কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল অনন্ত। মাথাটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। লোক টার গলার স্বর টা চিনতে চেষ্টা করল। যদি চেনা জানা হবে তবে ফোনটা কেটে দিলো কেনও? হাজার চিন্তা মাথায়। আস্তে আস্তে উঠে যেয়ে দাড়ালো মেডিসিন কেবিনেটর সামনে। ব্যথার ঔষধের বোতল টা খুলে দুটো ট্যাবলেট মুখে দিয়ে দিলো। যদিও ব্যথাটা অতটা তীব্র নয়। সেইক্ষণে ফোনটা বেজে উঠলো।
যাক এতদিনে তৃপ্তির মনে পড়লো ফোন করার কথা। মনে মনে একটা ছক কেটে নিলো কি কি সে জিজ্ঞাসা করবে। এও ভেবে নিলো সঠিক উত্তর সে পাবে না। তাড়াতাড়ি ড্রয়াইং রুমে যেতে যেয়ে হোচট খেয়ে পড়ে গেলো মেঝেতে। ততক্ষণে ফোনের রিং টা বন্ধ হয়ে গেছে। সময় নিয়ে অনেক কষ্টে উঠে দাড়ালো অনন্ত। ধীর পায়ে এসে ফোনটা হাতে নিলো। মিস কলটা দেখল কোথা থেকে এসেছে। না, তৃপ্তির কল নয়। সুপর্ণা কল করেছিল।
অনেকদিন সুপর্ণার সাথে যোগাযোগ নেই। সে আজই বা কেন কল করতে গেলো ? দুশ্চিন্তা টা আরও পাকিয়ে উঠল অনন্তের মাথায়। সাহস পেলো না সুপর্ণা কে কল করতে। টিভি টা চালিয়ে দিলো। টিভির পর্দায় চোখ কিন্তু মন টা তার অনেক দুরে।
কখন যে সোফাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে পড়ে না। এ ঐ পেইন কিলারে কারসাজি। চোখ টা যখন খুললও রাত তখন তিন টা।
সন্ধ্যা হয় হয়। বাসার সামনে গাড়ীর শব্দ শুনল অনন্ত। ইচ্ছে করেই উঠলো না সোফা থেকে। দরজা খোলা এবং বন্ধ হওয়ার শব্দ পেলো। ঘাড় ফিরে তাকালও। চোখাচোখি হোল তৃপ্তির সাথে। তৃপ্তি কোনো কথা না বলে সুটকেস টা নিয়ে ওর ঘরের দিকে চলে গেলো।
সাওয়ার শেষে তৃপ্তি এসে বসলো সোফার এক কর্নারে। চাদা থাই রেস্টুরেন্টে অর্ডার দিলো। তারপর তাকালও অনন্তের দিকে। অনন্তও তাকালও তৃপ্তির দিকে।
-তোমাকে কয়েক বার কল করেছিলাম। গম্ভীর ভাবে বলল অনন্ত।
-জানি, মিস কল দেখেছি। বলল তৃপ্তি।
-তোমার ফোন অন্য কেউ ধরেছিল।
-তাও জানি। নিষ্প্রভ ভাবে বলল তৃপ্তি ফোনটার দিকে তাকিয়ে।
-এক্সপ্লেন করবে? উত্তেজিত না হয়ে জিজ্ঞাসা করলো অনন্ত।
-এক্সপ্লেন করার কিছু নেই।
-কেন? আমার জানতে ইচ্ছে করে না? এবার গলার স্বর টা একটু উপরে ছিল অনন্তের।
-তুমি যে ভাবে ইচ্ছা সে ভাবেই ভাবতে পারো, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
-আমি ভাবতে চাই না জানতে চাই। তুমি কি চাও আমাদের সম্পর্ক এখানেই শেষ হয়ে যাক?
-সে কথা তো আমি বলিনি। সে তো তুমি বলছ। বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো তৃপ্তি।
উবার খাবার টা রেখে গেছে দরজার কাছে।
সে রাতে দুজন এক টেবিলে খেতে বসল না। খাওয়া শেষে যে যার রুমে চলে গেলো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে অনন্ত তৃপ্তি কে দেখতে পেলো না। ফোন করতে ইচ্ছে করলো না।
ফোন করলও তার বোন সায়লা কে। শুধু বলল আমি আসছি আজ রাতের ফ্লাইটে।
একটা চিরকুট রেখে গেলো টেবিলের উপর, লেখা, সায়লার ওখানে যাচ্ছি। অস্থির মন টাকে বাগে আনতে। কবে ফিরবো জানিনা।
সুটকেসে ভরে নিলো ঔষধ গুলো, লাঠি টা নিলো সাথে। যেটা তার নিত্ত সঙ্গী।
অনেক দিন পরে এলো যেখানে গোল্ডেন ব্রিজ, সেই শহরে।
সায়লা আর মাহমুদ দাড়িয়ে ছিল বাহিরে। দুরের থেকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে মাহমুদ অনন্তের হাত থেকে সুটকেস টা নিয়ে নিলো। বলল, হেটে যেতে পারবে অনন্ত।
অনন্ত আর মাহমুদ একই সাথে পড়ত। সেই সুবাদে পরিচয় হয়েছিল সায়লার সাথে।
-পারব, তবে একটু সময় লাগবে যেতে।
-কোন সমস্যা নেই। আমাদের হাতে অফুরন্ত সময়। বলে সায়লা আর একটা হাত ধরল।
-না, ধরতে হবে না।
মাহমুদ চোখের ইশারায় সায়লাকে না করলো ধরতে।
-অনেকদিন পরে এলে ভাইয়া। সামনে থ্যাংকসঘিভিং। খুব মজা হবে।
-তোর সেই টটন ভাই আছে এখনো? সেই বার থ্যাংকসঘিভিং করেছিলাম। খুব মজা হয়েছিল।
-হ্যাঁ, এবারও সেখানেই হবে। ওরা তো জানে না তুমি আসছ। হঠাৎ করে এলে—
কথা শেষ হবার আগেই মাহমুদ বাঁধা দিয়ে বলল, এবার আমরা লেক টাহো তে যাবো অনন্ত। গতবার যাওয়া হয়নি।
-অবশ্যই। বলে অনন্ত একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলো।
সায়লা বুঝতে পাড়লও মাহমুদ কেন তার কথা শেষ হওয়ার আগেই কথা বলেছে। ওরা এখনো জানে না কেন হঠাৎ করে অনন্ত এলো, আর সাথে তৃপ্তি কে না নিয়ে।
মাহমুদের দুই একটা কথার উত্তর দিয়েছে অনন্ত, বেশির ভাগ সময় জানালা দিয়ে চলমান গাড়ী গুলো দেখছিল। চোখ ছিল বাহিরে, মন ছিল অনেক দুরে।
গাড়ীটা বাসার সামনে থামতেই দৌড়িয়ে এলো মেহা। কেবল তেরো তে পা দিয়েছে।
-মামা অনেকদিন পরে তোমাকে দেখলাম। জানো তোমার ঘরটা আমি সাজিয়ে রেখেছি নীল লাল বাতি দিয়ে। আর জানো মা আজকে তোমার জন্য ইলিশ মাছ রান্না করেছে। তুমি কতদিন থাকবে মামা। আমার গানের প্রোগ্রাম না দেখে কিন্তু যাবেনা।
এতগুলো কথা একসাথে বলে গেলো মেহা।
অনন্ত ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, না রে পাগলি তোর গান না শুনে আমি যাবো না। চল, তোর নীল লাল বাতি দেখি।
সন্ধ্যায় তৃপ্তি ফিরে এসে দেখল ঘর অন্ধকার। এমন তো হয়নি কখন। পারতপক্ষে অনন্ত বাহিরে যায় না। যদিও বা কোন বন্ধু এসে নিয়ে গেলে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসে।
আলো টা জ্বালালো তৃপ্তি। কোথাও কোন শব্দ নেই। চোখ পড়লো টেবিলের উপর রাখা কাগজ টার দিকে।
হাতে উঠিয়ে নিলো।
পড়া শেষে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে এসে সোফাতে বসলো।
নিস্তব্ধ চারিদিক। এমন নিস্তব্ধতা আগে কখন উপলব্ধি করেনি।
এই প্রথম সে বাসাতে একা।
ভাবতে চাইলো গতরাতের ঘটনা গুলো। কেন সে সবকিছু বুঝিয়ে বলতে পারলও না অনন্ত কে। কেন বলতে পাড়লও না মোহিতের সাথে ওর সম্পর্ক শুধু বন্ধুত্তের। এর বাহিরে কিছু নয়।
কেন বলতে পারলও না বাসায় এলেই ওর মনে পরে সেই বাচ্চার কান্নাটা। যে কিনা ভূমিষ্ঠ হবার আগেই চলে গিয়েছিল পৃথিবী ছেড়ে।
কত বার না করেছিল অনন্ত কে সেই রাতে বন্ধুদের সাথে বাহিরে না যেতে। ও যদি বাসাতে থাকতো তাহলে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ওকে নিয়ে গেলে হয়ত বাচ্চা টাকে বাঁচানো যেতো।
পা পিছলে বাথরুমে কতক্ষণ পড়েছিল সে নিজেও জানে না। জেগে উঠে দেখে সে মেঝে তে পড়ে আছে।
অনন্ত কে কল করেছিল। হাসপাতালে গিয়েছিল।
ডাক্তার বলেছিল অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। আমরা আর কিছু করতে পারবো না।
সেই থেকে তৃপ্তি অনন্ত কে দায়ী করে।
অনন্ত কতবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে। তৃপ্তি কোন কথাই শুনতে চাইনি। আস্তে আস্তে দুজনের মাঝে দূরত্ব তৈরী হয়েছে।
টটন ভাইয়ের বাসায় গানের আয়োজন। অনন্ত প্রথমে যেতে চাইনি। মেহার টানাটানি তে যেতেই হোল। টটন ভাই হাস্যমুখে এসে হাতটা বাড়িয়ে দিলো অনন্তের দিকে।
-অনেকদিন পরে এলেন।
-হ্যাঁ, হঠাৎ ই চলে এলাম। গান বাজনার আয়োজন আছে নিশ্চয়? বলে অনন্ত তাকালও চারিদিকে।
-এইতো, গান, আড্ডা তারপর খাওয়া দাওয়া।
কথার মাঝে মেহা এসে অনন্তের হাতটা টান দিয়ে বলল, মামা এসো তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেবো আমার গানের মাস্টারের সাথে। বলে টেনে নিয়ে এলো এক ভদ্রমহিলার সামনে।
-শেফালি অ্যান্টি, আমার মামা।
শেফালি তাকালও অনন্তের দিকে, বলল, আপনার কথা শুনেছি সায়লার কাছে। আর এত শুনেছি যে মনে হয় আপনি অনেক দিনের চেনা।
অনন্ত হাসল, আর আপনার নাম আমি শুনেছি এই মিষ্টি মেয়ে টার কাছে।
কথা শেষ না হতেই টটন ভাই ডাক দিলো শেফালি কে।
গান শুরু হবে। অনন্ত পিছনের দিকে একটা চেয়ার টেনে বসলো।
বেশ কটা গানের পর শেফালি গাইতে শুরু করলো রবীন্দ্র সঙ্গীত। “সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে—-
অনন্তর মনটা শুনতে শুনতে চলে গেলো অনেক পিছনে। তৃপ্তির প্রিয় গান। বাড়ীর বারান্দায় আলো নিভিয়ে দিয়ে তৃপ্তি ওর কোলে মাথা রেখে গাইত এই গানটা।
-কিছু ভাবছেন? চমকে তাকাল অনন্ত।
সামনে দাঁড়ানো শিউলি।
– চলুন, ঐ যে ঢালু জাগাটা ওখান থেকে দেখতে পাবেন সামনের পাহাড় টা। অপূর্ব দৃশ্য। আমি টটন ভাই এর বাসায় এলে ঐখানে বসে থাকি। বলে শিউলি লাঠি টা এগিয়ে দিলো।
-গান শেষ?
-আপাতত।
অনন্তের ভালোই লাগছিলো শিউলির সান্নিধ্য।
অতি কাছের মানুষ যখন দুরে চলে যায়, কথা বলার মানুষটা যখন আর কথা বলে না, তখন শিউলির আপ্যায়ন অনন্তের ভালো লাগে।
ওরা এসে বসল টটন ভাইয়ের বাসার মাঠের শেষ প্রান্তের বেঞ্চে। দুরে লালচে আভার আকাশটা ঢলে পড়েছে পাহাড়ের গায়ে। সন্ধ্যা হয় হয়।
শিউলি বলল তার স্বামী, ছেলের কথা। বলল,তার স্বামী গেছে অফিসের কাজে বাহিরে। আরও অনেক কথা।
অনন্ত শুনল বেশি, বলল কম।
ডাক পড়লো, ডিনারের। উঠতে যেয়ে লাঠিটা ফসকে গিয়েছিল হাত থেকে। পড়তে যেয়ে আবার উঠে দাঁড়ালো।
-সাহায্য লাগবে। শিউলি জিজ্ঞাসা করল।
-না, আমি ঠিক আছি। বলে অনন্ত হাটতে আরম্ভ করলো।
সেই রাতের পর থেকে তৃপ্তি যায়নি দোকানে। মমতা কে বলেছে অর্ডার গুলো ঠিক মতো পাঠিয়ে দিতে। মোহিত কল করেছিল কয়েক বার। ফোনটা ধরেনি।
আবারও ফোনটা বেজে উঠল। মোহিত। এবার ধরলও সে।
শুধু বলল, একটি বার এসো আমার বাসায়।
মোহিত এলে ওর হাতে অনন্তের লেখা চিরকুট টা এগিয়ে দিলো।
লেখা টা পড়ে মোহিত বলল, দোষ টা তোমার। দুটো জীবন এইভাবে নষ্ট করে দিও না। ভুলে যাও অতীত।
ডাকো তাকে। বলো, আমরা দুজনেই ভুল করেছি। এসো, আমরা আবার নতুন করে গড়ে তুলি আমাদের হারিয়ে যাওয়া সংসার টা। ওর মনের মধ্যে যে ভুল তোমার আমার সম্পর্ক টা নিয়ে, সেটা ভেঙে দাও।
আমি থাকবো তোমার পাশে সব সময় বন্ধু হয়ে। উঠাও ফোনটা কল কর। মোহিত একসাথে এতগুলো কথা বলে যেয়ে দাঁড়ালো জানালার কাছে।
ফোনটা বেজে উঠল। অনন্ত তাকালও ফোনটার দিকে। তৃপ্তির ফোন। ধরতে যেয়ে হাত টা সরিয়ে নিলো।
আবারও বেজে উঠল। এবার ফোনটা ধরলও অনন্ত। কিছুক্ষন কেউ কোন কথা বলল না।
নীরবতা ভেঙে তৃপ্তি বলল, কবে আসবে, আমি অপেক্ষায় আছি।
কান্নার শব্দ। তারপর আবারও চুপ দুজনে।
-আগামীকাল। সাথে লাঠি টা আনবো না।
-কেন?
– তুমি হবে আমার লাঠি।
হাসতে যেয়ে আবার কেঁদে ফেললো তৃপ্তি।