৫ পর্ব
বৃস্টি ঝরা সকাল। অঝরে ঝরছে। ডালাসের মাটি গ্রীষ্মের তাপ থেকে কিছুটা রেহাই পেলো। সানন্দা ভিজে মাথায় এসে দাঁড়ালো ডেলটা এয়ার লাঈন্সের কাউনটারের সামনে। কোথাও আনন্দকে দেখতে পেলো না। ভাবল, হয়ত সে ভেতরে চলে গেছে। ছয় নম্বর গেঁটের কাছে এসেও আনন্দের খোজ পেলনা। হয়ত ঘুম থেকে উঠতে পারেনি। অথবা নতুন কোন কাজের চাপে রয়ে গেছে। সেদিন রাতে ফোন নাম্বারটা আদান প্রদান না হওয়াতে সানন্দা আনন্দের কোন খোজেই পেলো না।
সেই রাতে যা ঘটেছিল আনন্দ তার জন্য প্রস্তুত ছিলনা। রাত দুটার সময় যে ফোন টা এসেছিল তাঁর অপর প্রান্তে ক্রন্দন রত জেনীফার। ডেভিডের স্ত্রী।
“ তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো। ডেভিড এর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।”
আনন্দ পরের দিন প্রথম ফ্লাইটে চলে এসেছিল নিউ ইয়র্কে। সোজা চলে গিয়েছিল হাসপাতালের বারো তালায়, ইনটেনসীভ কায়ার ইউনিটের সামনে। সবাই দাঁড়ানো। জেনীফার কাঁদছে। অনন্যাদের মুখ মলিন। ডাক্তারে ভাষ্যে এ যাত্রা ডেভিড রক্ষা পাবে মনে হয়। তবে সবই সময় সাপেক্ষ। জেনীফার কে আশ্বাস দিয়েছিল আনন্দ।
বলেছিল,” তুমি ডেভিড কে দেখো, অন্য দিকটা আমি সামলাবো।
পরদিন অফিসে এসে আনন্দ খবর পাঠিয়েছিলো সবাইকে কনফারেন্স রুমে আসতে। ডেভিড এর পরেই তাঁর স্থান। ডি এন্ড যে আসোসিয়েটে সব মিলে ষোল জন কর্মচারী। পাঁচ জন আরকিটেকট আনন্দকে নিয়ে। লরেন্স, জন, এমীলী, মাইক।
“ গুড আফটারনুন, আমরা সবাই প্রাথনা করি ডেভিড তাড়াতাড়ী ভালো হয়ে উঠুক। ডেভিডের অবর্তমানে যে দায়িত্ব আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে তা শুধু আমার নয়, আমাদের সবার। এই ফার্ম আমাদের। এর ভালো মন্দ আমাদের। ডেভিড ফিরে এসে যেন বলতে পারে,” আমি এই ফার্ম দিয়ে গিয়েছিলাম কতগুলো নিঃস্বার্থবান লোকেদের কাছে।” কারো কোন বক্তব্য থাকলে বলতে পারো।” এই বলে আনন্দ থামল।
সবাই চুপ। আনন্দ জানে যদি কোন প্রবলেম আসে তবে আসবে লরেন্সের কাছ থেকে। লরেন্স চেয়েছিল ডেভিডের পরে তাঁর স্থান করে নিতে। ডেভিড দূরদর্শিতা সম্পন্ন লোক, তাই আনন্দকে ডেকে নিয়েছিল পাশে।
আর একজন হতে পারে সে এমীলী।
এমিলী আনন্দের সাথে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গোড়ে তুলতে চেয়েছিল। আনন্দ সেটা হতে দেইনি। কারণে অকারণে খুঁটী নাটি কাজ নিয়ে সে আনন্দের রুমে আসত। কাজের শেষে যেতে চাইতো আনন্দকে নিয়ে কোন নির্জন জাগায়। একদিন আনন্দ ওকে বলেছিল,” এমীলী তুমি আমার চেয়ে অনেক ছোট, কাজে মন দেও, তোমার সামনে যে ভবিষ্যৎ, সেটা নষ্ট করোনা।” এমীলী আর কোনদিন আনন্দকে বিরক্ত করেনি। তবে একটা চাপা আক্রোশ রয়ে গেছে আনন্দের উপর।
রুমে আসতেই ইনটারকমে সামান্তা জানালো হিউস্টন থেকে একটা কল আছে আনন্দ ধরবে কিনা? আনন্দ ফরওয়ার্ড করে দিতে বলে হাতের ঘড়িটাতে দেখল দুটা বাজতে চলেছে, জেনীফার তাকে কল করে ডেভিডের খবর দেওয়ার কথা ছিল। নিশ্চয় সে বাস্ত। খারাপ দিকে টার্ন নিলো কিনা ভাবতে ভাবতে ফোনটা উঠিয়ে হ্যালো বলতেই ঐপাশ থেকে রেমীর গলা। রেমী হিউস্টনের সাব অফিসটার তত্ত্বাবধানে। বললও, “ লরেন্সে কে একবার পাঠাতে পারবে কি এখানে? সেন্ডপোর্ট মাল্টি কন্সট্রাকসন টার ব্লুপ্রিন্ট টা একটু পাল্টাতে হবে, লরেন্স বুঝবে ভাল।” আনন্দ লরেন্স কে ডেকে সব বুঝিয়ে বললো। আগামীকালই যেন সে রওয়ানা হয়ে যায় হিউস্টনের পথে।
বিকেল পাঁচটা। জেনীফারের কল না পেয়ে আনন্দ বেড়িয়ে পড়ল হাঁসপাতালের পথে।
“
বের হবার পথে মাইক ডাকল আনন্দ কে। “ তুমি হাসপাতালে গেলে আমিও যাবো” বললও মাইক।
“চলো” বলে দুজনে বেড়িয়ে পড়ল।
মাইক হেসীয়ান। বাবা মার একমাত্র ছেলে। ওর যখন ৮ বছর বাবা চলে গিয়ে ছিল আর এক মেয়ের সাথে। অনেক কষ্ট করে মা তাকে মানুষ করেছে। আনন্দকে বলেছিল সব কথা। আনন্দ জিজ্ঞাসা করেছিল,” মেয়ে বন্ধু তো আছে জানি, বিয়ে করছো না কেনো?” উত্তর দিয়েছিল, বলেছিল,” আজকাল কজন মেয়ে চায় শাশুড়ী থাকবে একি চালার নীচে? বউ না থাক ভালো , মা কে আমি ছাড়বনা।” আনন্দের চোখটা জলে ভরে এসেছিল, কোন উত্তর দেইনি।
গাড়ীতে উঠে স্টার্ট দিতেই ফোন টা বেজে উঠল। চেনা নম্বর নয়। ইতস্তো করে ফোনটা উঠালো আনন্দ।
“ কেমন আছেন।” সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর। যার সাথে দেখা হওয়ার কথা ছিল এয়ারপোর্টে কিন্তু বিধির নির্দেশে দেখা হয়নি। “ অনেক কষ্টে আপনার নম্বর টা পেয়েছি। সব ভাল তো?”
আনন্দ বিশ্লেষণ করলো সব। শুনে সানন্দা বললও,” আমিও ভেবেছিলাম কিছু একটা হয়েছে। তা না হলে
আপনার কথার কোন নড়চড় হয়না শুনেছি আমি।”
“ বাহ! অনেক কিছুই তো শুনেছেন দেখছি।”
উত্তর না দিয়ে সানন্দা বললও,” আসবেন কি, আমার বাসায় রোববার বিকেলে চা খেতে? অবশ্য যদি বাস্ত না থাকেন।”
“ আসবো, ঠিকানা টা টেক্সট করে দিন।”
কথা আর বেশি দুরে আগায়নি।
“ দেখা হলে কথা হবে, আজ তাহলে রাখি।” বলে সানন্দা ফোন রেখে দিয়েছিল।
হাসপাতালে পোঁছে আনন্দ দেখল জেনীফার ভিজিটর রুমে বসে। মাথা টা হেলিয়ে দিয়েছে দেয়ালে। ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। স্বাভাবিক। আনন্দ এপথ দিয়ে গেছে, সে জানে শারীরীক এবং মানসিক যন্ত্রণা।
আনন্দ কে দেখে বললও,” আজ ডেভিডকে রেগুলার রুমে নিয়ে গেছে। এসব নিয়ে বাস্ত থাকাতে তোমাকে কল করতে পারিনি। চলো।”
আনন্দ ঢুকতেই ডেভিড চোখ মেলে চাইল। ডেভিডের হাতটা চেপে ধরে আনন্দ বললও,” সব ঠিক মত চলছে। তোমাকে কিছু চিন্তা করতে হবেনা।” ডেভিডের চোখের কণে জলের রেখা। জেনীফার বললও, ডেভিড কে রীহেবে নিতে হবে কয়েক মাসের জন্য। আশা করছে সব ঠিক হবে। আগের মত না হলেও কাজ করার মত শক্তি ফিরে পাবে। জেনীফারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আনন্দ আর মাইক বেড়িয়ে এলো।
রোববার বিকেল পাঁচটায় আনন্দের গাড়ী এসে দাঁড়ালো সানন্দার বাসার সামনে। একগোছা ফুল সাথে করে এনেছে সে। এই ধরনের ফর্মালিটি সে করেনি অনেকদিন। আজ নিয়ে এলো। কেন? নিজেও জানেনা। বেল বাজাতেই ঠোটের কোণে হাসিটা দিয়ে দরজা খুলে দাঁড়াল সানন্দা। পরনে কচি কলাপাতা রংএর শাড়ী। মাথায় সেই একি ভাবে আলতো করে ফেলে রাখা আঁচল।
“ শুনেছি আপনার সময় জ্ঞানের কথা। আজ পেলাম তাঁর নিদর্শন.”
“ কোথা থেকে এসব কথা শুনছেন?” বলে আনন্দ ফুলের তোড়াটা এগিয়ে দিলো সানন্দার দিকে।
ধন্যবাদ দিয়ে বললও,” বাতাসে তো সে কথাই বলে, দেখুনতো অভদ্রের মত দরজা আগলিয়ে কথা বলছি, ঢুকতে না দিয়ে। আসুন”।
ছিমছাম ভাবে সাজানো বসার ঘর। টেবিলে হরেক রকম বিকেলের নাস্তা।
“ আর কেউ আসবে কি?” আনন্দ প্রশ্ন করে।
“কেন?”
“ নাস্তার পরিমাণ দেখে বলছি। সব কিছু শুনেছেন, আর আমার খাবারের পরিমাণের কথা শোনেননি।?”
“ তাও শুনেছি, পাখীর মত খান আপনি।”
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো আনন্দ,” এবার বলুন আপনার কথা। “
“ দুই মেয়ে। বড়টার বিয়ে হয়ে গেছে। ছোটটা কলেজে।”
“ বুঝলাম, অন্যজন ওপারে।”
সানন্দার চোখের কোণটা ভিজে মনে হোল আনন্দের কাছে। কথার মোড় ঘুরিয়ে নিয়ে বললও,” অনেকদিন পর একজন কথা বলার সঙ্গী পেলাম। আপনার আপত্তি নেই তো মাঝে মধ্যে যদি বিরক্ত করি.”।
না , মোটেও নয়।
ঘটে যাওয়া ঘটনার পর আনন্দ মিশেছে অনেকের সাথে। কথাও বলেছে। কিন্তু সুর মেলেনি। একি প্রশ্ন বারবার। উহ, আহ, শব্দ। ভাঙা, ছেড়া মনটাকে আরও ভেঙ্গে দেওয়াই যেন তাদের অভিপ্রায়। সেই জন্যই আনন্দ সরে গিয়েছিল ওদের মাঝ থেকে।
পেয়েছিল আরেক বান্ধবী কে। একসাথে লেখা পড়া শেষ করেছিল। থাকে একটু দুরে। বলেছিল,” আনন্দ, তোমার দরকার কথা বলার সাথী। আমিতো আছি। ফোন করবো তোমাকে প্রতিদিন, কথা হবে, দেখবে ভালোই লাগবে।” আজও সেই ধারা বজাই রয়েছে।
“ কিছু ভাবছেন?”
কিছুক্ষণের জন্য আনন্দ ফিরে গিয়েছিল পেছনে। “ জানেন, আমার এক বান্ধবী, আমার দুঃসময়ে ফোন করতো প্রতিদিন, শুধু আমাকে উৎফুল্ল করে রাখার জন্য। আপনাদের দুজনের মধ্যে কোথায় যেন একটা মিল আছে। নামের সাথেও। আপনার নাম সানন্দা ওর নাম শাশ্বতী।”
“তাই! আপনার সেই শাশ্বতী কে দেখা করিয়ে দেবেন কি আমার সাথে?”
“ দেবো, সময় আসুক।”
আনন্দের সন্ধ্যাটা অতিবাহিত হোল খুব সুন্দর ভাবে। এবার উঠার পালা।
সানন্দা বললও ,” কিছু যদি মনে না করেন একটা কথা বলি।”
“ বলেন”
“ ঘরে উনন জ্বলে কি?”
“না, জ্বলেনা।”
“ আমার অতিরিক্ত একটা মাছের টুকরা রান্না করা আছে। দিয়ে দেই?”
আনন্দ তাকিয়ে ছিল সানন্দার দিকে। করুণা নয়, আন্তরিকতার ছাপ সারা মুখে ছড়ান।
না করতে পারেনি। শুধু বলেছিল ,” এটা যেন জীবনের রুটিনের মধ্যে না এসে পরে।”
আনন্দ গাড়ী স্টার্ট দিয়ে বসেছিল কিছুক্ষণ। পুরো সন্ধ্যাটার একটা বিশ্লেষণ মনে মনে আঁকার চেষ্টা করছিল।
ফোন টা বেজে উঠল। সু র ফোন।
“ কেমন আছো মা মনি। “
“ ভালো, আমার প্রমোশন হয়েছে। এক ধাপ উপরে উঠেছি। কাল রাজের “পেটেন্ট ল” পরীক্ষা। খুব টেনশনে আছি। বাড়ীর মরটগেজ অ্যাপরুভ হবে কিনা তাও কাল জানাবে। সব একসাথে। টেনশণ আর টেনশণ।”
এতগুলি কথা একবারে শেষ করে সে যেন বাঁচল।
“ চিন্তা করোনা সোনা, আমি তো আছি।”
সোমবার সকাল, রাস্তায় ভিড়। বিশ মিনিটের পথ ঘণ্টা নিয়ে টান দেয়। আজও তাঁর ব্যতিক্রম নেই। আনন্দের অফিসে পোঁছাতে একটু দেরী হয়ে গেল আজ। রুমে ঢুকে বসতেই দরজাতে টোকা পড়ল। জন দাঁড়িয়ে।
“ কিছু বলবে?” আনন্দ জিজ্ঞাসা করলো।
“ বাবার শরীর খুব খারাপ। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে। “
“ তুমি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে কেন? চলে যাও তাড়াতাড়ি। ফিলাডেলফিয়া যেতে দুঘণ্টার উপর লেগে যাবে। “ বললও আনন্দ।
জন ধন্যবাদ দিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। ছেলেটা চটপটে। গত তিন বছর আগে পাশ করে বেড়িয়েছে। এমীলীর উপর একটু আসক্তি ছিল, কার্যকরি হয়নি।
বারো টার দিকে সু ফোন করলো। “ আব্বু, রাজ পাশ করেছে। মরটগেজও অ্যাপরুভড। আম্মু খুব প্রাউড হতো আজ, তাই না?” গলার স্বর টা কান্নায় ভেজা।
“ হা, মা মনি, মামি এখনো প্রাউড হচ্ছে। দেখছে তোমাকে। আমরা সেলিবারেট করবো উইক এন্ড এ, ঠিক আছে?”
আনন্দের মনটা আজ প্রসন্ন। মেয়ের প্রমোশন, রাজের পরীক্ষায় পাশ, ওদের নতুন বাসা। সবাই কে ডেকে বললো সে কথা। বলল, “ বাহির থেকে নিয়ে আসি খাবার সবায় মিলে খাওয়া যাবে.”
সামান্তা কাছেই ছিল, বললও ,” আনন্দ, তুমি বসো, আমি যাচ্ছি.”
আনন্দ ডলার ওর হাতে দিয়ে নিজের কামরায় ফিরে এলো। সামান্তা নেমে গেল নীচে।
দীপকে ফোন করতে হবে মনে পড়ল আনন্দের। তাম্মানা কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা।
ফোনটা উঠিয়ে ডায়াল করতে যাবে এমন সময় শুনতে পেলো বাহিরে লোকদের আর্ত চিৎকার, সেই সাথে
গাড়ীর ব্রেক করার শব্দ। কিচ কিচ কিচ চ চ–। জানালা দিয়ে তাকাল আনন্দ। লোকের ভিড়। জোড়ও হয়ে কি যেন দেখছে। পাশে কালো গাড়ী টার থেকে ধোঁয়া উড়ছে। আনন্দের পেটটা অজানা ভয়ে মোচড় দিয়ে উঠল। সামান্তার এতক্ষণ রাস্তায় পৌছানোর কথা। আনন্দ দৌড়ে গেল নীচে। লোকের ভিড়ে কিছুই দেখতে পেলোনা।
ক্রমশ
1 Comment
গল্পটা প্রথম যখন পড়েছিলাম তখনই ভালো লেগেছিল।এখন আবারও পড়লাম।ভালো লাগার রেশটা এখনও রয়ে গেছে।