ডি এন্ড জে এসোসিয়েটের কর্মক্ষেত্র আজ আনন্দে ভরপুর। ডেভিড ফিরে আসছে পাঁচ মাস পর। এমিলি, জন, লরেন্স মিলে তৈরি করেছে “ওয়েল কাম ব্যাক” কার্ড। খুবই সুন্দর দেখতে । সবাই লিখেছে কিছুনা কিছু। ছোট্টও করে আনন্দ লিখেছিল, লং লীভ দা কিং।
ডেভিড এলো এগারটায়। জেনিফারের সাথে। সবার সাথে হাত মেলানোর পর কিছু বলতে যেয়ে আবেগে বলতে পারলনা। চশমাটা কয়েকবার মুছতে হোল। অবশেষে সবাই কে ধন্যবাদ জানিয়ে বললও সে কোনদিন ভুলবে না যে সাপোর্ট সে পেয়েছে সবার কাছ থেকে। সব শেষে সে যেয়ে বসলো তার নিজের রুমে। আনন্দকে বললও সে যেন দেখা করে তার সাথে।
আনন্দ রুমে আসতেই ডেভিড দরজা টা বন্ধ করে দিতে বললও। জেনিফার বসে আছে একটু দুরে। কোন ভণিতা না করেই ডেভিড সরাসরি বললও,” তোমাকে আমি আমার ফার্মের অর্ধেক পার্টনারশিপ দিতে চাই। রাজি আছো?’
আনন্দের একটু সময় লাগলো ডেভিড কি বলছে সেটা বুঝে উঠতে। ডেভিড আবারো বললও, আমি হয়ত আর পুরোপুরি সময় দিতে পারবোনা এই ফার্মের জন্য। । এই পাঁচমাস তুমি এক হাতে যে ভাবে ফার্ম টাকে এগিয়ে নিয়ে গেছো তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। এটা শুধু আমার পরিকল্পনা নয়, জেনিফারের ও। এই ফার্মের হাল একমাত্র তুমিই ধরতে পারবে। কি বল, রাজি?
জেনিফার এগিয়ে এলো আনন্দের কাছে। “ তোমাকে এই মুহূর্তে কথা দিতে হবেনা। চিন্তা করে দেখো।”
আনন্দ তাকাল দুজনের দিকে। “ এটা আমার স্বপ্নের অতীত যে এ ধরনের প্রস্তাব তোমরা আমাকে দিতে পারো। আই রিয়েলি অ্যাপরিসিয়েট ইট। কিন্তু,” বলে আনন্দ থামল।
ডেভিড জেনিফার দুজনেই তাকিয়ে আছে ওর চোখের দিকে।
“ অর্ধেক পার্টনারশিপ নিতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা আমার কাছে নাই, ডেভিড।’ বললও আনন্দ
“ তোমার যাতে হার্ডশিপ না হয় সে বাবস্থা আমি করবো” ডেভিড বললও।
আনন্দ উঠে চলে যেতে যেয়ে আবার ফিরে এলো। একটা কথা আছে।
বলো।
আমি কিছুদিনের জন্য একটু বাহিরে যেতে চাই। পারবে এক সপ্তাহ সামলাতে এদিকটা। বললও আনন্দ।
ডেভিড মাথা নেড়ে হাঁ সূচক ইঙ্গিত দিয়ে বললও,” ডেফিনিট”। শোন?
আনন্দ ফিরে তাকাল।
ফ্লরেন্তা তোমাকে ফোন করতে বলেছে, এই ওর সেল নাম্বার। বলে, হাতের কাগজ টা এগিয়ে দিলো ডেভিড আনন্দের দিকে।
হাতের কাজ গুলো শেষ করে ডায়েল করলো আনন্দ। লন্ডনে এখন রাত নয় টা। পাঁচ বার রিং হওয়ার পর ফোন টা ধরল ফ্লরেন্তা।
“ কেমন আছো?” জিজ্ঞাসা করলো আনন্দ
“ভালো,এখানে ইউরো সকার ফাঁইনাল। দুটো টিকেট আছে। অনেক কষ্টে পেয়েছি । চলে এসো।” বললও ফ্লরেন্তা
আনন্দ রাজি, যথারিতি দরকারি জিনিস পত্র ক্যারিঅনে নিয়ে পরদিন রওনা হয়ে গেল।
হিতরো এয়ার পোর্টে যখন এসে নামল তখন ভোর পাঁচটা। ফ্লরেন্তা দাঁড়িয়েছিল বাহিরে। ওকে দেখে দৌড়িয়ে এসে জড়িয়ে ধরল। “ ফ্লাইটে কোন অসুবিধা হয়নি তো?”
“মোটেও না” বললও আনন্দ।
ফ্লরেন্তার গাড়ীতে করে এসে পৌছালো ওর এপার্টমেন্টে। আধা ঘণ্টার পথ। সুন্দর ছিমছাম করে সাজানো ঘর। ফ্লরেন্তা আনন্দকে তার ঘর দেখিয়ে দিয়ে বললও। “ এখন অনেক সকাল, তুমি রেস্ট নেও। নয় টার দিকে আমরা নাস্তা করব। কেমন?”
আনন্দ রাজি। সেও ভীষণ ক্লান্ত। কিছুক্ষণ ন্যাপ নেওয়াতে শরীরটা একটু ঝরঝরে মনে হোল আনন্দের। বসার ঘরে এসে দেখে ফ্লরেন্তা খবরের কাগজ পড়ছে।
“ কি ঘুম হয়েছে ?” জিজ্ঞাসা করলো ।
“গোসল করে নাও। নাস্তা শেষে আমরা বের হবো। কেমন? তোমাকে নিয়ে যাবো আমার কাজের জাগায়।” বলল ফ্লরেন্তা।
আনন্দ বাথরুমের দিকে যেতে যেতে ভাবল, ফ্লরেন্তার সাথে দেখা হয়ে ছিল মাত্র একবার। অথচ মনে হচ্ছে সে অনেক দিনের চেনা।
লন্ডন শহরে সূর্যের মুখ দেখা দুরহ। আজ তার ব্যতিক্রম। ঝলমলে রোদ। মনে একটা আলাদা আমেজ এনে দিচ্ছে। আনন্দ ভাবে, সে এসেছিল লন্ডনে অনেক অনেক আগে। হেঁটেছিল দুজনে এই টেমস নদীর পাশ দিয়ে। বসে ছিল বিগ বেনের সামনে। ও আনন্দের কাঁধে মাথা রেখে তাকিয়ে ছিল চোখের দিকে। ভালবাসার ফুলগুলো ঝড়ে পড়ছিল চোখের চাউনী থেকে। সবই আজ স্রীতী।
কি ভাবছ?
কিছুটা জীবনের পিছনে চলে গিয়েছিলাম। “চলো।”
যাওয়ার পথে টমকে উঠিয়ে নিতে হবে। আমার কলীগ। বললও ফ্লরেন্তা।
টমের বাসা, গলিতে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকদের বসবাস এখানে নয় মনে হোল আনন্দের। খোলা ডাস্টবিনের ময়লা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দুরে ছোট ছোট ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। হর্ন দিতেই টম বেড়িয়ে এলো। বয়স বিশ থেকে পঁচিশ এর কোঠায়। গাড়ীতে আসতেই ফ্লরেন্তা পরিচয় করিয়ে দিলো। একটু লাজুক প্রক্রিতির। কথার মাঝে সে জিজ্ঞাসা করলো আনন্দকে কতদিন থাকবে।
আনন্দ বললও,” এসেছি ফাইনাল খেলা দেখতে। শেষ হওয়ার পর আরও দু এক দিন থাকব, তারপর প্যারিস, জার্মানি হয়ে স্টেটসে ফিরে যাবো।”
তিন তালা বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়ালো ফ্লরেন্তা। লেখা এন্ডড্রুস কমিউনিটি। জিজ্ঞাসা করতেই ফ্লরেন্তা বললও,” এন্ডড্রু নামের এক বিশাল ধনী লোক এর খরচ চালায়। দেখবে, কত হারিয়ে যেতে পারতো এমন ছেলে মেয়েরা আজ তাদের জীবনের সন্ধান খুঁজে পেয়েছে।”
আনন্দ দেখল বিভিন্ন রুমে বয়স বারো থেকে বিশ বছরের ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন কাজ নিয়ে বাস্ত। ফ্লরেন্তা আর টম চলে গেল তাদের নিজের কাজে। ফ্লরেন্তা যাওয়ার আগে বলে গেল,” আনন্দ তুমি ঘুরে ঘুরে দেখো। আমি মিটিং সেরে তোমার সাথে দেখা করবো।”
দুরে একটা মেয়ে কাঠের সরঞ্জাম দিয়ে কি জেনো বানানোর চেষ্টা করছিল। আনন্দ এগিয়ে গেল মেয়েটার কাছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল তার হাতের কাজ। মেয়েটা মুখ তুলে তাকাল।
“কিছু বলবে” জিজ্ঞাসা করলো
“ না, তোমার হাতের কাজ দেখছি। খুব সুন্দর। কার কাছ থেকে শিখেছ?”
“ এনড্রিয়ার কাছ থেকে।”
নাম কি তোমার?
আলভীনা।
সুন্দর নাম। কিভাবে এলে এখানে?
সে এক বিরাট কাহিনী।
বলবে কি?
দুটোয় আমার লাঞ্চ ব্রেক, তখন এসো বলবো।
সে বলেছিল, আনন্দের চোখের জল বাঁধ মানেনি সেদিন।
বারো বছর বয়সে তার জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। বাপের হাতের পিটুনি, মার গঞ্জনার থেকে বাঁচতে যেয়ে ধরেছিল ড্রাগস। সেই আসক্তি মেটাতে যেয়ে ধরতে হয়েছিল চুরির পথ। ধরা পড়ে জেলে ছিল তিন মাস। বেড়িয়ে এসে দেখে বাবা বাসা ছেড়ে চলে গেছে। মা নিয়ে এসেছে নতুন পার্টনার, নাম চার্লস। থাকে মার সাথে।
দিনের পর দিন চার্লস পাশবিক অত্যাচার করেছে আলভীনার পরে। মা দেখেও মুখ ফিরিয়ে রেখেছে না দেখার ভান করে। তখন আলভীনার বয়স মাত্র তেরো। মাঝে মাঝে আলভীনার মাকে মারতে ও দ্বিধা করেনি চার্লস। বাসাটা হয়ে উঠেছিল নরক কুণ্ডো। এক বছর ধরে এই অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। আলভীনা আর নিতে পারেনি এই যন্ত্রণা। একদিন বাধ্য হয়ে সে তার মা কে বলেছিল চার্লসকে বের করে দিতে বাসা থেকে। মা রাজি হয়নি। অগত্যা আলভীনা কেই বের হয়ে যেতে হয়েছিল রাস্তায়।
থেকেছে বন্ধুদের বাসায় কিছু রাত। শুয়েছে অন্য লোকদের সাথে শুধু মাথার উপর ছাদের আশায়। শেষপর্যন্ত এসে আশ্রয় নিয়ে ছিল আলোকোজ্জ্বল নগরীর পোড়ো বাড়ীর ছাদের নিচে। রাস্তায় কাটিয়েছে ওরই মত হারিয়ে যাওয়া ছেলে মেয়েদের সাথে।
আলভীনা বেচে থাকার কোন মানে খুঁজে পায়নি, জীবনের সব লেনদেন চুকিয়ে দিতে চেয়েছিল। সে ভাবতো, সে চলে গেলে কার কি আসে যায়। কেউ তো তার জন্য এক ফোটা চোখের জল ফেলবেনা। এই রাস্তায় পড়ে থাকা ছেলে মেয়েদের কথা কেউ ভেবেছে কি? কেউ কোনদিন জিজ্ঞাসা করেছে কি, তোমাদের কি সমস্যা? তাই একদিন সমস্ত জ্বালা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সে তার হাতের রগ কেটে ফেলে ছিল, রক্তাত অবস্থায় পড়েছিল রাস্তার গলিতে।
নিয়তির খেলা, সে দিন মরণের হাত থেকে কেউ বাঁচতে পারতনা আলভীনাকে, যদি না এনড্রিয়া ওই পথ দিয়ে না যেতো তার কর্মস্থলে।
এ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, কাজে আর যাওয়া হয়নি এনড্রিয়ার সেদিন। আলভীনা সুস্থ হয়ে উঠলে, পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল অ্যালেক্স আর রবার্টের সাথে। ওরা নিয়ে এসেছিল এন্ডড্রুস কমিউনিটিতে। ওদের চেষ্টায় আলভীনা আজ খুঁজে পেয়েছে তার নিজস্ব পরিচয়। জেনেছে কাউ না কেউ আছে যে কি না তার দুঃখে দুঃখিত, তার ব্যাথায় ব্যাথিত হয়।
“ ওরা আমাকে আশ্রয় দিয়ে ছিল, গ্রহণ করেছিল। জানতে চায়নি আমি কে। এযে কতবড় পাওয়া তুমি বুঝবে না” বলেছিল আলভীনা।
আনন্দ তাকিয়ে ছিল দুরে, ভাবল ফ্লরেন্তা, এনড্রিয়া, অ্যালেক্স, রবার্টের মত মানুষ ছিল বলেই আজ আলভীনা আর ওর মত কিছু হারিয়ে যাওয়া ছেলে মেয়ে আবারো নতুন করে স্বপ্ন দেখতে পারলো। নতুন করে জীবনকে উপলব্ধি করলো।
“ কি ব্যাপার, কি হোল, সব ঠিক তো?”
ডাক শুনে ফ্লরেন্তার দিকে তাকাল আনন্দ। বললও , চলো, বাসার পথে কি?
হা, টম কে নামিয়ে দেবো যাওয়ার পথে। টুমরোঁ ইজ এ বিগ ডে। দা ফাইনাল।
ক্রমশ
**** সমস্ত চরিত্রই কাল্পনিক, কারোর সাথে মিল থাকলে তা নিতান্তই কাকতালীয়”***
কাহিনীটি মন ছুয়ে গেল।আনন্দ পথ চলতে চলতে যাদের দেখা পাচ্ছে,তোমার কলমের আঁচড়ে তারাজীবন্ত হয়ে উঠছে।পাঠকরা সম্ভবত অপেক্ষা করছে আনন্দের কি হয় দেখার জন্য।সুতরাং হঠাত করে লেখা থামিয়ে দেয়া যাবেনা। পাঠকের প্রতি তোমার দায়বদ্ধতা রয়ে গেছে।
5 Comments
লেখকের কলমের আঁচড়ে একটি সুন্দর গল্পের সূচনা হয়েছে যা মনকে আপ্লুত করে।
Prottekti charittra mone dag ketese. Asha korsi arakom sundar lekha aro pabo.
Touching story.
খুব ভালো।fecebookএ লিখেছি।
কাহিনীটি মন ছুয়ে গেল।আনন্দ পথ চলতে চলতে যাদের দেখা পাচ্ছে,তোমার কলমের আঁচড়ে তারাজীবন্ত হয়ে উঠছে।পাঠকরা সম্ভবত অপেক্ষা করছে আনন্দের কি হয় দেখার জন্য।সুতরাং হঠাত করে লেখা থামিয়ে দেয়া যাবেনা। পাঠকের প্রতি তোমার দায়বদ্ধতা রয়ে গেছে।