এক অসমাপ্ত গল্প ৪

                                             ৪ পর্ব

  ভোরে ঘুম থেকে উঠা আনন্দের অভ্যাস। সেই কাঁক ডাকা ভোরে উঠে জিমে যাওয়া ছিল তার নিত্যনৈমিততিক ব্যাপার। এখন ও সে ভোরে উঠে। তবে জিমে আর যায়না। ছেলে মেয়েরা জিজ্ঞাসা করলে বলে,” ছয় প্যাক দেখানোর মানুষ টাই যখন নেই তখন ওটা বানিয়ে লাভ কি।”

   “ লাভ তোমার নিজের জন্য, বাঁচার জন্য, তোমার কিছু হলে তোমাকে সেবা শুশ্রষা করার কেউ নেই।” বলে সু।

     আনন্দ তা জানে। শুনেছিল এক বন্ধুর স্ত্রী কাছ থেকে। বলেছিল,” আনন্দ দা, নিজেকে সুস্থ রাখবেন। কিছু হলে আপনাকে কিন্তু    আমরা দেখতে আসতে পারব না ।”

চোখ বড় বড় করে আনন্দ জিজ্ঞাসা করেছিল,” কেন?”

“ কারণ, আপনি পরপুরুষ।”

       হায়রে, চল্লিশ বছর একসাথে উঠা চলাফেরা করেও আনন্দ পরপুরুষই রয়ে গেল।

     ইদানীং আনন্দের অনেক গানই শুনতে ভালো লাগেনা। শুধু দুটো গান সে গাড়ীতে রেখে দিয়েছে। সকালে কফির পেয়ালা নিয়ে গাড়ীতে উঠে চালিয়ে দেয় গান টা “ যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে—“ ফেরার পথে শুনতে থাকে “ আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি—“ আজও তার ব্যতিক্রম হলনা। গান শেষ হোল, আনন্দ এসে পৌছাল অফিসের পারকিং লট এ।

ফোন টা বেজে উঠল।

“ আনন্দ দা, কোথায় তুমি” বেলালের কণ্ঠস্বর। এক সাথে এই আর্কিটেক্ট ফার্ম এ কাজ করতো। চলে গেছে ডালাসে।

“ এতো ভোরে, কি মনে করে?”

“ আসতে পারবে এই উইক এন্ডে? আগে, পিছে ছুটি নিয়ে এসো। এলে পড়ে সব বলবো”

ডেভিড কে বলেছিল ছুটির কথা। সে বস। না করেনি। বস হলেও বন্ধুর মত। আনন্দের অসময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। বলেছিল,” মন শক্ত হলে কাজে এসো। আমি এদিক টা সামলাবো।”

ডালাসে আনন্দের এই প্রথম আসা। গ্রীষ্ম কাল। সূর্যের তাপ টা একটু বেশি। বেলাল এসে ছিল এয়ারপোর্টে। আনন্দের চেয়ে বয়সে সে অনেক ছোট। পঞ্চাশের কোঠায়। একটা মিষ্টতা আছে ওর মধ্যে। যা কিনা আকর্ষণ করে।

   “ তুমি কোনদিন একলা আসবে, ভাবি নি। সবই ভবিতব্য। যাক সে সব কথা, যার জন্য তোমাকে ডেকে আনলাম। আমার বিয়ে.”

     কথাটা বেলাল এতো দ্রুত, ভণিতা না করে বলে ফেলল যে আনন্দ প্রথমে বুজে উঠতে পারলো না সে কি বলছে।

   “ কি বললে?”

   “ বিয়ে, হ্যাঁ, বিয়ে করতে যাচ্ছি, তাই তোমার আশীর্বাদ চাই।”

   বেলাল গত পাঁচ বছর ধরে ডিভোর্স। প্রেম করেই বিয়ে করেছিল, কিন্তু সব প্রেমের ধারা বিয়ের পড়ে এক গতিতে চলেনা। ওরও চলেনি।

“তা ভাগ্যবতী টা কে?”

“ কল্যাণী! একই ফার্মে কাজ করি। ডিভোর্স। আমারই মত। বুঝতেই পারছো। প্লাসে প্লাসে, প্লাস। এবার নেগেটিভ হওয়ার কোন উপায় নেই। নাম কল্যাণী, কাজেই কল্যাণ কর কিছু একটা হবে মনে হচ্ছে।”

ওর এই উচ্ছ্বসিত ভাব, অতীতকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ, হাস্যজ্বল মুখ, এর জন্যই বেলাল কে তার ভালো লাগে।

   গাড়ী এসে থামল বিরাট এক অট্টালিকার সামনে।

   “ এই আমার এপার্টমেন্ট। এখানে থাকতে তোমার কোন অসুবিধা হবে নাতো আনন্দ দা?”

কি যে বলো? আমি কোন কাজে লাগতে পারি?

না, তুমি শুধু আমার পাশে থেকো।

   যথা রীতি খুব সুন্দর ভাবে সম্পন্ন হোল অনুষ্ঠান। অপূর্ব লাগছিল কল্যাণী কে। সিম্পল ভাবে সাজা। সব কিছুর মধ্যে মার্জিত ভাব। দুজন কে মানিয়েছে। আনন্দের কাছে এসে দাড়াতেই বললও,” আশীর্বাদ করি, ভালো থেকো।”

কল্যাণী বললও “ তোমার কথা অনেক শুনেছি আনন্দ দা, আজ দেখলাম। আশীর্বাদ করো যেন তোমার আর ভাবির মত মন নিয়ে চলতে পারি। তুমি তো ওর মেনটর।”

       ওরা চলে গেল। হোটেলের সুইট অপেক্ষা করছে ওদের জন্য। যাওয়ার আগে বেলাল আনন্দের কানে কানে বললও,”

কাল হবে বড় অনুষ্ঠান, সুট এনেছ তো?”

না আনি নি, তুমি তো বলনি।

নিজের কপালে ঠাস করে থাপ্পড় মেরে, ইস বলে, বললও “ আমি ফিরে আসি, একটা ব্যবস্থা হবে”।

আনন্দ ফিরে গেল বেলালের এপার্টমেন্টে। তখন রাত বারটা।

         অনেক লোকের আগমন। বিভিন্ন রংএর শাড়ী পরিহিতা মহিলারা বিভিন্ন ভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তড়িঘড়ি করে একটা সুট সে কিনে ছিল। ভালোই ফিট করেছে। বেলাল কে আনন্দ বলেছিল ,” আজ তোমার দিন, আমাকে নিয়ে ভেবোনা, আমি আমার মত আনন্দ করবো, তুমি করো তোমার মত।”

আনন্দ দাঁড়িয়ে ছিল দরজার পাশে, হাতে সফট ড্রিঙ্কস।

“ আপনি বুঝি একলা? আগে দেখেছি বলে মনে পরছেনা।” কথা শুনে তাকাল আনন্দ। লম্বা ছিপছিপে গড়ন। সাজটা একটু উগ্র মনে হল।

“আমার নাম প্রতিমা।”

ছোট বেলায় আনন্দ ওর হিন্দু বন্ধুদের সাথে প্রতিমা দেখতে যেতো। নিখুঁত টানা চোখ, দুধে আলতা মেশানো গায়ের রং। আনন্দের কাছে এ প্রতিমা সে প্রতিমা মনে হলনা।

তবুও বলতে হোল,” আমি একলা এসেছি, বেলালের বন্ধু, থাকি নিউ ইয়র্কে।” একসাথে সব তথ্য বলে গেল আনন্দ যাতে দ্বিতীয় বার প্রশ্ন না আসে।

“ চলুন না ঐ টেবিল টা বসে গল্প করা যাবে।”

আনন্দ একটু হোঁচট খেলো, জিজ্ঞাসা করলো,” আপনিও একলা বুঝি?”

“ হাঁ, কর্তা আসতে পারলো না, মাজায় ব্যথা।” বলে মিটমিট করে হাসল।

আনন্দ আমতা আমতা করতেই কোথা থেকে এসে হাজির হোল বেলাল।

“ কেমন আছো প্রতিমা দি?”

“ তোমার বন্ধু খুবই লাজুক।”

“হাঁ, ও সব সময় লাজুক প্রকৃতির”। বলেই আনন্দের দিকে তাকিয়ে বললও” আনন্দ দা তোমার সাথে কোথা আছে।” বলে আনন্দ কে হেঁচকা টান দিয়ে পাশে নিয়ে গেল বেলাল।

“ কি কথা?” জিজ্ঞাসা করলো আনন্দ।

“ কোন কথা না, শুধু তোমাকে বাঁচানো, উনার হাত থেকে। দাড়াও তোমাকে আমি পরিচয় করিয়ে দেই কয়েক জনের সাথে,”

বলে, আনন্দ হাতের ইশারায় কাকে যেন ডাকতে চাইল, এমন সময়,

“ কেমন আছেন।”

কথা শুনে দুজনেই তাকাল। কাকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন বোঝার আগেই, বেলাল বলে উঠল, “ আরে সানন্দা, তুমি? কবে এলে?”

উত্তর দেওয়ার আগেই আনন্দ বললও,” আপনি এখানে?”

বেলাল ঢোক গিলে জিজ্ঞাসা করলো,” তোমরা এঁকে অপর কে চেনো নাকি?”

“ চিনি বললে ভুল হবে। তবে শেষ দেখে ছিলাম মলের এস্কেলেটরে।” বললও আনন্দ।

মুখের সাজের সাথে মেলানো রুচিময় শাড়ীর আঁচল আলতো ভাবে মাথার পরে ফেলা সানন্দার।

“ আমি আপনাকে দেখেছি আমার বোনের বাসায়। দেখেছি ভাবীর সাথে। তাও অনেকদিন হয়ে গেল। তা এখানে কি মনে করে?”

“ সেই প্রশ্ন তো আমারও” আনন্দের জিজ্ঞাসা।

“ আমার কাজিন থাকে এখানে। এসেছি তার বাসায়। শুনলাম বেলাল ভাই এর বিয়ের রিসেপশান। চলে এলাম”।

“ খুব ভালো করেছ। আনন্দ দা কে আমিই টেনে নিয়ে এলাম। তা, তোমরা দুজন বসে গল্প করো, আমি ওই দিকটা সামলাই” বলে সে চলে যেতে যেয়ে একবার তাকাল আনন্দের দিকে রহস্যময় হাসি হেসে।

“ যদি কোন আপত্তি না থাকে তবে চলুন ঐ টেবিল টাতে যেয়ে বসি। সব অপরিচিত, অপরিচিতা দের মধ্যে আপনিই কিছুটা পরিচিত। কথা বলে সময় টা কাটবে। অবশ্য —,”

সানন্দা আনন্দের কথা শেষ করতে না দিয়ে বললও,” আমার আপত্তি নেই। চলুন।”

কোনার টেবিলে যেয়ে বসলো দুজন। এই মুহূর্তে টেবিল টা খালি তবে বেশীক্ষণ আর খালি থাকবে বলে মনে হয়না। সবাই বসতে শুরু করেছে।

“ কবে ফিরবেন?” সানন্দার প্রশ্ন

   “মঙ্গল বারে।”

“ ঐ দিন তো আমিও ফিরছি? তাহলে আবারো দেখা হবে।”

“ তাই তো মনে হচ্ছে?” আনন্দ হাসল একটু।

“ আপনার দুঃখ আমি বুঝি। কারণ,

কথা শেষ হলনা সানন্দার, কলকল করতে করতে চার পাঁচ জন মহিলা ঘিরে ধরল সানন্দা কে।

“ কি রে পরিচয় করিয়ে দে আমাদের সাথে?” এক সাথে সবাই বলে উঠল।

আনন্দ নিজেই নিজের পরিচয় দিলো। ওরা নাছোড় বান্ধা। কিছুক্ষণের জন্য রসালো একটা খবর নিয়ে আনন্দ করতে পারলে মন্দ কি? এই ওদের অভিপ্রায়। কিন্তু আনন্দ ওদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে বললও,” উনি ও নিউ ইয়র্ক বাসী, আমিও। সেই সুবাদে পরিচয়। বসুন না আপনারা সবাই। আলাপ করি।”

   ওরা বসলো। স্টেজ থেকে ভেসে এলো স্বপ্নার রবীন্দ্র সঙ্গীত। সবাই চুপ। নিস্তব্ধ চারিদিক। কারো মুখে কথা নেই। গানের ঝঙ্কারে হলঘর হয়ে উঠল মুখর। করতালি দিয়ে শেষ হোল সুন্দর একটা সন্ধ্যা। এবার যাবার পালা।

আনন্দ উঠে দাঁড়িয়ে বললও,” আসি ! এবার দেখা হবে আপনাদের সাথে কোথাও, কোনখানে ।”

সানন্দা আনন্দর দিকে তাকিয়ে বললও,” দেখা হবে এয়ারপোর্টে।”

আনন্দ হা সূচক অর্থে মাথা নাড়িয়ে বললও ,” অবশ্যই”।

 

বেলাল, কল্যাণী চলে গেল ওদের সুইটে। আনন্দ ফিরে এলো ঘরে। চোখের সামনে ভেসে উঠল, প্রতিমা, সানন্দা, আরও অনন্যাদের মুখ। আনন্দের মনে হোল তার জীবদ্দশায় এরকম একটা সুন্দর সন্ধ্যা আবারো আসবে কি না কে জানে।

রাত তখন দুটা।

আনন্দের টেলিফোন বেজে উঠল। ওপাশে কান্নার স্বর। এপাশে আনন্দের মুখ ফ্যাঁকাসে।

ক্রমশ:

You may also like

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *