পকেটমার

 ধড়মড় করে উঠে বসল সানু। চোখ কচলাতে কচলাতে তাকালও সামনে দাঁড়ানো লোকটার দিকে।

ওহ, কনেস্টবল।  ওর লাথি খেয়ে ঘুম টা ছুটে গেছে।  মনে মনে কনেস্টবল কে গালাগালি দিলো ওর বাপ মা তুলে। এই ব্যাটার কি এসে যায় এই স্টেশনের চত্বরে ও ঘুমালে। ঐ শালা কি জানে সানুর বাসা ঘর বলে কিছু নাই। এই মেঝেই তার বাসা। এই গায়ের কম্বল টাই তার সম্বল।

-এই ওঠ এখান থেকে। বলে লাঠি টা দিয়ে একটা খোঁচা দিলো সানু কে।  

-যাওয়ার তো কোথাও জাগা নেই। ভাই।

-ভাই, ভাই বলবি না। আমি ফিরে এসে যদি দেখি এখানে তবে তোর হাড্ডি ভেঙে দেবো। বলে কনেস্টবল অন্য দিকে গেলো।

সানু কম্বল টা গায়ে পেঁচিয়ে উঠে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো পাশের পানির কল টার দিকে। মুখ হাত টা ধুয়ে নিলো। ট্রেন টা আসবে আর একটু পরে। পনের মিনিট থামবে। এই সময়ের মধ্যে কয়েকটা কামরায় যেয়ে হাত পাতলে কেউ কিছু দেবে। একটা রুটির পয়সা উঠলে আজকের সকাল টা চলে যাবে।

কালু টা আজ ওর সাথে শুতে আসেনি। কোথায় গেছে কে জানে।

ট্রেনটা এসে দাঁড়ালো। সানু দৌড়িয়ে যেয়ে একটা কামরায় উঠে পড়ল। হাত পাতলো। কেউ দিলো কেউ বলল, কাজ করতে পারিস না? এই বয়সে ভিক্ষাবৃত্তি আরম্ভ করেছিস।

আর একজন সাথে যোগ দিলো, বলল, এটাই তো সহজ পন্থা।

এইসব কথা সানুকে শুনতে হয় প্রতিদিন। পেটের জ্বালা কি তাতো ওরা জানে না। কাজ করতে চেয়ে ছিল। পায়নি। কেউ দেয়নি। ভাবে ও বোধ হয় চোর। সব চুরি করে নিয়ে পালাবে।

ট্রেন টা চলে গেলো। এবার সে আস্তে আস্তে রওয়ানা দিলো বাসস্টেন্ডের দিকে। ওর বয়সী আরও দুজন আছে। কালু আর ফকা। দিন শেষে সন্ধ্যা নামলে ওরা এসে বসে ট্রেন স্টেশনের বেঞ্চে। নয়টার সময় শেষ ট্রেন টা চলে গেলে ওরা শুয়ে পরে।  কোনদিন বেঞ্চে কোনদিন মাটিতে।

এমনি একদিনে সানু,কালু আর ফকা শোয়ার ব্যবস্থা করছিল। সামনে এসে দাঁড়ালো একজন। কোট পড়া। ওরা ভাবল পুলিশের কোন লোক হবে। কম্বল টা হাতে নিয়ে সানু দৌড় দিতে যাবে, লোক টা ওর হাতটা চেপে ধরলও।

-আমাকে ছেড়ে দিন আমি আর এখানে শোবো না।

-বয়স কত?

-চোদ্দ।

-কাজ করতে চাস?

সানু ভ্যাবাচেকা খেয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

-কি? চাস কাজ করতে? ধমক  দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো লোকটা।

-চাই তো। মিনমিন করে বললও সানু।

-তবে চল আমার সাথে। বলে লোকটা ওর হাতটা ছেড়ে দিলো।

ওরা লোকটার পিছন পিছন মন্ত্রমুগ্ধের মত চলতে থাকলো। লোকটা একবারও পিছন ফিরে তাকালও না।

এসে দাঁড়ালো একটা জীপের কাছে।

-ওঠ। বলে লোকটা উঠে বসলো সামনে। ওরা পিছনে বসলো।

বুকটা দুরুদুরু করছে। একজন আর একজনের দিকে তাকালও। কাজ পাবে এই আশাতেই তারা দৌড় দিয়ে পালায়নি।

গাড়ীটা এসে দাঁড়ালো একটা টিনের ঘরের কাছে। দেখে মনে হোল গুদাম ঘর। লোকটা নেমে এলো। ওরা তিনজন নেমে লোক টাকে অনুসরণ করে এসে দাঁড়াল দরজার সামনে। দুটো টোকা দিতেই একটা লোক এসে দরজাটা খুলে দাঁড়ালো।

কোট পড়া লোকটা ঢুকল না। শুধু বলল, শম্ভু, এদের কে শিখিয়ে পড়িয়ে নিবি। আমি সাতদিন পরে  আসব।

লোকটার কথার মধ্যে কি যেন একটা আছে যাকে অবহেলা করা যায় না।

-জি বস। বলে লোক টা ওদের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করলো ভিতরে ঢুকতে।

ভয়ে ভয়ে ওরা এলো ভিতরে। সানু যা ভেবেছিল তাই। এটা একটা গুদাম ঘর। মেঝেতে লম্বা করে মোটা কম্বল পাতা। পাঁচ ছয় টা ওরই বয়সের ছেলে বসে আছে। ওদের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছিল।

লোক টা এবার তাকালও সানুদের দিকে। পাশে রাখা একটা লাঠি উঠিয়ে নিলো হাতে।  

বলল, আমার নাম শম্ভু। এখানকার সর্দার। আমি যা যা বলব তাই করবি। তা নাহলে হাত কেটে ফেলব।

ঐ কোনায় তোদের জায়গা। কাল থেকে ট্রেনিং শুরু হবে।

কি ট্রেনিং,কিসের ট্রেনিং কিছুই বুঝতে পারলো না।

কালু জিজ্ঞাসা করতে মুখটা শুধু খুলেছিল, সানুর চিমটি খেয়ে চুপ করে গেলো।

আস্তে আস্তে ওরা যেয়ে শুয়ে পড়লো ঘরের কোনটাতে।

শম্ভু আলোটা নিভিয়ে দিলো। অন্ধকারে ছেয়ে গেলো ঘরটা।

দরজা খোলার শব্দ পেলো ওরা। শম্ভু বেড়িয়ে গেলো। ঝুম করে একটা আওয়াজ হোল। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো। বাহিরে তালাটা ঝুলতে থাকলো।

অনেকদিন পর ওরা ঘুমিয়ে ছিল। উপরে ছিল ছাদ, পাশে ছিল দেওয়াল। পাশের ছেলেটার ধাক্কাতে ঘুমটা ভেঙে গেলো।

-এই ওঠ, এখনি সর্দার আসবে। ঘুমাতে দেখলে হাতের বেত টা দিয়ে পাছার ছাল ছিরে ফেলবে।

-নামটা কি তোর ? চোখ কচলাতে কচলাতে জিজ্ঞাসা করলো সানু।

-চন্দন। এক মুখ হাসি দিয়ে বলল সে।

-সকালে খাওয়া দেবে? বেশ অস্থির ভাবে জানতে চাইল কালু।

-দেবে, সর্দার নিয়ে আসবে। পোলাও করমা খাবি? বলে হাসতে থাকলো চন্দন।

-কি কাজ করতে হবে? সানু জানতে চাইল।

-চন্দন হাসতে হাসতে বলল, কাটিং।

-কাটিং?

-হ্যাঁ। মানে—

কথা শেষ হোল না। দরজা খোলার শব্দ পেলো ওরা।

সর্দার ঢুকল। হাতে ব্যাগ। 

সবাই উঠে দাড়িয়ে লাইন দিল। চন্দন পা দিয়ে ঠেলা দিলো সানু কে।

ওরা তিনজন তাড়াতাড়ি করে দাড়িয়ে পড়লো সবার পিছনে। বুঝতে পারলো না কি হতে চলেছে।

সর্দার ব্যাগ টা রাখল টেবিলের উপর। বের করলো রুটি আর হালুয়া।  

একে একে সবাই নিলো দুটো করে রুটি আর হালুয়া। যেয়ে বসলো যার যার জাগায়।

-বুলু, চন্দন, মতি, তোরা যাবি বান্দর নগর বাস টার্মিনালে। মহি, স্বপন, ঝীলু, তোরা যাবি রেল ষ্টেশনে। ঠিক ছয়টায় দেখা করবি আমার সাথে।

 এই তিন ছোড়া এদিকে আয়। বলে ডাক দিলো ওদের কে।

সর্দারের হাতে একটা বেত। বাড়ি দিলো টেবিলে।

সানু, কালু আর ফকা এসে দাঁড়ালো সর্দারের সামনে। হাত পা কাঁপছে। বেশ ভালই তো ছিল, এ কিসের মধ্যে এসে পড়লো। এখনো জানে না কি করতে হবে।

সানু ভাবছিল, খাওয়া টা ভালই ছিল। রুটি, হালুয়া। কতদিন  এই রকম পেট ভরে খায়নি।

চন্দন আর ওরা সবাই বেড়িয়ে গেলো।

-কি করতে হবে জানিস? বলে বেত টা দিয়ে আবারও টেবিলে একটা বাড়ি মাড়ল।

-না, জানি না। গলার স্বর টা নামিয়ে বললও ফকা।

-কাটিং করতে হবে, মানে পকেট মারতে হবে। বুঝলি কিছু? বলে চেয়ার  থেকে উঠে এসে দাঁড়ালো সানুর সামনে। আজকের থেকে তোদের ট্রেনিং শুরু। তিন দিন ট্রেনিং দেবো। তারপর রাস্তায় নেমে যাবি।

মনে রাখিস, আমি কিন্তু সব সময় তোদের চোখে চোখে রাখবো। কোন রকম চালাকি করার চেস্টা করেছো কি বাছাধন, কল্লাটা ফুঁস। বুঝেছিস?

সানু তাকালও কালুর দিকে। মনে হোল ও গামছে। কেমন যেন ফ্যাকাসে মুখ।

সানু গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বলল, সব বুঝেছি স্যার।

-স্যার? রাখ তোর স্যার, সর্দার বলে ডাকবি, মনে থাকবে?

-থাকবে সর্দার।

বুকে হঠাৎ করে যেন বল এলো সানুর।

-এদিকে আয়। দাড়া আমার সামনে। এই মানিব্যাগ টা আমি কালুর পকেটে রাখছি। কালু বাসে উঠতে যাচ্ছে, আর আমি এই ভাবে—

বলে দেখালও মানিব্যাগ টা  কি ভাবে কালুর পকেট থেকে চলে এলো সর্দারের হাতে।

ট্রেনিং শুরু হয়ে গেলো।

রাতে চন্দন এসে শুয়ে পড়লো। কোন কথা বলল না। যার মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকে তার মুখ টা অন্ধকারাচ্ছন্ন।

-কি হয়েছে তোর? সানু ওর পাশে এসে বসলো।

চন্দন তাকালও সানুর দিকে, চোখ টা ছলছল, বলল, জানিস, আজ যে মেয়েটার ব্যাগ থেকে টাকাটা নিয়ে নিলাম সেই টাকা ওর মা ওষুধের টাকা।

-তুই জানলি কি ভাবে?

-মেয়ে টা কাঁদতে কাঁদতে বলছিল। আমি একটু দুরে দাড়িয়ে শুনছিলাম। একটা বুড়ো লোক এসে কয়েকটা টাকা ওর হাতে দিয়ে বলল, যাও মা, দেখো এটা দিয়ে ঔষধ কিনতে পারো কিনা।

-শুয়ে পড়। বলে ও নিজের চোখ টা মুছে কম্বল টা টেনে নিলো গায়ের উপর।

ট্রেনিং শেষ।

ঠিক সাত দিনের দিন বস এলো। সন্ধ্যায়।

সর্দার একটা ব্যাগ বসের হাতে ধরিয়ে দিলো। কোন কথা নয়। শুধু চোখাচোখি। বস বের হয়ে গেলো।

কাজে লেগে গেলো সানু, কালু, ফকা। একেক দিন একেক স্থানে। দিন শেষে যা রোজগার হয় তা নিয়ে ওরা সবাই এসে মিলিত হয় এক মিষ্টির দোকানের পিছনের ঘরে। সেখানে বসে থাকে সর্দার। ওর হাতে উঠিয়ে দেয় সারাদিনের রোজগার।

মাস শেষে ওরা কিছু পায়। তাতেই ওরা খুশি। ওই টাকা দিয়ে ওরা আনন্দ করে। মাঝে মাঝে সিনেমা দেখে।

কয়েক মাস কেটে গেছে। সানু হাতের সাফাই ভালো রপ্ত করে ফেলেছে। ট্রেনে, বাসে যেখানে ভিড় সেখানে সে ওঠে। একদিন বাসে এক ধোপদুরস্ত ভদ্রলোক উঠতে যেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, পিছনে ছিল সানু। হাতদিয়ে ঠেকালও তাকে। ভদ্রলোক পিছন ফিরে ধন্যবাদ জানালো সানুকে। ইতিমধ্যে সে নিয়ে নিয়েছে মানিব্যাগ টা।

বেশ মোটাসোটা মানিব্যাগ। দাঁড়ালো না সেখানে সানু। দ্রুত পায়ে চলে এলো। বসলো এসে এক চা র দোকানে।

খুললও মানিব্যাগ টা। অনেক গুলো টাকা। এত সুন্দর মানিব্যাগ সে দেখেনি আগে। কয়েকটা ভাঁজ ব্যাগটাতে।

একটা ভাঁজ খুলতেই দেখতে পেলো একটা ছোট্ট মেয়ের ছবি।

বের করলো সে। ধরল চোখের সামনে। তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ।

ছবি টা মনে করিয়ে দিলো ওর ছোট্ট বোন টির কথা। আপন না। সৎবোন। নাম ছিল টিঙ্কু।

মা মারা যাবার পর বাবা বিয়ে করে ছিল। সৎমা প্রথম থেকেই কেনও জানি ওকে দেখতে পারতো না। শুধু নালিশ দিতো বাবার কাছে। বাবা কোনদিন গায়ে হাত তোলেনি। শুধু বলতো, মার কথা শুনে চলিস।

সৎমা প্রায় ওকে মারত। বলত, দুর হয়ে যা এখান থেকে।

টিঙ্কু এসে জড়িয়ে ধরত। বলত, না, ভাইয়া কোথাও যাবে না।

ওকে কাঁধে করে নিয়ে বেড়িয়ে পড়তো। যেয়ে বসতো আম গাছটার নিচে। অঝোরে কাঁদত। শুধু বলত, মা কেন তুমি আমাকে রেখে চলে গেলে। টিঙ্কু ওর ছোট ছোট হাতটা দিয়ে চোখ দুটো মুছিয়ে দিতো।

একদিন ওর বাবা আসতেই মা নালিশ দিলো, সে তার কানের দুল পাচ্ছে না। টেবিলের উপর ছিল। ওর বদ্ধ ধারনা সানু নিয়েছে। সে নাকি ওকে এখানে ঘুরঘুর করতে দেখেছে।

বাবার সেদিন কোন কারনে মেজাজ ভালো ছিল না। হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো সামনে।

জিজ্ঞাসা করলো, নিয়েছিস দুল টা।

-না নেই নি।

-তবে কোথায় গেলো এখান থেকে।

– আমি জানি না।

এই প্রথম বাবা ওর গায়ে হাত তুলেছিল। সেই রাতেই সানু বেড়িয়ে গিয়েছিল বাসা থেকে। শুধু কিছু বলে আসতে পারেনি ছোট্ট বোন টাকে।

অনেকদিন পড়ে মনে পড়ল বাবা কে, টিঙ্কু কে।

মানিব্যাগটা আর ফটো টা রাখল এক পকেটে। টাকা গুলো অন্য পকেটে।

মাঝে মাঝে ভাবে একাজ ছেড়ে দেবে। কিছু টাকা জমেছে। অন্য কোথাও চলে যেয়ে কোন দোকানে কাজ নেবে। কিন্তু সে জানে সর্দারের চোখ চারিদিকে। তাছাড়া বসের লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারিদিকে। পালাবার পথ নেই।

পালাতে চেয়েছিল ঝীলু, পারেনি।  

সেদিন দিনশেষে ঝীলু ফিরে আসেনি ছোট্ট ঘরে। গাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল অন্য কোথাও। শেষ ট্রেনে চলে যাবে ভেবেছিল। উঠেও  ছিল। ট্রেনটা ছেড়ে দিতেই ভেবেছিল, যাক এবার পগার পাড়।

না, পরের ষ্টেশনে দুইটা ষণ্ডা মার্কা লোক উঠলো। এসে বসলো ঝীলুর পাশে। জামাটা উঠিয়ে দেখালও চকচকে ছুরি টা। নামতে বলল।

দুইদিন পরে ফেলে রেখে গেলো ওকে গুদাম ঘরে। সারা শরীরে চাবুকের দাগ। সবাই মিলে শুইয়ে দিলো।

রাতে ঘুমের মাঝে চিৎকার করত। আস্তে আস্তে কথা বলা বন্ধ করে দিলো। একদিন সকাল বেলা ওরা সবাই বেড়িয়ে পড়লো কাজে। ফিরে এসে ঝীলু কে দেখল না। সর্দার কে জিজ্ঞাসা করতেই বলল, ওকে নিয়ে গেছে হাসপাতালে।

সেই শেষ, ঝীলু আর ফেরেনি।

ঝীলুর মুখ টা সানু ভুলতে পারে না। কথা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল, সানু পারবি ঐ বদমাশ বস টাকে মারতে। আমি আমার সেই গ্রামটাতে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম। ওরা আমাকে যেতে দিলো না। আমি আবার নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিলাম। ঐ বদমাশ টা আমাকে বাঁচতে দিলো না।

সেই শেষ কথা। ঝীলু আর কথা বলেনি।

সেদিন রোজগার খুব একটা ভালো হয়নি সানুর। সর্দারকে  কৈফিয়ত দিতে হবে। মনটা খারাপ ছিল। বাস থেকে নেমে এক ফলের দোকানের সামনে দাঁড়ালো। ভাবল একটা কলা খাবে। এমন সময় এক বয়স্ক লোক হন্তদন্ত হয়ে এসে দাঁড়ালো। বেশভূষায় গরিবিয়ানার ছাপ।

-ভাই দুটো কলা আর কয়েক টা খেজুর দেন। বলে মাজায় বাঁধা একটা পুঁটলি বের করলো।

সানু তাকিয়ে দেখল অনেক গুলো টাকার থেকে বিশ টাকা বের করে দোকানি কে দিয়ে আবারও হন্তদন্ত হয়ে হাটতে থাকলো।

সানুর কলা কিনা হোল না। লোকটাকে অনুসরণ করে ভিড়ের মধ্যে এসে দাঁড়ালো ওর পাশে। একটু ধাক্কা দিতেই লোকটা পড়ে যাওয়ার আগেই সানু ওকে জড়িয়ে ধরলও।

-সাবধানে হাঁটবেন। চোট লেগেছে?

-না, ঠিক আছি, বাবা। বলে আবারও দ্রুত চলতে থাকলো।

কাজ হয়ে গেছে। সানুর হাতে সেই পুঁটলি টা। খুলে দেখল অনেক অনেক টাকা। উপরওয়ালা কে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে এসে বসলো চা র দোকানে। চা র সাথে আজ সে ডালপুরি খাবে ঠিক করলো। বেশ তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছিল, এমন সময় দৌড়িয়ে এলো চন্দন, হাপাচ্ছে।

-কি হয়েছে? চা খাবি? জিজ্ঞাসা করতেই চন্দন বলল, চল হাসপাতালে, ফকাকে অনেক মেরেছে লোকেরা। হাতেনাতে ধরা পড়েছিল। চল,চল তাড়াতাড়ি।

খাওয়া টা শেষ করতে পারলো না।

হাসপাতালের গেটের কাছে আসতেই দেখল এক বুড়ো কাঁদছে আর হাত পেতে লোকের কাছে টাকা চাইছে। ওকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেয়ে থমকে দাঁড়ালো সানু।

সেই ফলের দোকানে দেখা বয়স্ক লোকটা।

সানু দাঁড়াল।

-এই চল তাড়াতাড়ি। চন্দন হাত ধরে টান দিল।

-তুই যা আমি আসছি। বলে একটু কাছে এলো লোকটার।

শুনতে পেলো কাঁদতে কাঁদতে বলছে, আমার ছেলের অপারেশন হবে। তাই বাড়িঘর জমিজমা বন্ধক রেখে টাকা এনেছিলাম। হারিয়ে গেছে সেই টাকা। আমার ছেলের আর অপারেশন হবে না। ওকে আমি বাচাতে পারলাম না। বলে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলো।

সানু কয়েক সেকন্ড তাকিয়ে রইল বুড়োর মুখের দিকে। এগিয়ে এলো বুড়োর কাছে।

পকেটে হাত দিলো। বের করলো সব টাকা গুলো। বুড়োর হাতে দিয়ে বলল, তোমার ছেলের অপারেশন হবে।

বলে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো। বুড়ো কত ডাকল ওকে। সানু ফিরে তাকালও না।

শুধু মনে মনে ঠিক করল, আর নয়। এই পেশা এখানেই শেষ।

সন্ধ্যায় সবাই এসে বসলো সেই ছোট্ট ঘরে। গুনে গুনে টাকা দিলো সর্দার কে। শুধু সানু ছাড়া।

সর্দার তাকালও সানুর দিকে।

সানু বলল, আজ থেকে আমি আর তোমাদের সাথে নেই। আমি চললাম।

বলে সে বেড়িয়ে এলো রাস্তায়।

সেইদিন থেকে সানুকে আর দেখা যায়নি ঐ শহরে।

Continue Reading