এক অসমাপ্ত গল্প (৭ পর্ব)

                                                             ৭ম পর্ব

   আনন্দ অফিসে ফিরে সোজা চলে গিয়েছিল স্টিভের চেম্বারে। স্টিভ ক্লায়েন্টের সাথে বাস্ত থাকায় বাহিরে সোফায় বসে কয়েকটা ফোন কল সেরে নেবে ঠিক করলো। জেনিফারের সাথে কথা হয়নি বেশ কিছুদিন। সানন্দার খবরও নেওয়া হয়নি। জেনিফার কে পাওয়া গেল, জিজ্ঞাসা করতেই বললো,” ডেভিডকে দুই এক দিনের মধ্যে বাসায় পাঠিয়ে দেবে।” সময় পেলে আজ বিকেলে আনন্দকে একবার আসতে বললো জেনিফার। কোন অসুবিধা হবেনা জানালো আনন্দ। সানন্দাকে কল করেতে যাওয়ার আগেই স্টিভ দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো।

“ কোন কথা আছে কি?”

“মহিউদ্দিনের স্ত্রী আর ওর মেয়ের ইমিগ্রেশনের স্ট্যাটাস টা জানতে এসেছিলাম।”

আনন্দ আমেনা ভাবী কে বলেছিল, তোমাদের এখানে তো আপন বলতে কাউ রইলনা, আমি চেষ্টা করবো তোমাদের কে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া কিনা। স্টিভ ছিল তার একমাত্র ভরসা। সে সমস্ত কাগজপত্র জোগাড় করে জমা দিয়েছিল।

বলল,” দুই এক মাসের মধ্যে আশা করছি উনাকে ডেকে পাঠাবে ভিসার জন্য।”

আনন্দ?” স্টিভ ডাক দিলো

বলো।

নিজের খবর রাখো?

হোয়াট ডু ইউ মিন?

শেষ কবে ওজন নিয়ে ছিলে? চোখের কোণটার পাশে যে কালো ছায়া, দেখেছ কি?

আনন্দ কোন উত্তর না দিয়ে হাসতে হাসতে গুডবাই বলে বেড়িয়ে এলো।

নিচে এসে দেখল লরেন্স ফিরে এসেছে ডালাস থেকে। কনগ্রাচুলেশন জানিয়ে আনন্দ এসে বসলো তার রুমে।

সামান্তা কফির কাপটা সামনে দিয়ে বললও,” পিটার হাসব্র আর জর্জ সয়েঞ্জার আসবে সাড়ে বারটার সময়। ওদের বিল্ডিং এর ডিজাইনের ব্যাপারে।”

সামান্তা চলে যেতেই আনন্দ ফোন করলো সানন্দা কে। আজ বুধবার। সানন্দা বলেছিল বুধবারে তার কাজের চাপ কম, কথা বলতে অসুবিধা নেই।

“কেমন আছেন” বলে অভ্যর্থনা জানালো সানন্দা।

সরি, অনেকদিন খোজ নিতে পারিনি বলে দুঃখিত। বলল আনন্দ

আপনি বাস্ত মানুষ, আসেন আরেক দিন আমার বাসায়।

“ এবার আমার পালা, শনিবার সন্ধ্যা সাত টায় আসবো আপনাকে নিতে। কোন আপত্তি আছে কি?”

না নেই, আমি রেডি থাকব।

সামান্তা এসে জানাল পিটার আর জর্জ এসেছে।

আনন্দ বলল সানন্দা কে, “একটা মিটিং আছে আমার, আজকের কথোপকথন যদি এখানে শেষ করি কিছু মনে করবেন নাতো?”

কি যে বলেন, কাজ আগে না কথা? যদি আবারো কথা না হয় তবে দেখা হবে শনিবারে।

 

আনন্দ কনফারেন্স রুমে এসে দেখল পিটার আর জর্জ কাগজে কি জেনো লেখা লেখি করছে। আনন্দ কে দেখে গুড আফটারনুন বলে অভ্যর্থনা জানাল। ওদের এসোসিয়েশন একটা synagogue বানাতে চায়। তার ডিজাইনের জন্য এসেছে।

পিটার বলল,” তোমাদের ফার্ম কে রেকমেন্ড করেছে আমাদের এক বন্ধু এবং তাদের এসোসিয়েশন”। আনন্দ ধন্যবাদ দিয়ে বলল, “কাগজপত্র রেখে যাও, আমাদের একজন আর্কিটেকট সাইটে যাবে, সমস্তকিছু দেখে আসবে। তারপর আমরা ডিজাইন এবং টাকা পয়সা নিয়ে আলোচনা করব, কেমন?”

ওরা রাজি।

আনন্দ উঠে পড়ল। বিকেল চারটা। ওকে যেতে হবে জেনিফারের বাসায়।

   ঘরে ঢুকতেই জেনিফার এসে আলিঙ্গন করলো আনন্দকে। পাশে দাঁড়ান ভদ্রমহিলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।

“ ফ্লরেন্তা, ডেভিডের বোন, থাকে লন্ডনে।”

“ ফ্লরেন্তা, আনন্দ, ডেভিডের ডান হাত। ডেভিডের অবর্তমানে আনন্দই সবকিছু দেখাশুনা করছে। তোমরা বসে গল্প করো, আমি এখনি আসছি”। বলে জেনিফার বের হয়ে গেল ঘর থেকে।

ফ্লরেন্তা, বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। ডিভোর্স। সাদা উজ্জ্বল গায়ের রং। তার সাথে মিলিয়ে গলায় কানে পার্লের নেকলেস, কান ফুল। “আপনার কথা জেনিফারের কাছে শুনেছি, আমার আসতে একটু দেরী হয়ে গেল। আন প্রিভিলাইযড বাচ্চাদের স্কুলে আমি পড়াই। কাজেই বুঝতে পারছেন, যখন তখন ওদেরকে রেখে চলে আসতে পারিনা।”

“ আমি বলব, আপনি মহান কাজ নিয়ে আছেন। অনেক ধরজো, অনেক সহিষ্ণুতা থাকলে তবেই পেশা হিসাবে এই কাজকে লোকে বরন করে। কতদিন থাকবেন?” জিজ্ঞাসা আনন্দের।

“ সপ্তাহ খানেক। সময় করে আসেন একবার লন্ডনে। “

“ আপনি সময় দিতে পারবেন তো?”

ফ্লরেন্তা উত্তর দেবার আগেই জেনিফার ফিরে এলো। হাতে কতগুলো কাগজ। আনন্দকে দিয়ে বললও, “ ডেভিড তোমাকে  দিতে বলেছে। “

   আনন্দ কাগজ গুলি হাতে নিয়ে বললও,’ আসি। “

ফ্লরেন্তা আবারো বললও,’ ভুলবেন না কিন্তু আমার ওখানে আসতে। ‘ চোখে উজ্জ্বলতার ছাপ।

“ না ভুলব না”

গাড়ীতে এসে আনন্দের মনে হোল সে ভীষণ ক্লান্ত। এক কাপ কফি খেলে ভাল হতো। না, বাসাতেই ফিরে যাবে সে। এলিয়ে দেবে শরীরটাকে সোফার উপর।

ঘরের ভেতর একটা সোঁদা সোঁদা গন্ধ। জানালা গুলো খুলে দিলো । বাতাস খেলে গেল এপাশ থেকে ওপাশে। টুং টুং শব্দ করে বেজে উঠল ছোট্ট গাছে ঝোলানো ঘণ্টা টা, ওটা কণা এনেছিল সালজবারগ, অস্ট্রিয়া থেকে। কত স্রীতি আনাচে কানাচে পড়ে আছে। সোফাটা ডাকছে তাকে। মাথাটা এলিয়ে টিভি টা অন করতেই গমগম করে উঠল সারা ঘর। তার মানে দীপ এসেছিল। ফুটবল খেলা দেখেছে ফুল ভলুম দিয়ে। বন্ধ করে দিলো টিভি টা। চোখটা বুজে আসল।

 

   আনন্দ দেখল সে দাঁড়িয়ে আছে এক ধু ধু মাঠের মাঝ প্রান্তে। উপরে হাস্যজ্বল আকাশ। হঠাৎ এক টুকরো কালো মেঘ কোথা থেকে এসে মাথার উপর ঘোরা ফেরা করছে। ডানে গেলে সে যায় ডানে, বাঁয়ে গেলে সে যায় বাঁয়ে। আনন্দের মনে হোল এ যেন এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে। সেই চোখ, সেই কান, সেই মুখ। রৌদরজ্বল আকাশে নেমে এলো কালো ছায়া। বিদ্যুতের রেখা একে দিলো কালো মেঘের বুকে। নেমে এলো জল। আকাশ পানে তাকাল আনন্দ। হারিয়ে গেছে মেঘটা। ভিজিয়ে রেখে গেছে তাকে চোখের জলে। চিৎকার করে ডাকতে চাইল তাকে। পারলনা। ঘুম ভেঙ্গে গেল। সারা শরীর ঘামে ভেজা। তাকিয়ে ছিল সে দুরে ছবিটির দিকে।

 

ফোন টা বেজে উঠল। বেলালের ফোন। স্বপ্নের রেশ তখনো কাটেনি আনন্দের। হ্যালো বলতেই বেলাল বললও

“ তোমাকে কি ঘুম থেকে জাগালাম”?

“ না তুমি জাগাওনি, অন্য কেও জাগিয়ে দিয়েছিল আমাকে । বল, কি খবর?”

   “ একটা জরুরী দরকার ছিল তোমার সাথে। তুমি ছাড়া আর কারো সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করতে চাইনা। তোমার উপর আমার একটা অধিকার জন্মে গেছে। তাই না আনন্দ দা।”

“ এত ভণিতা না করে আসল কথাটা বলবে কি?”

“ কল্যাণীর ভাই, নাম শুভ্র। কাজ করে ফার্মাসীউটিকাল কোম্পানিতে। অনেক দিন ওর খোজ পাচ্ছিনা। বুঝতেই পারছো কল্যাণীর অবস্থা। আমি তোমাকে ঠিকানাটা টেক্সট করে দেই, একটু খোজ নিতে পারবে কি?”

আনন্দ বললও সে চেষ্টা করবে। সময় করে খোজ নিয়ে জানাবে। বেলাল জানে আর কিছু বলার দরকার নিই। আনন্দ সময়

বের করে নেবে।

   আনন্দ পৌছেছিল ব্রুকলিনের এক গলিতে। বেল টিপতেই দরজা খুলে দাঁড়াল এক মহিলা।

কাকে চাই?

শুভ্র আছে? জিজ্ঞাসা করতেই মহিলা ভেতরে আসতে বললও

সোফায় বসে আনন্দ পর্যবেক্ষণ করছিল ঘরের চারিদিক। আগোছাল ঘর। জিনিস পত্র ছড়ানো ছিটানো। টেবিলের পরে ঔষধের বোতল। লেখা ভাইকোডিন। আনন্দ জানে এ কীসের ঔষধ।

শুভ্র এলো ঘরে। চোখের কোনে কালি। আলুথালু বেস। চেহারায় রুক্ষতার ছাপ।

আনন্দ নিজের পরিচয় দিলো। বেলাল এবং কল্যাণীর সাথে কি সম্পর্ক তাও জানালো।

“ তোমার খোজ না পাওয়াতে তোমার বোন ভীষণ বিচলিত।” বললও আনন্দ

“ আমি আজিই কল করব,” বলে শুভ্র এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে।

আনন্দ ওর বিজনেস কার্ডটা এগিয়ে দিয়ে বললও, “ কোন দরকার হলে কল করতে ভুলো না। অনেক ডাক্তার বন্ধু আছে আমার।”

শুভ্র আনন্দের দিকে তাকাল। বুঝতে পারলো আনন্দ কি বলতে চাইছে। ভাইকোডিনের বোতলটা হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললও ,” অবশ্যই”।

আনন্দ আর কিছু না বলে বেড়িয়ে এলো।

আজ শনিবার। সানন্দাকে উঠানোর কথা সন্ধ্যা সাতটায়। যথাসময়ে আনন্দের গাড়ী এসে দাড়াল সানন্দার ড্রাইভওয়ায় তে। সানন্দা বেড়িয়ে এলো। পরনে কালো জমিনের উপর মেজেন্টা পাড়ের শাড়ী।

দাড়ান, আপনার একটা ছবি নেবো ওই গোলাপ গাছের কাছ থেকে। বলেই আনন্দ সানন্দার দিকে তাকাল।

সানন্দা না করলো না।

কোথায় যাবো আমরা আজকে? জিজ্ঞাসা করলো সানন্দা।

“ সুশি রেস্টুরেন্টে? একটু দুরে। তবে দিস ইজ দা বেষ্ট।”

“ তাই! জানলেন কি ভাবে আমি সুশি পছন্দ করি?”

“ সবই ইমাজিনেসন।”

আগে থেকে রিজার্ভ থাকাতে টেবিল পেতে অসুবিধা হলনা। বাহিরে অনেক লোক লাইনে দাঁড়ানো। কোনের একটা টেবিল।    সুন্দর জায়গা। আনন্দ বলল সানন্দা কে,” অডার দেওয়াতে আমি অভ্যস্ত নই। ওটা আপনার দায়িত্বে।

“ খাওচ্ছেন আপনি আর অডার দেবো আমি।”

“ হা, তাই।

আনন্দ ভাবে, ওর আর সানন্দার জীবনের সুর এক। ওদের মধ্যে আছে নিটোল বন্ধুত্ব। শুধুই বন্ধুত্ব। ওরা একে অন্যের দুঃখ বোঝে। ওরা একে অন্যকে সান্ত্বনা দেয়। ফিরে যায় অতীতে। অতীত যখন কথা বলে তখন দুজনের চোখ জলে ভরে আসে।

   কি ভাবছেন?

   ভাবছি এইযে আপনি এলেন বান্ধবী হয়ে, এটাও কি একদিন শেষ হয়ে যাবে?

   জীবনে কোন কিছুরই গ্যারান্টি নেই। আছে কি? আগে থেকে সে ভাবনা ভেবে লাভ কি?

   আসলেই তাই! চলেন উঠি। আনন্দ বলে, আজকের সন্ধ্যাটা থাক আমাদের মনের মধ্যে সন্ধ্যা তারার মত।

   বাহিরে আসে দাঁড়ালো দুজনে। আকাশে তারার ঝিলিমিলি।

সানন্দা কে পৌছে দিয়ে আনন্দ ফিরে এলো বাসাতে। চিঠির বাক্স থেকে চিঠি গুলো কুড়িয়ে নিলো। ফেলে আসা সন্ধ্যার আমেজটা হারিয়ে যেতে দিতে চায়না সে। অলস নয়নে তাকিয়ে রইল ছড়িয়ে ছিটেয়ে পড়া চিঠি গুলোর দিকে। চোখটা আটকিয়ে গেল একটা খামের পরে। অজানা এই খাম। কখনো দেখিনি আগে। বাংলায় লেখা আনন্দের নাম। সে হাত বাড়াল খাম টার দিকে।

ক্রমশ:

You may also like

1 Comment

  1. ভালো লাগছে গল্পটা।ক্রমশ এগিয়ে চলেছে কাহিনী।খুবই সুন্দর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *