হাটতে যাই প্রতিদিন। কাছেই একটা মল আছে, সেখানে। যারা হাটতে আসে তাদের জন্য দরজা খোলে একঘণ্টা আগে। অনেকদিন ধরে হাঁটছি। তাই সবার মুখই আমার চেনা। এমন কি যে মেয়েটা পরিষ্কার করে মেঝে, মোছে ডাস্টবিন, সে কয়টায়ে আসে জানিনা তবে ঠিক কয়টায় ফিরে যায় তা আমার নখও দর্পণে। এমন কি কবে তার ছুটি সেটাও আমি বুঝে নিয়েছি। রোববারে তার সাথে দেখি সুদর্শন চেহারার একটা ছেলে। পাশে পাশে হাটে। মেয়েটার পরিষ্কার করার গাড়ী টা ছেলে টা ঠেলে নিয়ে যায়। দুজনে কথা বলে। মাঝে মধ্যে একে অপরের হাত ধরে। স্বামী বলে মনে হয় না। স্বামী হলে কাজের সময় হাত ধরতও না। আমি পাশ দিয়ে হাটতে হাটতে চলে যাই। ওদের কথা বুঝতে পারিনা। ওরা কথা বলে ইসপেনিসয়ে।
আর ঐ যে চারজন ভারতীয় মহিলা, দক্ষিণ ভারতীয় হবে, তারা আসে দশটার দিকে। তাদের মধ্যে চিকন যে মহিলা টি সে আসে প্রথমে। আস্তে আস্তে অন্যরা এসে যোগ দেয়। ওরা দ্রুত হাটতে পারে। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হয়। আমি চোখ নামিয়ে পানির বতলে মুখ দেই। বেশ কিছুদিন হোল ওদের সবাই কে এক সাথে দেখিনা। শুধু আসে চিকন মেয়ে টা। ফোনে কথা বলে। মাঝে মধ্যে ভাবি জিজ্ঞাসা করবো নাকি, তোমার বান্ধবীরা কোথায়? হয়তো গিয়েছে ছুটিতে, অথবা চলে গেছে এই এলাকা ছেড়ে।
আর ঐ যে ছেলে টা, মাথা ভরা টাঁক, ঢেকে রেখেছে বেজবল ক্যাপ দিয়ে। তার হাতে থাকে ডানকিনের কফি। ছেলে টা কেনও জানি ক্রমেই শুকিয়ে যাচ্ছে। তাকে আমি যখন প্রথম দেখে ছিলাম সে অনেক দ্রুত হাটতে পাড়ত। আজ আর দ্রুত হাটে না সে। পুরো হাটা পথ শেষ করে না। মাঝ পথ থেকে ফিরে আসে। মাঝে মধ্যে আমার মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি ওর –। না ওই চিন্তা মাথা থেকে দুর করে দেওয়ার চেষ্টা করি।
প্রায় দুই সপ্তাহের জন্য আমি বাহিরে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে আমি আর তাকে দেখি না। একদিন দুইদিন গেলো সে এলো না। ভাবলাম আমার মতো সেও হয়তো বাহিরে গেছে। না, একমাস হয়ে গেলো তাকে আর দেখিনা। আমার চোখের সামনে ভাসে তার ক্যাপ টা। ভাসে তার চেহারা টা।
নতুন নতুন অনেকে এসে যোগ দিয়েছে। পুরনো দের মধ্যে একটা জোড়া, মাঝ বয়সী। ভদ্রলোক লম্বায় প্রায় ছয় ফুট হবে, মহিলাটা ওর মাজা সমান। হাটার গতি মেয়েটার বেশি। প্রায় ভদ্রলোক পিছিয়ে পরে। মেয়েটা থামে ওকে সংগে নেয়।
একদিন হাটতে যেয়ে দেখা আমার পরিচিত এক মহিলার সাথে।
-আপনি? প্রায় আসেন বুঝি?
আমি বললাম, তা প্রায় প্রতিদিনই আসার চেষ্টা করি। বাসা থাকে তো বেশি দুরে নয়। তাছাড়া সময়টা ও কেটে যায়।
মহিলার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল বাংলাদেশ নাইটে। বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমন সময় উনি পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। তন্নী ডাক দিলো। এক গাল হেসে এসে বসলেন আমাদের আড্ডার মাঝে। সবাইকেই চেনে মনে হোল শুধু আমাকে ছাড়া। তন্নী পরিচয় করিয়ে দিলো।
-মনটু ভাই, আমাদের ভাবী তনুকা।
বলে আমার নামটা ও তনুকাকে বলল। আমি সালাম দিলাম। তনুকাও সালাম দিয়ে পাশে বসলো। ঝাল মুড়ি,পিঁয়াজু আরও কি কি যেন নিয়ে এসেছিল তন্নী আর ওর বান্ধবী রা। মাঝে মধ্যে আমরা দুজন কথা আদান প্রদান করছিলাম। উনার কথার মধ্যে যশোর দিককার কথার টান আছে। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার জন্মস্থান কি যশোরে?
-কি ভাবে বুঝলেন?
-কথার টানে। আমিও ওই দিককার কিনা?
তন্নী বাঁধা দিয়ে বলল, নাও এবার তোমরা ছোট বেলার কথা বলতে থাকো। তবে একটু আস্তে। আমরা গান শুনতে এসেছি। তনুকা ভাবী, তুমি আমার এই ভাইটা কে বাসায় দাওয়াত দেও সেখানে তোমরা অনেক আলোচনা করতে পারবে ছোটবেলার।
-ঠিক আছে বলে আমি সেদিন চুপ করে গিয়েছিলাম।
উনার সাথে আর আমার দেখা হয়নি। তন্নী বলেছিল, উনার স্বামী মারা গিয়েছিলেন হার্ট অ্যাটাকে।
বেশ কয়েক মাস পরে আবার দেখা। সনু নীগামের কনসার্ট দেখতে এসেছি। দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভাজপোড়া খাচ্ছিলাম বন্ধুদের সাথে। পিঠে হাতের স্পর্শ পেয়ে তাকিয়ে দেখি তনুকা।
কোন ভূমিকা না করেই বলল, আপনাকে আমি মলে আর দেখিনা। ওদিকে আর যান না বুঝি?
-যাই, তবে সময়ের কোন ঠিক নেই। আপনি ঠিক কয়টায় আসেন?
-ঠিক দশটায়। এলে দেখা হবে।
আমার বন্ধুরা আমার পাশ থেকে একটু দুরে সরে গেছে। কি নিয়ে যেন হাসা হাসি করছে।
-অবশ্যই।
তনুকা চলে গেলো। আমিও ফিরে এলাম আমার বন্ধুদের কাছে।
এরপর দেখা হয়েছে মলে। আমরা দুজনে হাটি। প্রায় প্রতিদিনই। একদিন হাটা শেষে বলল, চলুন আজ আমার বাসায়। যদি আপনার কোন অসুবিধা না থাকে।
অসুবিধা যেটুকু ছিল তা তুচ্ছ মনে হোল।
লেভীটটাউনে একটা এপার্টমেন্ট থাকে। পরিপাটি করে সাজানো।
দেয়ালে এক ভদ্রলোকের ছবি। একটাই ছবি লিভিং রুমে। মনে হোল বাচ্চা কাচ্চা নেই। থাকলে ছবি থাকতো।
তনুকা চলে গেলো বেডরুমে। কিছুক্ষণ পরে পোশাক পালটিয়ে, হাতমুখ ধুয়ে এসে বসলো সোফার উপর। ওর পোশাক টা আমাকে একটু অস্বস্তিকর পরিবেশের মধ্যে ফেললো।
আমি বসেছিলাম ঠিক ওর সামনে। ও মাঝে মাঝে চারিদিকে কি যেন দেখছিল।
মনে মনে ভাবছিলাম, কেনও এলাম, এমন কোন সম্পর্ক তো ওর সাথে আমার নেই যে এক কথায় ওর বাসাতে চলে আসবো। অনেক অজুহাত দিতে পারতাম। কিন্তু কেন দেইনি? এমনই হয়তো হয়, যখন ঠিকমত মাথা কাজ করে না।
বুঝলাম দেরী হয়ে গেছে। ও উঠে যেয়ে কফি বানিয়ে নিয়ে এলো। সাথে গুর দিয়ে বানানো বিস্কুট। আমাকে সে জিজ্ঞাসাও করে নি আমি আমার কফিতে চিনি বা দুধ খাই কিনা।
সে নিজেই বলল, চিনি এবং দুধ ঠিক মত হয়েছে তো?
আমি বললাম, পারফেক্ট। ঠিক যে পারফেক্ট হয়েছিল তা নয়। কিন্তু বলতে পারলাম না।
ঐযে বলেছিলাম না, মাথা টা ঠিক কাজ করছে না।
আমরা আমাদের পারিবারিক কোন কথায় গেলাম না। সেও কিছু বলল না, আমিও তাগীদা অনুভব করলাম না।
সে বলল, খেলাধুলা গান বাজনা আমার খুব প্রিয়। T20 খেলা দেখতে গিয়েছিলেন?
বললাম, হ্যাঁ, ইস্টার্ন সাইডে ছিলাম।
আমিও তো ইস্টার্ন সাইডে ছিলাম। আপনার টিকেট নাম্বার কত ছিল।
বললাম।
কি বলেন আমি তো দুই রো পিছনেই ছিলাম। আপনি দেখেন নি? খুব উত্তেজিত হয়ে সে জিজ্ঞাসা করলো।
-না, আমার দৃষ্টি ছিল সামনের দিকে। পিছনে তাকানোর দরকার পড়েনি।
-আপনি তো খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারেন। বলে হাসল তনুকা।
আমি খুব গর্ব অনুভব করলাম।
ঘণ্টা খানেকের উপর হয়ে গিয়েছিল আমরা কথা বলছি। এবার উঠবো।
তনুকা বলল, আপনাকে আমার অন্য রুম গুলো দেখানো হয়নি।
বললাম আর একদিন দেখবো। বিদায় নিয়ে এক পা সিঁড়িতে রাখতেই সে বলল, যাবেন নাকি শ্রেয়া ঘোষালের কনসার্ট দেখতে।
দাড়িয়ে পড়লাম সিঁড়িতে।
-কবে, কোথায়।
-আগামী মাসে, নিউজার্সি তে।
-না, ওর কনসার্ট আমি আগে দেখেছি। একটু কঠোর হওয়ার চেষ্টা করলাম।
-আমি আপনাকে ওর লিংক টা পাঠিয়ে দেবো। এখনও তো সময় আছে। মত পাল্টাতে তো পারে, আমার দুই একটা বন্ধুও যাবে।
গান শুনতে গিয়েছিলাম। মাঝে মধ্যে ও আমার হাতটা চেপে ধরে বলছিল, জানেন এই গান টা আমার খুব প্রিয়। আমি হাত টা ছাড়িয়ে নিতে চেয়েছি, কিন্তু পারিনি। ওর ভেজা ভেজা হাত টা আমার কাঁপা কাঁপা হাতে আটকে গেছে। আমরা কিন্তু এখনো আপনি থেকে তুমিতে আসিনি।
আর তাছাড়া আমার মনের মধ্যেও এমন কিছু ঘটছেনা যাতে করে সম্পর্ক টা তুমিতে আনতে পারি। ওর সান্নিধ্য আমার ভালো লাগছে। এই পর্যন্তই, এর বাহিরে কিছু নয়।
বলতে ভুলে গেছি এর মধ্যে আমাদের মাঝে ফোন নাম্বার আদান প্রদান হয়ে গেছে। প্রায় ফোনে কথা হয়। ফোন টা বেশির ভাগ সময় ওর দিক থেকেই আসে। মাঝে মধ্যে ভাবি ধরবনা কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না।
একদিন রাত নয়টায় তন্নীর ফোন এলো।
হ্যালো, বলতেই বলল, কারো সাথে ফোনে ছিলেন বুঝি।
-বাহ বাহ বা, তুমি জ্যোতিষী হলে কবে থেকে।
-না থাকতেও পারেন। বলে হাসল, তবে হাসি টার মাঝে একটু প্রশ্ন বোধক চিহ্ন।
-সময় ব্যায় না করে বলে ফেলো এত রাতে কি মনে করে।
-আগামী শনিবার আমার বাসায় পার্টি, আপনি আমন্ত্রিত।
অনেকে এসেছে, সেই সাথে তনুকাও।
আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। অনেক কাছে আসে বলল, এসেই আপনার খোঁজ করছিলাম। তন্নী কে জিজ্ঞাসা করতেই ও বলল, আসবেন, তবে দেরী হতে পারে।
কয়েক জোড়া চোখ যে আমাদের উপর দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে তা বুঝতে পারলাম। আমারও একটু
অস্বস্তি লাগছিল। সেই মুহূর্তে ওর ডাক পড়লো গান গাওয়ার জন্য।
ওর যে এই গুনটা আছে জানা ছিলনা।
আমি পিছনের সারিতে দাড়িয়ে ছিলাম। তন্নী এসে দাঁড়ালো আমার পাশে।
-কেমন গাইছে?
-ভালো।
-শুধু ভালো।
-কেনও ওর সাথে আর কোন শব্দ জোড়া লাগানোর দরকার আছে কি? আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম।
-সাবধান!
-মানে?
ও কোন উত্তর না দিয়ে চলে গেলো অন্যদের সাথে কথা বলতে। হাজার হলেও ওর বাসায় পার্টি। ওকে তো সব দিকেই দেখতে হবে।
সেই রাতে আমার ঘুমের বিঘ্ন ঘটে ছিল।
একদিন সকালে হাটতে হাটতে তনুকা বলল, আপনার কাছে ২০০ ডলার হবে। জরুরি দরকার। আমার একাউন্টে একটু অসুবিধা হচ্ছে।
বললাম, কাছে তো নেই, ব্যাঙ্ক থেকে তুলে দিতে পারব।
দিয়েছিলাম, সেও আমাকে দুদিন পরে ফেরত দিয়েছিল।
এরপর একদিন চেয়ে বসলো সাত হাজার ডলার। বলল, আমার লজ্জা করছে টাকা টা চাইতে। কিন্তু না হলেই নয়। যদি পারেন দিতে আমার খুব উপকার হয়।
একটু খটকা লাগলো, বললাম এই মুহূর্তে তো পারবো না, তবে দুই চার দিন পরে দিতে পারবো।
ও কোন কথা বললও না।
আমরা হাঁটছিলাম, হাটা থামিয়ে বলল, আসি। এই বলে হনহন করে চলে গেলো মল থেকে বের হবার দরজার দিকে।
আমি কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম ওর পথের দিকে। একটু আশ্চর্য হলাম ওর ব্যাবহারে।
বাসায় ফিরে এসে কল দিলাম। ভয়েস মেলে চলে গেলো।
আর দেখা পাইনি তনুকার। ওর বাসায় গিয়েছিলেম, কেউ দরজা খোলেনি।
তন্নী কে কল দিয়ে জানতে চাইলাম তনুকার কথা।
বলল, সে জানে না, শুধু জানতে চাইলো আমি ওর বেডরুমে গেছি কিনা।
অবাক হয়ে বললাম, না যাইনি। কেন? ওকথা কেনও?
-বেডরুমে ক্যামেরা আছে শুনেছি। বেচে গেছেন।
আমি আবারও ফিরে এসেছি আমার হাটার সঙ্গীদের কাছে। মাঝের কয়টা মাস ছিল আনন্দময়।
শুরুটা ছিল সুন্দর, শেষটাও হতে পাড়তও কিন্তু হোল না।
শুধু মনে পরে তন্নীর কথা, বেচে গেছেন।