এক জীবন ভালবাসা

 তখনো দেখেনি তাকে, যে এসে ছিল পায়ে পায়ে, আটপৌড়ে শাড়ী পরে, কপালে টিপ, নাকে নাক ফুল, ঠোটে আলতো করে আকা রং, দুপাশে বেনি, থাক —-এসব কথা আসবে পরে

    ফিরে যাই ছোটো বেলার দিন গুলোতে, হাফ পেন্ট পরা ছেলেটা নাম তার কৌশিক, ধুলো মাখা পায়ে দৌড়ে এসে দেখলো স্কুলের সময় হয়ে গেছে,মারবেল টাই যতো নষ্টের মুল ঝটপট চান সেরে দৌড় দিলো স্কুলের দিকে মা ডাকলোকৌশিক ভাত খেয়ে যা বাবাসময় নেই স্কুলের ঘন্টা পড়ে যাবে সেই দুরন্তপনা কোথায় গেলো

     জাম্বুরা কে ফুটবল বানিয়ে খেলায় কতনা আনন্দ তাতো উপভোগ করেছিলো সেই ছোট বেলায়কাচের মান্জা দেওয়া সুতো দিয়ে ঘুড়ি উড়ানো, ‘ফক্কা, কেটে দিয়েছে একটা ঘুড়ি, ছেলেরা ছুটছে কেটে দেওয়া ঘুড়ির পিছনে মনে পরে স্কুল পালিয়ে নদিতে ঝাপ দেওয়া ড়াংগুলি খেলতে যেয়ে যেদিন পাশে দাড়ানো মেয়ে টার নাকটা ফাটিয়ে দিয়েছিলো সেদিন ভয়ে সে জড়সড় বাসাতে ফিরলে জানি আজ একটা হেস্ত নেস্ত হয়ে যাবে না কিছু হয়নি যেদিন আট আনা দিয়ে বাসে টিকিট কিনে চলে গিয়ে ছিলো দুরের এক শহরেআলি বাবা চল্লিশ চোরসিনেমা দেখতে, সেদিন ভয় আসেনি রাতে ফিরে এলে কি হবে সে যাত্রা দাদি বাচিয়ে দিয়ে ছিল তখন কতবড় সে? চতুর্থ শ্রেনিতে পড়ে যেদিন তিন মাইল হেটে গিয়ে ছিলো আরাপপুরে পুতুল নাচ দেখতে সেই কৌশিক আজ একলা বসে ভাবছে কোথায় গেলো সেই আনন্দ মুখোর দিনগুলো

       এতো দুরন্তপনা করেও কৌশিক ক্লাসে প্র্থম অথবা দ্বিতিয় স্থানের নিচে নামেনি আস্তে আস্তে হাফ পেন্ট ছেড়ে সে ফুলপেন্ট ধরেছে দুরন্তপনা এখন তার মধ্যে নেই এসেছে সাবলীল গতি সে হয়েছে ফুটবল টিমের কেপ্টেন, স্কাউটের গুরুপ লিডার সেদিন কৌশিকের চোখে কোনো স্বপ্ন ছিলোনা ভাবেনি তার ভবিষ তাকে কোনদিকে নিয়ে যাবে সে ভাবে কেনো জীবনটা সেদিন ওখানেই থেমে যাইনি তাহলে আজ তার জীবন বিসলেশন করার কোনো প্র্য়োজন ছিলনা থেমে না যেয়ে ভালই হয়ে ছিলো দেখা হয়ে ছিল তার সাথে যে দিয়ে ছিলো তার জীবনের পরিপুর্নতা কৌশিকের জীবন টা ছিলো বাধা হিন বলগা হরিনের মত কৌশিক, মফস্বল শহরে এক ডাকে পরিচিত নাম

       মাধ্যমিক পরীক্ষায় চার টা লেটার নিয়ে সে পাশ করলো ১৯৬৬ সালে ছোট্ট টিমটিমে জ্বলা শহর থেকে সে এলো উজ্জল নিয়ন সাইনে ভরা ঝলমল শহরে দেশের রাজধানী এখানে সে অনেকের মধ্যে একজন পিছনে ফেলে আসা ছোট্ট শহরটা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে না পিছনে সে তাকাবেনা তাকে সামনে আগিয়ে যেতে হবে ভর্তি হলো সব চেয়ে নাম করা কলেজে হস্টেলে থাকা কালিন বন্ধুত্ব হলো অনেকের সাথে রাতের অন্ধকারে বেড়িয়ে পড়ত বন্ধুদের সাথে শাসন করার কেউ নেই নিজের দায়িত্ত নিজের কৌশিক জানতো আলোয় ঝলমল শহরে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা অনেক

   দুবছর পার হয়ে গেলো কোথা দিয়ে সে নিজেও জানেনা কলেজ শেষ রেজাল্ট ভালো সামনে ভবিষ জানে না তার তরী কোথায় যেয়ে ভিরবে জীবনের নতুন অধ্যায়ে আদৌ সফলতা আছে কিনা

ভর্তি হলো ফার্মেসিতে হেসে খেলে বন্ধু বান্ধবিদের নিয়ে ভালই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো

     সেই চলার পথে হঠা করে কেনই বা দেখা হয়ে ছিলো দুই বেনি বাধা মেয়ে টার সাথে যদি দেখাই হয়ে ছিল তবে কেনই বা দুজনে দুজনের চোখের ভাষা বুঝে নিয়ে ছিলো আজ কৌশিক জীবনসায়াহ্নে বসে অতীতের দিকে ফিরে চাইছে

   দেখা হয়ে ছিল বোনের বাসায়, চোখে কাজল, কপালে টিপ, পরনে সাদা শাড়ী কালো পাড়, ছিপ ছিপে গরন জিজ্ঞাসা করে ছিলো তাকে, “ তোমার নাম কি?” বলল, কনাআপনি বুঝি ভাবির ভাই

বাহ, জেনে গেছ” “ সাদা শাড়ী কালো পাড়ে তোমাকে বেশ মানিয়েছে কৌশিক ভাবল কথা বলাটা ঠিক হলো কিনাপ্র্থম দেখায় কোনো মেয়েকে একথা বলতে নেই” “ তা কেনো, যা দেখতে ভালো তা বলতে বাধা কি কোনো সংকোচ সে দেখেনি তার মাঝে উচ্ছলোতায় ভরা কি এক অনাবিল আনন্দ।। কি এক অমোঘ আকর্ষণ যে আকর্ষণ বার বার কৌশিক কে ফিরিয়ে এনেছে ওখানে কিসের টান সে জানেনা সেই শুরু

           কনা ভর্তি হবে বিশ্ববিদালয়ে উপদেশ চায় কৌশিকের কাছে ঘরে একেলা দুজন অনর্গল হাসির ফোয়ারা বইছে কবে কখন কনা কৌশিকে তুমি বলে ডাকতে শুরু করেছে, সে নিজও জানে না কৌশিক ওর হাত টা হাতের মধ্যে চেপে ধরে বলেছিল, “ ঠকবে না তুমি, কথা দিলামকনার চোখে জল, “ তুমি থেকো আমার মাঝে চিরজীবনের জন্যবলতো,” তুমিই একমাত্র মানুষ যার হাতে আমি হাত রেখেছি, তোমার হাতেই আমি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে চাই

     কৌশিক প্র্তিদিন আসে ছাত্রীহলের গেটের কাছে কনা বেড়িয়ে আসে, কৌশিক বলে, “তুমি এলে পাশের অনান্যরা এতো ম্লান হয়ে যায় কেনো?” “তোমার চোখে আমাকে দেখো তাই

কনা বলত, “ ঝড়ের মতই তুমি এলে আমার জীবনে ভালবাসার মধ্যে যে এতো আনন্দ তাতো বুঝিনি আগে কতদিন তারা কাটিয়ে দিয়েছে খোলা আকাশের নিচে বসেছে দুগাছের ছায়ায় সন্ধ্যা হয়ে আসে কথা ফুরাতে চায়না

     নদীর জল অনেক গরিয়ে গেছে কৌশিক হারিয়ে গেছে দুই বেনি বাধা মেয়েটির মাঝে সে বলেজানো কনা, গান আমার গলায় আসেনা তবু গাইমোরা আর জনমে হংসমিথুন ছিলাম কনা বলে, “ তাই”?

   পেরিয়ে গেছে সময় দুজন দুজন কে বুঝে নিয়েছে বুঝেছে একেছাড়া অন্যের অস্তিত্ব নেই মাঝে মাঝে কৌশিক গাইতো, “আমার পরান যাহা চায়, তুমি তাই তাই গো” , কনা ওর ঠোট দিয়ে আলতো করে কৌশিকের ঠোট টা চেপে ধরে বলত,” গাইতে হবে না আমি জানি

     কৌশিকের পরীক্ষা শেষ এবার যাবার পালা আমেরিকা আসার ব্যবস্থা তার অনেক আগেই হয়ে ছিলো ইমিগ্রেশন নিয়ে আসবে তার বন্ধুরা অনেক আগেই চলে গেছে ১৯৭৪ সালের মে মাসে নিউ ইয়র্কের পথে রওনা দেবে আসার আগের দিন দুজনে এসে বসলো ইগলু ক্যাফেতে অনেক কথার পর কৌশিক বলল, “ একটা বছর অপেক্ষা করো, আমি ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে যবো বাইরে মুষলধারে বূষ্টি সন্ধ্যা হয়ে এলোচলো তোমাকে পৌঁছে দেই তোমার ভাইয়ের বাসায়,” ওর চোখে জল বলল, কাল আকাশের দিকে চেয়ে থাকবো যতক্ষন না তোমার প্লেনটা উড়ে যায়

     যাবার দিন মা বাবা এলো কৌশিককে বিদায় দিতে মার চোখ ভিজা বলল, বাবা সাবধানে থাকিস, এতদুর পথভেবো না মা, চিঠি দিয়ে সব জানাবো বাবা শুধু তাকিয়ে থাকলো হাত নেড়ে কৌশিক বিদায় নিলো যাওয়ার পিছনে আনন্দ বিরহ মিশানো চোখের জল সে দেখেছে কনার, দেখেছে মা ,অজান্তে চোখ ওর ভিজে এলো এই বিরাট শুরুর পিছনে মা বাবার দান কত কৌশিক ভাববার চেস্টা করলো বাবা মা তাকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলো মধ্যবিত্ত সংসারে অভাব সে দেখেনি কোনদিন, দেখেনি মা বাবার মধ্যে দ্বন্দ্ব সেকেলের প্রেম দিয়ে গড়া ছিলো দুজন আজ কৌশিক নিজের প্রেম দিয়ে বুঝতে চেস্টা করল মা বাবার প্রেম মা কে ছাড়া বাবা চলতে পারতো না, মা চলতে পারতো না বাবাকে ছাড়া হয়ত তারই ছায়া এসে পড়েছিলো কৌশিকের উপর এয়ার হস্টেসের ঢাকে সে ফিরে এলো বাস্তবেকোনো ড্রিঙ্কস নেবেকৌশিক তুলে নিলো সেভেনআপ. তাকিয়ে থাকলো জানালা দিয়ে উড়োজাহাজ তখন আকাশে

       নিউ ইয়র্কের মাটিতে যখন সে পা দিলো তখন রাত তিন টা কৌশিক বাইরে এসে দেখে কেউ তার জন্য অপেক্ষা করছে না অপেক্ষা করার তো কথা ছিল? প্লেন আসতে দেরী হওয়াতে ওরা চলে গেছে কৌশিক কি করবে বুঝতে পারছে না নিজেকে অসহায় মনে হোলো বিদেশ বিভুই বলে কথা এতো বড় শহর, ইংলিশ জানে কিন্তু বলার অভ্যাস নাই অজানা আতংকে তার শরীর শিউরে উঠলো নিওনের আলো তার কাছে ঝাপসা লাগছে বিশ ডলার তার পকেটে এই ডলার দিয়ে কতটুক পথ যেতে পারবে তা সে জানেনা যে দিকে তাকায় সাদা কালো মুখ বাংলায় ডাক শুনে কৌশিক ফিরে তাকালোআমাকে বলছেনকৌশিকের প্র্শ্নহা,কেউ আসেনি বুঝিদেখছি না তো?” “কোথায় যাবেনভদ্র্লোকের প্র্শ্ন কৌশিক হাতের কাগজটা আগিয়ে দিলো

ঠিকানাটা দেখে বললেন, “ আপনি কি ফার্মাসিট? “ “কি ভাবে বুঝলেন” “ ঠিকানা দেখে, বেশির ভাগ ফার্মাসিট ওখানেই থাকে, আমিও ওই দলের, তবে থাকি অন্যখানেপরিচয় হলো উনি কৌশিকের থেকে পাচ বছর সিনিয়ার এসেছে ভাগনেকে নিতেপয়সা করি কিছু আছে?” বিশ ডলার ওতেই হবে টেক্সি ঠিক করে দিচ্ছি সোজা চলে যান কৌশিক ভাবলো যাক একটা হিল্লে হলো টেক্সি চলেছে কখনো আস্তে কখনো জোর

   রাতের নিউ ইয়র্ক বইয়ে পড়েছে, ছবিতে দেখেছে বন্ধুরা গল্প করতো, জানিস এম্পায়ার এস্টেট বিল্ডিং, এত উঁচু, নিচের থেকে যদি ওর মাথা দেখতে চাস, তবে তোর মাথার টুপি পড়ে যাবে শুনে এসে ছিলো রাস্তায় কাগজ পড়ে থাকে, লোকে পয়সা পাশে রেখে কাগজ নিয়ে চলে যায় সে ভুল পরে তার ভেঙেছিলো

ট্যাক্সি এসে দাড়িয়েছে তিন রাস্তার মোড়ে ট্যাক্সিচালকের লাল বাতি সে দাড়িয়ে আছে এত রাতে নিস্তব্দ রাস্তা তবু সে দাঁড়িয়ে আছে কৌশিক এতে অভ্যস্ত নয় একথা সে লিখে জানিয়ে ছিল তার ছোট বোন কে

ট্যাক্সি এসে দাড়ালো , ভাড়া মিটিয়ে কৌশিক উঠে গেলো উপরে সবাই ঘুমাচ্ছে, একজন বলল, পাশে শুয়ে পর, সকালে কথা হবে পকেটে রইলো মাত্র্ দশ ডলার

             বাবা জানতো তার ছেলে ফার্মাসিস্টের কাজ নিয়ে গেছে আসলে তা নয় এখানে ফার্মাসিস্ট হওয়ার পথ কঠিন না হলেও, অতো সহজ নয় অনেকের মতে একেবারেই সহজ নয় যে ছেলে কোনদিন ঘাসের কুটোটা ছেঁড়েনি, বাজারের থলে হাতে বাজারে যায়নি, গায়ে ফু দিয়ে বন্ধুবান্ধব নিয়ে আর লেখাপড়া করে কাটিয়ে দিয়েছে, তাকে আজ কাজ নিতে হয়েছে একটা টয় ফ্যাক্টরিতে আট ঘন্টা কাজ দুই ঘন্টা পর দশ মিনিটের জন্য বিশ্রাম মেশিন থেকে প্র্তি সেকেন্ডে বেরিয়ে আসছে টয়ের একটা অংশ আর কৌশিক সেই গরম অংশটাকে টেনে বের করে পাশে রাখছে কাজ শেষে বাহিরে এসে দাঁড়াল, হাতের আঙ্গুল গুলো লাল আজ চোখে জল আসতে দিলো না কৌশিক, ভেসে উঠলো কনার মুখ, ভেসে উঠলো মা বাবার মুখ, কনা কে কথা দিয়ে এসেছে, আশ্বাস দিয়েছে বাবা মাকে   ভেঙে পড়লে চলবে না

     তিন বন্ধু মিলে বাসা নিয়ে ছিলো টয় ফেক্টরির কাজ ছেড়ে, চাকরি নিলো এক ফর্মাসিউটিক্যাল কোম্পনীতে উচু মানের কোনো চাকরি নয়, তবুও খাওয়ার পরার পরে কিছু ডলার বাড়তি থাকবে তার কিছু অংশ পাঠিয়ে বাবা মার মুখের হাসি সে দেখতে পাবে হিসেবের অংক কসে সে বুঝতে পারবে কবে আসবে ফিরে যাবার দিন টা যে দিন কনাকে দেখবে ,দুজন এক সাথে হবে, সংসার বাধবে বলে এসে ছিলো এক বছর পর আসবো

       চিঠি আসে প্র্তি সপ্তাহে লেখাতে কত সতর্কতা, অত বেশি কাজ করোনা, শরীর খার হয়ে যাবে কৌশিক ভাবে বিধাতা ভালোই করেছে ভবিষ জানতে দেয়নি তাইতো তুলির আচড়ে গড়ে নিয়েছে সে তার নিজের ভবিষ এখানে নেই কোনো দ্বন্দ্ব, নেই কোনো প্র্তিঘাত, আছে শুধু উচ্ছাস আছে শুধু আনন্দ , তুলির আচড়ে আচড়ে একেছে সে কনার হাসি ঝরা অবয়ব মূর্তি ভাঙবার নয় মূর্তি তার হৃদের তন্ত্রীতে গাথা        

কিরে? যাবিনে, বন্ধুর ডাকে ফিরে এলো বাস্তবেসিনেমা তো আরম্ভ হয়ে যবে প্র্তি বন্ধের দিনে ওরা যায় ভারতীয় হিন্দি ছবি দেখতে এই হচ্ছে তাদের রিক্রিয়েশন. “তোর এই উদাস উদাস ভাব কবে কাটবে?” “ এবার কনা ছেড়ে অন্য কিছু কল্পনা করএক বন্ধুর মন্তব্য কৌশিক ওদের কে বুঝাতে পারে না, যা সে পিছনে রেখে এসেছে তা তার জীবনের এক বিরাট অধ্যায়

   “কি রে গলা ভিজাবি আজকে?’” ওটা চলে না কৌশিকের বললনা তোরা পান করিস, আমার কিছু লেখা শেষ করতে হবে ওকে বলে লাভ নেই, গোতম বুদ্ধো,মন্তবো করলো আর এক বন্ধু মূভি শেষে ওরা নিয়ে এলো লাল পানিয়ো, এটাও একটা রিক্রিয়েশন, পাচ দিন অক্লান্ত পরিশ্র্মের পর একটু আমেজ, একটু আনন্দ, এইতো ওরা চেয়েছে ,এর বেশি কিছু নয়

     দেখতে দেখতে বছর ঘুরে এলো, এবার দেশে যাওয়ার পালা কিছু কিনা কাটা করতে হবে বিয়ের বাজার বলে কথা কৌশিক ওর এক ভাবিকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো   “কি কি কিনতে হবে জানো কি?”ভাবি জিজ্ঞাসা করলআমি কি ভাবে জানবোবলল কৌশিকমাপ জানো” “ কিসের মাপকৌশিক আকাশ থেকে পড়লো

এইযে ৩২, ৩৩ বি , সিভাবি, স্পষ্ট করে বলো যে পাতলা গঠোনের কৃষাংগ মেয়ে টা দেখছো, ওরকম হবেকি? “ ভাবির প্র্শ্নতা হবে, তবে লম্বায় নয়বুঝেছি তুমি দাড়াও এখানে, আমি আসছি বলে ভাবি চলে গেলো ফিরে এলো কিছুক্ষণ পর এবার কৌশিক বুঝতে পাড়লো ভাবি কি বলতে চাইছিলো

কেনা কাটা শেষ, নিয়েছে কসমেটিক, কিনেছে গোলাপি সুটকেস

     এয়ার পোর্ট এসেছে অনেকে কৌশিককে বিদায় দিতে গুডলাক এন্ড গুডবাই জানালো সবাই আস্তে আস্তে ভিতরে চলে গেলো কৌশিক কোন দ্বিধা ভয় মনের মধ্যে আসেনি শুধু উচ্ছাস, শুধু আনন্দ বাবা মা কে দেখবে, দেখবে কনাকে একদিন পেরোনোর পর উড়োজাহাজ এসে দাড়ালো তার গন্তবো স্থানে   দাড়ালো টারমিনাল থেকে বেশ দুরে সকাল এগার টা রৌদের তাপ বাড়ছে কপালে ঘামের রেখা হাত দিয়ে মুছে এগিয়ে গেলো টারমিনালের দিকে

     বেরিয়ে এসে কৌশিক দেখলো বাবা দাড়িয়ে আছে, পাশে কনা এক গোছা ফুল নিয়ে বান্ধিদের সাথে যাওয়ার আগে কৌশিক বাবা মার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ছিলো কনাকে বাবা বলল, “ চলো, বাহিরে গাড়ি অপেক্ষা করছে, “ বাবা এগিয়ে গেল কনা ওর হাতের ফুলের তোরা কৌশিক কে দিয়ে বলল, “ অনেক ক্লান্ত লাগছে তোমাকেওর বান্ধবি মাগফের বলল,” কৌশিক ভাই অনেক হ্যান্ডসাম লাগছে, ওজন বেড়েছে মনে হচ্ছে,:

তোরা থামবিকনা ধমোক দিলো

ওতো তোরই থাকবে, আমাদের কে একটু আনন্দ করতে দে

গাড়ী এসে দাড়ালো বাসার সামনে মা বেড়িয়ে এলো জড়িয়ে ধরে বলল,” অনেক শুকিয়ে গেছিস পিছনে কনার বান্ধবীর একটু মুচকে হাসলো সব মা রাই এরকম বলে বৌদি বেড়িয়ে এলো, বলল,” কি দেবর মশাই এত তাড়াতাড়ি চলে এলে যে, মন টিক ছিল না বুঝি?” “ তা যা বলেছো, বড় কঠিন পীড়া ছোট বোন দুটো দৌড়িয়ে এলো, “আচ্ছা তোমরা সব দাড়িয়ে দাড়িয়ে বকর বকর করবে, না সুটকেস গুলো খুলে দেখবে কি কি জিনিস এনেছে সবাই হেসে উঠলো মা কনাকে বলল, “ যাওতো মা, ওর ঘরে ওর কাপড় চোপড় গুলি গুছিয়ে রাখোকনা বাসার অতি পরিচিত মুখ এই সংসারের এক জন হয়ে গেছে শুধু কাগজে কলমে নয় দরজাটা ভেজিয়ে দিলো কৌশিক, কনা কি জেনো বলতে চাইলো বলা হলো না ওর ঠোট টা হারিয়ে গেলো কৌশিকের ঠোটের মাঝে সন্ধা ঘনিয়ে এলো কনা আর তার বান্ধবিরা ফিরে যাবে ছাত্রীহলে কনা মার কাছে যেয়ে বলল,” কাল ফিরে যাবো বাবা মার কাছে, লজ্জায় লাল”,মা জড়িয়ে ধরে কপালে চুম দিয়ে বলল, “ এসো মা এক ঝলক তাকালো সে কৌশিকের দিকেচলো তোমাদের কে এগিয়ে দিয়ে আসি

     ২৬শে অক্টোবর বিয়ে এক অদ্ভত অনুভুতি যাকে নিয়ে সে স্বপ্ন দেখতো আজ তা বাস্তবে পরিনিত হতে চলেছে এক বিরাট দায়িত্ব পারবে কি সে ? বৌদি ডাক দিলো, “ দেবর পো এদিকে একটু এসো, এই লিস্ট টা দেখো সব ঠিক আছে কি না

তোমরা করো আমাকে জরিও না, বলল কৌশিকতা না কেনো, তুমি বসে বসে তোমার কনার ধ্যান করো আসলেই তাই সে ওর কথাই ভাবছিলো, অতিত, বতর্মান, ভবিষ্য

     সব ঠিক কনা দের বাড়ী ছোট শহরে যেতে হবে প্লেনে, তারপর মাইক্রোবাস যথারিতি, যথা সময়ে শুভ কাজ সম্পন্য হলো অপুর্ব লাগছিলো ওকে বিয়ের সাজে কপালে টিকলি, নাকে নথ, গলায় হার, আলতো করে রংএর প্র্লেপ কৌশিক চোখ ফেরাতে পারে না, লজ্জায় নতো হওয়া সুযর্মুখি, রুপ সে দেখিনি আগে জেনো লজ্জাবতি ফুল টোকা দিলেই ঝরে পড়বে কৌশিক আলতো করে মুখ টা উঠালো ওর চোখের সামনে, পলক পড়েনা চোখে, বলে , কি সুন্দর রুপ তোমার, আগেতো দেখিনি কখনো কনা বলে তোমারই হাতে গড়া, তোমারিই চোখে দেখা

       কৌশিক নিয়ে এলো কনা কে ওদের বাসায় মা বৌদি দাড়িয়ে আছে বৌ কে বরন করবে, হাতে দুধের পাত্র্, কৌশিক জানেনা এসব রিতি দুর থেকে ভেসে আসছে গানের কলি, “এসো এসো আমার আমার ঘরে এসো আমার ঘরে আজ সে বৌ হয়ে এলো বাসায় জড়িয়ে গেলো সুখ দুখের সাথে কৌশিক বলেছিল, “অনেক কষ্ট করতে হবে

ওখানে, পারবে তোতুমি পাশে থাকলে কোন কষ্ট আমার হবেনা

       দেখতে দেখতে তিনটি মাস হেসে খেলে কেটে গেলো এবার কৌশিকের ফিরার পালা বাবা কে বলেছিলো ওখানে সে কি করে মা কে সে বলেনি মার চোখের জল সে দেখতে চায় না বাবা বলেছিলো, কোনো চিন্তা করিস না, বৌমাকে আমি দেখে রাখব কে জানতো বাবার সাথে এই হবে তার শেষ দেখা কনা চুমো দিয়ে ওকে বলেছিলোচোখের জল দিয়ে তোমার পথ ভিজাবো না, তাতে তোমার অমংগল হবে, যেদিন তুমি আমাকে ডেকে নেবে, সেদিন যেয়ে তোমার কষ্টের ভাড় আমিও বইবো তোমার সাথে

         ফিরে এলো কৌশিক, রেখে এলো কনাকে এখন সে আর একা নয়, তাকে পায়ে দাড়াতে হবে যত কঠিনই হোক রেজিস্টারড ফারমাসিস্ট তাকে হতেই হবে

         একদিন কৌশিক গেছে বাহিরে ফিরে এসে দেখে ঘর ভর্তি, সব বন্ধু বসে আছে ছেকে ধরল তাকে বলতে হবে বাসর রাতের কথা সহিদ এসে বলল, “ শোন এখানে পিপ সো আমরা দেখেছি, এবার বাছাধন তোমার পিপ সোর কথা বলো হাউ ডিড ডু? ওরা সবাই কনা কে চেনেকৌশিক জানে এরা নাছোর বান্দা একটা কিছু তাদের কে বলতে হবেইশোন সবাই নড়ে চড়ে বসলো ভিষন উদগ্রীব,ঘর নিস্তবধ সবার চোখ কৌশিকের দিকেপীপ সো তোরা দেখেছিস নো দা সিচুয়েশন নো হোয়াট ইজ গোয়িং অন, এখন আমার মুখটা বসিয়ে দে ছেলেটার মুখে আর কনার মুখটা বসিয়ে দে মেয়ের মুখের উপর খেল খতম পয়সা হজম ওরা মোটেই সন্তুষ্ট নয় আরো রসালো কিছু আশা করছিলো

       কৌশিক শুরু করলো বিনা পয়সায় ইন্টানর্শীপ একটা ফার্মেসিতে আট ঘন্টা কাজ তারপর বেরিয়ে পড়ে রুজির সন্ধানে কাজ নিয়ে ছিলো ওয়েটারের, এক রেস্টুরেন্টে সব কাজ সেরে ফিরতো রাত একটায় পড়াশুনা করতো ট্রেনের ভিতর, যতটুকু সময় পেতো সপ্তাহে সাত দিন কাজ বিরাম নেই

       দেখতে দেখতে ছয় মাস কেটে গেলো কনার আসার ব্যবস্থা পাকা বাসা নিতে হবে কৌশিকের চিন্তার অন্ত নাই বাসা পাওয়া কষ্টসাধ্য ব্যপার চাইলেই পাওয়া যায় না বিধাতা হয়তো ওর মনের কথা শুনতে পেয়ে ছিলো

রাতে একটা ফোন এলো রউফ ফোন করেছে ঘনিস্ট বন্ধু বিবাহিত থাকে বৌ নিয়েএকটা ওয়ান বেড রুম এপার্টমেন্ট খালি হয়েছে আমাদের বিল্ডিং তুই তাড়াতাড়ি খোজ নেসকালে যেয়েই আমি খোজ নেবোবলল কৌশিক এপাশ ওপাশ করে রাত টা কেটে গেল সকাল দশ টায় কৌশিক এসে হাজির খবর নিয়ে জানলো সুপার বাহিরে গেছে ফিরবে ঘন্টা খানেক পর কৌশিক বসে রইলো সামনের সিঁড়িতে জাগাটা ভালো লাগলো কৌশিকের পা বাড়ালেই পাতাল রেলপথ বায়ে মোড় নিয়ে একটু গেলেই পোস্ট অফিস দু ব্লক দুরে এন্ড পি সুপার মার্কেট কনার অসুবিধা হবেনা বাজার করতে ভাবনা শেষ না হতেই কৌশিক দেখলো লম্বা প্রায় ছয় ফুট, হেংলা পাতলা মুখে খোচা খোচা দাড়ি একজন ওর পাশের শিড়ি দিয়ে উপরে উঠছে সে আগে কখনো সুপার কে দেখেনি নাম জানে কেনেথ উইলিইয়াম মনে হয় এই হবে সুপারমিঃ উইলিইয়াম?” ডাক দিতেই ভদ্র্লোক ফিরে তাকালো কৌশিকের দিকেইয়েস?” “ আই হার্ড দেয়ার ইজ ওয়ান বেড রুম অ্যাপার্টমেন্ট অ্যাভেইলেবল ?”মিঃ উইলিয়াম কৌশিকের আপদ মস্তক দেখলো, “হু টোলড ইউকর্কশ কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো

কৌশিক আমতা আমতা করে বললো, “আমার এক বন্ধু রউফ এখানে থাকে, সে বলেছিলো,” “ইয়া, আই হাভ বাট — “ কৌশিক এই বাট শুনে বুঝতে পাড়লো সে কি চাইছে” “ হাউ মাচ আই হ্যাভ টু গিভ?”

ফিটি ডলার

নো প্রবলেম” “কান আই হাভ লুককৌশিক জানালো

লেটস গো

.কৌশিকের পছন্দ হলো বেশ বড় বসার ঘর বড় বড় জানালা, জানালা দিয়ে আলো এসে পরেছে বসার ঘরে শোয়ার ঘর টাও মন্দ নয়হাউ মাচ ইজ দা রেন্ট?” কৌশিকের প্র্শ্ন “ “২১০ ডলার

কৌশিক রাজি সব ঠিক কৌশিক চিন্তা মুক্ত বেরিয়ে আসার পথে সুপার ডাক দিলো তাকে বলল, “ নিচে একটা পুরানো সোফা আছে ফেলে দেবো, যদি চাও নিতে পার জেনো শাপে বর বলল,” নিশ্চয়পড়ে পাওয়া সোফা দিয়ে ঘর সাজালো যে রেস্টুরেন্টে কাজ করতো তাদের ফেলে দেওয়া কফির জারগুলি নিয়ে এলো এলাচ, দারচিনি, হলুদ, মরিচের গুড়া দিয়ে সাজিয়ে রাখলো থরে থরে ৫০০ ডলার দিয়ে একটা বেডরুম সেটও কিনে ফেললো

         আজ কণ্ঠার অবসানের দিন অনেক অপেক্ষার পর এসেছে সেই দিন ১২টা ১০ মিনিটে প্লেন আসবে কেনিডি এয়ারপোরর্টে কনাকে দেখবে নতুন জীবন শুরু হবে এক অজানা শিহরন কৌশিকের সারা শরীর দোলা দিচ্ছে সেই চোখ, সেই মুখ, সেই ঠোট

       গত রাতে ফারুক কে বলে রেখেছে তার টোপ খাওয়া গাড়িটা নিয়ে যবে কনাকে আনতে সে রাজি, তবে বললতোদের অশোভন কাড়জো কলাপ আমাকে দেখতে হবে নাতো” “ তোর দেখে অভ্যাস আছেবলল কৌশিক প্লেন এসে নামলো সময় মতো কৌশিকের মনে হচ্ছে সে অনেক ক্ষন ধরে অপেক্ষা করছে পায়চারি করছে দ্রুততুই একটু ধৈয্ ধরবিফারুকের মন্তবো কৌশিক পায়চারি বন্ধ করে এসে দাড়ালো চোখ তার

দেয়ালে ঢাকা দরজার দিকে হালকা নীল রং এর শাড়ীর আভা সে দেখতে পেলো নীল রং শাড়ীতে মোড়ানো কনাকে অপুর্ব লাগছিলো কৌশিকের চোখে ছোট্ট একটা মিস্টি হাসি দিয়ে কনা তাকালো কৌশিকের দিকে কৌশিক এগিয়ে দিলো লাল গোলাপের তোড়া আলতো ভাবে চুমো দিলো কনার ঠোটে

           কৌশিক ছুটি নিয়ে ছিলো কয়েকদিনের জন্য যেদিন সে এসেছিল তার পরদিনই

গেল সাকর্ল লাইন পরনে বড় বড় ছাপ দেওয়া শিফনের শাড়ী, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা অপূর্ব লাগছিলো কনাকে কৌশিকের চোখে

বলল,” শাড়ী সামলিয়ে রাখতে পারবে তো, ভীষন বাতাস হবে বোটেবোট চলছে কনা ডাক দিলো কৌশিককে

দেখ দেখ এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, বুঝি টুইন টাওয়ার,” খুশি, আনন্দে উছলে পড়ছে দুজনে কৌশিক বললো,” আইস ক্রিম কোণ খাবে?” আপত্তি নেই কনার কৌশিক নিয়ে এলো রেলিং সে হেলান দিয়ে দাড়ানো, বাতাসে শাড়ীর আচল উড়ছে ওটাকে সামলাতে গিয়ে আইসকি্র্মটা পড়ে গেলো পানিতে হাতে রইল শুধু কোণ

কনা তখনো শাড়ী ছেড়ে পেন্ট ধরেনি, লাল শাড়ীতে ওকে ভীষন মানাতো, অপুর্ব লাগতো কৌশিকের চোখে দুজনে বসে থাকতো রেডীও সিটি মিউজীক হলের এর সামনে বসে থাকতো রকফেলের সেন্টারের স্ট্যাচু এর সামনে কনা কৌশিকের কাধেঁ মাথা রেখে বলতো, “ দেখারতো শেষ নেই, সোনা, এখন আমি তোমার কাধে মাথা রেখে তোমাকে দেখবোকৌশিক ওর ঠোট দিয়ে চেপে ধরতো কনার লালচে রং এর ভেজা ঠোট হারিয়ে যেতো দুজনে ভালোবাসার গভীর বন্ধনে

           কনা কাজ নিল ম্যানহাটানের একটি কলম কারখানায় ভোর সাতটায় বেড়িয়ে যায় কৌশিকও বেড়িয়ে পড়ে সেই সাথে কাজ সকাল আটটা থেকে রাত একটা রাতে ফিরে এসে দেখে কনা ঘুমিয়ে আছে দেখা তাদের হতো সাবওয়ে স্টেশনে কনা ফিরতো কাজ থেকে , কৌশিক যেতো তার দ্বিতীয় কাজের দিকে মাঝপথে একই স্টেশনে মিলতো দুজন কিছু সময় কাটাতো একসাথে তারপর কনা চলে যেতো বাসার দিকে,কৌশিক যেতো তার দ্বিতীয় কাজে

         কোন অভিযোগ ছিলোনা কনার কোনদিন কৌশিক কনার মুখে হাসি ছাড়া কিছু দেখেনি মনে পড়ে কৌশিকের পাঁচডলার দিয়ে একটা কার্ট কিনে দিয়ে ছিলো বাজারসওদা আনার জন্য কি যে খুশি হয়েছিলো কনা সেদিন অল্পতেই খুশি ছিলো সে

       অবশেষে লাইসেন্স পরীক্ষা পাশ করে রেজিস্টাডর্ ফামার্সিস্ট হলো কৌশিক তারপর আর পিছনে ফিরে চাইনি

পাচঁ বছর পর কৌশিক আর কনার কোল জুড়ে এলো এক ফুটফুটে ছেলে সুসান্ত মাঝ রাতে দুধ গরম করে কৌশিক খাওয়তো সুসান্তকে কাঁদলে বুকে করে নিয়ে ঘুরতো কনা ঘুমাত, ওর মুখের দিকে তাকালে মনে হতো কি

শান্তিতে ঘুমাচ্ছে সারা দিনের ক্লান্তির পর অনেক আদরে ওকে তিলেতিলে বড় করেছে কনা শহরের হট্টগোল থেকে বেড়িয়ে কিছু দুরে বাসা নিলো কৌশিক ছেলেকে ভালো স্কুলে পড়াবে কনার কষ্ট বৃথা যাইনি সুসান্ত মস্তবড় ইউনিভার্সিটি থেকে বিজনেসে বেচেলার ডিগ্রি নিয়ে বেড়িয়ে ছিল একদিনের ঘটনা মনে পরে কৌশিকের

কৌশিক আর কনা গেছে সুসান্তর আবাসিক হলে অনেকক্ষন কাটিয়ে ওরা বেড়িয়ে এলো এসে দাড়ালো এক বড় রাস্তার কোনায়, রাস্তা পাড় হতে হবে সুসান্ত তার মার হাত চেপে ধরে আস্তে আস্তে পাড় হচ্ছে বলল, ভয় পেয়োনা আম্মু আমিতো আছি ছেলে তার মাকে পাড় করে নিয়ে গেলো কৌশিক চেয়ে চেয়ে দেখলো চোখে তার জল আজ সে নিশ্চিন্ত তার অবর্তমানে তার কনা হারিয়ে যাবেনা, তার কষ্টে মানুষ করা ছেলে তাকে আকড়িয়ে থাকবে

           কনা একদিন কৌশিকের কানে কানে বলে ছিলো চাদের এক পিঠ তো দেখলাম আমার অন্য পিঠ দেখতে ইচ্ছা করে বিধাতা তার আশা পুরন করেছিলো কোল জুড়ে এলো এক সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে সুস্মিতা সুস্মিতার সাথে আট বছরের ব্যবধান সুসান্তর সুসান্তর আনন্দ ধরেনা সব সময় সুস্মিতাকে নিয়ে সে খেলছে কখোনো আস্টে পিস্টে জড়িয়ে ধরছে কখনো কুস্তির লড়াই আর সুস্মিতা ভাই এর দুষ্টমিতে খিলখিল করে হাসতো আস্তে আস্তে হামা গুরি থেকে দাড়াতে শিখলো সুস্মিতা কৌশিক কাজ থেকে ফিরে জোড়ে ডাক দিতো, সুসু মেয়েটা দৌরিয়ে এসে বাবার কোলে ঝাপিয়ে পড়তো সারাদিনের কাজের ক্লান্ততা হারিয়ে যেতো এই ছোট্টো মেয়ে টার মাঝে চুমাতে চুমাতে ভরিয়ে দিতো ওর মুখ টা সেও আদর নিতো, আরো জোড়ে চেপে ধরতো বাবা কে

কনা বলতো,” মেয়ে টা আমার বুদ্ধির টোপলা ওকে মানুষ করতে আমার একটুও কষ্ট হয়নিবাবার পদাংক অনুসরন করে ভর্তি হয়েছিলো ফার্রমেসিতে ফিলাডিলফিয়া কলেজ অফ ফার্মেসিতে তিন বন্ধু মিলে নিয়ে ছিলো একটি বাসা বছর তার ছিলো এক সাথে ফার্ম ডী হয়ে বেরিয়ে এসেছিলো আজ বিরাট এক ফার্মে সে কাজ করে নিজের পায়ে দাড়িয়েছে অনেক পরিশ্র্ম করে ছেলে মেয়েকে মানুষ করে ছিলো কনা তাদের আজকের সফল প্র্তিষ্ঠার সব কৃতিত্ব তাদের মায়ের

           কৌশিকের মধ্যে ছিলো অর্গানাইজীং ক্যাপাসিটি বন্ধুদের নিয়ে বেড়িয়ে পড়তো দুর পাল্লায় সব ব্যবস্থা করতো সে আনন্দ তার নিজের আনন্দ বাচ্চাদের আনন্দ সবার একটার পর একটা দেশ দেখেছে, দেখেছে সবাই মিলে, দেখেছে শুধু ওরা চার জন

       মনে পরে কৌশিকের, সুসান্ত সুস্মিতা তখন ছোট ওরা বেড়াতে গেছে দেশে দাদি ফুফুর কাছে রেখে দুজনে গেলো, কলকাতা, দিল্লি, আগ্র্রা , জয়পুর কলকাতার ভিক্টরিয়া মেমোরিয়ালের মাঠে হাটতে হাটতে সন্ধা হয়ে এলোকৌশিক বলল,” চলো গাছের নিচে বসি অনেক তো হাটলাম “   “ চলো তোমার কোলে মাথা রেখে আমিও একটু জিরিয়ে নেবোসেই চলার পথ তাদের শেষ হয়নি

দিল্লির লালকেল্লা, কুতুব মিনার, শেষ করে এসে দাড়িয়ে ছিল তাজমহলের সামনে ইতিহাস ঘেটে লাভ নেই, সবারই জানা তবু কৌশিক কনা কে বলল, “ এই তাজমহলের ইতিহাস তো তোমার জানা, তাই না? যদি উল্টোটা হতো তাহলে তুমি কি করতে কনা কৌশিকের ঠোট টা চেপে ধরে বলেছিলো,” বালই সাঠ, ওকথা বলতে নেই, আমার অমংগোল হবেদিল্লি শেষে এসে পৌছালো জয়পৃর পিংক শহর ।। প্লেন থেকে নেমে চারিদিকে তাকাতেই এক জন এসে বলল, “মাইক্র্বাস লাগবে সাবলাগবেকোথায় যাবেন জানি না, তবে একটা ভালো হোটেলে চলেন, আমার জানা ভালো জায়গা আছে কোনো অসুবিধা হবেনা কতদিন থাকবেন?

তিন দিন একটু দ্বিধা লাগছে কনা বলল, দেখেতো টেক্সি ড্রাইভার বলে মনে হচ্ছে না লেখাপড়া জানা মনে হচ্ছে দামদর ঠিক হলো উঠে পড়লো কৌশিক আর কনাকৌশিক জিজ্ঞাসা করল ওর নাম বলল মহেন্দ্র্ চলতে চলতে কথা হলো, “ কতদিন ধরে এই ব্যবসায়ে,” এটা আমার ব্যবসা নয় স্যার কমার্সের শেষ বছরের ছাত্র্ আমি বাসায় বাবা মা আর ছোট একটা বোন

বাবা চাকরি করে, কলেজ এখন বন্ধ মাইক্র্বাসটা ভাড়া নিয়েছি,বন্ধের মধ্যে যা পাবো তা দিয়ে আমার আর বাবা কেও কিছু সাহায্য করতে পাড়বো কনা ঠিকি বলে ছিলো, সে তাকালো কনার দিকে, দেখলো ওর চোখটা ছলছল করছে এসে গেছি ছোট্টও একটা বাসা ছিমছাম একটা লোক দাড়িয়ে হিন্দিতে কি জেনো বললো ওকে

ওকে যাওয়ার দিন এতো টাকা দিয়েন, স্যার,” স্যার স্যার করোনা, আমার নাম কৌশিক, কনা তাহলে আপনি কৌশিক দা উনি কনাদি এই তিন দিন কি ভাবে চলাফেরা করবেন? আমি বলি কি এই কদিন আমিই আপনাদের কে নিয়ে সমস্ত জাগা দেখিয়ে নিয়ে বেড়াবো, এমনকি আজমির শরিফ নিয়ে যাবোএযেনো শাপে বড়তোমার পোষাবে তো? আজকের ভাড়া টা দিয়ে দেই,” নিলোনা সে বলল, এক সাথে যাওয়ার দিন দিয়েন প্র্তিদিন

ঘুম থেকে উঠে দেখতাম বসে আছে সে বাহিরে সব কিছ সে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে ছিলো যাওয়ার দিন বলল,” কৌশিক দা যাবেন আমদের বাসায়, মা আপনাদের কে দেখতে চেয়েছে গিয়ে ছিলো ওরা অভর্থনার কোনো ত্র্টি ছিলোনা বিদায় বেলায় কনা তার ওড়নার আচল দিয়ে চোখ টা মুছে নিয়ে ছিলো

           চার জন মিলে ঘুরেছে অনেক দেশ টেমস নদীর পাশে বসে দেখেছে বিগবেন পড়ন্ত বেলা হাওয়াতে উড়ছিলো কনার সদ্য কার্ল করা চুল, কৌশিকের কাছে অপুর্ব লাগছিলো ওর ঘামে ভিজা মুখটা

   সেইন নদিতে বোটে চড়ে দেখেছিলো আলোয় আলোকিত প্যারিস ঝলমল করছে আইফেল টাওয়ার

আরক দে ট্রায়াম্ফের কাছে কৌশিকের কাধে মাথা রেখে বলেছিল,” এত সুখ আমার সইবেতো”,

লূভের মোনালিসার ছবির সামনে কতক্ষণ ওরা দাড়িয়ে ছিলো আজ কৌশিকের তা মনে নেই

    

ধুসর মরুভুমির মাঝে দাড়িয়ে পিরামিড দেখতে দেখতে কনা বলেছিল, “ সপ্তম আশচারযর এক আসচারয দেখতে পাবো ভাবিনি আগে প্র্চন্ড গরমে ওর মুখটা লালচে হয়ে এসেছিলো বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখা কপালে কৌশিক মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিলো কনা হাত দিয়ে ঘাম টা মুছে বলল, “ চলো স্পিক্নসা দেখে আসি

       হেটে ছিলো চারজনে বারসিলোনার রাম্বলাস এর পথে জমজমাট রাস্তা, নিউ ইয়র্কের মত সিটি ঘুমাতে জানেনা  

       প্রাগ এর চার্লস ব্রীজ এর উপর দিয়ে হাটতে হাটতে কৌশিক কনাকে বলে ছিল,” দাড়াও আর্টিস্টা কে বলি তোমার একটা ছবি একে দিতেকনা রাজি হয়নি জানে এক মাত্র্ কৌশিকের চোখে সে তুলোনা হিন

সেবার ওরা তিন জন এসেছিলো সুসান্ত আসতে পারেনি সুস্মিতা বলতো, “ আব্বু আমি সানত কে মিস করছি,’

ওরা জানে ভাই বোন একে অন্যের ছাড়া চলেনা সেখান থেকে ভিয়েনা, মোজার্টের ঘর কতকিছু দেখে ছিল

     রোমের পথে ঘুরে ছিলো, দেখে ছিলো মাইকেল এন্জেলোর আকা সিসটিন চেপেল কলেসিয়াম, যেখানে এক সময় হতো গ্লাডিয়েটর দের লড়াই হেটে ছিলো ফ্লোরেন্সের পথে, দেখে ছিলো ডেভিডের মুর্তি গনডুলায় চরে দেখেছিলো ভেনিসের সন্দর্যো

     নামাজপড়ে ছিলো ইস্তানবুলের বুলু মসজিদে এথেনসের পারথিওনের সামনে কত ছবিই না উঠিয়েছে ওরা চারজন সান্তরিনির সূর্য অস্ত দেখে মুগ্ধ হয়েছিলো শেষ তারা গিয়েছিলো কোস্টারিকা এতো স্রীতী এতো আনন্দ কৌশিকের চোখে জল আনে কোথায় গেলো সেইদিন গুলো একদিন কনা কৌশিকে ডেকে বলল, “ সোনা একটা কথা বলব?” “বলো” “ পারবে আমাকে হজে নিয়ে যেতে, আমার অনেক দিনের ইচ্ছা কৌশিক কথা রেখেছিলো দুজনে মিলে হজ সম্পন্য করে এসেছিলো

         সময় পেড়িয়ে গেছে দিন ঘুরে মাস, মাস ঘুরে বছর পেরল ছেলে বড় হয়েছে কনা সুসান্ত কে জিজ্ঞাসা করে,” এবার তো সময় হলো আব্বু, নিজের পায়ে দাড়িয়েছ, সঙ্গী একজনকে তো খুজে নিতে হবে আছে কেউ?”

না নেই, তবে ভাবছি অন্য গোষ্ঠির কোনো মেয়েকে নিয়ে এলে কেমন হয়?” সুসান্ত জানে মা এই উত্তরে রাগ হবে, মাকে রাগানোই তার উদ্দেশ্য কনা চায় নিজ ধমর্ের মেয়ে আনতে, প্র্শ্ন করে কৌশিককে, তোমার কি মত?

কৌশিক বলে,” আমার কোন কিছুতে আপত্তি নেই তা সে কালা ধলা মোটা কানা যা হোক, সংসার করবে সে, সুখ তার, সে যদি কালা ধলাতে সুখ গায় তাতে তোমার আপত্তি কি?” কনা রেগে বলে,” তুমিতো ফেরেশতা, কথা বলবে নাতো? আমি চাই আমাদের গোত্র্তোমার ছেলের বন্ধু বান্ধবি কোনো টাই গোত্র্ নয়, যদি ওখানকার কাউকে নিয়ে আসে তবে মেনে নিয়ে নয়, না হলে তুমিই কষ্ট পাবে

         রাত ৯টা ৩০ মিনিট ফোনটা বেজে উঠলো, সানার কলকাল শনিবার কোনো প্রোগ্রাম আছে?” মনে হয়না, কেনো? প্র্শ্ন কৌশিকেরতাহলে কয়েক জন কে বলবো, আড্ডা মারা যাবে,” মন্দ নয়, উই উইল বি দেয়ার

যথা রিতি কনা কৌশিক হাজির অনেক বন্ধুর অগোমন ভাবি এপিটাইযার নিয়ে এলো, সাথে চা কফি, যে যেমন চায় আড্ডা ভালই জমে উঠেছে দেশের রাজনিতি, আমেরিকার রাজনিতি ফারুখ এক সময় সাদা চাদর গায়ে ঝুলিয়ে মার্কশ পন্থী রাজনিতি করতো, আজ সে বুর্জোয়া প্র্থায় বিশ্বাসী বিশ্বাস তার পাল্টিয়ে গেছে বললো, “টাকা যেখানে আমি সেখানে

       হঠা করেই সুসান্তুর আবির্ভাব কনা দেখে বললো,” তুমি এখানে?” হা এলাম, জোয়েল বললো আসতে জোয়েল সানার ছেলে, এক সাথে ওরা বড় হয়েছে

কতক্ষন এসেছ?” সুসান্তর জিগ্গাসা ওর বাবা কে

এইতো এলাম কৌশিক লক্ষ করলো ছেলে তার দিকে চেয়ে কথা বলছে না তার চোখ কাকে জেনো খুজছে কৌশিক কথার ছলে একবার পিছনে তাকালো শ্যমলা ছিপছিপে একটা মেয়ে বসা আগে কখনো দেখিনি তাকে কৌশক নিজে পথ দিয়ে চলেছে, সে চোখের ভাষা বোঝে ছেলের চোখের চাউনি দেখে সে বুঝেছে কাকে সে খুজছে

মেয়েটা একবার তাকালো কৌশিকের দিকে তারপর মাথা নিচু করে রইলো রাত হয়ে এলো এক সময় কৌশিক কনা কে একপাশে ডেকে বললো, “ যে মেয়ে টা কে দেখছদেখে রাখো, পরে বলবোবন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে এলো সুসান্ত বাই বলে চলে গেলো ওর বাসায় গাড়ীতে এসে কৌশিক বললো,” তোমার ছেলের চাউনি দেখে মনে হলো এই সেই মেয়ে যাকে সে খুজছেকৌশিকের ধারনা ভুল হয়নি কনা সুসান্ত কে জিজ্ঞাসা করেছিল, সে না করেনিতোমার পছন্দ হয়মার পছন্দ তার কাছে বিরাট কিছু সে জানে বাবা মেনে নেবে তা সে যেই গোত্র্ মেয়ে নিয়ে আসুক মার পছন্দ টাই বড়

হা আব্বু পছন্দ হয়েছে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো সুসান্তর নাম তন্নি, দেখা ওদের হয়েছিলো এক বিয়ে বাড়ীতে, ওর বাবা ফার্মাসিস্ট কৌশিকের দুবছরের ছোটো, এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে বছর তিনেক হলো ওরা সবাই কৌশিককে চেনে ভালই হলো, নিজেদের জানা শোনার মধ্যে তন্নি সুস্মিতার বন্ধু সুস্মিতা খবরটা পেয়ে একটু রাগান্নিতো হয়েছিলো প্র্থমে বললো,” আমি পাঁচ মিনিটের জন্য রেস্টরুমে গেলাম আর এর মধে্য চোখে চাওয়া চায়ি হয়ে গেলো?”

           দিনক্ষন ধার্যও করে কৌশিক কনা আর সুস্মিতা গিয়েছিলো তন্নির খালার বাড়ী কনা তার হাতের দুটো বালা দিয়ে তন্নিকে বরন করেছিলো যাকে বলে পানচিনি তন্নির মা জিবুর চোখে জল বললো,” এখন থেকে আপনি হলেন ওর বাবা, আপনি ওকে দেখে রেখেন

       এনগেজমেন্টের দিন ধার্য হলো এক মাস পর কনা তার পচিশ বছর বিবাহ বার্ষিকতে কৌশিকের দেওয়া গলার হার টা দিয়ে বরন করলো তন্নিকে, বললো,” এটা বংশ পরম্পরায় হাত বদল হবে আমার তাই ইচছা

কৌশিক তার ভাষণ অনেক কিছু বলার পরে একটা প্র্শ্ন রেখেছিলো সবার কাছে, “ বলোতো আজকে কে জিতেছে?” অনেকে অনেক কিছু বললো কৌশিক বললো না সব ভুল আজ জিতেছে তন্নি, সে তার বাবা কে আবার ফিরে পেয়েছে তন্নির চোখে জল

         ছয় মাস পর বিয়ে জিবু বিয়াইন দের আত্মীয় স্বজন সব এখানে বিয়ের গেস্ট লিষ্টে সংখা যেয়ে দাড়ালো সাতশর উপরে দেশ থেকে কৌশিকের বোন বোনের জামাই ভাগনে অপু এসে ছিলো এসে ছিলো আর এক বোন অহাইও থেকে কনার বোন এসে যোগ দিলো ফ্লোরিডা থেকে কনা আনন্দে আত্মহারা তন্নি মঝে মধ্যে ছুটির দিনে সকালে নাস্তা বানায় সবার জন্য বিয়ে বাড়ি বিয়ে বাড়ি ভাব ভাড়া নেওয়া হোলো বিরাট কান্ট্রি ক্লাব যথারিতি ধুমধামের সাথে সম্পন্য হলো বিবাহের অনুষ্ঠান ওরা চলে গেলো হানিমুনে কৌশিক কনার সংসারে এলো আরেক কন্ন্যা কৌশিক কনাকে বললো,” এবার তোমার বিশ্রামের পালাকে জানতো তার শরীরে বাসা বাধে আছে এক মর্মান্তিক রোগ

       কনা ছিলো সংসারের মধ্যমনি সত্য কথা বলতে কোনদিন পিছপা হয়নি মনে যা আসতো তাই বলে দিতো

রান্নায় কনার পারদশির্তা ছিল সর্ব মহলে ওর হাতের রান্নার তুলনা ছিলনা কাচা বাজার করা ছিল তার নেশা কাজের পর প্রায় প্র্তিদিন ছুটত বাজারে দুস্টুমি করে কৌশিক বলত, “ আচ্ছা তুমি প্র্তিদিন বাজারে যাও কেন? একদিন দেখতে যাবো তুমি কার সাথে দেখা করতে যাও জীবনের প্র্তিটি মুহুর্ত উপভোগ করেছে দুজনে

অনেক বছর কেটে গেছে জীবনের, অনেক পথ এগিয়ে গেছে তবু মনে হতো এইতো সব সেদিনের কথা এইতো মাত্র্ সেদিন কনাকে নিয়ে এলো সে ঘরে বলতো, আচ্ছা সোনা , এখনোতো আমার সাধ মিটলো না তোমাকে নিয়ে

কনা বলতো, তোমাকে পেয়ে জীবনের সব সাধ আমি মিটিয়েছি, তোমার মাঝে আমি কোন খুঁত পাইনি তুমি আমার ১০১ পারসেন্ট তুমি ওয়ান ইন মিলিয়ন

         এতো সুখ এতো আনন্দ ওদের ভাগে্য সইলো না কনা একদিন বলল, আমার মাজায় ভীষন ব্যথা আমি আর পারছি নাকৌশিক দেরী করেনি, তাড়াতাড়ী কনাকে ভর্তি করা হলো হাসপাতালে বিভিন্ন টেস্ট, সিটী স্ক্যান। এমআরআই করা হলো তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে কৌশিক হল ঘরে দাড়িয়ে, মনের অস্থিরতা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে সুসান্ত, সস্মিতা মার কাছে কাধে হাতের স্পরশে কৌশিক ফিরে তাকালো পালমোনোলোজিস্ট। ফিরে তাকাতেই পালমোনোলোজিস্ট বলল, “একটা কথা বলব,” বলেনআপনার স্ত্রীর লাঙ্গে একটা ম্যাস দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে ক্যানসারাস। বায়োপসির পরে বুঝা যাবে তবে লক্ষণ ভালো নয়, আরও অনেক জাগায় ছরিয়েছে, একে বলা হয় ফিফত স্টেজে। বাম পাশের লাঙ্গে জল ভর্তিএতগুলি কথা এক সাথে বলে পালমোনোলোজিস্ট একটু থামলো কৌশিকের মনে হলো তার চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করল, না, হতে পারে না সত্যি নয়, সত্যি নয়

           ডাক্তার এসে দাড়ালো কনার পাশে বলল সব কথা কনার মুখে কোন ভাবান্তর এলো না মনে হলো সে কিছু বুঝতে পারছে না, বুঝতে পারছে না এর ভয়াবহতা সুসান্ত চোখের জল মুছতে বেড়িয়ে গেলো কনাকে ভর্তি করা হলো মন্টি পেভিলোনের তালা তে সার্জেন এলো পরদিন সকালে লাঙ্গের জল বের করবে ইনশিশন করে বসিয়ে দিলো টিউব, লালচে রংএর জল বেড়িয়ে এলো

           আজ ২৬ শে অক্টোবর, কনা কৌশিকের বিবাহ বার্ষিকি কৌশিক নিয়ে এলো লাল গোলাপের গুচ্ছো

কনার চোখে জল, কৌশিকের মনে হলো অনেক শুকিয়ে গেছে, চোখের কোনে কালি চুমো দিয়ে বলল,” ভয় করো না সোনা, এখন অনেক নতুন নতুন ঔষধ বেড়িয়েছে, তুমি ভালো হয়ে যাবেকনা কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলোতারপর বলল, “ তোমাকে নিয়ে বেহশত আমি এখানেই বানিয়ে ছিলাম, আমার কোন আফসোস নেইসে আরও বলল, “ যখন খোদা আমাকে সুখ আর বেহশত দিয়েছিলো তখন তো আমি বলিনি কেন দিলে? আজ যখন সে আমাকে নিতে চলেছে তখন কেন আমি বলব,”হোয়াই মি?” কৌশিকের চোখের জলের ফোটা পড়লো কনার কপালে ,কনার চোখ বুজে এলো

       চারিদিকে ছরিয়ে পড়েছে কনার অসুস্তার কথা দলে দলে বন্ধু বান্ধব শুভআকাংকিরা আসছে ওকে দেখতে জানতো না সবাই ওকে কত ভালোবাসে ভালবাসতো ওর উদার মনের জন্য, ভালবাসতো ওর সততার জন্য

     শুরু হলো কিমোথেরাপি দেওয়া ডক্টর রেফ এর ত্তাবধানে বায়োপসির রেজাল্ট এসেছে ভালো নয় দুটো মিউটেশন এক্সন ২০  এক্সন ২১ । এক্সন ২০ চিকিৎসা আছে এক্সন ২১ এর চিকিৎসা নেই ডক্টর রেফ আশাবাদী বললআমরা দুটো ঔষধ এক সাথে দেবো, প্র্তি তিন সপ্তাহ পর পর   তাতে আশা করছি টিউমার টা ছোটো হয়ে যাবে”। এসে ছিলো কৌশিকের বোন Ohio থেকে। সেবা করে ছিলো আড়াই মাস। দাড় করিয়ে ছিলো কনাকে চলার মত করে। এসে ছিলো দেশ থেকে কনার ভাবী, এসে ছিল বোন। তাদের সেবা কৌশিক দেখেছে, দেখছে তাদের অকেলানত পরিসরম। কৌশিক নিভর্তে চোখের জল ফেলেছে। বিধাতার কাছে প্র্াথর্না করেছে তার জীবনের পরিবর্তে কনার জীবন ফিরিয়ে দিতে।এই অসহায় মুহুর্তে কৌশিক ,কনার পাশে এসে দারিয়ে ছিল বিয়াইন (সুসানতুর শাশুড়ি), দাড়িয়ে ছিল জলি ভাবি, চমন ভাবী, রিতা ভাবী। কৌশিক জানে তাদের সেবার ৠন কোন দিন শোধ দেবার নয়। নিঃস্বার্থ ভাবে তারা করে গেছে।

       কনা ভালোর পথে। তবুও এ রোগের কোন বিশ্বাস নেই। বিশ্বাস নেই বলেই সুসানত খোজ নিয়েছে Yale University তে। ওরা বলেছে, সব দরজা যখন বন্ধ হয়ে যাবে তখন এক মাত্র্ উপায় Clinical Trial Medicine.যদি কাজ হয়। কৌশিক মনের জোড় ফিরে পায় কনার শারিরিক সুস্থতা দেখে। বলে, চলো দেশ থেকে ঘুরে আসি। গিয়ে ছিলো। কৌশিক দেখে ছিলো কনার উচছলতা দেশের মাটিতে। যত টুকু আনন্দ করার তা সে করে ছিলো। হয়ত তার অদ্রিশট বুঝতে পেরেছিলো এই তার শেষ আনন্দ।

     দেশ থেকে ফিরে এলো। ঔষুধের কর্মোক্ষমতা একটা একটা করে কমতে থাকলো। কনা বুঝতে পারলো তার সময় বেশি নেই। বলল, “সুসমিতা কে ডাকো।” সুসমিতা কে বলল, মা তুমি রেজ কে বলো ওর বাবা মা কে বলতে, আমি থাকতে থাকতে সবকিছু করে দিয়ে যেতে চাই” রেজ সুসমিতার সমপরকো কৌশিক কনা জানে। রেজের বাবা মাকেও ওরা চেনে। অনেক আগের পরিচয়। রেজের বাবাও ফারমাসিসট। কৌশিকের তিন বছরের সিনিয়র। বিধাতার আশীর্বাদে সূশটো ভাবে সম্পন্ন হলো ওদের বিবাহ। রেজকে কনার খুব পছন্দ। কৌশিকের ও।

     কনার শাস কোষ্ঠও ক্রমেই বাড়তে থাকলো। কৌশিক কে ডেকে বলল,”আমার সময় এসে গেছে সোনা”। কৌশিক পাগলের মত ছুটে গেলো Yale University Smilow Cancer center এ, বলল,” ওকে Clinical Trial Medicine দাও,”

       দেওয়া হলো। কাজ হলো না। সে তখন কষ্টের শেষ সীমায় পৌছে গেছে। কৌশিক কে কাছে ডেকে বল, বাই। কেনো এমন বলছো। ধীরে ধীরে বলল, আমাকে যেতে দাও। কনা চলে গেলো।

       কান্নার রোল উঠল Smilow Cancer Center এর ২২২ কক্ষে। কাদঁছে ছেলে সুশান্ত, কাদছে মেয়ে সুস্মিতা। কৌশিক চোখের পানির অঝোর ধারাকে ধরে রাখতে পারেনি। চোখের পনিতে ঝাপসা হয়ে আসা দৃশটি ফেরাতে পারছিল না কনার দিক থেকে। সাদা কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে ওকে। মুহুর্ত কয়েক আগেও যে ছিল জীবন্ত , এখন সে লাশ। কেনসারের সাথে কনার আড়াই বছরের লড়াই শেষ হয়ে গেল। জীবনের সব আড়ম্বর হারিয়ে সে আজ রিক্ত হাতে বিদায় নিল। নিঃশেষ হয়ে গেল কৌশিক। দীর্ঘ প্রায় চল্লীশটি বছর পায়ে পা মিলিয়ে পথ চলেছে যার সাথে, হাতে হাত ধরে জীবন সংগ্রামে এগিয়ে গেছে যার সাথে, সে আজ তাকে অসহায় ফেলে রেখে চলে গেল। চলে গেল সেই রহসময় অজানা জগতে, যেখান থেকে কেউ আর কোনোদিন ফেরে না।

       কৌশিক আজ একলা বসে সৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে দেখে চল্লিশটি বছরের বিবাহিত জীবনে একটা দিনও খুজেঁ পেলোনা যেখানে হাসি আর ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু ছিল। বাড়ীটার আনচে কানাচে তার স্রীতী এখনও উজ্জ্বল। যেদিকে তাকায় ওর অস্তিত্ব অনুভব করে। কোথাও শান্তি পায়না। শান্তি পায় যখন তার কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকে। চারিদিক নিস্তব্ধ। কোন হট্টগোল নেই। শান্ত পরিবেশ। মাঝে মাঝে গাংচিল উড়ে যাচছে। হাত টা এগিয়ে দিয়ে বলে,” সোনা আমি তোমার কাছে আছি, তোমার পাশে।মনে হয় সে হাত টা বাড়িয়ে দিয়ে বলবে , সোনা অনেক দিন তুমি আমার হাত ধরোনা , এবার ধরো।

   চল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবন ,তার আগে তিন বছরের জানা শোনা। এই ৪৩টা বছর কোথা দিয়ে চলে গেল বুঝতে পারলো না। কৌশিকের মনে হয় এইতো সেদিন। মনে হচ্ছে শুরু তেই সব শেষ হয়ে গেল। কৌশিকের চিৎকার করে বলতে ইচছা করে , দিস ইজ নট ফেয়ার, লাইফ ইজ নট ফেয়ার।

     বিশাল বাড়ীটা আজ শূন্যতায় গ্রাস করছে। ছেলে মেয়েরা যার যার বাসায় চলে গেছে। ওদের নতুন দুটো পাতানো সংসার কনা দেখে গিয়েছিলো। ছেলে মেয়ে ছিল তার চোখের মনি। যখন জীবনটা পরিপুরনতায় বিকশিত হলো, কৌশিক তাকিয়ে দেখে তার চারপাশে সব রইল শুধু রইল না সে।

     শূন্য বাড়ীতে আজ সে একা। স্রীতীর ভারে আজ সে ক্লান্ত। জানেনা এর শেষ কোথায়।

দুমাস পেড়িয়ে গেছে। মনের ভীতরের ক্রন্দন থামে না। আজ এই অসহায় একাকিততে তার সৃতির পাতাগুলি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এ যেন এক সেলুলয়েডের ফিতা, একটার পর একটা ঘটনা চোখের সামনে ভেসে আসছে। এ সূতি যে এত হৃদয় বিদারক তা সে আগে বোঝেনি। এ যনত্র্না তো দারিদরের যনত্র্না নয়, এতো পায়ে কাটা ফুটার যনত্র্না নয়, এ হৃদয় নিংড়ে নেওয়া যনত্র্না। এ যনত্র্না শুধু সেই উপলবধি করতে পারবে যে এই পথ দিয়ে পায়ে পায়ে চলেছে। ঝাপসা চোখে দুরে তাকিয়ে থাকে মনে হয় সিড়ি দিয়ে সে নেমে আসছে ওপর থেকে। এখনি শুনবে তার কণ্ঠস্বর, ওটমিলটা বসিয়েছ? প্র্টিন একটু কম দিও। না সেই কণ্ঠ সে শোনে না। সে আসে না। সে নেই।

     অনেক দিন তো হয়ে গেলো, তবু কৌশিকের চোখে জল ভেসে আসে। ছেলে সুশান্ত, মেয়ে সুস্মিতা ,বৌমা, জামাই সবাই পালা করে রযেছে কৌশিকের সাথে। একলা থাকতে দিতে চায়না। পাছে কিছু হয়। ওরাও ওদের মা কে হারিয়েছে। ওদের মনের বেথা অপরিসীম। কনা যত দিন ছিলো ওরা প্র্তি বলদিন প্র্তি রাতে ফোন করতো। ফেস টাইমে দেখতো তাদের মা কেমন আছে। সুস্মিতা তার মাকে ডাকত গরজ বলে (মানে গরজিয়াস)।

     দিনের শেষে সন্ধ্যা নামে। কৌশিকের কাজ শেষ, বাড়ী ফেরার পালা। জানে কেউ অপেক্ষা করছে না তার জন্য। সারা দিনের ভালো মন্দ ঘটনা গুলো শোনানোর মানুষটা আজ তার হারিয়ে গেছে, চলে গেছে অজানা দেশে। চাবি দিয়ে দরজাটা যখন খোলে, নিস্তব্দতা তাকে গ্রাস করে। মনে হয় ভুতুরে বাড়ী। মেয়ে কোন এক সময় এসে সাজিয়ে রেখে গেছে ভাতের থালা। গরম করে খেয়ে নেবে। সেই পাচঁ পদের বাটিতে সাজিয়ে রাখা দিনগুলি আজ আর নেই। কৌশিক জানে একটু পরে ফোনটা বেজে উঠবে, ছোট বোন রিনা কল করবে। বলবে,”দাদা ভাত খেয়েছ? ওষুধটা খেতে ভুলোনা।” রাত বাড়লে ধীর পায়ে কৌশিক সিড়িঁ বেয়ে উপরে উঠে যায় ঘুমাতে। বিছানায় এখন দুটি বালিশ পাশাপাশি সাজানো আছে। কেন তা সে জানেনা। হয়ত তার অবচেতন মন এখনো ভাবে সে হয়ত আসবে। নীস্তব্দ ঘর। এপাশ ওপাশ করতে করতে রাতটা কেটে যায়।

   সাত সকালে সেই পরিচিত মধুর ডাকটা আর শোনেনা। যখন কাজে যাওয়ার জন্য তৈরি সে, কনা বলতো, সেল ফোনটা নিয়েছ? মানিবেগটা কোথায়, চাবি নিতে ভুলোনা। সে কণ্ঠ আর নেই। সে কণ্ঠ হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। আজ তার পরিবর্তে সকাল পৌনে সাতটায় রিনা ফোন করে বলে, সব কিছু নিয়ে বেড়িও ছোটদা, সাবধানে গাড়ী চালিও।

     কৌশিকের কাছে মনে হয় জীবন বেহালার তার ছিড়েঁ গেছে, সুরটা আর ঠিক মত বাজছে না। এ তার আর কখনই জোড়া দেবার নয়। এ আর ঠিক হবার নয়। তবুও নিজেকে একটু সান্ত্বনা দিতে প্র্তি সপ্তাহে কৌশিক গিয়ে বসে থাকে সেখানে, যেখানে কনা ঘুমিয়ে আছে। চড়া রোদ, যেখানে সে ঘুমিয়ে আছে, জায়গাটা রুক্ষ। আর সেখানে মাটি নয় বালি।পার্ক কর্মকর্তাদের কে কৌশিক বলল,” একটা ছোট মাপেল গাছ লাগাতে পারি ওর কবরের পাশে? একটু ছায়া হবে।” ওরা বললো,” না, তা হবেনা।” তা হলে? কৌশিকের মন ছটফট করতে লাগল। সারাক্ষনই মনে হতে লাগল, এই রুক্ষতা তো ওর সইবে না। নিয়ে এলো সে তিন বস্তা মাটি। ছড়িয়ে দিলো কনার কবরের উপর। সেই সাথে ঘাসের বিচি। ঘাস বড় হবে , রুক্ষতা চলে যাবে। কবরের ওপর ঘাসের একটা আবরন হবে। হয়ত কিছুটা শান্তির ছায়া নেমে আসবে তাতে।

         অনেকে বলেন সব কিছুর পিছনে একটা মানে আছে। ওর চলে যাওয়ার পিছনে কি মানে ছিল?

একথা কৌশিক কাকে জিগগাসা করবে? যাকে জিগগাসা করতে পারতো সে তো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তবু জানতে ইচছা করে এতো সুখ যদি সে দিয়েছিলো তবে এত তাড়াতাড়ি চলে গেল কেন? বড় সাঁধ ছিলো কনার নাতি পুতি দেখার। বলত, ওদেরকে আমি ইসপয়েল করে দেবো আদর দিয়ে দিয়ে। তা আর হলো না। গাড়ী চালাতে চালাতে একটা গান কৌশিকের মনের ভেতর গুমরে ফেরে,” আমার জীবনের এত হাসি এতো খুশি আজ কোথায় গেলো,”। এই পথ দিয়ে অননানন যারা গেছে তারাও কি কৌশিকের মত জীবনের সমাধান খুজতে চেয়েছিল? কৌশিক ভাবে, যে পথের শেষে আলোর নিশানা নেই সে পথে চলে লাভ কি? তবু চলতে হবে।

   চোখ ঝাপসা হয়ে আসে কৌশিকের। কিনতু তা হলে তো চলবে না, আজ তো তার গুছানোর পালা।

কনার ক্লোজেট টা খুলে দেখে এখনো সাজানো রয়েছে ওর চলে যাওয়ার আগে যে কাপড় গুলো সে নিয়ে এসে ছিলো ধোপার দোকান থেকে। থরে থরে সাজানো তার শাড়ীর বহর। সুসমিতা, বৌমা ভাগ করে নিয়ে যাবে সেগুলো।

     ছেলেমেয়েরা বলে, “ বাবা বাড়ীটা বিক্রি করে দাও। এতে তোমার অনেক স্রীতী জড়ানো,” সুসমিতা বলে,” তুমি আমার কাছে থাকবে। তোমার স্বাধীনতাতে কোন হস্তক্ষেপ হবেনা। তোমার ছোট একটা ঘর থাকবে তোমার নিজেস্ব।” তাই কি? ছোট একটা ঘরে গেলে কি কৌশিকের সৃতি কৌশিক কে কাতর করবে না। পেছনের সুখময় দিনগুলি কি তার চোখের সামনে ভেসে উঠবে না? এই স্রীতী তো তার মনের প্র্তিটি রন্দ্রে রন্দ্রে গাথাঁ হয়ে রয়েছে। সুসানত সুসমিতা বলে, তোমার নাতি পুতি হবে। ওদেরকে নিয়ে তোমার দিন কেটে যাবে আববু।

   হয়ত তাই। কৌশিক ভাবে নাতি-পুতি এলে ওদেরকে আকাশের চাদঁটা দেখিয়ে বলবে,” ঐ দেখ ওটা হচছে অজানা দেশ। ওই খানে তোদের নানি দাদি রয়েছে। ওখান থেকে সে তোদেরকে চুমো দিচছে।” যখন ওরা আসবে হয়ত শান্তি পাবে ওদের কে আকড়ে ধরে।

     প্রায় তিন মাস হয়ে গেলো কনা চলে গেছে, রেখে গেছে এক বিরাট শূন্যতা কৌশিকের জীবনে।

ঈদের দামাঢোল বাজছে, কৌশিকের ঘর অন্ধকার। জ্বলছে শুধু বসার ঘরের আলোটা। টুং করে সেল ফোনে শব্ধ হলো, মেসেজ এসেছে, কাল ঈদ। এমন তো ছিলোনা ঈদের আগের দিন। কনার হাড়ি পাতিলের শবদে মুখর হয়ে থাকতো বাসাটা। কৌশিক বলত,” কখন শেষ হবে তোমার এই টুংটাং।

কনা বলত, অনেক রাত হবে, তুমি ঘুমাতে যাও। কৌশিক বলত,” রসমালাইয়ের জন্য তোমার বানানো ছানাটা গোল করে দেবো? সে বলত, না, ও তুমি পারবে না। নাছোড়বানদা কৌশিক বলত, বাসন পাত্র্ গুলি ধুয়ে দেবো? তাই দেও। কৌশিক বলত,” এত কিছু বানাচছ, কজন লোক আসবে? সে তুমি বুঝবেনা এটাই আমার আনন্দ। কিনতু আমার মনে হচ্ছে তোমার কষ্ট হচ্ছে। কনা কথায় কান দিতো না বলত,” বক বক না করে ওপরে ঘুমাতে যাও”। আচছা যাচ্ছি। কৌশিক জানে ঘুম তার আসবে না যতক্ষন না সে আসবে। কনার আসতে আসতে রাত প্রায় দুটো হয়ে যাবে। সেই দিনগুলি আজ কোথায়। সেই দিনগুলি চিরতরে হারিয়ে গেছে ।

     কৌশিক তাকিয়ে আছে টিভি টার দিকে, ওটার পর্দা টা কালো, চলছে না। ইচছা করেই সে চালাই নি। ভালো লাগছে না। একটা অস্থিরতা তাকে তারিয়ে ফিরছে। মেয়ে সুসমিতা আর রেজ আসবে অনেক রাতে। ধীর পায়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসে কৌশিক। কনার ওয়ারডরোবটা খুলে ভাজে ভাজে রাখা শাড়ীগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলো। ভাবলো বেচে থাকলে কোনটা সে কালকে পরত। চোখ ভিজে আসাতে বনধো করে দিলো ওয়ারডরোবটা। আলোটা নিভিয়ে নিসংগ বিছানায় বালিশে মুখ গুজে শুয়ে পড়লো।

     আজ ঈদুল ফিতর। প্র্থম জামাত আটটায়। সুস্মিতা আর রেজ কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো কৌশিক।অনেক লোক এসেছে জামাতে। নামাজ শেষে কোলাকুলি। এটার আনন্দই আলাদা। মেয়ে বলে,” তুমিতো হাত মিলাতে পছন্দ করো আববু”। হা, করি। তবে ঈদের কোলাকুলি একটা ভিন্ন আনন্দ আছে।

   কিন্তু আজ আর সেই স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দটা কৌশিকের অনুভবে আসছে না। কিছুতে যেন আনন্দ পাচ্ছেনা সে। কেন তা সে জানেনা। বুকের ভেতর একটা বিরাট শূন্যতা। দুই একজন সহানুভুতি জানালো। দুই একজন উপদেশ দিলো, কি করা উচিত, কি করা উচিত না। কৌশিক শুধু শুনলো।

     আজ কৌশিককে যেতে হবে সেই জাগায় যেখানে কনা ঘুমিয়ে আছে। লাল গোলাপ কিনেছে সে। লাল গোলাপ ছিল কনার খুব পছন্দের।সুশান্তর শাশুড়ি জিবু বিয়াইন বললেন,” কৌশিক ভাই আপনি কবরস্থানে যাবার সময় আমাকেও নিয়ে যাবেন।” বিয়াইন তার স্বামী হারিয়েছেন পাচঁ বছর হয়ে গেল। তার মনটাও কৌশিকের মতো কেঁদে বেড়াচছে।। বেড়িয়ে পড়ল কৌশিক সবাইকে নিয়ে। কবরস্থান ঘণ্টা খানেকের পথ। গাড়ীতে অরুন বিয়াইন, জিবু বিয়াইন, বৌমা, বুসরা। বুসরা বৌমার খালাতো বোন। কথা বলতে বলতে কৌশিক জিবু বিয়াইনকে জিজ্ঞাসা করলো,” আপনি অনেক শক্ত মনের দিক থেকে,। কি ভাবে হলেন।” তিনি বললেন,” সব আল্লার ইচছা, বান্ধার কিছু করার নেই,” আপনি তো আল্লা আর বান্ধা নিয়ে বেশ আছেন, আমি পারছিনা কেনো” প্রশ্ন কৌশিকের।

   ওরা পৌছে গেলো কবরস্থানে। আকা বাকা পথ ধরে গাড়ি যাচছে সেখানে যেখানে চির নিদ্রায় শায়িত। অনেক লোকের সমাগম আজ। এসেছে প্রিয়জনের কবর যিয়ারত করতে। কেউ কাদঁছে, কেউ বসে কলমা পড়ছে। ঝিরঝির বাতাস বইছে।

   শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। গাড়িটা দাড়ালো। যেখানে দাড়ালো সেখান থেকে কিছু দুরেই কনার কবর। বৌমা রক্ত গোলাপ গুলো নিয়ে এলো। বুসরা পাশে, জিবু বিয়াইন আর অরুন বেয়ান দাড়িয়ে একটু দুরে। এই প্র্থম একটা ঈদ, যে ঈদে কনা কৌশিকের পাশে নেই। জিয়ারতের পর কৌশিক বলল,” আমিতো তোমার কাছে এসেছি, সোনা, আমার ঈদ তো আজ এখানে।”

   চোখে জলের বাধ মানছে না। কৌশিকের মনে হলো কনা বলছে, কেদোঁ না, আমি তো তোমার পাশেই আছি। তোমার মধ্যেই আছি, তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাইনি। বৌমা আর বুসরা কৌশিককে জড়িয়ে ধরে বলল,” কেদোঁ না বাবা কেদো না।” বৌমার বাবাও শুয়ে আছে এখান থেকে কিছু দুরে। ওর মনের কথা কৌশিক বুঝতে পারছে, ও প্র্কাশ করছেনা। বেয়াই এর কবর। জিবু বিয়াইন দুরে দাড়িয়ে। এটই হয়ত নিয়ম। কৌশিক জানেনা। তার চোখ কালো চশমার নিচে নিশ্চয় ছলছল করছে। দু ফোটা জল হয়ত গড়িয়েও পড়ছে। এটাই স্বাভাবিক। বৌমা কাদছে। কৌশিক যেদিকে তাকায় দেখে সবারই মুখ মলিন। কিছু দুরে একটা নতুন কবর খোঁড়া হয়েছে। কোন অভাগার বুকের ধন সবাইকে কাঁদিয়ে আজ এসেছে এখানে ঘুমাতে।

   সবাই বলল, চলো এবার সময় হয়েছে, ওদের কে বিদায় দাও।

কৌশিককে যেতে হবে সুস্মিতার শশুড় বাড়ী। সেখানে পৌছাতে পৌছাতে দুপুর হয়ে গেলো। কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লো কৌশিক। ভীষন ক্লান্ত সে। জিবু বিয়াইন কে নামাতে হবে। কেন জানি একটা অস্থিরতা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচছিলো। বাসায় চলে এলো। সুস্মিতা পড়ছে।  রেয এলে ওরা রেজের বাবার বাসায় যাবে।

      রেজ এলো, ওরা চলে যাচছে। সুস্মিতা বলল,” আব্বু তুমি একলা থাকতে পারবে তো।” হা, মা মনি, পারবো। গাড়ি থেকে হাত বাড়িয়ে বাই জানিয়ে মেয়ে টা চলে গেলো। ও দেখতে পেলোনা ওর বাবার চোখটা জলে ভর্তি। সেই ভালো। দেখতে পেলে সে কষ্ট পেতো।

    ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসে কৌশিকের শরীর। মন চাইছে না বাইরে যেতে। হয়ত যে উদ্দীপনা আগে ছিলো আজ তা ভাটার দিকে। যে নৌকায় সে ভাসতো দমকা হাওয়ায় তার পাল আজ ছিড়ে গেছে।ওটা আর ভাসবে না, ওটা ডুবন্ত। মন চাইছেনা তবু কৌশিক গেলো বিয়ইনের বাসায়। দেখা হলো অনেকের      সাথে। সব পরিচিত মুখ। কথা হলো। শেষে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো কৌশিক।

     বাহিরে এসে দাড়ালো। অন্ধকারে ছেয়ে আছে চারিদিক। নিস্তব্ধ রাস্তা। বুকের ভিতর হাহাকার। ও নেই, কেউ নেই। এই প্র্থম একটা ঈদ যে ঈদে কেউ তার পাশে নেই।

     একটা চাপা ব্যথা অনুভব করছে বুকে। হয়ত কিছু নয়। গাড়িটা একটু দুরে। পাশের দালানে হেলান দিয়ে একটু দাড়িয়ে নিলো কৌশিক। ব্যথা টা বাড়ছে। Stent লাগানো আর্টারি টা হয়ত বুজে এসেছে। গাড়ীর কাছে এসে পৌছালো কৌশিক। ER এ সে যেতে রাজি নয়। বীভীশিকা ময় ER সে দেখেছে। বাসায় পৌছালো। উপরে উঠে এলো। ব্যথাটা বাম হাতের থেকে উপরে উঠে আসছে। কৌশিক জানে এ কিসের ব্যথা। এর থেকে মুক্তি নেই। শুয়ে পড়লো সে। ভেসে উঠলো কনার মুখ। সে জেনো ডাকছে তাকে। নিজেকে বড় স্বার্থপর মনে হলো।সুশান্ত ,সুস্মিতার মুখটা ভেসে উঠলো, ওরা চিৎকার করে বলছে, যেওনা বাবা যেওনা” কৌশিক ফোন টা আকরিয়ে ধরলো। ডায়েল করতে চাইলো ৯১১। কিন্তু পারলো না। ৯-১—- শরীরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। হাত থেকে পড়ে গেলো ফোনটা। নিস্থব্ধ হয়ে গেল চারিদিক। সে চলে গেলো। চলে গেলো কার কাছে। যাকে সে দেখেছিলো, যাকে সে পেয়েছিলো, যাকে সে হারিয়েছিলো তার কাছ

You may also like

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *