পলাশের গাড়ী টা সোজা কবরস্থানের গেট পেড়িয়ে মায়ের কবরের কাছে এসে দাঁড়ালো। বিশাল মাঠের মাঝে ও একা। আজ কেউ বুঝি আসেনি তাদের প্রিয়জনের কবরের পাশে কিছুক্ষণের জন্য দাড়িয়ে থাকতে। কলেমা পড়তে। হয়তো এসেছিল। চলে গেছে। এই মুহূর্তে সে একা।
সন্ধ্যা হতে অনেক দেরী। আকাশ টা কালো মেঘে ছেয়ে আছে। অনেক গাংচিল বসে আছে মাঠের মাঝে। মাঠ টা সাদা হয়ে গেছে ওদের গায়ের সাদা রঙে। পলাশ এত গাংচিল একসাথে কখন দেখেনি। হঠাৎ একদল উড়ে গেলো আকাশে। পলাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। মনে মনে ভাবছিল এরাই কি পাহারা দেয় যারা এখানে শুয়ে আছে তাদের কে? এই দৃশ্য তো দেখেনি আগে।
অসংখ্য গাংচিল কোথা থেকে এলো। পলাশ উড়িয়ে দিতে চাইলো ওদের কে। ওরা উড়ল না। পলাশ যত ওদের কাছে গেলো ওরা আস্তে আস্তে সড়ে গেলো। কেউ কেউ ওর পায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু উড়ল না। ওরা উড়ে যখন ওদের মন চায়। পলাশ একটাকে ধরতে চাইল।
চিঁ চিঁ শব্দ করে সে একপাশে সড়ে গেলো।
পলাশ এসে দাঁড়ালো ওর মায়ের কবরের পাশে। গাংচিল গুলো একটু নোংরা করে দিয়েছে কবরের উপর বাঁধানো ফলক টাকে। ও রাগ করলনা। রাতে তো সে এসে পাহারা দেয় না ওর মা কে। পাহারা দেয় ওরা। ওরাই তো পাহারাদার।
ফলক টার উপর লেখা আছে মার জন্ম,মৃত্যু তারিখ। মাত্র একষট্টি বছর বয়সে মা চলে গিয়েছিল। বাবা চলে গিয়েছিল আরও আগে। তার কবর এখানে নয়।
মা পলাশ কে ডাকতো পলু বলে। কেন যে ওর কোন ভাই বোন এলো না সে কথা কোনদিন জিজ্ঞাসা করেনি। বরং মনে হয়েছে, যাক ভালোই হয়েছে কাউকে কোন কিছুর ভাগ দিতে হবে না। আজ সে কথা মনে হয় না। বড় মিস করে ওর বোন ভাই নাই বলে।
পায়ে সুড়সুড়ি লাগতেই তাকিয়ে দেখে একটা গাংচিল ওর পায়ে মুখ গসছে। ধরতে যেতেই দুরে সরে যেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। সে আগন্তুক। ওরা ওকে চিনতে পারছে না, তাই কাছে এসেও দুরে চলে যাচ্ছে। পলাশ ফিরে তাকালও ফলকের দিকে।
মার মুখ টা ভেসে উঠলো। কি কষ্ট করেই না মা ওকে মানুষ করেছিল। বাবা চলে গিয়েছিল ওর বয়স যখন আট।
এই দেশে এসেছিল অনেক আগে। বাবা ছিল প্রকৌশলী। এই দেশে এসে পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স নেওয়া হয়নি। তবে বড় একটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছিল। নিজের যোগ্যতায় ধীরে ধীরে উপরে স্থান করে নিয়েছিল।
বাবার কথা কিছু কিছু মনে পরে পলাশের। কাজ থেকে এসে ওকে নিয়ে বাহিরে হাটতে যেতো। হাত ধরে কি যত্নেই না রাস্তা টা পাড় করতো।
মা করতো বাসার কাজ। বাবা ফিরে এলে মা চা বানিয়ে সাথে বিস্কুট নিয়ে পাশে এসে বসতো। কত কথাই না বলতো ওরা। পলাশ কিছুই বুঝত না।
তারপর হঠাৎ কি হয়েছিল পলাশ জানে না। শুধু মনে পরে এ্যাম্বুলেন্স এসে বাবা কে নিয়ে গেলো।
সেই শেষ যাওয়া।
মা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত। ওর সামনে কোনদিন চোখের জল ফেলেনি। বুঝতে দেয়নি বাবা চলে গেছে। শক্ত হাতে হাল ধরে ছিল। ঐ কোম্পানিতেই বাবার খ্যাতির জন্য মা কে ওরা নিয়েছিল ছোট্ট একটা পদে। বেতন কতই বা হবে, খুব যে বেশি তা নয়। অথচ সেই অল্প মাইনে দিয়েই মা কি সুন্দর ভাবে সংসার টা চালাত।
কোনদিনই পলাশ কে বুঝতে দেয়নি কোন অভাব এই সংসারে আছে। শুধু বলতো বাবা পড়াশুনাটা ঠিক মতো করিস, তোকে আমি যেন মানুষের মত মানুষ করে দিয়ে যেতে পারি।
হ্যাঁ, মা তাকে তাই করে দিয়ে গেছে। আজ সে অনেকের মাঝে একজন।
মা বলেছিল ডাক্তারি পড়বি? পলাশ বলেছিল, মা, ডাক্তারি পড়া আমার দাড়া হবেনা। আমি বিজনেস নিয়ে পড়তে চাই। মা, না করেনি। ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরিয়ে চাকরি নিয়েছিল বড় একটা ফার্মে।
মা কে আর চাকরি করতে দেয়নি। বলেছিল, অনেক করেছ এবার শান্ত হয়ে বসো।
মা ওর মুখের দিকে চেয়ে বলেছিল, আমি একা একা কতক্ষণ বসে থাকবো এই ঘরের মধ্যে। কাউকে নিয়ে আয়।
মুচকি হেসে পলাশ বলেছিল, আনবো। তোমার পছন্দ হবে কিনা জানি না।
-তোর পছন্দই আমার পছন্দ। মা বলেছিল পলাশ কে।
তসলিমা কে যেদিন সন্ধ্যায় নিয়ে এসেছিল, মা তখন কোরআন শরিফ পড়ছিল।
-পলু এলি?
-হ্যাঁ, মা, তুমি বাহিরে এসো। দেখো কাকে নিয়া এসেছি।
মা তার স্বভাবজাত হাসি টা দিয়ে বেরিয়ে এলো।
-মা, তসলিমা, বলে পরিচয় করিয়ে দিতেই মা তসলিমার হাত ধরে বলল, এসো মা, বসো।
মা তসলিমাকে বলেছিল, শোন, আজ এখানেই রাতের খাবার টা খাবে। কোন অসুবিধা হবে?
পলাশ শুনেই বলেছিল, না মা, আজ পারবে না। আমাদের একটা রেস্টুরেন্টে রিজার্ভেশন আছে। আর একদিন খাবে। বলে পলাশ তসলিমার দিকে তাকাল।
-ঠিক আছে, আর একদিন না হয় অনেক কিছু রান্না করবো, তখন কিন্তু না করবি না। বলে মা তসলিমার হাত টা ওর হাতের মধ্যে নিয়ে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে।
-না, অ্যান্টি, আজই খাবো। বলে তসলিমা পলাশের দিকে তাকিয়ে বলল, রেস্টুরেন্টের রিজার্ভেশন টা বাতিল করে দাও,
-কি বলছ? বলে পলাশ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তসলিমার দিকে।
-ঠিকই বলছি, আজকের এইদিন টা আর একবার আসবে না। হোটেলটা ওখানেই থাকবে, অন্য একদিন আমরা যেতে পারবো।
পলাশ বিড়বিড় করে বলল, মেয়েদের মন বোঝা দায়।
সেই রাতে মা আর তসলিমা অনেক কথা বলেছিল। পলাশের কাছে মনে হয়েছিল ওরা যেন একে অপরের অনেক দিনের চেনা। পলাশ ছিল নীরব দর্শক।
গাংচিল গুলো আবারও চিঁ চিঁ করতে করতে উড়ে গেলো। শুধু রয়ে গেলো ওর পায়ের কাছে ঘুরে বেড়ানো পাখিটা। ও বারবার তকাচ্ছে ওর দিকে। মনে হয় কি যেন বলতে চায়।
ঝিরঝির করে বাতাস বইছে।
পলাশের মনে হোল এখানে যারা শুয়ে আছে রৌদ্রের তাপে যেন ওরা কষ্ট না পায় সেইজন্যই কি এই বাতাস। আকাশের আলো নিভে এলে গেট টা বন্ধ করে দেবে। সূর্য এখনো ঢলে পড়েনি পশ্চিম দিগন্তে।
পলাশ বসে পকেট থেকে কাগজের ন্যাপকিন টা বের করে ফলক টা মুছে দিলো।
মনে হোল মা যেন বলছে, বাবা পলু, তান্নী মা কে দেখে রাখিস। আমার সোনা টাকে বড় করে দিয়ে যেতে পারলাম না।
দুই ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়লো ফলকের উপর। পলাশ হাত টা ফলকের উপর রেখে বলল, মা, তুমি তো ওকে ছয় মাস কোলে পিঠে করে নিয়ে বেড়িয়েছিলে, কিন্তু তুমি তো ওর দাদি, দাদি ডাক শুনে যেতে পারলে না।
আবারও গড়িয়ে পড়লো দুই ফোঁটা জল।
পলাশ উঠে দাঁড়ালো, সন্ধ্যা হয় হয়।
পাখিটা ও উড়াল দিয়ে চলে গেলো।
পলাশ বলল, মা ওরা গেট বন্ধ করে দেবে। আমি আজ আসি। তুমি ভালো থেকো।