নাম না জানা মেয়েটা

       সন্ধ্যা হয় হয়। জমির আলী রিক্সাটা দাড় করিয়ে মাথার ঘামটা মুছে নিলো হাতের গামছা দিয়ে। শেষ ভাড়াটা ছিল দূরপাল্লার। প্রথমে যেতে চায়নি। বয়স হয়েছে। ইদানীং বেশি ঘণ্টা রিক্সা চালাতে অসুবিধা হয়। মাথাটা ঝিমঝিম করে। কিন্তু কোন উপায় নেই। সংসার চালাতে হবে। বৌ সকালে উঠে চলে যায় গারমেন্ট ফ্যাক্টরিতে। ফিরতে রাত হয়। ছেলে মেয়ের মুখ এই জন্মে দেখা হলনা। মাঝে মাঝে বৌ মন মরা হয়ে বসে থাকে। জমির আলী সান্ত্বনা দেয়।

বলে,” মন খারাপ করোনা বৌ। সবই আল্লার ইচ্ছা”। কোন কোন দিন শেষ যাত্রীকে নামিয়ে চলে যায় জামীলার ফ্যাক্টরিতে।

দুজনে একসাথে ফেরে বাসাতে।

 “ এই চলো” বলেই এক বিদেশী উঠে পড়লো ওর রিক্সাতে। চেহারায় আতঙ্কের ছাপ।

 “ তাড়াতাড়ি চলো” বলল ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায়।

কোন কিছু ভাববার সময় পেলনা জমির আলী।

কোথায় যেতে হবে? জিজ্ঞাসা করল ।

তোমার যে দিকে মন চায়। টাকার কথা ভেবো না। শুধু অলি গলি দিয়ে জোরে চালিয়ে যাবে।

কথা শেষ হলনা। একটা কালো রং এর গাড়ী পাঁশে আসে দাড়াতেই লোকটা লাফ দিয়ে রিক্সা থেকে নেমে দৌড় দিলো। হারিয়ে গেলো ভিড়ের মাঝে।

এত দ্রুত সব ঘটে গেলো যে জমির আলীর কিছুক্ষণ সময় লাগলো বাস্তবে ফিরে আসতে।

কালো গাড়ীটা জোরে শব্দ করে বেরিয়ে গেলো।

জমির আলী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তাকাল পিছনে। দেখল কি যেন পরে আছে রিক্সার পা দানিতে। একটা এনভেলাপ।

উঠিয়ে নিলো। খুললও এনভেলাপটা। ভিতরে কয়েকটা ফটো। একটা মেয়ের। সুন্দর দেখতে। ফটো গুলো উঠানো মলের ভিতর।

মলটা চেনা মনে হোল জমির আলীর। চারি দিকে তাকাল সে। অজান্তে গাটা শিরশির করে উঠল।

রিক্সার গদী টা উঠিয়ে এনভেলাপটা রেখে দিল।

এখনও দুঘণ্টা দেরী জামীলার ছুটি হতে।

“এইযে ভাই যাবেন?”

তাকাল জমির আলী।

মা তার ছোট্ট মেয়েটার হাত ধরে তাকিয়ে আছে  উত্তরের অপেক্ষায়।

জামির আলী ভেবেছিল আর কোন প্যাসেঞ্জার নেবেনা।  বিশ্রাম নেবে। কিন্তু পরিস্থিঁতি ঘোলাটে হওয়াতে দুজনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তাছাড়া এই ঘটনার পরে এখানে থাকাটাও সমীচীন নয়।

“ কোথায় যাবো”?

“ রায়ের বাজার।“

চালাতে চালাতে শুধু মনে হতে লাগল এই বুঝি কালো রঙের গাড়ীটা পাঁশে আসে দাঁড়াল।

 ঘিঞ্জি এবড়ো থেবড়ো রাস্তা পাড় হয়ে সে এসে দাঁড়াল রায়ের বাজারের একতালা  বাড়ীটার সামনে।  টাকা মিটিয়ে দিয়ে মহিলা বাড়ীর ভিতর ঢুকতে যাওয়ার আগে জমির আলী জিজ্ঞাসা করল

“কটা বাজে, মেমসাব”?

“সাত টা” বলে ভদ্রমহিলা বাহিরের দরজা টা বন্ধ করে দিলো।

বাহিরে ছাউনী দেওয়া চা’র দোকানে এসে বসলো জমির আলী।  গরম চা টা ফু দিয়ে ঠোটের কাছে ধরল। আরও  একবার ফু দিয়ে কিছু পরিমাণ  ঢেলে দিলো মুখের ভিতর। সারাদিনের ক্লান্তির পর এযেন অমৃত মনে হোল।

একটা নন্তা বিস্কিট ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেলো।  এখনো হাতে কিছু সময় আছে জামীলাকে আনতে যাওয়ার।

চা টা শেষ করে রিক্সার পাঁশে এসে দাঁড়াল জমির আলী। গদীর নীচ থেকে বের করল এনভেলাপটা।  দেখল আবার। কি যেন রহস্য আছে এর  মাঝে মনে হোল জমির আলীর।

জামীলাকে কিছুই জানালো না সে।  পরের দিন রিক্সা চালিয়ে কিছু টাকা হাতে আসতেই জমির আলী চলে এলো সেই মলের সামনে। এযেন এক অদৃশের টান। রিক্সাটা রাস্তার পাঁশে রেখে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো উপরে। হাতে এনভেলপটা। ফটো টা

 আর একবার দেখল।

 দোতালায় এলো জমির আলী। জয়ন্তী জুয়েলারস। এর সামনে তোলা ছবি। আশে পাঁশে কয়েকবার হাঁটল সে। ভেবে ছিল মেয়েটাকে এখানে দেখতে পাবে। আর দেখতে পেলে ওর ছবি ওকে ফিরিয়ে দেবে।

না, কোন কিছু চোখে পড়লনা জমির আলীর। ছবিটা যে কাউকে দেখাবে সে ভরসাও পেলোনা। অগত্যা এস্কেলেটর দিয়ে নিচে নেমে এলো। বাহিরে এসে দাঁড়াল। ভাবল একটা সিগারেট টানলে মন্দ হয়না।

সামনেই দোকানে।  সিগারেট কিনে পাশ ফিরতেই চোখে পড়ল দুই টা লোক কিছু দূরে দাড়িয়ে  তাকিয়ে আছে ওর  দিকে । ওদের দুজন কে সে জয়ন্তী জুয়েলারসের সামনে দেখেছে। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে তাকাল সামনের দিকে ঝুলিয়ে রাখা  খবরের কাগজের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল কাগজটার দিকে। সারা শরীর হীম হয়ে এলো। এতো সেই মেয়ের ছবি সাথে সেই বিদেশির। বড় বড় করে লেখা, “ যমুনা হোটেলে জোড়া খুন”।

জমির আলী বুঝতে পারল নিজের অজান্তে সে কীসের মাঝে জড়িয়ে পড়েছে।

 তাড়াতাড়ি রিক্সার দিকে রওনা হোল। ভাবল, বাসায় যেয়েই ছবি গুলো পুড়িয়ে ফেলবে। আর গোয়েন্দা গিরি নয়।

  রিক্সা পর্যন্ত পৌছাতে পারলনা জমির আলী। সেই দুজন ষণ্ডা মার্কা লোক এসে দাঁড়াল ওর দুপাশে। ওদের চোখ এনভেলাপটার দিকে। জিজ্ঞাসা করল,” এই এনভেলপটা কোথায় পেয়েছ?”

আমতা আমতা  করে কিছু বলার আগেই জমির আলীর মনে হোল এনভেলপটা রেগুলার এনভেলপের মতো নয়। করাতের দাতের মত দুপাশে খোঁদায় করা। আর দুইটা কোদালের ছবি। এই ভিন্ন ধরনের এনভেলাপ টাই যত নষ্টের মুল।  এটার জন্যেই সে ওদের নজরে পড়েছে।

 উত্তরের অপেক্ষা না করেই একজন ওর হাত থেকে এনভেলপটা নিয়ে নিলো। অন্যজন ইশারা করে দেখাল ওর হাতের রিভলভারটা। জমির আলীর সারা শরীর দিয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে। গলা শুকিয়ে গেছে। ওকে নিয়ে এলো ওরা রাস্তার ওপাশে দাঁড়ান সাদা মারসেডিসের কাছে। কালো টিনটেড গ্লাসে ঢাকা চারিদিক। বাহিরের থেকে কিছুই দেখা যায়না।

  একজন দরজা খুলে দাঁড়াল। অন্যজন আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে গাড়ীর ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো জমির আলীকে।

  ভিতরে বসে আছে তিনশ পাউন্ডের একটা লোক। দরজা বন্ধ হতেই ষণ্ডা মতন লোকটা এনভেলপটা এগিয়ে দিলো মোটা লোকটার দিকে।

 “বস, এই সেই এনভেলপ।“ বলে জমির আলীর দিকে তাকিয়ে নেকড়ের হাসির মতো হাসি দিলো।

মোটা লোকটা এনভেলপ থেকে ছবি গুলো বের করে পাশে রেখে দিলো। ঊল্টা পালটা করে কয়েক বার দেখলও  এনভেলপটা । কি যেন খুজছে , পাচ্ছে না।

তাকাল জমির আলীর দিকে। জমির আলীর আত্মা তখন খাচা ছাড়া।  বুজতে পাড়লো না কি সে খুজছে।

“ Where is that paper? কাগজটা কোথায়?” হুঙ্কার দিয়ে উঠলো মোটা লোকটা।

“কাগজ? কোন কাগজ?” কান্না কান্না স্বরে বলল জমির আলী।

গলা টা টিপে ধরল। জমির আলী নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো।

ছুড়ির ধারাল ফলা ওর গালের কাছে ধরল মোটা লোকটা। একটু চাপ দিতেই রক্ত গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে।

 ভয়ে থর থর করে কাঁপছে জমির আলী।

লোক টা ছুরির ফলাটা গাল থেকে সরিয়ে এনে ছোঁয়াল ডান চোখের পাশে। হাতের ইংগিতে বোঝাল চোখ টা উঠিয়ে আনবে।

জমির আলীর মনে পড়ল একটা কাগজ সে দেখে ছিল এনভেলাপের মধ্যে। হিজি বিজি কি সব লেখা ছিল। ভালো করে তাকিয়ে দেখেনি। ওটা সে রিক্সার পা দানিতে ফেলে দিয়ে ছিল।

মনে মনে সে ভাবল এই সুযোগ, রিক্সাতে আছে বলে সে যদি একবার এই গাড়ী থেকে বের হতে পারে তাহলে দেবে ছুট। কপালে যা থাকে।

লোকটার ছুরি টা ওর বুকের কাছে আসার আগেই জমির আলী বলল রিক্সাতে রেখে এসেছে সেই কাগজ টা।

 চোখে ইংগিত করতেই একজন জমির আলিকে নিয়ে বেরিয়ে এলো গাড়ী থেকে।

বেরিয়েই জমির আলী দেখল সামনে দাঁড়ান দুই টা পুলিশের গাড়ী।

চারিদিকে তাকালও একবার।

 চিৎকার করে উঠলো, বাচাও বাচাও বলে।

কিছু লোক তাকাল জমির আলীর দিকে। পুলিশ দৌড়িয়ে এলো স্টেনগান হাতে।

লোকটা  ভড়কিয়ে যেয়ে দৌড় দিল গাড়ীর দিকে। ততক্ষণে পুলিশ এসে ঘিরে ফেলেছে গাড়ীটা।

ভিতর থেকে বের করে আনা হোল মোটা লোকটাকে।  সাথে ফটো গুলো।

পুলিশের কর্তা ফটো দেখে বলল,” এই মেয়েটাই কাল রাতে খুন হয়েছে যমুনা হোটেলে। পাশে পাওয়া গেছে এই মলের ছবি”।

জমির আলী কাঁদতে কাঁদতে বলতে যাচ্ছিল সব কথা। পুলিশের বড় কর্তা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,” থানাতে যেয়ে সব শুনব।“ এই কথা বলে পাশে দাঁড়ান পুলিশ কে বলল একটা রুমাল জামির আলিকে দিতে গালের ক্ষত জাগায় চেপে ধরার জন্য।

রুমাল টা চেপে ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,” স্যার, আমি একটু আমার রিক্সার কাছে যেতে পারি?”

উদ্দেশ সেই কাগজটা। পড়ে আছে, কি নেই।

আছে, পাদানিতেই পড়ে আছে। আস্তে  করে উঠিয়ে নিলো জমির আলী। পরে খতিয়ে দেখবে কি আছে ওই লেখার মাঝে।

পুলিশ মোটা লোকটা আর সাথের সঙ্গী দুজনকে উঠিয়ে নিলো পুলিশের গাড়ীতে।

জমির আলী কেও নিয়ে এলো থানাতে। ওর বয়ান শেষে চলে যেতে বলল ওকে।

বাসায় এসে সব ঘটনা বলল জামীলাকে। দেখালও চিরকুটটা। ইংরাজিতে লেখা একটা ঠিকানা।

দুই দিন পরে খবরের কাগজে বড় বড় করে লেখা ৬৬৬ বান্দর লেন থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে প্রচুর হীরক সাথে অস্ত্র, কয়েকশো রাউন্ড গুলি।

জমির আলী পড়ল সংবাদটা। কাগজটা বের করে দেখল ঠিকানাটা।  ৬৬৬ বান্দর লেন।

ভাবল, আহ, একটু আগে যদি সে যেতে পারত।

তাহলে———— হীরা–

 

You may also like

6 Comments

  1. খুব ভালো হয়েছে।নতুন বাড়িতে এসে দেখ কত সুন্দর একটা লেখা বের হলো তোমার হাত দিয়ে। ছোট্ট লেখা কিনতু চমতকার।এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম।

  2. অসম্ভব সুন্দর একটা লেখা। খুব ভালো লাগলো পড়ে।finishingটা চমৎকার।

  3. Soo nice story,read this story in one breath…….incredible. Also ending has something which makes me to think a lot…….enjoy it.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *