“ তপু ভাই বল টা দেবা, একটা লাথি মারবো”। কানের কাছে এখনো বাজে কথা গুলো। ছোট্ট ছেলে, পাঁচ বছরের, কোঁকড়া চুল, সামনের দুটো দাঁত নেই।
সুন্দর লাগে হাসলে। আমার বন্ধুর ভাই। দাঁড়িয়ে থাকতো মাঠের পাশে। হারিয়ে গেছে। আর ডাকবে না তপু ভাই বলে।
প্রায় পঞ্চাশ বছর পর ফিরে এসেছিলাম আমার জন্মস্থানে। এখানে কাটিয়ে ছিলাম ১৬ টা বছর। ভালই হতো যদি না আসতাম আমার সেই ছোটবেলার আনন্দ মুখর শহরে। আমার স্মৃতিতে ভেসে থাকতো সেই কণ্ঠস্বর যা আমি রেখে গিয়েছিলাম ৫০শ বছর আগে।
বিদেশ বিভুয়ে অনেক দিন কাটিয়ে এসেছিলাম বাংলার মাটিতে। ভাবলাম ঘুরে আসি আমার জন্ম স্থান থেকে। একটা গাড়ী ভাড়া করে এলাম এই শহরে।
গাড়ীর ড্রাইভার কে বললাম, তুমি এখানে, এই মোড়ে নামিয়ে দাও। কিছুক্ষণ হাঁটলাম। পরিচিত জাগা অপরিচিতর মত মনে হোল। সব বদলে গেছে। যে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমরা তিন বন্ধু, দীলীপ, ওয়াহেদ আর আমি সেটা আজ বিলুপ্ত। চেনা মুখ চোখে পড়ছেনা। একজন কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ বলতে পারেন ওয়াহেদ নামে একজন এ শহরে ছিল কোথায় পাবো তাকে।” ভদ্রলোক কিছুক্ষণ আমরা দিকে তাকিয়ে থাকল বললেন, “ কোন ওয়াহেদ, ওই মাঠ পাড়ার”। বললাম।”হা”। সেতো মারা গেছে আজ দশ বছর হোল। ধাক্কা খেলাম। বলল, “ ওই যে দেখছেন ছোটো গলিটা ওখানে ওর ছোটো ভাই এর দোকান, সে খবর দিতে পারবে।” ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। ছোট্ট লোহা লক্কড়ের দোকান। উচ্চতায় বেশী নয় এমন একজন বসে আছে দোকানে। মুখ টা চেনা মনে হোল। সামনে যেয়ে দাঁড়ালাম। কতক্ষণ দুজনে দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম বলতে পারব না। শুধু শুনলাম,” তপুভাই না?” “ চিনতে পারলে কি ভাবে?” আপনি একটুও পাল্টাননি তপুভাই।” তাই কি? হা তাই। তোমার ভাই হারিয়ে গেলো কি ভাবে? সে অনেক কথা। দিলিপ দার সাথে দেখা হয়েছে? “ না, দেখা করতেই তো এলাম আজ এত বছর পর।” বসুন আমি ফোন করছি। ওরই আগ্রহ বেশী। মনে হোল সে জেনো খুঁজে পেয়েছে ওর ভাই কে আমার মধ্যে। “ দিলিপ দা তুমি বিশ্বাস করবে না, তাড়াতাড়ি
এসো, ফোনে আমি কিছু বলবো না।” “ কি হোল, এতো উত্তেজিত কেন?” “ উত্তেজিতো হবো না? সেই যে SSC পরীক্ষা দিয়ে চলে গেলে, আর ফিরলেনা। তোমরা তিন জন ছিলে হরিহর আত্মা।”
“ ওই যে দিলিপ দা এসে গেছে।” দিলিপ ও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল আমার দিকে, জড়িয়ে ধরে বললও, এলি তাহলে। হা– এলাম। চল একটা রিক্সা নিয়ে ঘুরে দেখতে চাই শহর টা আর একবার। বেড়িয়ে পড়লাম। অলি গলি দিয়ে পাড় হচ্ছে রিক্সা। কিছু চেনা কিছু অচেনা। এই সেই সিনেমা হল যেখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমরা তিন জন।
জিজ্ঞাসা করলাম, মোহিতের খবর কি? বললও, আছে তবে ভাল না। ওর ছোটো ভাই সানু মারা গেছে আজ ১৫ বছর হোল। “ কি ভাবে?” ড্রাগ ওভার ডোজে। ভেসে উঠল সেই কোঁকড়া চুল, সুন্দর হাসি ভরা মুখের ছেলেটার চেহারা। বললাম, নিয়ে যাবি আমাকে মোহিতের কাছে। ‘ চল” ।
আগে আমাদের বাসার কাছেই থাকতো আজ চলে গেছে একটু দুরে। দুই বোন আর এই ছোটো ভাই ছিল। এলাম ওর বাসার কাছে। শেওলায় ভরা বাসার প্রাচীর, কিছুটা অংশ ভেঙ্গে পড়েছে। দারিদ্রতার ছাপ চারিদিকে। মোহিত বলে ডাক দিতে বেড়িয়ে এলো হ্যাংলা পাতলা একজন, চিনতে আমার অসুবিধা হলনা। ও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। “ এতদিন পরে কি মনে করে?” প্রশ্ন তার। বললাম” ফেলে আসা দিনগুলি খুঁজতে এসেছি”। দিলিপ বললও তোরা গল্প কর আমি আমার হাতের কাজ সেরে মিলবো তোদের সাথে।
“ চল বসি ওই চা র দোকানে।” বললও, “ জানিস তপু যে শহর তুই ছেড়ে গিয়েছিলি, এ আর সে শহর নেই। এর আনাচে কানাচে হচ্ছে অশথ কার্জ কলাপ। আমদের সানু হারিয়ে গেলো ওই মাদকের মরণ নেশায়। তুই ওকে বড় ভালোবাসতিস।”এই বলে থামল। চোখে জল। বললাম, এ শুধু এদেশে নয়, সব দেশে ছড়ীয়ে পড়েছে এই মাদকের নেশা।
জানিস, সানু লেখা পড়ায়ে খারাপ ছিলোনা। স্কুলে ভালই করছিল। বুঝতে পারিনি কখন সে হেরোইনের নেশায় জড়িয়ে পরেছে। একদিন মা ডেকে বললও, “ মোহিত এই বাক্সে কিছু টাকা ছিল, দেখেছিস?” না আমি দেখিনি। ঘরে আমরা দুজন মাত্র। একটু সন্দেহ হোল। সানুর ঘরে তল্লাশি করতেই একটা সিরিনজ পেলাম বই গুলোর পিছনে। ধক করে উঠল বুক টা।
বসে রইলাম ওর আসার অপেক্ষায়। ইদানীং সে ক্রমেই রাত করে ফেরত। বাসায় আসতেই ডেকে আনলাম আমার ঘরে। সিরিনজ টা দেখাতেই অনেক কিছু বলল। বুঝলাম সবই মিথ্যা। বললাম এ বড় ভয়ঙ্কর নেশা সানু, ওই দিকে যাসনে। মার হারানো টাকার কথা এর বললাম না। ঘরে ডুকে সে দরজা বন্ধ করে দিলো। আমার মনের অবস্থা বুঝতেই পারছিস।
ক্লাসের রেজাল্ট খারাপ হতে থাকল। হেঢ মাস্টার একদিন ডেকে পাঠালো আমাকে, বলল সানু ঠিক মত ক্লাসে আসেনা, প্রায় অনুপস্থিত থাকে। মাকে কিছুই বলিনি। বুঝলাম সে বেপথে চলেছে। সেই শান্ত শিষ্ট সানু হারিয়ে গেলো। চোখের কোনে কালি, উগ্র মেজাজ,। তুই সেই সানু কে চিনবি না।
মার হাতের দুটো বালা একদিন হারিয়ে গেলো। এবার এর মাকে না বলে পাড়লাম না। মা শুনলো, কোন উত্তর দিলোনা। বাবা কে হারিয়ে মা এমনিই ভেঙ্গে পড়েছিল। এই সংবাদে তাকে আর এক ধাপ এগিয়ে দিলো মরণের পথে।
আমার চোখের সামনে ভাসছিল কি ভাবে একটা সংসার ধংসের পথে এগিয়ে যায়। হঠাৎ একদিন মোহিতের এক বন্ধু এসে খবর দিলো, পুলিশ রেড করেছিল হেরোইনের আস্তানায় । সানু সহ তিনজন কে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে গেছে।
মোহিত ছুটে গিয়েছিল থানায়। সানু ছলছল চোখে বলল, আমাকে বাচাও ভাইয়া, আমাকে বাচাও। মোহিত কিছু করতে পারেনি। শুধু দারোগা কে বলেছিল,” আসল মাস্তানকে আপনারা কিছু করতে পারলেন না, যার জন্য আজ আমার ভাইয়ের এই দশা।”
তিন বছরের জেল হয়ে ছিল সানুর। মোহিতের মা এ খবর সহ্য করতে পারেনি, এক রাতে হার্ট এটাঁকে মারা গেলেন অনেক কষ্ঠ বুকে নিয়ে। সানু বেড়িয়ে এসেছিল তিন বছর পরে। মোহিত নিয়ে গিয়েছিল রিহেব সেন্টারে। ওরা চিকিৎসার কোন ত্রুটি করেনি। সানু ফিরে এলো নূতন মানুষ হয়ে। মোহিতের আনন্দ ধরেনা। ছোট ভাইকে বুকে টেনে নিয়েছিল। একটা কাজ যোগাড় করে দিয়েছিল। সানু তাতেই খুশি।
ছোটো শহরে সবাই জানে সানু ড্রাগ এডিকট। ভালো বন্ধুরা তাকে সরিয়ে দিয়েছে। খারাপ বন্ধুর দল হাত ছানি দিয়ে ডেকেছে। এই সমাজ তাকে ভালো হতে দেইনি। মানুষ সমাজের দাস। সমাজ ছাড়া চলতে পারেনা। একাকীত্ব শানুকে পাগল করে তুলেছিল। যেতে সে চায়নি, তাকে যেতে বাধ্য করেছিল। প্রলোভন থেকে দুরে থাকতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। ভাইয়ের ছায়া তলে থেকে সে বাঁচতে চেয়ে ছিল কিন্তু তাও হয়ে উঠলনা।
ফিরে গিয়েছিল সেই আস্তানায়। হেরোইন আসক্তিদের সাথে মিশে গিয়েছিল আবার। হাতের ভেনে ঢেলে দিয়ে ছিল হেরোইনের বিষ। সেই শেষ।
দরজা ধাক্কার শব্দে মোহিত উঠে পরেছিল। রাত তখন চারটা। দরজা খুলতেই দেখল পুলিশ দাড়িয়ে। বলল এখনি হাসপাতালে যেতে হবে মৃতদেহ সনাক্ত করতে। সারা শরীর হিম হয়ে গিয়েছিল মোহিতের। লাশের পাশে দাঁড়িয়ে সনাক্ত করলো। মোহিতের মনে হোল কি শান্তিতেই না সানু ঘুমিয়ে আছে। আর উঠবে না। ভাইয়া বলে আর ডাকবে না।
মোহিত তাকিয়ে রইল আমার দিকে, দুচোখে জল, বলল আমি ওকে বাচাতে পারলাম নারে তপু, বাঁচাতে পারলাম না। আমার কানের কাছে বাজতে থাকল সেই কণ্ঠ, “ তপু ভাই বল টা দেবা একটা লাথি মারব”.