এক অসমাপ্ত গল্প ( ১৪ পর্ব)

                                                                                                       ১৪ পর্ব

       জনের কাঁধে হাত রেখে আস্তে আস্তে হেটে আনন্দ এসে বসলো লাউঞ্জের সোফাতে। তাকিয়ে থাকল জনের দিকে। পরিতৃপ্তির হাসি। হাল্কা মন। কিছুক্ষণ আগেও যা ছিল সমুদ্রের গর্জনে ভরা, এখন তা শিথিল। একজন চলে গেছে। দ্বিতীয়কে হারাতে সে রাজি ছিল না।

ভীষণ ক্লান্ত। জনকে বলল সে ভাবছে দুই তিন দিন পরে ফিরে যাবে নিউইয়র্কে। জনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো ঘরে।

কতক্ষণ শুয়ে ছিল আনন্দ মনে করতে পারেনা। টেলিফোনর শব্দে চোখটা খুলে ঘড়িটা দেখল। পাঁচটা বাজে। ফোনটা বাজছে। বিরক্তের সাথে ফোন টা উঠালো।

“ এখনি আসতে পারবে?” বলল থম্পসন।

“ ঠিক আছে ।” বলে উঠে বসল। দেখল দরজার কাছে একটা কাগজ পরে আছে। আগে দেখেনি। কাগজটা উঠাল।

অক্ষর গুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে কেটে কেটে বসানো হয়েছে। লেখা আছে, “ Your life is in danger. Say nothing to anyone. You must leave the city immediately and never return. Repeat: say nothing—“.

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল কাগজটার দিকে। কয়েকবার পড়ল। ভয় যে পেলোনা তা নয়। একটু থ্রীলও অনুভব করলো। জন কে ফোন করলো । বিজি টোন।

ট্যাক্সি ডেকে বেড়িয়ে পড়ল পুলিশ স্টেশনের উদ্দেশ্যে। পিছনে তাকাতেই মনে হোল একটা ট্যাক্সি তাকে ফলো করছে। ড্রাইভার কে একটু জোড়ে যেতে বলে আবারো পিছনে তাকাল আনন্দ। ট্যাক্সিটার গতিও বেড়ে গেল। আনন্দ ড্রাইভারের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে বলল, “ ডান দিকে মোড় নিয়ে গলিতে ঢুকে একটু আস্তে যাবে, আমি নেমে পরার সাথে সাথে তুমি জোড়ে চালিয়ে চলে যাবে।”

আনন্দ যথারীতি নেমে পাশের দোকানে ঢুকে পড়ল। ট্যাক্সিটা গলিতে ঢুকে সোজা চলে গেল। কিছুক্ষণ পর আনন্দ বেড়িয়ে এসে আর একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়ল।

থম্পসন অপেক্ষা করছিল। আনন্দ ঢোকার সাথে সাথে থম্পসন বলল দরজাটা বন্ধ করে দিতে। বলল” যাকে ধরা হয়েছে সে হত্যাকারী নয়।”

আনন্দ আকাশ থেকে পড়ল। “ তুমি বলে ছিলে প্রমাণ আছে।”

“ আছে, তবে সেই প্রমাণে কাজ হবেনা। তার alibi আছে। এমিলি যে সময়ে মারা গেছে সেই সময় সে ছিল অন্যখানে। তার প্রমাণ আছে। সেখানের সারভেলেন্স ক্যামেরায় তার ছবি পর্যন্ত আছে। একটা লোক একই সময়ে দু’জাগায় থাকতে পারেনা।”

“ছেড়ে দিয়েছ কি?”

“হা, তবে এই স্টেটের বাহিরে যেতে পারবে না”।

এই বলে থম্পসন দুটা এমিলির ছবি আনন্দকে দেখাল। একটা মারা যাওয়ার আগের। অন্যটা মেঝেতে পরে আছে।

বুঝতে পারো কিছু ?

আনন্দ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লনা।

“প্রথম ছবিটায় এমিলির আঙ্গুলে আংটি। দ্বিতীয়টাতে নেই। Who ever is the killer, took the ring. But why?”

কথা বলতে বলতে আনন্দ রুমে পাওয়া কাগজটা থম্পসনের দিকে এগিয়ে দিলো। দেখতে পেলো থম্পসন দাঁতে দাঁত কামড়াচ্ছে। চোয়ালের পেশী গুলো ওঠা নামা করছে। ভুরু কুঁচকিয়ে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে থাকল।

“ I wish I will be lucky –“

কথা শেষ হবার আগেই আনন্দ জানতে চাইলো সে কি বলতে চাইছে।

থম্পসন একটা মেগনিফাইন গ্লাস নিয়ে এলো। হাতে গ্লোভস পরে খুব সাবধানে danger ওয়ার্ড টাকে ফোকাস করলো।

“ কিছু দেখতে পাচ্ছো?”

না

“ ছোট্ট কালো –“

“ হা, পাচ্ছি। ওটা কি”?

“ চুলের অংশ। That could be the turning point.”

থম্পসন ওর অ্যাসিস্ট্যান্টকে ডাক দিয়ে সাবধানে কাগজটা জীপ লক ব্যাগে ভরে ক্রাইম ল্যাবে পাঠিয়ে দিলো।

আনন্দ বুঝে উঠতে পারলনা কেন তাঁকে ফলো করা হচ্ছে। সে কথা বলতেই থম্পসন বলল, “ তুমি খুব বেশি মাথা গলিয়ে ফেলেছ। অনেক কিছু জেনেছ। পিছনে ফেরার পথ নাই। শুধু সাবধানে থাকবে।”

আনন্দ গুডবাই বলে উঠতে যাবে এই সময় হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল থম্পসনের অ্যাসিস্ট্যান্ট।

“ খবর আছে। আংটি পাওয়া গেছে।”

“ কোথায়?” জিজ্ঞাসা করলো থম্পসন

“ Pawn Shopএ বিক্রি করতে এসেছিল। ওকে ধরে রাখা হয়েছে।”

থম্পসন আনন্দ কে জিজ্ঞাসা করলো সে যাবে কিনা। আনন্দ রাজি।

সব গোল্ড বেচা কেনার দোকানে আংটিটার ছবি দিয়ে রাখা হয়েছিল। থম্পসনকে দেখেই লোকটা হাউমাউ করে পা চেপে ধরল। “ আমি কিচ্ছু জানিনা। পড়ে পেয়ে ছিলাম,”

থম্পসন উত্তর না দিয়ে বলল, থানায় যেতে হবে। সেখানে সব শুনব।

লোকটা বলল যে হোটেলে খুন হয়েছে সে ওই হোটেলের রান্নাঘরে কাজকরে। সেদিন সেসময়ে সে ছিল একেলা। বাসন পত্র সাজিয়ে রাখছিল। একজন অচেনা লোক মাথায় বেজবল ক্যাপ, চোখে সানগ্লাস রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে দ্রুত হেটে যাচ্ছিল। সে ভেবে ছিল নতুন কর্মচারী হয়ত। টুং করে একটা শব্দ হোল। প্রথমে ভ্রুক্ষেপ করেনি। পরে চেয়ে দেখে একটা আংটি পরে আছে। জ্বলজ্বল করছিল। লোভ সামলাতে পারেনি। উঠিয়ে নিয়েছিল।

থম্পসন দেরী না করে লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে এলো হোটেলে। ম্যানেজার কে নিয়ে এলো ওই রান্নাঘরে। জিজ্ঞাসা করলো কোন সারভেলেন্স ক্যামেরা আছে কি না।

বলল,” আছে”

“ নিয়ে এসো ওই দিনের টেপ গুলি।” নির্দেশ দিলো থম্পসন।

যথারীতি আনন্দ কে হোটেলে নামিয়ে সে চলে গেল থানায় লোকটাকে নিয়ে।

হোটেল লাউঞ্জে ঢুকতেই জন ডাক দিলো আনন্দকে। বসেছিল কর্নারের সোফাতে।

কোথায় গিয়েছিল জিজ্ঞাসা করাতে আনন্দ সঠিক উত্তর না দিয়ে বলল, “একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম।” জনের চোখের চাহুনিতে মনে হল সে বিশ্বাস করলো না কথাটা।

ফোনটা বেজে উঠল। থম্পসনের ফোন। জিজ্ঞাসা করলো কাছে কেউ আছে কিনা।

বলল,” আছে”। কোন উত্তর না দিয়ে শুধু শুনতে বলল।

লাউঞ্জ ছেড়ে কোথাও যেন না যায়, বলল থম্পসন। আনন্দ রহস্যের ঘন্ধ পেলো। ভয়ও হোল।

জন উঠে যাবার সময় আনন্দকে বলল সে মলে যাবে কিনা। আনন্দ না বলে সোফাতে বসে পড়ল।

আবারো থমস্পনের ফোন। একি প্রশ্ন। জানা শোনা কেউ কাছে আছে কিনা।

বলল, না

“ রুমে চলে যাও। আমি আসবো রাত নটায়। দরজা খুলবেনা। আমি তিন টোকা দিয়ে আমার নাম বলব, তখন দরজা খুলবে।”

আনন্দের সারা শরীর ছমছম করছে। কিছু একটা ঘটতে চলেছে।

রাত নটা। যথা রীতি দরজায় টোকা দিয়ে নাম বলতেই আনন্দ দরজা খুলল। থম্পসনের সাথে আর একজন। নাম এডওয়ার্ড। এডওয়ার্ড ঘরে ঢুকতেই থম্পসন আনন্দকে বাহিরে আসতে বলল, দ্রুত উল্টো দিকের রুমটাতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। ঘটনাটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে আনন্দ কোনকিছু জিজ্ঞাসা করার সময় পেলোনা।

থম্পসন বলল, “ আজ রাতে কিছু একটা ঘটবে তোমার রুমে আমি আশা করছি এবং সেটাই হবে ঘটনার শেষ অধ্যায়।”

থম্পসনের আদেশে হলওয়ের আলো গুলি নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আনন্দের রুমের অপর দিকের রুমে থম্পসন, Peep hole দিয়ে দেখছে কেউ আসে কিনা।

রাত একটা। পা এর আওয়াজ শোনা গেল। এগিয়ে আসছে। কাছা কাছি এসে দাঁড়াল। আবার ফিরে গেল। আর কোন শব্দ নেই। থম্পসন তার নিজের হার্ট বিট শুনতে পাচ্ছে। Peep hole থেকে চোখ সরিয়ে নিতেই পা এর শব্দ ফিরে এলো। এসে থামল দরজার কাছে। হলওয়ের নাইট লাইটে থম্পসন দেখতে পেলো লোকটাকে। এপাশে ওপাশে তাকাল। ছয় ফুট লম্বা। হাতে গোল আকারের একটা বস্তু। পকেট থেকে ইলেকট্রনিক চাবি বের করলো। স্লটের ভিতর দিতেই ক্লিক আওয়াজ করে দরজাটা খুলে গেল। আস্তে করে ঢুকে পড়ল।

থম্পসন বেড়িয়ে এলো। দরজার পাশে এসে দাঁড়াল। আনন্দ ঘরের ভিতরে কাঁপছে। গলা শুকিয়ে গেছে।

দড়াম করে শব্দ হোল। চিৎকার। থম্পসন তাড়াতাড়ি দরজা খুলে পিস্তল টা বের করে আলো জ্বালিয়ে দিলো।

এডওয়ার্ড লোকটাকে মেঝেতে জাপটিয়ে ধরে রেখেছে। আনন্দ দৌড়িয়ে এসে রুমে ঢুকল। লোকটার হাতের সেই গোল বস্তুটা বিছানায় পরা। এডওয়ার্ড বলল এটা দিয়ে সে আঘাত করেছিল বালিশে। ভেবে ছিল আনন্দ ওখানে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু ভাবেনি বিছানাতে কেউ নাই। দেখে মনে হচ্ছিল কেউ শুয়ে আছে। এডওয়ার্ড লুকিয়ে ছিল ক্লজেটে। বেড়িয়ে এসে জাপটিয়ে ধরেছিল।

মাথায় হুড উঠানো। এডওয়ার্ড মাথার হুডটা সরিয়ে দিলো। আনন্দ তাকিয়ে থাকল ওর দিকে। চোখে পলক পড়েনা। শুধু জিজ্ঞাসা করলো,” Is that you?”

কোন উত্তর এলোনা জনের কাছ থেকে।

   সকাল দশটা। থম্পসন কফির কাপটা এগিয়ে দিলো আনন্দের দিকে।

মুখে কথা নেই আনন্দের। সমস্ত ব্যাপার টা তখনো তার বোধগম্য হচ্ছেনা। কেন জন এপথে গেল। আর তাকেই বা কেন টার্গেট করেছিল। জিজ্ঞাসা করলো থম্পসন কে।

জনের জবানবন্দির মাঝে ফাঁক ছিল অনেক। তখনি থম্পসনের সন্দেহ হয়েছিল। খোজ নিয়ে জেনে ছিল সে ডালাসে এসেছে চার দিন আগে অথচ বলল ফোন পেয়ে এসেছে। গাড়ী সে রেখে ছিল লং টার্ম পারকীং লটে। এসেছিল এমিলিকে সারপ্রাইজ দিতে। সারপ্রাইজ দিতে এসে এমিলিকে দেখেছিল আর এক জনের সাথে, খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে। মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। ওদেরকে অনুসরণ করে জেনে ছিল কোন রুমে এমিলি থাকে।

একদিন লোকটা এমিলির ঘর থেকে বেড়িয়ে চলে যাবার কিছুক্ষণ পর সে টোকা দিয়েছিল। এমিলি অবাক হয়ে গিয়েছিল জনকে দেখে। ওর পড়নে ছিল ব্রা আর প্যান্টি, তার উপরে নাইট গাউনটা চাপানো। জন জিজ্ঞাসা করেছিল লোক টা কে, কি সম্পর্ক। শোবার ঘরের আগোছাল বিছানা দেখে রাগে বেড়িয়ে চলে গিয়েছিলে রুম থাকে। এই ঘটনা লেখা ছিল এমিলির ডাইরিতে। পরে এমিলি ডাইরির ওই পাতাটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল ডাস্ট বিনে।

পরদিন জন এসেছিল এমিলির রুমে, হাতে ছিল লোহার বল। ওটা দিয়ে আঘাত করেছিল এমিলির মাথায়।

থম্পসন থামল। বলল, “ হুড দিয়ে ঢাকা মুখ, চেনা যায়নি। কিন্তু হাতের ঘড়িটা ঢাকতে পারেনি। জনের হাতে ওই ঘড়ি আমি দেখে ছিলাম। অনেক চুলের মাঝে একটা চুলের ডিএনএ ম্যাচ করেছিল জনের সাথে। তবুও তাকে ছেড়ে দিয়ে ছিলাম। কারণ এই প্রমাণ আদালতে ধোপে টেকবেনা। তবে তোমাকে লেখা চিঠির থেকে যে চুল পাওয়া গিয়েছিল সেটা ম্যাচ করেছিল ওর ডিএনএ র সাথে। রান্না ঘরের সারভেলেন্স ক্যামেরায় ওঠা ছবিতে দেখা গিয়ে ছিল ওর মুখ।

ডাইরির পাতাটা রহস্য উন্মোচন করতে সাহায্য করেছিল। ডাইরিটা খুঁজে পাওয়া যাইনি এমিলির ঘরে। পাওয়া গিয়েছিল জনের গাড়ীতে। এমিলির ডাইরিতে লেখা ছিল তোমার কথা। এমিলি তোমাকে ভুলতে পারেনি। কাল্পনিক ভাবে তোমাকে জড়িয়ে লেখা ছিল অনেক প্রভোকেটিভ কথা। তারই মাসুল তোমাকে দিতে হচ্ছিল সেই রাতে।” বলে থম্পসন থামল। “খুন করতে সে আসেনি। এসেছিল সারপ্রাইজ দিতে। কিন্তু ভাগ্যের লিখনতো খণ্ডাতে পারবেনা।”

থম্পসন শেষ করলো তার বক্তব্য। নীস্তবতা গ্রাস করে রইল কিছুক্ষণের জন্য।

আনন্দ বলল ,” এবার আমার ছুটি। বাড়ী ফেরার পালা।”

সানন্দা কে কল করলো।

“ কবে আসবে” জিজ্ঞাসা করল সানন্দা

“কাল”

“ সাবধানে এসো। আমি এয়ারপোর্টে থাকব।”

ক্রমশ

You may also like

7 Comments

  1. অপূর্ব ।আসলেই তুমি রহস্য গল্প লিখতে সিদ্ধহস্ত ।নিশ্বাস রুদ্ধ করে পড়ছিলাম।খুবই ভালো লাগলো।

  2. বড় তাড়াতাড়ি রহস্যের সমাধান হয়ে গেল।আর একটু ঘোরালো করতে পারতে।বাকি সব ভালো।তবে যে আগ্রহ নিয়ে খুনির জন্য অপেক্ষা করছিলাম তুমি দ্রুত তাতে পানি ঢেলে দিলে। দেখা যাক এরপর কাহিনী কোন দিকে মোড় নেয়।

  3. আনন্দ বাবু আপনি লিখে জান অনেক অনেক সুন্দর হয়েছে আপনার কাহিনি আরো সুন্দর সুন্দর কাহিনি নিয়ে লিখেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *