এক অসমাপ্ত গল্প (৮ পর্ব)

                                        ৮ম পর্ব      

চিঠিটা খুললো আনন্দ,

“ কাকুমনি,

আমি লাবণ্য, তোমার পাঠানো টাকা মা পেয়েছে। তোমার মোবাইল নাম্বার আমার কাছে না থাকাতে চিঠি লিখে জানাতে হোল। বাবা কে দেখিনি কখনো, তোমাকে দেখেছিলাম। তাও কিছুক্ষণের জন্য। সেই ব্যস্ততার মধ্যে। মা বলেছিল বাবা আর তোমার বন্ধুত্বের কথা। বাবা আদৌ কিছু রেখে গেছে কিনা, থাকলে কোথায় আমরা কিছুই জানিনা। মাস্তানদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। আসতে যেতে বড় বিরক্ত করে। জানে আমরা দুই অসহায় মহিলা থাকি এখানে । আমার মোবাইল নাম্বার রইল। কল করো কাকুমনি।

তোমার

লাবণ্য।”

চোখের কোণটা মুছে কল করেছিল আনন্দ। লাবণ্যকে বলেছিল,” চিন্তা করিস না মা, আমিতো আছি। চেষ্টা করছি তোদের কে এখানে নিয়ে আসতে। আমার বোনকে বলবো তোদের খোজ নিতে।” লাবণ্য কাঁদোকাঁদো স্বরে বলেছিল, বাবা হয়ত আমাকে তোমার কাছেই দিয়ে গেছে, তা না হলে তোমার সাথে তার দেখা হবে কেন? আমাকে, আমার মা কে তোমার কাছে রাখতে পারবে না কাকুমনি ?

পারবো। কাঁদিস না , তোর মা কে ফোনটা দে।

“ কেমন আছেন আনন্দ দা?” আমেনা ভাবীর ও গলার স্বর নিচু। কান্নার পূর্বাভাস। “ ও, তো, চলে যেয়ে বেচে গেল, যতো বোঝা দিয়ে গেল আপনার আর আমার ঘাড়ে।

ওকথা বলতে নেই, ভাবী।

জানেন আনন্দ দা, সবাই কে ছেড়ে ওর হাত ধরে একদিন বেড়িয়ে পরেছিলাম। তখন আমার বয়স আঠারো, ওর বিশ। বাসার সবার আপত্তি আমাকে ওর হাতে উঠিয়ে দিতে। যদিও একি গ্রামে পাশা পাশি বাস। যাওয়া আসা ছিল। ওর বাবা কাজ করত আমার বাবার গুদামে। তাই আমার বাবা মা এই বিয়েতে রাজি নয়। অগত্যা আমাদের করনীয় কিছু ছিলনা। এক রাতে ওর হাত ধরে বেড়িয়ে পরেছিলাম। আর পিছনে ফিরে চায়নি।

আপনার সাহস ছিল বলতে হবে? ভবিষ্যৎ কি হতে পারে ভেবেছিলেন কি?

না ভাবিনি। এসে উঠেছিলাম আমার এক দুঃসম্পর্কের খালার বাসায়। খালু বছর চার হয়েছে গত হয়েছেন। এক ছেলে। থাকে লন্ডনে। যার কাউ নেই তার উপরওয়ালা আছে। উনিই ঠাই দিয়ে ছিল। মহীউদ্দিন, আমি ডাকতাম মনা বলে, সকালে কাজ করত আর রাতে যেতো কলেজে। আমি খালাকে সাহায্য করতাম।

বাবা মার সাথে দেখা হয়ে ছিল?

না আর দেখা হয়নি, ওরাও আর আমার খোজ নেয়নি।

নতুন চাকরি নিয়ে নতুন বাসা ভাড়া করে আমরা একদিন উঠে গিয়েছিলাম। খালা অনেক কেঁদেছিলেন।

এর পরের ঘটনা আপনি সব জানেন। খালা বেচে থাকলে আজ হয়ত আমার জীবনের খাতা অন্য ভাবে লেখা হতো।

আনন্দদা, আপনি কেন এই উটকো ঝামেলা ঘাড়ে নেবেন। অনেক তো করলেন, করছেন।

ওই যে, মেয়েটা বললও,” আমাদেরকে তোমার কাছে রাখতে পারবে না কাকুমনি ? ওর জন্যেই এই ঝামেলা আমার ঘাড়ে নিতে হবে। আমার ছেলে, মেয়ে, বৌমা, জামাই আছে, ওদের সাথে হেসে খেলে ও একদিন বড় হয়ে যাবে।

আমেনা ভাবী বলেছিল, আপনি যা ভালো মনে করেন তাই হবে। আমিও জানি আপনি ছাড়া আমার আর কেউ নেই।

আনন্দ ওর বোন ঝুম্পা কে বলেছিল লাবণ্যদের খোজ খবর নিতে। ঝুম্পা খোজ রেখেছিল। মাস্তানদের সাথে কথা বলেছিল। বলেছিল, ওদের বড় বস দের সাথে তার চলাফেরা আছে। মাস্তানরা আর বিরক্ত করেনি লাবণ্যদের।

   আজ রবিবার। নিষ্প্রভ দিন। আনন্দের কিছুই ভাললাগছে না। মাঝে মধ্যে এমন হয়। কিছু একটা নিয়ে বাস্ত থাকার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা। মনে হল সামিতাদের কে ছেড়ে আসার পর আর খোজ নেওয়া হয়নি। কথা দিয়েছিল সামিতাকে, আবার সে ফিরে আসবে। কে জানে মেয়েটা কেমন আছে। সামিতার মার ফোন নাম্বারে কল করলো। উত্তর এলো নম্বরটা বাতিল হয়ে গিয়েছে। আনন্দ খুঁজে বের করল হোটেলের নম্বরটা। ডায়েল করলো। ওপাশ থেকে মহিলার কণ্ঠস্বর, “ কুরেঙ্গা হোটেল, ক্যান অ্যাই হেল্প উ?” সব কিছু বুঝিয়ে বলল আনন্দ।

   ওরা নেই এখানে। দুমাস আগে চলে গিয়েছে এই শহর ছেড়ে। আনন্দ চুপ করে ছিল কিছুক্ষণ। ওপাশ থেকে হ্যালো শুনে বলল , যদি কোন সময় ওদের খোজ পান এই নম্বরটা দেবেন, বলবেন আমেরিকা থেকে ফোন করেছিল। “

সামিতা হারিয়ে গেল। হারিয়ে গেল ঐ বোবা মেয়েটা। ওকে আনন্দ কথা দিয়ে ছিল , আবার আসবে, দেখা হবে।

আজ একটা অস্বাভাবিক জ্বালা, যন্ত্রণা আনন্দকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। দুই কাপ কফি শেষ করেছে, আরেক কাপ বানাতে হবে। আনন্দ উঠতে যাবার আগেই ফোনটা বেজে উঠল। সমিতের ফোন।

“ কি খবর? হঠাৎ। কি মনে করে?”

“ খবর ভালনা। কারীনা ভাবীর ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়েছে। স্টেজ ফাইভ। যাবি দেখতে?”

“ না, আমি যাবনা। আমি এসব সহ্য করেতে পারিনা। কোন পরিত্রাণ নেই এর থেকে। শুধু তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে নিয়ে  যাওয়া। আমি মিঠুর মুখের দিকে চাইতে পারব না। তুই যা।”

আনন্দ ফোন টা রেখে ডায়েল করল স্টিভ কে।

“হোয়াটস আপ”

“ যাবে বারে, ড্রিঙ্কস খেতে চাই।”

“ তোমার ড্রিঙ্কস তো যেকোনো দোকানেই পাবে। তার জন্য বারে যাবার দরকার নিই।”

“ হার্ড ড্রিঙ্কস খাবো আজ। অস্থির লাগছে।”

“ আই উইল পিক ইউ আপ এট ফাইভ।”বলল স্টিভ

বারে এসে বসতেই বারটেনডার যথারীতি ক্লাব সোডা এগিয়ে দিলো।

“ না আজ এসব নয়। গিভ মি স্কচ উইদাউট আইস” আনন্দ বললও

বারটেনডার অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল আনন্দের দিকে। স্টিভ মাথা নেড়ে হা সূচক ইঙ্গিত করতেই সে হুইস্কীর গ্লাসটা এগিয়ে দিলো।

এক পেগ পেটে পড়তেই চোখ ঘোলাটে হয়ে এলো আনন্দের। একটা রমরমা ভাব এলো মনের মধ্যে। সবকিছুতে হলদে রং এর আঁচড়।

চিনতে পারছো? পাশে তাকাল আনন্দ। ঝাপসা। আমি শিখা। মনে পড়ে?

না।

এক শহরে থাকতাম। একি ক্লাসে। তুমি ছেলেদের স্কুলে আমি মেয়েদের । একবার পিকনিকে গিয়েছিলাম একি জায়গায়। তুমি তোমার বন্ধুদের আর আমি আমার বান্ধাবীদের নিয়ে।

মনে পড়ে ?

না।

তোমরা তিন বন্ধু আমাদের বাসার সামনে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যেতে আর টুং টুং করে বেল দিতে। দেখতে চাইতে জানালাটা খুলে কেউ এসে দাড়ায় কি না। মনে পড়ে?

না

তুমি ছিলে হ্যাংলা পাতলা।

দেখতে ভালো নই, তাই বলতে চাইছ ?

না তা নয়, তবে আহামরি কিছু নয়।

তা মনে রেখেছ সেই চেহারা।

তাইতো এলাম তোমাকে দেখে।

এতদিন পড়ে দেখা। বল তোমার কথা। আনন্দ জানতে চাইল।

ভালোই ছিলাম। হঠাৎ করে স্বামী এসে বলল সে ডিভোর্স চায়।

কেন?

নতুন একজন কে পেয়েছে। বয়স কম, তারপর আবার ব্লন্ড।

তা কি করবে ঠিক করেছ ?

এই বয়সে পাল্লা দিতে পারবো না।

হু! আমি এক কাগজে ডিভোর্স সম্পর্কে পড়েছিলাম। বিষয়টা সত্য। যদি কাজে লাগাতে পারো।

বলো।

তোমারই মত কাহিনী।

ছেলেটা ডিভোর্স চেয়েছিল। মেয়েটা বলেছিল ,” ডিভোর্স দাও আপত্তি নেই। তবে তিরিশ দিন পরে। এই তিরিশ দিন প্রতি রাতে কোলে করে আমাকে বসার ঘর থেকে শোয়ার ঘরে নিয়ে যেতে হবে। পারবে ?”

ছেলেটা রাজি।

প্রথম দিন কোলে করে নিতে যেয়ে মেয়েটার নিশ্বাস এসে পড়ল ছেলেটার মুখে। চোখা চোখি হয়নি দুজনের।

দ্বিতীয় দিন মেয়েটা এলিয়ে দিয়েছিল মাথাটা ছেলেটির বুকে। ওর ব্লাউসের পারফিউমের গন্ধ নাকে এলো। মনে পড়ল এতো তারই পছন্দের পারফিউম। ভুলে গিয়ে ছিল এর গন্ধ।

৩য় দিন কোলে নিয়ে যাওয়ার সময় ওর চুল গুলো এসে পরেছিল ছেলেটার মুখে। সরাতে যেয়ে মনে হোল আগে ওর চুলে অনেক গোছা ছিল, কবে যে হাল্কা হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি।

পরদিন কোলে উঠাতে যেয়ে মনে হোল ও অনেক শুকিয়ে গেছে। অনেক দিন ওর দিকে ভালো ভাবে তাকায়নি, কবে যে ওর বয়স বেড়ে গেছে, মুখে বলিরেখা, চুলে পাক ধরেছে জানতে পারেনি। ছেলেটা ভাবল “এই সে, যে কিনা তার জীবনের দশটা বছর দিয়েছে আমাকে”। এই সে যে কিনা প্রতিদিন ডাল ভাত বেড়ে খাইয়েছে। আগলিয়ে রেখেছে আমার ছেলে কে। ছেলেটার মনে হোল তার ভালবাসা ফুরিয়ে যায়নি। ওর চোখের মাঝে খুঁজে পেলো তার হারিয়ে যাওয়া ভালবাসা।

পরের দিন কোলে নিয়ে চেপে ধরেছিল তাকে, মুখের উপর পরে থাকা চুল গুলো সরিয়ে বলেছিল, আমি এখনো তোমাকে ভালবাসি, তুমি আমার।

কি! শুনলে তো। এবার এই পরীক্ষা তোমার স্বামীর উপর প্রয়োগ করো, বলে আনন্দ তাকাতে চাইল শিখার দিকে, পারলনা। ঢলে পড়ল মাথা টা টেবিলের পরে।

   যখন চোখ খুলল মাথায় দারুণ ব্যাথা। সানন্দা সামনে দাঁড়িয়ে।

তুমি এখানে?

স্টিভ কল করেছিল। ছাইপাঁশ খেয়ে মাতাল হয়ে গিয়েছিলে। কিছু মনে পড়ে কি?

না।

অনেক আবোল তাবোল বকেছো শুনলাম। পেটে যা পরেছিল সব বের করে দিয়েছিলে ওখানে। একটা কথা বলি।

বলো।

তুমি একদিন আমাকে বলেছিলে তুমি খারাপ হতে চাও। জানো আনন্দ দা, খারাপ হতে চাইলেই সবাই খারাপ হতে পারেনা । অন্ততপক্ষে তুমি পারবেনা। তোমার মত ভালো মানুষরা খারাপ হতে জানেনা। এবার বিশ্রাম নাও। আমি আসি।

এসো।

 ক্রমশ

You may also like

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *