অপরিচিতা ২য় পর্ব

                           

   কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল অনন্ত। মাথাটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। লোক টার গলার স্বর টা চিনতে চেষ্টা করল। যদি চেনা জানা হবে তবে ফোনটা কেটে দিলো কেনও? হাজার চিন্তা মাথায়। আস্তে আস্তে উঠে যেয়ে দাড়ালো মেডিসিন কেবিনেটর সামনে। ব্যথার ঔষধের বোতল টা খুলে দুটো ট্যাবলেট মুখে দিয়ে  দিলো। যদিও ব্যথাটা অতটা তীব্র নয়। সেইক্ষণে ফোনটা বেজে উঠলো।

যাক এতদিনে তৃপ্তির মনে পড়লো ফোন করার কথা। মনে মনে একটা ছক কেটে নিলো কি কি সে জিজ্ঞাসা করবে। এও ভেবে নিলো সঠিক উত্তর সে পাবে না। তাড়াতাড়ি ড্রয়াইং রুমে যেতে যেয়ে হোচট খেয়ে পড়ে গেলো মেঝেতে। ততক্ষণে ফোনের রিং টা বন্ধ হয়ে গেছে। সময় নিয়ে অনেক কষ্টে উঠে দাড়ালো অনন্ত। ধীর পায়ে এসে ফোনটা হাতে নিলো। মিস কলটা দেখল কোথা থেকে এসেছে।  না, তৃপ্তির কল নয়। সুপর্ণা কল করেছিল।

অনেকদিন সুপর্ণার সাথে যোগাযোগ নেই। সে আজই বা কেন কল করতে গেলো ? দুশ্চিন্তা টা আরও পাকিয়ে উঠল অনন্তের মাথায়। সাহস পেলো না সুপর্ণা কে কল করতে। টিভি টা চালিয়ে দিলো। টিভির পর্দায় চোখ কিন্তু মন টা তার অনেক দুরে।

কখন যে সোফাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে পড়ে না। এ ঐ পেইন কিলারে কারসাজি। চোখ টা যখন খুললও রাত তখন তিন টা।

সন্ধ্যা হয় হয়। বাসার সামনে গাড়ীর শব্দ শুনল অনন্ত। ইচ্ছে করেই উঠলো না সোফা থেকে। দরজা  খোলা এবং বন্ধ হওয়ার শব্দ পেলো। ঘাড় ফিরে তাকালও। চোখাচোখি হোল তৃপ্তির সাথে। তৃপ্তি কোনো কথা না বলে সুটকেস টা নিয়ে ওর ঘরের দিকে চলে গেলো।

সাওয়ার শেষে তৃপ্তি এসে বসলো সোফার এক কর্নারে। চাদা থাই রেস্টুরেন্টে অর্ডার দিলো। তারপর তাকালও অনন্তের দিকে। অনন্তও তাকালও তৃপ্তির দিকে।

-তোমাকে কয়েক বার কল করেছিলাম। গম্ভীর ভাবে বলল অনন্ত।

-জানি, মিস কল দেখেছি। বলল তৃপ্তি।

-তোমার ফোন অন্য কেউ ধরেছিল।

-তাও জানি। নিষ্প্রভ ভাবে বলল তৃপ্তি ফোনটার দিকে তাকিয়ে।

-এক্সপ্লেন করবে? উত্তেজিত না হয়ে জিজ্ঞাসা করলো অনন্ত।

-এক্সপ্লেন করার কিছু নেই।

-কেন? আমার জানতে ইচ্ছে করে না? এবার গলার স্বর টা একটু উপরে ছিল অনন্তের।

-তুমি যে ভাবে ইচ্ছা সে ভাবেই ভাবতে পারো, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।

-আমি ভাবতে চাই না জানতে চাই। তুমি কি চাও আমাদের সম্পর্ক এখানেই শেষ হয়ে যাক?

-সে কথা তো আমি বলিনি। সে তো তুমি বলছ। বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো তৃপ্তি।

উবার খাবার টা রেখে গেছে দরজার কাছে।

সে রাতে দুজন এক টেবিলে খেতে বসল না। খাওয়া শেষে যে যার রুমে চলে গেলো।

সকালে ঘুম থেকে উঠে অনন্ত তৃপ্তি কে দেখতে পেলো না। ফোন করতে ইচ্ছে করলো না।

ফোন করলও তার বোন সায়লা কে। শুধু বলল আমি আসছি আজ রাতের ফ্লাইটে।

একটা চিরকুট রেখে গেলো টেবিলের উপর, লেখা, সায়লার ওখানে যাচ্ছি। অস্থির মন টাকে বাগে আনতে। কবে ফিরবো জানিনা।

সুটকেসে ভরে নিলো ঔষধ গুলো, লাঠি টা নিলো সাথে। যেটা তার নিত্ত সঙ্গী।

অনেক দিন পরে এলো যেখানে গোল্ডেন ব্রিজ, সেই শহরে।

সায়লা আর মাহমুদ দাড়িয়ে ছিল বাহিরে। দুরের থেকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে মাহমুদ অনন্তের হাত থেকে সুটকেস টা নিয়ে নিলো। বলল, হেটে যেতে পারবে অনন্ত।

অনন্ত আর মাহমুদ একই সাথে পড়ত। সেই সুবাদে পরিচয় হয়েছিল সায়লার সাথে।

-পারব, তবে একটু সময় লাগবে যেতে।

-কোন সমস্যা নেই। আমাদের হাতে অফুরন্ত সময়। বলে সায়লা আর একটা হাত ধরল।
-না, ধরতে হবে না।

মাহমুদ চোখের ইশারায় সায়লাকে না করলো ধরতে।

-অনেকদিন পরে এলে ভাইয়া। সামনে থ্যাংকসঘিভিং। খুব মজা হবে।

-তোর সেই টটন ভাই আছে এখনো? সেই বার থ্যাংকসঘিভিং করেছিলাম। খুব মজা হয়েছিল।

-হ্যাঁ, এবারও সেখানেই হবে। ওরা তো জানে না তুমি আসছ। হঠাৎ করে এলে—

কথা শেষ হবার আগেই মাহমুদ বাঁধা দিয়ে বলল, এবার আমরা লেক টাহো তে যাবো অনন্ত। গতবার যাওয়া হয়নি।

-অবশ্যই। বলে অনন্ত একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলো।

সায়লা বুঝতে পাড়লও মাহমুদ কেন তার কথা শেষ হওয়ার আগেই কথা বলেছে। ওরা এখনো জানে না কেন হঠাৎ করে অনন্ত এলো, আর সাথে তৃপ্তি কে না নিয়ে।

মাহমুদের দুই একটা কথার উত্তর দিয়েছে অনন্ত, বেশির ভাগ সময় জানালা দিয়ে চলমান গাড়ী গুলো দেখছিল। চোখ ছিল বাহিরে, মন ছিল অনেক দুরে।

গাড়ীটা বাসার সামনে থামতেই দৌড়িয়ে এলো মেহা। কেবল তেরো তে পা দিয়েছে।

-মামা অনেকদিন পরে তোমাকে দেখলাম। জানো তোমার ঘরটা আমি সাজিয়ে রেখেছি নীল লাল বাতি দিয়ে। আর জানো মা আজকে তোমার জন্য ইলিশ মাছ রান্না করেছে। তুমি কতদিন থাকবে মামা। আমার গানের প্রোগ্রাম না দেখে কিন্তু যাবেনা।

এতগুলো কথা একসাথে বলে গেলো মেহা।

অনন্ত ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, না রে পাগলি তোর গান না শুনে আমি যাবো না। চল, তোর নীল লাল বাতি দেখি।

সন্ধ্যায় তৃপ্তি ফিরে এসে দেখল ঘর অন্ধকার। এমন তো হয়নি কখন। পারতপক্ষে অনন্ত বাহিরে যায় না। যদিও বা কোন বন্ধু এসে নিয়ে গেলে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসে।

আলো টা জ্বালালো তৃপ্তি। কোথাও কোন শব্দ নেই। চোখ পড়লো টেবিলের উপর রাখা কাগজ টার দিকে।

হাতে উঠিয়ে নিলো।

পড়া শেষে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে এসে সোফাতে বসলো।

নিস্তব্ধ চারিদিক। এমন নিস্তব্ধতা আগে কখন উপলব্ধি করেনি।

এই প্রথম সে বাসাতে একা।

ভাবতে চাইলো গতরাতের ঘটনা গুলো। কেন সে সবকিছু বুঝিয়ে বলতে পারলও না অনন্ত কে। কেন বলতে পাড়লও না মোহিতের সাথে ওর সম্পর্ক শুধু বন্ধুত্তের। এর বাহিরে কিছু নয়।

কেন বলতে পারলও না বাসায় এলেই ওর মনে পরে সেই বাচ্চার কান্নাটা। যে কিনা ভূমিষ্ঠ হবার আগেই চলে গিয়েছিল পৃথিবী ছেড়ে।

কত বার না করেছিল অনন্ত কে সেই রাতে বন্ধুদের সাথে বাহিরে না যেতে। ও যদি বাসাতে থাকতো তাহলে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ওকে নিয়ে গেলে হয়ত বাচ্চা টাকে বাঁচানো যেতো।

পা পিছলে বাথরুমে কতক্ষণ পড়েছিল সে নিজেও জানে না। জেগে উঠে দেখে সে মেঝে তে পড়ে আছে।

অনন্ত কে কল করেছিল। হাসপাতালে গিয়েছিল।

ডাক্তার বলেছিল অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। আমরা আর কিছু করতে পারবো না।

সেই থেকে তৃপ্তি অনন্ত কে দায়ী করে।

অনন্ত কতবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে। তৃপ্তি কোন কথাই শুনতে চাইনি। আস্তে আস্তে দুজনের মাঝে দূরত্ব তৈরী  হয়েছে।

টটন ভাইয়ের বাসায় গানের আয়োজন। অনন্ত প্রথমে যেতে চাইনি। মেহার টানাটানি তে যেতেই হোল। টটন ভাই হাস্যমুখে এসে হাতটা বাড়িয়ে দিলো অনন্তের দিকে।

-অনেকদিন পরে এলেন।

-হ্যাঁ, হঠাৎ ই চলে এলাম। গান বাজনার আয়োজন আছে নিশ্চয়? বলে অনন্ত তাকালও চারিদিকে।

-এইতো, গান, আড্ডা তারপর খাওয়া দাওয়া।

কথার মাঝে মেহা এসে অনন্তের হাতটা টান দিয়ে বলল, মামা এসো তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেবো আমার গানের মাস্টারের সাথে। বলে টেনে নিয়ে এলো এক ভদ্রমহিলার সামনে।

-শেফালি অ্যান্টি, আমার মামা।

শেফালি তাকালও অনন্তের দিকে, বলল, আপনার কথা শুনেছি সায়লার কাছে। আর এত শুনেছি যে মনে হয় আপনি অনেক দিনের চেনা।

অনন্ত হাসল, আর আপনার নাম আমি শুনেছি এই মিষ্টি মেয়ে টার কাছে।

কথা শেষ না হতেই টটন ভাই ডাক দিলো শেফালি কে।

গান শুরু হবে। অনন্ত পিছনের দিকে একটা চেয়ার টেনে বসলো।

বেশ কটা গানের পর শেফালি গাইতে শুরু করলো রবীন্দ্র সঙ্গীত। “সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে—-

অনন্তর মনটা শুনতে শুনতে চলে গেলো অনেক পিছনে। তৃপ্তির প্রিয় গান। বাড়ীর বারান্দায় আলো নিভিয়ে দিয়ে তৃপ্তি ওর কোলে মাথা রেখে গাইত এই গানটা।

-কিছু ভাবছেন? চমকে তাকাল অনন্ত।

সামনে দাঁড়ানো শিউলি।

– চলুন, ঐ যে ঢালু জাগাটা ওখান থেকে দেখতে পাবেন সামনের পাহাড় টা। অপূর্ব দৃশ্য। আমি টটন ভাই এর বাসায় এলে ঐখানে বসে থাকি। বলে শিউলি লাঠি টা এগিয়ে দিলো।

-গান শেষ?

-আপাতত।

অনন্তের ভালোই লাগছিলো শিউলির সান্নিধ্য।

অতি কাছের মানুষ যখন দুরে চলে যায়, কথা বলার মানুষটা যখন আর কথা বলে না, তখন শিউলির আপ্যায়ন অনন্তের ভালো লাগে।

ওরা এসে বসল টটন ভাইয়ের বাসার মাঠের শেষ প্রান্তের বেঞ্চে। দুরে লালচে আভার আকাশটা ঢলে পড়েছে পাহাড়ের গায়ে। সন্ধ্যা হয় হয়।

শিউলি বলল তার স্বামী, ছেলের কথা। বলল,তার স্বামী গেছে অফিসের কাজে বাহিরে। আরও অনেক কথা।

অনন্ত শুনল বেশি, বলল কম।

ডাক পড়লো, ডিনারের। উঠতে যেয়ে লাঠিটা ফসকে গিয়েছিল হাত থেকে। পড়তে যেয়ে আবার উঠে দাঁড়ালো।

-সাহায্য লাগবে। শিউলি জিজ্ঞাসা করল।

-না, আমি ঠিক আছি। বলে অনন্ত হাটতে আরম্ভ করলো।

সেই রাতের পর থেকে তৃপ্তি যায়নি দোকানে। মমতা কে বলেছে অর্ডার গুলো ঠিক মতো পাঠিয়ে দিতে। মোহিত কল করেছিল কয়েক বার। ফোনটা ধরেনি।

আবারও ফোনটা বেজে উঠল। মোহিত। এবার ধরলও সে।

শুধু বলল, একটি বার এসো আমার বাসায়।

মোহিত এলে ওর হাতে অনন্তের লেখা চিরকুট টা এগিয়ে দিলো।

লেখা টা পড়ে মোহিত বলল, দোষ টা তোমার। দুটো জীবন এইভাবে নষ্ট করে দিও না। ভুলে যাও অতীত।

ডাকো তাকে। বলো, আমরা দুজনেই ভুল করেছি। এসো, আমরা আবার নতুন করে গড়ে তুলি আমাদের হারিয়ে যাওয়া সংসার টা। ওর মনের মধ্যে যে ভুল তোমার আমার সম্পর্ক টা নিয়ে, সেটা ভেঙে দাও। 

আমি থাকবো তোমার পাশে সব সময় বন্ধু হয়ে। উঠাও ফোনটা কল কর। মোহিত একসাথে এতগুলো কথা বলে যেয়ে দাঁড়ালো জানালার কাছে।

ফোনটা বেজে উঠল। অনন্ত তাকালও ফোনটার দিকে। তৃপ্তির ফোন। ধরতে যেয়ে হাত টা সরিয়ে নিলো।

আবারও বেজে উঠল। এবার ফোনটা ধরলও অনন্ত। কিছুক্ষন কেউ কোন কথা বলল না।

নীরবতা ভেঙে তৃপ্তি বলল, কবে আসবে, আমি অপেক্ষায় আছি।

কান্নার শব্দ। তারপর আবারও চুপ দুজনে।

-আগামীকাল। সাথে লাঠি টা আনবো না।

-কেন?

– তুমি হবে আমার লাঠি।

হাসতে যেয়ে আবার কেঁদে ফেললো তৃপ্তি।

Continue Reading

অপরিচিতা

  সকাল নয়টা। সূর্যের আলো টা জানালা দিয়ে এসে অনন্তর চোখের উপর পড়ছিল। কতবার তৃপ্তি কে বলেছে  একটা কালো পর্দা দিয়ে ডেকে দিতে। আজও তার সময় হয়নি। বিছানা থেকে উঠতে যেয়ে বাম পা টা ব্যাথায়  টনটন করে উঠলো। কোন রকমে  পা টা টানতে টানতে রান্না ঘরে এসে দাঁড়ালো অনন্ত। তৃপ্তি বেড়িয়ে গেছে। প্রথমে যাবে জিমে। তারপর বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দেবে। ফিরতে ফিরতে এগারটার উপর হয়ে যাবে।

অনন্তর নিজের নাস্তাটা নিজেই করে নিতে হবে। ব্যাথা টার তীব্রতার জন্য বেশিক্ষণ দাড়িয়ে থাকতে পারে না। কফির পটটা আনতে যেয়ে হাতের লাঠি টা পড়ে গেলো মেঝেতে। অনন্ত জানে নিচু হয়ে সে উঠাতে পারবে না। একবার চোখ বুলিয়ে নিলো চারিদিকে। কোথাও রীচার গ্রাবার টা দেখতে পেলোনা। পাশে থাকা স্টুল টা টেনে নিয়ে এলো। ওটাতে বসে ডান হাতটা নামিয়ে দিলো নিচে। প্রথম বার ছুঁতে পাড়লও না। আর একবার চেষ্টা করতেই তীব্র ব্যাথায় সারা মুখ নীল হয়ে এলো।

যাক উঠাতে পাড়লও সে। কিছুক্ষন বসে রইল।   ব্যাথা টা একটু কমে আসতেই উঠে দাঁড়ালো। কফি টা বসিয়ে দিয়ে এলো ফ্রিজের কাছে। পাউরুটি আর জেলি টা নিয়ে রাখল টেবিলে। তৃপ্তি বাসায় না থাকলে সকালের নাস্তা টা সে এই ভাবেই সেরে নেয়।

কফিটা তে চুমুক দিয়ে দেয়ালের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল ওর আর তৃপ্তির ছবি টা। বিয়ের আগে তোলা।

অনন্ত তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকলো তৃপ্তির ঠিক ঠোটের নিচের তিল টাকে। ঐ তিল টাই ওকে আকর্ষণ করেছিল। আজ থেকে অনেক বছর আগে তোলা এই ছবি।

তৃপ্তির সাথে দেখা হয়েছিল এক রেস্টুরেন্টে।

 অনন্ত, স্বপন আর সন্ধ্যা কর্নারের একটা টেবিলে কফি নিয়ে বসেছিল।

হঠাৎ দেখতে পেলো তার পরিচিত একজন কে, সুপর্ণা। সাথে তিন বান্ধবী।

সুপর্ণার সাথে চোখাচোখি হতেই সুপর্ণা এগিয়ে এলো।

-কেমন আছো অনন্ত। তোমার তো ইদানীং পাত্তা পাওয়া যায় না। থাকো কোথায়? বলে সুপর্ণা অনন্তর উত্তরের অপেক্ষা না করে পরিচয় করিয়ে দিলো ওর বান্ধবীদের সাথে। তৃপ্তি, তাসনিম, মমতা।

-তোমাদের কোন আপত্তি না থাকলে বসো আমাদের সাথে। একসাথে আড্ডা দেই। সুপর্ণা কে  কথাটা বলে অনন্ত তাকাল তৃপ্তির দিকে।

সেইক্ষণে সে দেখতে পেলো ঐ তিল টা।

চোখ টা আটকিয়ে গেলো।

-কি, হ্যাঁ করে কি দেখছ। কপট হাসির ভান করে জিজ্ঞাসা করলো সুপর্ণা।

একটু লজ্জা পেলো অনন্ত। পরক্ষনে  নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল, না, দেখছি তোমার সুন্দরী বান্ধবীদের।

-হু, তা কোনটাকে পছন্দ?

-আহ, তুমি সেই আগের মতই রয়ে গেছো। বসো, কি খাবে বলও।

-দেখি মেনুতে কি আছে। ঘাড় যখন তোমার ভাঙ্গব তখন ভালভাবেই ভাঙ্গি।

-কুছ পরোয়া নেই। বলে চেয়ার টা একটু পিছনে ঠেলে দিলো।  

ওরা বসলো একসাথে।

দুই একবার চোখাচোখি হোল তৃপ্তির সাথে।

আড্ডা টা বেশ ভালই জমেছিল

বের হয়ে যাওয়ার আগে অনন্ত সুপর্ণা কে একটু পাশে ডেকে নিয়ে যেয়ে বলল, এই ঐ যে মেয়েটা ঠোটের নিচে তিল, নাম টা যেন কি?

-তৃপ্তি

-লাইন আছে ওর না থাকলে লাইন টা আমার সাথে লাগিয়ে দাও

-হু, মনে ধরেছে তাহলে

-ধরেছে তো

– ঠিক আছে, কাল সন্ধ্যা সাত টায় এইখানেই আবার এসো সুপর্ণা অনন্তের হাতে একটা চিমটি দিয়ে হাসতে হাসতে বের হয়ে গেলো।

তৃপ্তি এসেছিল

 সুপর্ণা ওদের দুজনকে রেখে কোথায় যে চলে গেলো এলো দুই ঘণ্টা পড়ে

এই দুই ঘণ্টায় ওরা অনেক কথা বলল, দুজনের মধ্যের লজ্জার আবরণ টা কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো

তারপর ওরা আবারও মিলল একসাথে হাত ধরাধরি করে হাঁটল ঠোঁটে ঠোঁট রাখল

তারপর একদিন ওরা হয়ে গেলো মিস্টার আর মিসেস

দরজা খোলার শব্দ হোল তৃপ্তি ঢুকল

অনন্ত ছবিটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে তাকালও দরজার দিকে।

-নাস্তা করেছো? গায়ের কাপড়টা খুলতে খুলতে জিজ্ঞাসা করল তৃপ্তি।

-করেছি তবে অনেক কষ্টে। বলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো।

-সরি, আমাকে এখুনি দোকানে যেতে হবে। কতগুলো কাপড় ডেলিভারি দেবে। আমি না থাকলেই নয়। তুমি উবার ইটে দুপরের খাবার অর্ডার দিয়ে দাও। একটু বেশি করে দিও তাহলে রাতেও খেতে পারবে। আমার আসতে দেরি হতে পারে। আমি বাহিরে খেয়ে আসবো। এই বলে তৃপ্তি সাওয়ার নিতে চলে গেলো।  

অনন্ত আস্তে আস্তে এসে বসলো বাহিরের বারান্দায়। কুয়াশায় তখনো ঘাস ভেজা। দুটো শালিক কিচিরমিচির করছে ওর বারান্দার কোনায়। অনন্ত তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল  শালিক দুটো কে। আর ভাবছিল,

কোথায় গেলো সেইদিন গুলো। যখন তৃপ্তি বসে থাকতো  অনন্তের জন্য ভাতের থালা আগলে। কাজ থেকে আসতেই দরজা খুলে প্রথমে একটা চুমো দিয়ে বলতো, তাড়াতাড়ি গোসল করে এসো, আমার অনেক খিদে পেয়েছে।

অনন্ত ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলতো, কতদিন বলেছি, তুমি খেয়ে নিও, তারপর আমি খেতে বসলে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করো।

-আহারে, এসব বুঝি শরৎচন্দ্রের বই তে পড়েছ।

-হ্যাঁ, কিন্তু আমার শরৎচন্দ্র হারিয়ে গেছে।

-না হারায় নি, মডার্ন হয়েছে। আমি এয়ারকন্ডিশন চালিয়ে দিয়েছি। বলে হেসে উঠত। আর ঠিক সেইক্ষণে অনন্ত আলতো করে চুমো দিতো ঐ তিল টার উপর।

সেইসব দিনগুলো  একদিন কর্পূরের মতো উবে গেলো।

তৃপ্তির অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল একটা বুটিকের দোকান দেবে। অনন্ত কে বলেছিল। অনন্ত না করেনি।

-কিন্তু টাকা কোথায় পাবো?

-শোন, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। যদি চাও তবে হোম ইকিউটি নিয়ে আরম্ভ করো। বলেছিল অনন্ত।

-ভয় হয়। যদি ব্যবসাটা দাড় করাতে না পারি। তাহলে টাকা শোধ দেবো কি ভাবে। তৃপ্তি ভয়ে ভয়ে বলেছিল।

অনন্ত আশ্বাস দিয়েছিল। বলেছিল, চেষ্টা করতে দোষ কি?  তোমার উপর আমার অগাধ বিশ্বাস। তুমি পারবে।

পেরেছিল সে। আস্তে আস্তে ছোট্ট দোকান টাকে অনেক বড় করেছিল।

শুধু হারিয়ে গিয়েছিল সেই  বৌ টা।

দেরি করে ফিরতে আরম্ভ করলো তৃপ্তি। জিজ্ঞাসা করলে বলে দোকানে কাজ ছিল অনেক। অনন্ত বসে থাকে ওর জন্য এক সাথে ডিনার করবে বলে। তৃপ্তি খেয়ে আসে বাহিরের থেকে।

বললে বলে, তুমি এখন থেকে খেয়ে নিও। আমার জন্য বসে থেকো না।

এর মাঝে একদিন  এক অঘটন ঘটলো। গাড়ীর এক্সিডেন্টে অনন্ত বাম পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পেলো। সেই সাথে মাজায়।  ডাক্তারেরা অনেক চেষ্টা করল পা টাকে আবার আগের অবস্থাতে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু পাড়লও না।

চাকরি থেকে আর্লি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে বাসাতে বসে থাকতে হোল।

প্রথম দিকে তৃপ্তিই ওকে দেখাশোনা করতো। ক্রমেই কয়েকটা মাস পাড় হতেই অনন্ত বুঝতে পাড়লও তৃপ্তি আস্তে আস্তে দুরে সরে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক থাকে। ডাকলে সাড়া দেয়না।

এক রাতে বারান্দা বসে তৃপ্তি বলল, এবার একটা লোক রাখো, আমি আর পেরে উঠছি না। ঘরে বাহিরে আমার পক্ষে সামলানো দায় হয়ে উঠেছে।

কথাটা একটু ঝাঁঝালো স্বরে বলেছিল তৃপ্তি।  

কিছুক্ষন চুপ করেছিল অনন্ত।

কোথায়, সে তো নিজের কাজ যতটা পারে নিজেই করে। কাপড় জামা এখনো নিজেই পড়ে, তবে একটু কষ্ট হয়। টয়লেটে নিজেই যেতে পারে। শুধু যখন ব্যথাটা প্রচণ্ড আকার ধারন করে তখন বিছানা থেকে নামতে গেলে নামতে পারেনা।

অনন্ত তৃপ্তির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, একটা লোক রাখতে তো অনেক টাকার দরকার।

তৃপ্তি কোন কথা না বলে উঠে ঘরের দিকে চলে গেলো।

বাড়ীতে অশান্তি দেখা দিলো।

তৃপ্তি একদিন বলল, সে আর রান্না করতে পারবে না। তার সময় নেই। খোঁজ নিতে বলল, কাউকে পাওয়া যায় কিনা যার কাছে অর্ডার দাওয়া যাবে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেলো তসলিমা কে।

ইয়ং মেয়ে। ছোট একটা বাচ্চা আছে তার।

রান্না ভালো করে। অনন্ত বলেছিল, তোমাকে কিন্তু বাসায় দিয়ে যেতে হবে।

-কোন অসুবিধা নেই ভাইয়া।

মাঝে মাঝে খাবার দিতে এসে তসলিমা বসে।  গল্প করে অনন্তর সাথে। অনন্ত ওকে বিভিন্ন লেখকের বই পড়ে শোনায়।

বলেছিল, ওর বড় ভাই এর কথা। একদিন কাজ থেকে এসে বলল, মা শরীর টা ভালো লাগছে না। আজ আর খাবো না। একটু শুয়ে থাকি। সেই শোয়াই তার শেষ শোয়া। বলে অনেক কেঁদে ছিল।

আরও বলেছিল, তুমি ঠিক আমার বড় ভাই এর মতো। সে ও আমাকে বই পড়ে শোনা তো। সে আমার বিয়ে দেখে যেতে পাড়লও না। আমার সংসার দেখল না।

আচ্ছা ভাইয়া, ভাবী কে দেখি নাতো। অনেক ব্যস্ত বুঝি।

-অনেক।

-তোমার এই পা আর ভালো হবে না?

-না, অসুবিধা কি। এই লাঠি টা তো আছে। বলে হাল্কা করতে চায় পরিবেশ টাকে অনন্ত।

সেদিন তৃপ্তি একটু তাড়াতাড়িই বাসায় এলো। যেটা অনেক অনেক দিন ধরে হয়নি।

-আজ একসাথে আমরা ডিনার করবো। বলে ফ্রীজ টা খুলে দেখল তৃপ্তি।

এরকম প্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেনি অনেকদিন। অনন্ত তৃপ্তির দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল। আনন্দে সে আত্মহারা।

আবার বুঝি ফিরে এলো সেই হারিয়ে যাওয়া দিন গুলো।

মনে মনে অনেক কিছু ভাবল অনন্ত। ঐ তিল টাতে আবার আজকে সে চুমো দেবে। খাওয়ার আগে না খাওয়ার পরে।

তৃপ্তি কাছে আসতেই অনন্ত উঠে দাড়িয়ে ওকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করতেই সে অনন্ত কে আস্তে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে  বলল, কি ঢং আরম্ভ করলে।

অনন্ত অপ্রত্যাশিত এই ধাক্কা টা সামলিয়ে নিয়ে বলল, এসো না ওই ঢং টাই আমরা আবার করি। আচ্ছা তোমার মনে পরে না আমাদের সেই প্রেমের কথা। তুমিই না হয় আমার লাঠি হয়ে দাড়াও আমার পাশে। চল আমরা বেড়িয়ে আসি কাছে কোন এক জায়গা থেকে।

তৃপ্তি তাকালও অনন্তের দিকে। কোন উত্তর না দিয়ে ভাত বাড়তে বাড়তে বলল, আমি দিন পাচেকের জন্য বাহিরে যাচ্ছি। নিজের চোখে দেখে কাপড়ের অর্ডার গুলো দিতে চাই। তোমার একা থাকতে কোন অসুবিধা হবে?

-অসুবিধা হলেই বা তুমি কি করবে বলও। তবে কোথায় যাচ্ছ? একটু রেগেই বলল অনন্ত।

-স্টেটসের বাহিরে। 

-কবে যাবে?

-আগামীকাল দুপুরে আমার ফ্লাইট। হঠাৎ করেই যেতে হচ্ছে।  দরকার পড়লে আমার হোয়াটস আপে কল দিও।

-কোন হোটেলে থাকবে?

-হিলটনে।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। শুধু চামচের টুংটাং শব্দ।

অনন্ত নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, আচ্ছা তৃপ্তি আমি কি সত্যিই তোমার কাছে একটা বোঝা হয়ে উঠেছি।

-দেখো এই ধরনের প্রসঙ্গ আমি শুনতে চাই না। বলে উঠে দাঁড়ালো তৃপ্তি।

-তৃপ্তি, শোন, আমি এখনও পুরপুরি অথর্ব হয়ে যাইনি। এখনো লাঠি ভর দিয়ে অনেক দুর যেতে পারবো। আমি শুধু  চাই তুমি আমার পাশে এসে দাড়াও। ঐ বুটিক শপ একদিন আমিই তোমাকে করার জন্য উৎসাহ দিয়েছিলাম। আজ সেই বুটিক শপই আমার কাল হয়ে দাঁড়ালো।

-ও। তোমার হিংসে হচ্ছে? বলে তৃপ্তি তাকালও অনন্তের দিকে।

– হিংসে কেনও হতে যাবে। বরং আমার গর্ব হচ্ছে। তুমি ছোট্ট একটা দোকান কে কত বড় করে তুলেছ। মনে নেই সেদিন আমি বলেছিলাম, তুমি পারবে।

তুমি পেরেছ। তুমি পেরেছ।  আমি হারিয়েছি।

-তোমার সাথে তর্ক করার ইচ্ছে আমার  নেই, আমি ঘুমতে গেলাম। বলে তৃপ্তি চলে গেলো তার রুমে।

অনন্ত আরও কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর আস্তে আস্তে উঠে টিভি টা চালিয়ে দিলো।

দুইদিন পার হয়ে গেছে। তৃপ্তি ফোন করে নি। অনন্ত অস্থির হয়ে লাঠি ভর দিয়ে একবার এঘর, ওঘর করে বেড়াতে লাগলো। কত বার কল করলো ওর হোয়াটস আপে। তৃপ্তি ফোন ধরলও না।

তৃতীয় দিন রাত দশটায় ফোন করল, বেশ কিছুক্ষণ বাজার পর ফোন টা ধরল।

হ্যাঁলো বলল, এ স্বর কোন মেয়ের নয় ছেলের।

অনন্ত কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, তৃপ্তি কোথায়।

লাইন টা কেটে দিল, যে ধরে ছিল ফোনটা।  

অনন্ত চোখ বন্ধ করে বসে রইল।

Continue Reading