এক অসমাপ্ত গল্প (৬ পর্ব)

                                                                                                                           ছয় পর্ব

   আনন্দ আরো কাছে এগিয়ে গেল। বুকটা ধুঁকধুঁক করছে। একটু দুরে মাটিতে পড়ে থাকা মেয়েটার পায়ের স্যান্ডেলটা দেখতে পেলো আনন্দ। ভিড় ঠেলে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করলো সে। উকি দিয়ে দেখার আগেই শুনতে পেলো তার নাম ধরে কে যেন ডাকছে রাস্তার ওপার থেকে। “আনন্দ”। সামান্তা ।

সামান্তার হাতে খাবার। আনন্দের জমে যাওয়া বুকটা আবার নিশ্বাসে ভরপুর হয়ে উঠল।

কাছে এসে সামান্তা বললও, “ তুমি ভেবেছিলে ওটা আমি, তাই না?’

হা,

আনন্দ বললও,’ তুমি খাবার নিয়ে উপরে চলে যাও, আমি খবরের কাগজটা কিনে নিয়ে আসছি।”

মুহূর্তে মধ্যে চারিদিক থেকে পুলিশের গাড়ী, এ্যাম্বুলেন্স এসে জাগাটা ঘিরে ফেলল। লোকের ভিড় কমছে।  উৎসুক পথচারীরা উকিঝুঁকি মেরে চলে যাচ্ছে।

আনন্দ আর দাঁড়ালনা। এসে পৌছালো খবরের কাগজ নিয়ে বসে থাকা লোকটার সামনে। আনন্দ কাছে আসতেই উর্দুতে বলল,” আপ কায়সা হেয়, সাব?”

ভালো।

আজ আনন্দের মনে পড়ছে মহিউদ্দিনের কথা। এই জাগাতেই সে বসতো কাগজ নিয়ে।

এইখানেই প্রথম দেখা হয়েছিল মহিউদ্দিনের সাথে। আনন্দকে দেখে ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বলত, “ কেমন আছেন?” প্রতিদিন সকালে আনন্দ আসতো কাগজ নিতে। কথা হতো। একটা বন্ধন তৈরি হয়েছিল দুইজনের মধ্যে। বন্ধুত্বের সম্পর্ক। হাতে সময় থাকলে আনন্দ একটা টুল নিয়ে ওর পাশে বসে গল্প করতো। এক কাপ কফি হাতে তুলে দিত।

কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে মহিউদ্দিন বলত তার সংসারের কথা। বলত তার স্ত্রী, তার মেয়ের কথা, যাকে সে এখনো দেখেনি। পনেরো বছর হয়ে গেল। বলত,” জানেন আনন্দ দা মেয়ে আমার আজ পনেরো বছরের যুবতী. অনেক কিছুর জন্য আবদার করে। সবচেয়ে বড় আবদার তার কি জানেন আনন্দদা?

বলো ?

বলে,” কবে আসবে তুমি বাবা, কবে তোমাকে দেখব,” বলতে বলতে মহিউদ্দিনের চোখটা ছলছল করত।

বলেছিল,” সেই যে দেশ ছাড়লাম অন্নের সন্ধানে, আর ফিরে যেতে পারলাম না।”

প্রথমে সে গিয়েছিল জার্মানি। দুই বছর কাজ করেছিল সুতার ফ্যাক্টরিতে। ইল্লিগাল ইমিগ্রান্টদের বের করে দাও, এই অভিযানের শুরুতে মহিউদ্দিন পাড়ি দিয়েছিল আমেরিকার উদ্দেশ্যে। অনেক কাঠখর পুড়িয়ে একদিন কানাডার বর্ডার পেড়িয়ে এসে পৌছেছিল নিউ ইয়র্কে। সেই শুরু।

“ অনেক রকম কাজই করেছি। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন পরামর্শে চেষ্টা করেছি গ্রিনকার্ড পাওয়ার। আইনজীবিদের কাছে গিয়েছিলাম, টাকার অভাবে ওই পথটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যখন এসেছিলেম, চুল ছিল কালো। আজ সাদাতে ভরে গেছে। কাগজ বেচা শেষ করে, বাসায় যেয়ে দু মুঠো খেয়ে বেরিয়ে পরি আর এক কাজের পথে, ফিরতে ফিরতে রাত একটা।”

আনন্দ বলেছিল, “ কোন এক রবিবারে ছুটি পেলে বলবেন, বেড়িয়ে পরবো দুর পাল্লায়।”

সময় হয়েছিল মহিউদ্দিনের। আনন্দ তাকে নিয়ে গিয়েছিল “মনটক পয়েন্টে”। প্যাকেটে বাধা লাঞ্চ নিয়ে বসেছিল পার্কে। বসেছিল সমুদ্রের ধারে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মহিউদ্দিন বলেছিল, অনেকদিন পর প্রাণভরে নিশ্বাস নিলাম আনন্দদা।” সুন্দর একটা দিন ওরা কাটিয়ে ছিল একসাথে।

       আনন্দ আলাপ করেছিল স্টিভিন রসের সাথে মহিউদ্দিনের ব্যাপার নিয়ে। স্টিভিন রস আইনজীবি। ওর চেম্বার আনন্দের বিল্ডিং এর আট তালায়। মাঝে মাঝে দুইজন একসাথে সময় কাটায় বারে। আনন্দের হাতে থাকে সফট ড্রিঙ্কস, স্টিভ হুস্কির পেয়ালায় বুদ হয়ে যায়। অনেক সময় আনন্দ তাকে বাসাতে নামিয়ে দেয়। গাড়ী চালানোর মত অবস্থা তার থাকতনা। মেয়ে বন্ধু তার থেকেও নেই। কাপড় পাল্টানোর মত সে মেয়ে বন্ধু পাল্টায়। তবে মনটা তার উদার।

   আনন্দ তাকে বলেছিল, পারবে কি উপকার করতে? টাকা আমি দেবো। যৎসামান্য অর্থের বিনিময়ে সে কাজটা হাতে নিয়েছিল। আনন্দ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল মহিউদ্দিনকে স্টিভের সাথে। মহিউদ্দিন একদিন আনন্দকে জিজ্ঞাসা করেছিল,” কিভাবে এই অসাধ্য সাধন করলেন”।

প্রতিদিন সকালে দেখা হলেই বলত, “ আনন্দদা, অপেক্ষায় আছি।”

একদিন আনন্দকে দেখে দৌড়িয়ে এসে জড়িয়ে ধরল।

“কি ব্যাপার! কি হয়েছে?”

খবর এসেছে। অ্যাপরুভাল লেটার এসেছে। ছয় মাসের মধ্যে গ্রীনকার্ড হয়ে যাবে।

আবারো জড়িয়ে ধরে বললও, সব আপনার জন্য।

না, আমার জন্য নয়। বল, উপরওয়ালার জন্য। স্টিভ কে আমি বলবো।

“ উনি ফেরেশতা, আমার কাছ থেকে টাকা নেইনি, বললেন আপনার বন্ধু তাই।”

আনন্দ সে কথার উত্তর না দিয়ে বললও,” আমি দেশে যাচ্ছি সামনের সপ্তাহে, দেখা করব কি ভাবীর সাথে?”

“ নিশ্চয়!” বলে ঠিকানা দিয়েছিল, সাথে কিছু টাকা।

আনন্দ দেখা করেছিল আমেনা ভাবীর সাথে। মহিউদ্দিনের দাওয়া টাকার সাথে নিজের কিছু টাকা মিশিয়ে ভাবীর হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল,” সুসংবাদ আছে! ছয় মাসের মধ্যেই আপনার কর্তা দেশে আসবে।”

অনেক আপ্যায়ন করেছিলেন আমেনা ভাবী।

ঠিক সময় মত গ্রীনকার্ড পেয়েছিল মহিউদ্দিন। আনন্দের সাথে দেখা হতেই বলেছিল, “ আগামী পরশু দেশে যাচ্ছি। দোয়া করবেন”।

আগামী পরশু আর আসেনি মহিউদ্দিনের জীবনে। সেই রাতে আনন্দের ফোন বেজে উঠেছিল। রাত তখন তিনটা। ওপাশের কান্নায় ভাঙা স্বর। আমি মহিউদ্দিনের রুমমেট বলছি,” আপনি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে আসুন”।

আনন্দ দেরী করেনি। হাসপাতালে পৌছিয়েছিল। একটু দেরী হয়ে গেছে। চলে গেছে মহিউদ্দিন এই ধরাধাম ছেড়ে। যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল, আনন্দদা যেন আমার পাশে থাকে।

মেয়েটাকে সে বুকে চেপে ধরতে পারলনা, পারলনা মেয়েটা তার বাবা কে দেখতে। যখন সে পেলো তার আকাঙ্ক্ষিত কার্ডটা তখনি বন্ধ হয়ে গেল তার হৃদক্রিয়া।

আনন্দ ছুটি নিয়ে গিয়েছিল লাশের সাথে। আমেনার কান্না সহ্য করার নয়। আনন্দকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,” আপনি বলেছিলেন, ও আসবে। ও এসেছে, ও এসেছে আনন্দদা, এসেছে লাশ হয়ে।”

সাব, আপকা চেঞ্জ।

ও, হা, দাও। আনন্দ ফিরে এলো বাস্তবে।

কাগজটা নিয়ে পা বাড়ালো অফিসের দিকে।

ক্রমশ

You may also like

1 Comment

  1. গল্পটা যত বারই পড়ি চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়।আমার ধারনা প্রতিটা পাঠকেরই তা হবে।লেখক তার লেখনি শক্তিতে অপূর্ব ভাবে লিখেছে গল্পটা যা আমাদের মনকে স্পর্শ করে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *