নতুন জীবন

                                                                         নতুন জীবন

   শফিক তার তল্পী তল্পা নিয়ে এসে উঠলো এক ঘর বেষ্টিত এপার্টমেন্টে। ছেলে মেয়েরা গোছায়ে দিয়ে গেছে এক চিলতে শোবার আর এক চিলতে বসার ঘর টা। বলে গেছে, বাবা এই ক্লোজেটে থাকলো তোমার জামা আর প্যান্ট, হাঙ্গারে ঝুলানো। পাশের এই ড্রয়ারে থাকল তোমার আন্ডার গারমেন্ট গুলো। এই ঝুড়িটার ভিতর রাখবে তোমার ময়লা কাপড় গুলো। বাহিরে যেতে হবেনা । রান্না ঘরের পাশেই আছে ওয়াসার আর ড্রায়ার। পরিষ্কার করে নিও।

শফিক বলেছিল, ঠিক আছে মনে থাকবে। কবে যে সে শেষ ওয়াসার আর ড্রায়ার ব্যবহার করেছিল মনে করতে পারেনা। যদিও সেই বিশাল বাড়ীর নিচের তালাতেই ছিল সব কিছু। এসব নিয়ে মাথা সে কোনদিনই ঘামায়নি। এতদিন তো নুবীয়া এসেই সবকিছু করে দিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে বলত, মিস্টার, সব কিছু ধুয়ে ভাজ করে রেখে গেলাম, এখান থেকে নিয়ে নিয়ে পড়বে। আমি আবার দুই সপ্তাহ পরে আসবো।

 শফিক জিজ্ঞাসা করেছিল আসবে তো আমার এপার্টমেন্টে? দুই সপ্তাহে না হয় নাইবা এলে, তিন সপ্তাহ পরে হলেও চলবে।

নুবীয়া রাজি হয়নি। বলেছিল বন্ধের দিন সে কাজ করেনা।

শফিকের বাসাটা ছোট হলেও ছিমছাম। শোয়া বসা আর রান্না ঘর ছাড়াও একটা ছোট্ট বেলকনি আছে। ওখানে বসলে সামনের ফুলের বাগানটা চোখে পরে। রংবেরঙের ফুল দিয়ে সাজানো।

সব মিলে দশটা পৃথক পৃথক তিন তালা বাড়ী। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সুন্দর করে ছাটা লন। চারিদিকে লোহার বেড়া। ঝুট ঝামেলা নেই। নেই কোন পথচারীর হাঁটাচলা । নেই কোন হট্টগোল।

শফিক প্রথমে আসতে চায়নি। ছেলে মেয়েরাই জোর কোরে নিয়ে এসেছে। বলেছিল, বাবা, এত বড় বাড়ী ছেড়ে কারোর বাড়ীর নিচের তলায় মাথা গুজলে তুমি বাজবে না। তোমাকে থাকতে হবে সুন্দর খোলা মেলা নতুন তৈরী এপার্টমেন্টে।

শফিকের কোন না ছিলনা। ওরাই সব ব্যবস্থা করেছিল। সব কিছু শেষ করে এসে বলেছিল, আব্বু সব ঠিক হয়ে গেছে। দোতালায় তোমার ঘর। বেশি উপরে উঠতে হবেনা। পারকীংও কাছে। শুধু টাকাটা পাঠিয়ে দিও।

এতো এক নতুন জীবনের শুরু।

 শফিক কফির পেয়ালা টা নিয়ে এসে বসলো বেলকনিতে। বিকেলের সূর্যের তাপটা উপভোগ করার মত।  ভাবছিল, বিয়াল্লিশ বছর আগে এসে উঠেছিল এক এপার্টমেন্টে, আজ বিয়াল্লিশ বছর পরে ফিরে এলো সেই জায়গায়। শুধু মাঝের সময় টা  সিনেমার পর্দায় দেখা ছবি। আরম্ভ হয়েছিল হাসি আনন্দ, হৈ, হুল্লা করে। শেষে হোল চোখের জল ফেলে। আলো জ্বেলে উঠলো। পর্দা সাদা। শুধু রেশটা রইল আর কিছু রইল না।

এ শুধু ওর জীবনেই নয়, একিই ঘটনার প্রতিফলন ঘটেছে অনেকের জীবনেও। কেউ আবারও জড়িয়ে গেছে অন্যের জালে। ভেবেছে এপথে সে পাবে আলোর সন্ধান, পাবে মানসিক শান্তি। কেউ বা ভাবছে নামাজ কালামের মাঝে ফিরে পাবে তার সুখ শফিক পাবে কি সে?

     শফিক চাইছে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বিকেলের রৌদ টা উপভোগ করতে। উপভোগ করতে চাইছে খোলামেলা ছোট্ট এপার্টমেন্টটা। পা বাড়ালেই মুভি হল। বায়ে মোড় নিলে বিশাল পার্ক। খাবারের বড় বড় রেস্টুরেন্ট গুলো বেশি দূরে নয়।

হাটা পথ।

   আগের মতো অন্ধকার ঘর গুলো আর তাকে গ্রাস করবেনা। কিছুক্ষণ আগে সবাই কে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিয়েছে নতুন  ঠিকানা দিয়ে। অনেকে অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছে, নতুন জীবন নতুন ভাবে শুরু হোক এই কামনা করি। আমরাও একদিন হবো এপথের পথিক।

ফোন টা বেজে উঠল।

 ওপাশে সামন্তীর কণ্ঠস্বর। বন্ধুত্ব অনেক দিনের।

 কেমন লাগছে?  নতুন জায়গা, নতুন ঘর। জিজ্ঞাসা করলো সে।

 অনুভূতি টা তোমাকে ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারবো না। বলল শফিক

আমরা চার বন্ধু বান্ধাবী শেষ তোমার বাসাতে রাত কাটিয়ে ছিলাম মনে পরে?

তা আর পরবেনা, তুমিই তো নিয়েছিলে সবচেয়ে বড় ঘরটা। এখন একটা শোয়া আর একটা বসার ঘর। পারবে এসে থাকতে? জিজ্ঞাসা করেছিল শফিক।

কোথাও থাকতে জায়গা লাগেনা, মন লাগে। সে মন আমার আছে শফিক। বলেছিল সামন্তী।

আজ রাখি। তুমি সব গুছিয়ে নাও। আসব একদিন। শুধু একটা কথা বলি তোমাকে,” I am so proud of you.” বলে ফোন টা রেখে দিয়েছিল।

 সন্ধ্যা হয় হয়। পাশের বাড়ীর ঘর গুলোতে বাতি জ্বলে উঠল। এ দৃশ্য সে দেখেনি অনেক দিন। শুধু দেখে এসেছে বড় বড় বাড়ী। এক এক বাড়ীতে এক একটা ফ্যামিলি। সন্ধ্যার পর অন্ধকারে ঢেকে যেতো চারিদিক। পাশের বাড়ীর কুকুরটা মাঝে মাঝে চিকন সুরে ডাক দিতো। দু একটা গাড়ী সাঁ করে চলে যেতো।

আজ মনে হচ্ছে ছোট ছোট আলোর কনা চারিদিকে। উপরে, নিচে, মধ্যে। ঘরের মাঝে দু এক জনের চলাফেরা দেখতে পাচ্ছে শফিক তার বেলকনিতে বসে। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা।

সামনে শীতের মাস। শফিককে ভাবতে হবেনা বরফ পরিষ্কারের কথা। ভাবতে হবেনা এন্টোনিও কে ডাকার কথা। বলতে হবেনা ড্রাইভওয়ে টা পরিষ্কার করে দিয়ে যাও আমার গাড়ী বের করতে হবে। এ কথা ভাবতে যেয়ে শফিকের মনে পড়ল অনেক বছর আগে ওরা ভেবেছিল পড়ন্ত বয়সে এই রকম এপার্টমেন্টে এসেই ঠাঁই নেবে, তবে সেটা হবে দুই থেকে তিন ঘরের।

কফি টা ফুরিয়ে এলো। আবার উঠতে হবে। ভাতের চাল টা বসিয়ে দিয়ে একটু বাহিরে হাটতে যাবে, ভাবল শফিক।

অনেক দিন ঝলমলে আলোর নিচে হাটা হয়নি। অন্ধকারে পাশের পার্কে যেতে মন চাইছে না। এসে দাঁড়াল ফুলের বাগানের চত্বরে।  সামনে আলোয় আলোকিত রাস্তা। শফিককে ডাকছে। শফিক পা বাড়াল সেই পথে।

 

You may also like

5 Comments

  1. অল্প কথা দিয়ে অনেক গুছিয়ে লেখা।অনুভূতির প্রকাশ খুব সুন্দর।ভালো লাগলো পড়ে।

  2. তোমার বাড়ীর বরননা পড়েমুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমার মনে হয় ভালো সময় কাটবে তোমার এখানে। জীবনতো এমনই। সময় সময় অনেক কিছু ছেড়ে দিতে হয়।এও একটা অভিগতা। এই ব্যালকনিতে বসে আরও লেখা লিখবে তুমি।ভালো থেকো।

  3. আপনার নুতন জীবন সুন্দর হক দোয়া করি আরো সামনের জীবনে আল্লাহ যেন আপনাকে সুস্থ রাখেন আরো সুন্দর সুন্দর গল্প লিখার খমতা দেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *