এক অসমাপ্ত গল্প

                                                                                     ১০ পর্ব

       সাত দিন পর আনন্দ ফিরে এসেছিল। সাতটা সুন্দরতম দিন কাটিয়েছিল ফ্লরেন্তার সাথে। বসে ছিল টেমস নদীর ধারে। সময় ক্ষণ, ঝিরঝির বাতাস, নির্মল সন্ধ্যা, আকাশে চাঁদ এই সব বেস্টিত জগত ফ্লরেন্তাকে করেছিল ব্যকুল। সেই সন্ধ্যায় অনর্গল বলে গিয়েছিল তার জীবনের ডায়রি।

এক ভাই এক বোন। ডেভিড আর ফ্লরেন্তা। ফ্লরেন্তা সাত বছরের ছোট। যখন তার বয়স পঁচিশ. গাড়ী দুর্ঘটনায় বাবা মার মৃতু গভীর দাগ কেটেছিল ওর মনে। কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে চেয়েছিল, পারেনি। মা বাবার আদর আর ভাইয়ের ভালবাসায় বড় হয়েছিল। হঠাৎ জীবনের এই একটা অংশ হারিয়ে যাওয়া সে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনি। মানসিক ডাক্তারদের মতে এ শুধু সময় সাপেক্ষ।

ইন্টারনেট খুঁজে জেনেছিল, মানসিক শান্তির পথ আছে শুধু মেডিটেশন আর ইয়োগার মাধ্যমে। যেতে হবে আশ্রমে। কোথায় সে আশ্রম ?

ভারতের কেরালা স্টেটে।

ডেভিড কে বলেছিল। ডেভিড না করেনি। শুধু বলেছিল তার এক বন্ধু থাকে দিল্লিতে সেই সব ব্যবস্তা করে দেবে।

দিল্লী বিমান বন্দরে যথাসময়ে জনাথন ফ্লরেন্তাকে রিসিভ করে নিয়ে গিয়েছিল ওর এপার্টমেন্টে। ফ্লরেন্তার থাকার ব্যবস্থার কোন ত্রুটি জনাথন করেনি।

জনাথন বলেছিল,” চলো, আশ্রমে যাওয়ার আগে তোমাকে ঐতিহাসিক জাগা গুলো দেখিয়ে নিয়ে আসি। রাজি তো?”

ফ্লরেন্তা রাজি হয়েছিল। কেন জানি জনাথনের সান্নিধ্য তার ভালোই লাগছিল। স্মার্ট, হ্যান্ডসাম, উচ্চতা সাত ফুটের কাছা কাছি। এক কন্সট্রাকশন কোম্পানির উচ্চপদে অধিসঠিত। জনাথন কিছুদিনের ছুটি নিয়ে ফ্লরেন্তাকে দেখিয়ে ছিল লাল কেল্লা,কুতুব মিনার। গিয়েছিল তাজমহল দেখতে।

তাজমহলের চত্বরে বসে সেই প্রথম জনাথন চুমো দিয়েছিল ফ্লরেন্তা কে। ফ্লরেন্তা বাধা দেইনি। এক নতুন আনন্দের শিহরনে তার সর্ব শরীর শিহরিত হয়ে উঠেছিল। আশ্রমে আর যাওয়া হয়নি। থেকে গিয়েছিল জনাথনের সাথে।  ডেভিড কে জানিয়ে ছিল সব কথা। বলেছিল ওদের বিবাহর দিন ঠিক হয়েছে। ওরা জেনো আসে এই অনুষ্ঠানে।

কিছু মাস পর জনাথন নূতন কাজ নিয়ে চলে এসেছিল লন্ডনে ফ্লরেন্তাকে নিয়ে। ফ্লরেন্তা আরম্ভ করেছিল স্কুলের মাস্টারি। কাজের ফাকে ফাকে দুজনে চলে যায় বিভিন্ন জাগায়। বাবা মা হারিয়ে যাওয়ার বেদনা লাঘব হয়েছে ফ্লরেন্তার। মানসিক ভারসাম্য ফিরে পেয়েছে।

একদিন ফ্লরেন্তার স্কুল ছুটি হয়েছিল নির্ধারিত সময়ের আগে। ঠিক করেছিল জনাথন কে ফোন করে বলবে লাঞ্চ করবে একসাথে। কি মনে করে ফোনটা রেখে দিয়েছিল। ভেবেছিল তার নিজেস্ব কিছু কাজ আজে, সময়ের অভাবে শেষ করা হয়ে ওঠেনি। তাই বাসায় ফিরে যাওয়াটাই মনস্থ করল ।বাসার ড্রাইভওয়েতে অচেনা একটা গাড়ী। জনাথনের গাড়ীও এই মুহূর্তে এখানে থাকার কথা নয়। ভয়ে ভয়ে দরজাটা খুলেছিল ফ্লরেন্তা।

জনাথন সোফাতে গভীরভাবে মিশে গেছে এক অচেনা মেয়ের মাঝে। শুধু শুনতে পেলো ইস,উঃ,আঃ,আঃ শব্দ। হাতের কাছের ফুলদানী টা ছুড়ে ফেলেছিল। ঝনঝন শব্দে ভেঙ্গে পড়েছিল দুরে। জনাথন কে বেড়িয়ে যেতে বলেছিল বাসা থেকে।

সেই শেষ।

তারপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। স্কুলের এক মিটিং এ দেখা হয়েছিল এনড্রুর সাথে। এনড্রু বলেছিল ওর এনড্রু কমিউনিটি প্রজেক্টের কথা। ফ্লরেন্তার ভালো লেগেছিল। হারিয়ে যাওয়া ছেলে মেয়ে গুলোকে ভালবাসা দিয়ে মানুষ করার দায়িত্ব নিয়ে ছিল। আর পিছনে ফিরে তাকায়নি।

বিমান বন্দরে বিদায় দিতে এসে বলেছিল, আনন্দ তোমার সান্নিধ্য আমার খুব ভালো লেগেছে। পারলে আবার এসো।

   আনন্দের কেন জানি অস্বস্তি লাগছে আজ। দুদিন ঘুম আসেনি। গতকাল আনন্দ জিজ্ঞাসা করেছিল সানন্দাকে ,” যাবে নিউপোর্টে বেড়াতে? খুব একটা দুর নয়। সকালে যেয়ে রাতে ফিরে আসবো। যাবে?”

হা, না কিছুই সে বলেনি। যেতে ইচ্ছুক্ক নয় মনে হোল। কোথায় জেনো একটা দ্বিধা। আনন্দ আর কোথা বাড়ায়নি। আনন্দের স্বভাব, একবার চাইলে যদি না পাওয়া যায়, দ্বিতীয় বার সেটা চাইতে সে রাজি নয়। আজ হঠাৎ করে কেন সব কিছুর পরে বিতৃষনা আসছে সে বুঝতে পারছেনা। রাত দশটা। মনে হচ্ছে কারো সাথে যদি একটু কথা বলেতে পারতো হয়ত ভালো লাগত। সানন্দা কে ফোন করেছিল।

বলল,” ভাল লাগছেনা। তাই কথা বলে কিছুটা সময় পার করতে চেয়েছিলাম। তুমি কি বাস্ত?”

একটু, কাল কথা বলবো?

ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ পায়চারী করলো আনন্দ। নীচে নেমে টিভি টা অন করলো। ভালো খবর নেই। শুধু মারামারি কাটাকাটি। বন্ধ করে দিলো। মাথার পোকাটা আজ আনন্দকে পেয়ে বসেছে। রাত এগারটা।

গাড়ীর চাবিটা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে এলো। রাস্তা নির্জন। ভাবল কিছুক্ষণের জন্য উদ্দেশহীন ভাবে ঘুরবে। একটু ড্রাইভ করতেই পাশে একটা পার্ক দেখে থামালো গাড়ীটা। পার্কের ভিতরে পায়ে চলা পথ। কিছুদুরে একটা ছোট্টও দীঘি। শান বাধানো। আনন্দ এসে বসলো সিঁড়িটার পরে। ফুটফুটে জোছনা। চাঁদের এলো ঝরেঝরে পড়ছে দীঘির জলে। নিস্তব্ধ চারিদিক। নিস্তব্ধটাকে ভাঙতে চাইল আনন্দ। ছোট্টও একটা পাথর ছুড়ে মারল দীঘির জলে। টলমল করে উঠল জল। চাঁদের আলো জলের ঢেউএ মিশে সৃস্টি করলো এক অপূর্ব মায়াময় পরিবেশ। আনন্দের মনে হোল অসংখ্য হীরের টুকরা ঝলমল করছে।

চোখ বুজে এলো। শুয়ে পড়ল দীঘির পাড়ে।

ফিরে গেল অনেক পিছনে।

বসুন্ধরা মার্কেটে ঘুরছিল ওরা দুজন।

কণার ব্যাগে টান পড়তেই হাতটা চেপে ধরেছিল। ছোট্টও বাচ্চার হাত। ফিরে তাকাতেই দেখল চোখ ছলছল করা এক সাত আট বছরের ছেলে।

বললও, “ আমাকে পুলিশে দিয়েন না মেম সাব ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।”

একাজ কেন করছিস ? ধমক দিয়েছিল কণা।

ওরা আমাকে করতে বাধ্য করেছে, তা না করলে আমার হাত কেটে ফেলবে।

ওরা কারা? জিজ্ঞাসা করেছিল কণা

যাদের কাছে মা বাবা আমাকে বিক্রি করে দিয়েছিল।

বিক্রি করে দিয়েছিল?

হা, মাত্র পাঁচশ টাকা দিয়ে। আমার অনেক খিদে পেয়েছে মেমসাব।

কণার হাসি পেয়েছিল। সে এসেছিল চুরি করতে, এখন চাচ্ছে ভাত। কণা নিয়ে গিয়েছিল পাশের হোটেলে।

খাওয়া শেষে বলেছিল, আমরা ছিলাম দুই ভাই এক বোন। কোন দিন পেট ভরে খেতে পারিনি। বাবা ছিল অসুস্থ।

মা অন্যের বাসায় ধোয়া মোছার কাজ করত। মার পাশে আমরা দুই ভাই শুয়ে থাকতাম। রাতে দেখতাম মা কাঁদছে। একদিন দেখলাম দুটা লোক এসে মা বাবার সাথে কি জেনো গুজগুজ ফুসফুস করছে। আমি আসতেই ওরা কথা বন্ধ করে দিলো। আরও একদিন দেখলাম ওদেরকে। শুনলাম টাকার কথা বলছে। পাঁচশো, পাঁচশো।

এর পর কথা নয়। শুধু খসখস শব্দ শুনলাম। শুনলাম কান্নার আওয়াজ। মার কান্না মনে হোল।

কিছুই বুঝলাম না। ভাই আমার দু বছরের বড়। ওকে জিজ্ঞাসা করলাম। ও একবার আমার দিকে তাকাল। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে কি জেনো গুনতে থাকল। সেই শেষ দেখা তার সাথে আমার।

ওরা বেড়িয়ে এলো। বাবা শুয়ে ছিল। ডাকল আমাদেরকে। শুধু দুজনের মাথায় হাত বুলাল। কিছু বলল না।

চোখের কোণ দিয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল।

মা পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে যেয়ে বলেছিল, ওদের সাথে যেতে, ভালো ভালো খেতে পারবো। নতুন নতুন জামা কাপড় পাবো। এখানে তো একবেলাও খাওয়া জোটেনা। ছেড়া কাপড় পরে থাকি।

ওরা শিখিয়ে ছিল কেমন ভাবে পকেট কাটতে হবে। বলেছিল যদি প্রতিদিন এই পরিমাণ টাকা না আনতে পারি তবে খাওয়া বন্ধ। আর চাবুক দিয়ে পিঠ ছিলে দেবে।

পিঠের কাপড় উঠিয়ে দেখিয়েছিল দাগ গুলো। দু একটা জাগা এখনো শুকিয়ে যায়নি।

কণা উঠে চলে গিয়েছিল। গিয়েছিল রেস্টরুমে। আনন্দ জানে কণা ওখানে যেয়ে কাঁদবে।

ফিরে এসেছিল চোখ লাল করে। কিছু টাকা ওর হাতে দিয়ে বলেছিল, “ তুই যা, এর বেশি আমি তোকে কিছু করতে পারবোনা। ওদের হাত থেকে আমি তোকে বাঁচাতে পারবোনা।”

সে চলে গেল, মিশে গেল ভিড়ের মাঝে।

কোথায় একটা খসখস শব্দ। উঠে বসল আনন্দ। সেল ফোনটা খুঁজল। পেলোনা। হয়ত গাড়ীতে। কিছুই মনে করতে পারলনা। চাঁদটা ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। পাখিদের কলকাকলী নাই। ভোর হতে দেরী আছে। আনন্দ চিন্তা করলো কোথায় সে তার গাড়ীটা পার্ক করেছিল। পায়ে চলা পথ দিয়ে এগুতেই দেখতে পেলো কে একজন সামনে এগিয়ে আসছে। ভাবল ওরই মত দুঃখ বেদনা দুর করতে এসেছে এই নির্জনে। কাছে এসে দাঁড়ালো। এই গরমেও মাথা হুডটা দিয়ে ঢাকা। চাঁদের আলোতে ঝলমল করে উঠল ওর হাতের সিলভার রংএর পিস্তল টা।

ক্রমশ

You may also like

4 Comments

  1. ভালো।একটা নতুন কৌতুহল সৃষ্টি হলো।কিনতু তুমি কি আনন্দকে পিস্তলের গুলিতে মেরে ফেলতে চাও? তাহলে কিনতু শেষটা সুন্দর হবেনা।দেখি তুমি কি করতে চাও।

  2. এই পর্বেও লেখকের লেখনী শক্তির পরিচয় মেলে।মনে হয় চরিত্রগুলি সে অনেক কাছ থেকে দেখেছে।আনন্দের নিসঙ্গতাও আমাদের মনকে আচ্ছন্ন করে।তার কষ্টের সাথে আমরা একাত্ম হয়ে যাই।আমরা চাই আনন্দের জীবন যেন আনন্দময় হয়ে ওঠে।

  3. Anondo means happiness but I sense a feeling of loneliness in the character. Great job on for the ending; building suspense and keeping the reader hooked.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *