর্তি নদীটা। পাথর টা কোথায় যেয়ে পড়লো দেখতে পেলনা সে।
বিকেলের সূর্যের তাপ টা সহ্য করা যায়। আকাশ কালো মেঘ শূন্য। ওদের চোখে ডিযাইনার রোদচশমা। কিছু কিছু লোক ওদের দিকে তাকাচ্ছে। ওরা যে এই শহরের নয়, বুঝতে ওদের দেরী হয়নি।
-এই রাস্তার কোনায় তো ভুবন চাচার কাপড়ের দোকান ছিল? উৎকণ্ঠ ভরে বলল আহসান। এই দোকান থেকেই তো বাবা ঈদের দিনে পাজামার কাপড় কিনত। এখন তো চেনাই যাচ্ছেনা রাস্তা টা কে। বলে চারিদিকে তাকালও সুশান্ত।
-এই তৌফিক দেখ, এই খানে একটা গলি ছিলনা? গলি টা দিয়ে গেলেই বা পাশে কাঞ্চন দের বাসা ছিল। সেই গলি তো আর নেই দেখছি। আহসান গলায় বিষণ্ণতাঁর ছাপ। যেন এই পরিবর্তন সে দেখতে চায়না।
ওরা হাটতে হাটতে এসে দাঁড়ালো সেই পুকুর পাড়ে। কোথায় সেই পুকুর। পুকুর ভরাট করে দালান উঠেছে। সেই এবড়ো থেবড়ো ভাঙ্গা রাস্তা টা আর নেই। বাসন্তীদের সেই বাড়ীটাও নেই। ওখানে নতুন বাড়ী উঠেছে।
আহসান কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ওই দিকে। কোন কথা বললও না। মনে হোল ও ভেবেছিল বাসন্তী হয়তো আবারও এসে দাঁড়াবে সেই ছাঁদে।
পাশ দিয়ে এক ভদ্রলোক কে হেটে যেতে দেখে আহসান এগিয়ে গেলো।
-আচ্ছা ভাই, এইখানে একটা বাড়ী ছিল সোমনাথ মজুমদারের। বলতে পারেন ওরা কোথায়?
লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আহসানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কতদিন আগেকার কথা বলছেন?
-এই ধরুন ষাটের দশকের।
-ঐ সময় তো আমার জন্মই হয়নি। আমার বাবা হয়তো জানলে জানতে পারবে।
নিরাশ হয়ে আহসান ফিরে এলো ওদের কাছে।
-চুল পাকলেই ভেবেছিস সে বয়স্ক? চল, ওর বাবা কে খুজে বের করি। তোর বাসন্তী ফুরুৎ করে উড়ে গেছে। বলে হাসতে থাকলো সুশান্ত।
এক বিংশ শতাব্দীতে এসেও ওরা ফিরে গিয়েছিল বিংশ শতাব্দীতে। মানুষ তাঁর অতীত ভুলতে পারেনা। মনে হয় আবার যদি ফিরে যেতে পারতাম সেই অতীতে।
ওরা এসেছে সেই অতীতকে খুজতে। এঁকেই বলে নস্টালজিয়া। বর্তমান তো আছেই। ভবিষৎ এঁর কথা ভেবে লাভ কি? ওটাতো দেখা যায়না।
এতদিন পরে ফিরে এসে রাস্তা গুলো চেনা মনে হচ্ছে না। পরিচিত একটা লোকের ও দেখা পেলো না। যে বাসাতে তৌফিক বড় হয়েছিল সেটা বিবর্ণ প্রায়।
যেই রেস্তোরায় ওরা মাঝে মাঝে খেলা শেষে এসে বসতো সেটার নামটা একই আছে, শুধু ভিতর টা পালটিয়েছে।
তিনটে চেয়ার টেনে নিয়ে ওরা বসলো। এক অল্প বয়স্ক ছেলে এলো অর্ডার নিতে।
অর্ডার দিয়ে সুশান্ত বলল, তোমাদের ম্যানেজার কে একটু আসতে বলবে।
ম্যানেজার হাসি মুখে এসে দাড়াতেই সুশান্ত কয়েকটা নাম বলল, জিজ্ঞাসা করলো চিনতে পারে কিনা।
ম্যানেজার এবার ওদের দিকে চোখ বুলিয়ে বলল, উনাদের মধ্যে শুধু একজনই আছেন, তবে তিনি বাসা থেকে বের হন না।
ওরা নিজেরা নিজেদের দিকে তাকালও।
আহসান বলল, চল বাংলোই ফিরে যাই।
ওরা যা খুজতে এসেছিল টা নেই, চলেগেছে অনেক পিছনে, বিস্মৃতির আড়ালে।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। ঝি ঝি পোকা ডাকছে। সামনের নদীটা অন্ধকারের ভিতর ডুবে চাচ্ছে। ওপারে কে যেন চিৎকার করে কাউকে ডাকছে।
ওরা এসে বসলো বারান্দায়।
আবু নামের একটা ছেলে কে মহীউদ্দীন বলেছিল ওদের খাবারের ব্যবস্থা এবং দেখাশুনা করতে।
সে এসে মশা মারার কয়েল টা জ্বালিয়ে দিয়ে গেলো। জিজ্ঞাসা করলো কখন ওরা ডিনার করবে।
কয়েক মিনিট ওরা চুপচাপ বসে রইল। নীস্তব্দতা টাকে ওরা উপভোগ করতে চাইলো। হৈ চৈ হীন সন্ধ্যা।
কারো মুখে কথা নেই।
তৌফিক বলল, আচ্ছা, এইযে এতকাল পরে আমাদের দেখা হোল, মধ্যে একটা বিরাট সময় আমরা কে কি করেছি, সুখ দুঃখের কথা জানতে ইচ্ছে করছে। তোর কি মত আহসান। বলে তৌফিক তাকালও ওর দিকে।
-দ্যটস এ গুড পয়েন্ট। তৌফিক তোকে দিয়েই শুরু হোক। সুশান্ত প্রস্তাব টা দিলো।
কিছুক্ষণ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে তৌফিক বলতে আরম্ভ করলঃ
এই শহর ছেড়ে চলে গেলাম। কলেজ জীবন টা পাড় করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। সেখানে পরিচয় হয়েছিল চয়নিকার সাথে।
সুশান্ত ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তা সেই যে মেয়ে টি যে তোর স্কুল জীবনে তোর জানালার কাছে এসে মাঝে মাঝে উকি দিতো। তাকে ভুলে গেলি?
হ্যাঁ, আসলেই ভুলে গেছি। সময় গুলো যেন দ্রুত চলে গেলো। বলে তৌফিক আবার আরম্ভ করলো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে এসে একটা অফার পেলাম আমেরিকা আসার। হাতছাড়া করতে রাজি নই। তাই চয়নিকাকে বললাম,চল বিয়ে করি। এক সাথে চলে যাবো ওখানে।
সে বলেছিল, আমার তো আরও এক বছর বাকি।
-তাঁর মানে বিয়ে হয়নি ওর সাথে? সুশান্ত বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল।
-আগে শোন, বড় ব্যগরা বাধাতে পারিস।
বিয়ে হোল, আমি চলে গেলাম। ও এলো এক বছর পরে।
-এতো নিতান্ত এক গেয়েমী গল্প। আবারও সুশান্তর কথায় থামতে হোল তৌফিক কে।
– আর একবার যদি তুই কোন কথা বলেছিস তাহলে আমি বলা বন্ধ করে দেবো।
-কান মললাম।
পাঁচটা বছর অনেক ঘুরলাম দুজনে মিলে। সুখ শুধু সুখ।
এক রাতে চয়নিকা বলল, এবার আমাদের পাখা গুটিয়ে বসার পালা। ছোট্ট ছোট্ট দুটো হাত বড় ধরতে ইচ্ছে করছে।
সেই মাসেই সে প্রেগন্যান্ট হোল। ডাক্তার বললও মেয়ে হবে। কত জল্পনা কল্পনা। ও বলল, নাম রাখব চন্দ্রিমা।
ঠিক সময় মতো চন্দ্রিমা এলো আমাদের মাঝে।
কথা শেষ করে তৌফিক চুপ করল।
-তারপর? জিজ্ঞাসা করল আহসান।
-তারপর, তারপর সব ওলটপালট হয়ে গেলো। চন্দ্রিমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পথে একটা বড় গাড়ী এসে ধাক্কা দিল চয়নিকা যে পাশে বসেছিল সেই দিকে।
জ্ঞান ফিরে এলো। ডাক্তার এসে পাশে দাঁড়ালো। বিষণ্ণ মুখ।
বলল, তোমার স্ত্রী কে বাচাতে পারলাম না। বাচ্চা টা ভালো আছে।
চয়নিকা চলে গেলো। রেখে গেলো চন্দ্রিমাকে আমার কাছে। নিয়তির কি পরিহাস।
কেউ কোন কথা বলছে না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো তৌফিক।
চোখের কোণ টা মুছে বলতে শুরু করলো আবার।
চন্দ্রিমা আর আমি। অফিস থেকে ছুটি নিলাম। দুঃখ বেদনা কে পাশে রেখে চন্দ্রিমার মুখটার দিকে তাকালাম।
চয়নিকার মুখ টা যেন বসান চন্দ্রিমার মুখের উপর।
মনে মনে বললাম এইতো আমার চয়নিকা। ওর মাঝে ভুলবো আমার দুঃখ।
ওকে তিলে তিলে বড় করেছি। কষ্ট যে হয়নি তা নয়। ওর মুখটা, হাঁটি হাঁটি পা পা করে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরা আমাকে দিয়ে ছিল শক্তি, বেচে থাকার প্রেরনা।
আমিই ওর মা, আমিই ওর বাবা। তাই সে ডাকে পাপামা বলে।
ওর মাঝেই আমি ভুলেছি আমার দুঃখ, পেয়েছি সুখ।
আমার কাহিনী এখানেই শেষ। আবার সুশান্তর পালা।
সুশান্ত গলা ঝেড়ে নিয়ে চেয়ারে সোজা হয়ে বসলো।
তোরা তো জানিস পড়াশোনায় আমি কোন সময়েই খুব ভালো ছিলাম না। তবুও কলেজ টা শেষ করার পরে এক আদম ব্যাপারীর সাথে যোগাযোগ হোল। তাঁরই মাধ্যমে আমি একদিন এসে পৌছালাম জার্মানিতে। বার্লিনে থাকা অবস্থায় ছোট খাটো কাজ করতাম। ভালোই চলে যেতো।
একদিন বারে বসে ড্রিঙ্ক করছি সেইখানে পরিচয় হোল পিটার সামসের সাথে। এক কারখানায় কাজ করে।
একদিন যেতে বললও ওর বাসায়।
গেলাম।
চার পাঁচ জন বন্ধু ঘরে। ঘরে ঢুকতেই বুঝতে পারলাম এই ধোঁয়া সিগারেটের ধোঁয়া নয়। প্রায় জোর করেই পিটার আমার হাতে দিলো একটা।
সেই প্রথম। সেখানে যদি সেদিন না যেতাম তা হলে আমার জীবনীটা একটু অন্য রকম করে লেখা হতো।
কয়েক মিনিটের জন্য থামল সুশান্ত।
গ্লাসের পানিটা শেষ করে আরম্ভ করল।
আস্তে আস্তে ওদের দলে ঢুকে গেলাম। নেশা খোরের সাথে থাকলে নেশা না করে কি থাকা যায়। আমাকে পেয়ে বসলো। টাকা ফুরিয়ে যেতে লাগলো মাস পাড় হবার আগেই। বাড়ী ভাড়া বাকি পড়লো।
একদিন বাড়ীওয়ালা বের করে দিলো।
পিটারের ওখানে গেলাম। দুইদিন থাকার পর সে বলল, চল আজ এক জাগায় যাবো।
জিজ্ঞাসা করিনি কোথায় যাচ্ছি।
এসে দাঁড়ালাম এক ব্যাঙ্কের সামনে। ভাবলাম পিটার হয়তো টাকা উঠাবে।
সে বলল এই মুখোশ টা পড়ে নে, ব্যাঙ্ক ডাকাতি করব।
বললাম, না আমি পারবো না।
সে জোড় গলায় বলল, তাহলে তুই আমার রুমে থাকতে পারবি না। রাস্তায় থাকবি।
টাকা আমার দরকার। নেশা মেটাতে হবে।
নিয়তি লিখে রেখে ছিল জেলের ভাত খেতে হবে, তাই ধরা পড়লাম ব্যাঙ্ক ডাকাতি করতে যেয়ে।
সাত বছরের জন্য জেল হোল। সেখানেই পরিচয় হয়েছিল ইব্রাহীমের সাথে। কনভারটেড মুসলমান। আগে নাম ছিল আলেক্স। খুনের দায়ে পঁচিশ বছরের কারাদণ্ড তাঁর। আবদুল্লাহ নামে এক কয়েদি ওকে একদিন বলেছিল, যাবে সেখানে যেখানে আমরা নামাজ পড়ি। ও বসে থাকতো। একদিন আবদুল্লাহ কোরআনের ইংরাজি অনুবাদ বইটা দিয়ে বলেছিল, পড়ে দেখো। পড়ে সে কি পেয়েছিল সেই জানে, এসে বলেছিল আমি তোমাদের ধর্মে দীক্ষিত হতে চাই।
পরে সে ইমামতি করত।
সেই আমাকে কোরআন পড়া শেখাল। আমিও কনভার্ট হলাম।
-তাহলে তোর নাম টা? জিজ্ঞাসা করলো তৌফিক।
সুশান্তর সাথে ইসলাম যোগ করে নিয়েছি।
বেশ, তারপর।
আমি আস্তে আস্তে পালটিয়ে যেতে লাগলাম। আমার সামনের কালো পর্দা সরে গেলো। নতুন আলোর সন্ধান পেলাম।
সাতটা বছর কাটিয়ে যেদিন বেড়িয়ে আসবো, ইব্রাহীম একটা চিঠি দিয়ে বলল, এই ঠিকানায় যোগাযোগ করে চিঠি টা দেবে, আমি সব বলে রেখেছি।
মসজিদের পাশেই বাড়ীটা। মসজিদের ইমাম নাজাম। ওই বাসাতেই আমার থাকার জায়গা হোল। এখনো ওখানেই থাকি।
ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে কিছুটা জানার চেষ্টা করছি। আর মসজিদের দেখাশুনা করি।
সবই নাজাম সাহেবের জন্য।
সুশান্ত ইসলাম আজ ভিন্ন মানুষ। যা পেয়েছি তাতেই আমি সুখী।
এবার আহসানের কথা।
আবু কে ডাক দিয়ে চা দিয়ে যেতে বলল তৌফিক।
চা টা দিয়ে গলা ভিজিয়ে আহসান আরম্ভ করলো তাঁর কথা।
দেশে বড় এক ব্যাঙ্কের ম্যনেজার ছিলাম। দৈব যোগে আমার কলিগ অমিতের বাসায় দাওয়াত খেতে যেয়ে
দেখা হয়েছিল সেলীনার সাথে। অমিতের চাচা তো বোন। থাকে লন্ডনে। বেড়াতে এসেছে।
-জিজ্ঞাসা করেছিলাম সেলীনাকে, কতদিন থাকবেন?
উত্তরে বলেছিল তিন মাস।
একদিন লাঞ্চ ব্রেকে অমিত প্রশ্ন করলো, বিয়ে করবি?
-হোয়াট? বুঝে উঠতে একটু দেরী হোল। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, কাকে?
-সেলীনা কে?
আবারও এক ধাক্কা।
-হ্যাঁ, ঠিক বলছি। সেলীনা রাজি, এখন তুই রাজি থাকলেই হয়।
ওকে যে আমার ভালো লাগানি তা নয়। বললাম, বাবা মার সাথে আলাপ করে জানাবো।
বাবা মা অরাজি হবে না জানি।
তাই শুভস্য শীঘ্রম।
আমাদের বিয়ে হয়ে গেলো। সেলীনাকে ফিরে যেতে হবে।
-তারমানে তৌফিকের মত প্রেম করে নয়? সুশান্ত জানতে চাইলো।
না, তবে দুই একবার বসেছি রেস্তোরায়।
তারপর? জিজ্ঞাসা করল সুশান্ত।
ও চলে গেলো।
তাঁর মাস ছয়েক পরে আমিও পাড়ি জমালাম। পিছনে রেখে গেলাম বাবা মা কে। ওটাই ছিল মনকষ্ট। জানিস তো আমিই একমাত্র সন্তান।
বলে ছিলাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের কে নিয়ে যাবো।
দুই বছর পেড়িয়ে গেলো সংসার টা গুছিয়ে নিতে।
এক রাতে খবর এলো বাবা হার্টফেল করে মারা গেছে।
সাথে সাথে দেশে ফিরে এলাম। মা একা। চোখের জল শুধু ঝরছে। বাবা,মা ছিল এক বৃন্তে দুটি ফুল।
সেলীনা বলল, তুমি কিছুদিন থেকে মা কে নিয়ে আসার ব্যবস্থা কর।
তাই করলাম।
নিয়ে এলাম সাথে করে।
অনেক অনেক বছর কেটে গেলো। বাচ্চা কাচ্চা নেই আমাদের।
মা আস্তে আস্তে ভুলে যেতে থাকলো সব কিছু। ডাক্তার বলল উনার Alzheimer disease. বাহিরে যেন কখন একা না যায়। রাতের খাওয়ার শেষে সেলীনা মা র চুল বেঁধে বিছানায় শুইয়ে দিতে গেলে মা বলে, বৌমা রাতে তোঁ আমাকে খেতে ডাকলে না তোমরা। চোখে জল আসে। সব সেলীনাই করে, গোছল দেওয়া থেকে আরম্ভ করে খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত।
কাজ ছেড়ে দিয়ে মা র সেবাই সে মগ্ন।
আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি। পরের মেয়ে নয় এ যেন তাঁরই মেয়ে। মন টা ভরে যায়।
এর চেয়ে সুখ আর কি বল।
এই বলে আহসান থামল।
সবাই চুপ।
তৌফিক মৌনতা ভেঙে বলল, সুখ টা হচ্ছে একটা রিলেটিভ টার্ম। এই তো দেখনা আমরা সবাই সুখী তিন ভাবে।
আবু এসে বলল, স্যার, খাবার টেবিলে দিয়েছি।