এক অসমাপ্ত গল্প ( ১১ পর্ব)

                                                                     ১১ পর্ব

        ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল মাথা থেকে গালের পাশ বেয়ে। রক্তের স্রোত ততোটা নয়। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। পকেটের রুমাল টা দিয়ে মাথা টা চেপে ধরে পাশের গাছে হেলান দিয়ে বসলো আনন্দ। আকাশে তখনো জ্যোৎস্না। ভোর হতে কিছু বাকি। লোক টা রেগে গিয়েছিল। রেগে গিয়েছিল কারণ আনন্দের পকেটে কিছুই ছিলনা। মানিব্যাগ টা রেখে এসেছিল গাড়ীতে, ফোন টা কোথায় মনে করতে পারেনা। গালাগালি দিয়েছিল লোকটা। “ হারামজাদা, কিছু নেই পকেট ? আজকের প্রথম বউনী আমার মাঠে মারা গেল ?” বিড়বিড় করে আরও কি জেনো বললও। তারপর পিস্তলটা আনন্দের বুকের কাছে ধরল। আনন্দ দেখতে পেলো হুডের নীচে ওর চোখের হিংস্রতা। দ্রুত তার মাথার মধ্যে খেলে গেল, “দিনের শুরুতে তার জীবন প্রদীপ নিভে যাবে আজ। দীপ, সু তাদের মা কে হারিয়েছে আজ তারা বাবা কেউও হারাতে চলেছে। পিস্তল টা যেখানে ধরা সেখানেই হৃদপিণ্ড। গুলিটা হৃদপিণ্ড কে ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে যাবে। ও লুটিয়ে পরবে মাটিতে। পুলিশ আসবে। কোন আইডেনটিটিকার্ড নেই ওর কাছে। ও হয়ে যাবে জন ডো।”

না, লোক টা গুলি না করে এক পা পিছিয়ে গেল। তারপর পিস্তলের বাঁট দিয়ে জোড়ে মেরেছিল আনন্দের মাথায়। লুটিয়ে পড়েছিল আনন্দ। কতক্ষণ জানেনা। চোখ খুলতেই মনে হল গালের পাশটা ভিজে ভিজে। রক্ত।

গাছে হেলান দিয়ে বসে আনন্দ ভাবল এবার উঠতে হবে। রক্ত গুলো জমাট বেঁধে গেছে। ফিরে যেতে হবে পুলিশ আসার আগেই। পুলিশে ছুলে আঠারো ঘা। ওরা বিভিন্ন জিজ্ঞাসা বাদ করবে। কাজের কাজ কিছুই হবেনা। সময় নষ্ট। হাসপাতালে সে যেতে রাজি নয়। বিভীষিকা ময় ER সে দেখেছে। বাসায় ফিরে এলো আনন্দ। রুমাল টা রক্তে ভেজা। গালের পাশের জমাট বাধা রক্ত গুলো গরম জল দিয়ে পরিষ্কার করলো। আঠা আঠা চুলগুলো সরিয়ে আয়না দিয়ে দেখতে চাইলো ডেমেজ টা কতটুকু। ততোটা নয়। ইস্টিচ লাগবে বলে মনে হোল না। আশেপাশের চুল গুলো কেটে জাগাটা পরিষ্কার করলো আনন্দ। এলকোহল প্যাড টা চেপে ধরল কাটা জাগায়। ঠোট দুটো কামড়িয়ে জ্বালাটা কমাতে চাইল । এনটিবাওটিক ওয়েনটমেনট লাগিয়ে সোফাতে এসে বসলো আনন্দ।

   সকাল হয়ে এলো। বন্ধের দিন আজ। এতো ভোরে কাউকে বিরক্ত করতে চাইলনা। একবার ফোনটা উঠিয়ে ছিল সানন্দাকে ঘটনাটা জানানোর জন্য। পরে রেখে দিয়েছিল। ইদানিং সবকিছুতে না সুচক উত্তরের জন্যই হয়তবা।

সকাল দশটা। আনন্দ টেক্সট মেসেজ পাঠাল ওদের চার জন কে। বিস্তারিত না জানিয়ে। শুধু লিখেছিল, মাথাটা কেটে গেছে, রক্ত এসেছিল, এখন বন্ধ। আনন্দ জানে এটাই যথেষ্ট। এখনি ফোন আসা আরম্ভ হবে। ঠিক তাই। সু র ফোন।

কি বললে তুমি? রক্ত এসেছিল ? কিভাবে? কখন?

আনন্দ কিছু বলার আগেই সে বললও,” তুমি ফোন রাখো, আমি দীপ কে কল করে থ্রি ওয়ে কথা বলব।”

সব কিছু বিশ্লেষণ করতেই দীপ বললও,” আমরা এখনি আসছি।

ঘণ্টা খানেকের মধ্যে চার জন এসে হাজির। বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন। কেন এতো রাতে বের হয়েছিল। বের যদি হবেই তবে পার্কে যাওয়ার কি দরকার। অবশেষে ওদের প্রস্তাব আনন্দকে দুজনের যেকোনো এক বাসাতে থাকতে হবে। একা আর নয়।

     আনন্দ একটু হাসল। ওদের ছেলে মানুষি দেখে। আসলে বাবাকে ভালবাসে তাই। সহজ সরল সমাধান।

   তা হয়না, বললও আনন্দ। আমার নিজস্ব একটা স্বত্বা আছে। তাছাড়া আমিতো পঙ্গু হয়ে যাইনি। তোমাদের উৎকণ্ঠা আমি বুঝি। শোন, কথার  মোড় ঘুরিয়ে বললও, “ বউমা, তোমার ডাক্তার ফারুক আঙ্কেল কে কল করে বল যদি পারে তবে একবার জেনো আসে এখানে”।

সু, দীপ, রাজ বউমা এদের নিয়েই আনন্দের সংসার। প্রতিদিন দুই তিন বার করে ফোন করবে। বাবার কি অবস্থা। ওরা ভাবে আনন্দের নিজেকে টেক কেয়ার করার ক্ষমতা ফুরিয়ে এসেছে। খুব বেশি ভালবাসার এটাই হয়ত নিদর্শন।

   দরজার বেলটা বেজে উঠল। রাজ দরজাটা খুলে দিতেই সানন্দা ঘরে ঢুকল।

“ আমাকে জানাওনি কেন।”

বিরক্ত করতে চাইনি। বললও আনন্দ।

“সেই রাতে তুমি যে ফোন করেছিলে কথা বলবে বলে, যদি কথা বলতাম তা হলে হয়ত এ ঘটনা নাও ঘটতে পারতো। নিজেকে খুব দোষী মনে হচ্ছে।”

“ তুমি কি করবে বলো, বিধির বিধান তুমি তো খণ্ডাতে পারবেনা।”

সানন্দাকে খবর সু দিয়ে ছিল। জানে সানন্দা আসলে একটু স্বস্তি। সেই সব দেখাশুনা করতে পারবে।

বউমা বললও, “অ্যান্টি তুমি বাবার পাশে বসো আমি তোমার জন্য চা নিয়ে আসি।” বলে সবায় কে ইঙ্গিত করলো অন্য ঘরে যেতে।

ওরা উঠতে যাওয়ার আগেই সানন্দা সু কে বললও এলকোহল প্যাড, ডিসপজেবল গ্লভস, অ্যান্টিবাওটিক অইনটমেন্ট আর ব্যান্ডেট টা আনতে। কাটা জাগা টা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেট টা লাগিয়ে দিয়ে বললও,” এসব পাগলামি বন্ধ করো। রাত বেরাতে বেড়িয়ে একটা না একটা অঘটন করবে আর অন্যদেরকে ভোগাবে।”

আনন্দ সানন্দাকে দেখছিল। ভাবছিল, শুধুতো বান্ধবী তার বেশি তো কিছু নয়। সব কিছুই সে করছে অথচ কোথায় জেনো একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে।

মনে পরে একদিন আনন্দ বলেছিল,”যাবে কি আমার সাথে, আমি লন্ডন হয়ে মারাকাশ যাবো। তোমার আপত্তি আছে?”

যেতে চাইলেও যেতে পারবো না বলেছিল সে।

কেন? বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল সানন্দার দিকে।

আমি বিধবা, সমাজ নিয়ে চলতে হয়। তোমার মত উদার মনের মানুষ তো সবায় নয়। অনেকে অনেক কিছু মনে করতে পারে।

মনে করতে পারে ? কি মনে করতে পারে ? ছেলে মেয়ে একসাথে ভেকেসনে যেতে পারবেনা ? তাতে অসুবিধা কোথায় ? আনন্দ কিছুটা উত্তেজিত হয়েই কথা গুলো বলেছিল।

সানন্দা ধীর স্থির। উত্তেজিত হতে আনন্দ তাঁকে দেখিনি কখনো। সেটাকে বজায় রেখে বলেছিল, লোকের মুখতো বন্ধ করতে পারবেনা। তারা দেখবে অন্য চোখে। সে সুযোগ নাই বা দিলে। তোমার সাথে বোস্টনে তোমার বান্ধবীর বাসাতে তো গিয়েছিলাম। সেখানে ছিল তোমার বান্ধবী ও তার স্বামী। অসুবিধা হয়নি কারণ সেখানে তুমি আমি একা নই। এখন বুঝলে?

বুঝেছি? গজগজ করতে করতে আনন্দ বলেছিল, এই ঘুণধরা সমাজটার মানসিক চিন্তা ধারা যদি পাল্টানো যেতো।

সানন্দা হাসতে হাসতে বলেছিল তুমি তো সমাজ কর্মী নও, নিতান্তই ভালো মানুষ। তোমাদের মত মানুষরা শুধু দুঃখই পায় ।

দুমাস পরে আমি দেশে যাবো, কয়েকটা কাজ হাতে নিয়ে তখন যাবেতো। আনন্দ জিজ্ঞাসা করেছিল সানন্দা কে।

যাবো। তোমার বোনের বাসায় উঠবে তো। তাতে আমার আপত্তি নেই।

কি ভাবছ? সানন্দার ডাকে আনন্দ ফিরে এলো বাস্তবে।

উত্তর দেওয়ার আগেই ফোনটা বেজে উঠল। বেলালের ফোন। অনেক দিন পরে। সানন্দা ফোনটা উঠিয়ে হ্যালো বোলতেই , সরি, রং নাম্বার বলে বেলাল রেখে দিচ্ছিল।

“ বেলাল ভাই , আমি সানন্দা।”

“ আমি কি তোমার ফোনে কল করেছি?”

“ না, তুমি আনন্দ দার ফোনে কল করেছ। সে একটু বাস্ত। তুমি ধর।”

হ্যালো বলতেই ,” আনন্দ দা আমি নিউইয়র্কে। শুভ্র মারা গেছে।” বলে একটু থামল বেলাল। “ তুমি আসতে পারবে? একটু এসো, কল্যাণী কে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ছে আমার পক্ষে। পারবে আসতে?”

ওর বেদনা ভরা কণ্ঠস্বর আনন্দ কে ব্যাকুল করে তুলল।

“ঠিক আছে, ঠিকানা টা দাও আমি আসছি”। যদিও মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ব্যাথার ঔষধ খেয়েছে কিনতু না গেলেই নয়।

সানন্দকে সব বুঝিয়ে বলতেই সে বলল,” আমি তোমার সাথে যাবো”।

সু,দীপ জানে বাবা কে বলে কোন লাভ নেই। সে যখন মনস্থির করেছে যাবে, তখন সে যাবেই। তবে সান্ত্বনা সানন্দা সাথে যাচ্ছে।

লোকের ভিড় বেশি নয়। কল্যাণী কাঁদছে। সানন্দা এগিয়ে গেল ওর দিকে। বেলাল আনন্দকে জড়িয়ে ধরল।

ড্রাগ ওভারডোজ। বললও বেলাল।

মা মারা গিয়েছিল ছোট বেলায়। কল্যাণী দশ, শুভ্র আট। বাবা বিয়ে করেছিল এক বছরের মাথায়। সৎ মার সাথে বনিবনা হয়নি ওদের দুজনের। বাবা বুঝেও না বুঝের ভান করে থাকতো। মামা একদিন ওদের কে নিয়ে গিয়েছিল তার বাসায়। বাবা না করেনি। সন্তান হীন মামা কোলে পিঠে করে ওদের দুজন কে মানুষ করেছিল। দিয়ে ছিল উচ্চশিক্ষা। কল্যাণী ভালো চাকরি নিয়ে চলে গিয়ে ছিল ডালাসে। শুভ্র নিউইয়র্কে এপার্টমেন্ট ভাড়া করেছিল।

     পিটার লুগারের সাথে শুভ্রর দেখা হয়েছিল এক কন্সার্টে। সম বয়সী। অতি ভদ্র, যুক্তি তর্ক দিয়ে কথা বলে। কথায় মাধুরী মিশানো। বন্ধুত্ব হয়েছিল। পিটার শুভ্রকে নিয়ে গিয়েছিল এক পার্টিতে। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল লোটাসের সাথে। ড্রাগ ডিলার। শুভ্রকে হুকড আপ করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি লোটাসের। সেই শুরু।

ভাইকোডিন। প্রথমে একটা দুটো পিল। তারপর ক্রমেই বাড়তে থাকল পিলের পরিমাণ। সেই সাথে কাজে যাওয়া কমে আসল। শুভ্রর বস কল্যাণী কে বলেছিল ওর কাজের অনিয়মের কথা। অনেক চেষ্টা করেছিল কল্যাণী ওকে এই নেশার থেকে ফেরাতে। পারেনি।

এক রাতে পেটে প্রচণ্ড ব্যাথা। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ডাক্তার বললও Pancreatites. শুভ্র তার এডিকশনের কথা বলেনি। তাঁকে prescribe করা হোল ভাইকোডিন। ব্যাথার জন্য। বাসায় ফিরে এসে কল্যাণীকে ফোন করে বলেছিল, আপা আমি বোধ হয় আর বাচবো নারে। সেই রাতে ব্যাথার যন্ত্রণায় টিকতে না পেরে ভাইকোডিনের পুরো বোতল ঢেলে দিয়েছিল গলার ভিতর। সব ব্যাথার অবসান হয়েছিল। চোখ আর খোলেনি শুভ্র।

আনন্দ ধীর পায়ে এগিয়ে গেল কল্যাণীর কাছে। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই। কল্যাণী,সানন্দা,বেলাল কাঁদছে। দাঁড়িয়ে আছে ওর বাবা। চোখে জল নেই। তাকিয়ে আছে সাদা কাপড়ে ঢাকা লাশের দিকে। আর নয়। এবার শুভ্রর যাবার পালা হিম শীতল কক্ষে। কান্নার ধনী চারিদিকে। ফুঁপিয়ে উঠল কল্যাণী।

কাল শুভ্রর শেষ যাত্রা।

ক্রমশ

You may also like

5 Comments

  1. অপূর্ব।স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম তুমি আনন্দকে শেষ করে দাওনি দেখে।তোমার লেখার ভাষা খুব সহজ সরল।অল্প কথায় অনেককিছুবলে দাও যা ভালো লাগে।

  2. প্রথমবার পড়ে ভালো লেগেছিল। এখন পড়ে চোখে জল এলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *