প্রতিশোধ

বাংলো টাইপের বাড়ী। অনেক জনতার ভিড়। পুলিশের গাড়ী। উৎসুক জনতার মুখে শুধু একটাই কথা, “খুব ভালো হয়েছে। পাপের শাস্তি আল্লাহ দুনিয়াতেই দিয়ে দেয়”।

 রাখালের লাশ বাঁধা তার বাংলো বাড়ীর এক পিলারের সাথে। পাঁচটা তীক্ষ্ণ ছুরি গাঁথা তার বুকে। একটা ছুরি হৃদপিণ্ড ভেদ করে বেরিয়ে গেছে ওপর পাঁশে। রক্ত ঝরছে।

   রাখালের অত্যাচারে অতিষ্ঠও হয়ে উঠেছিল এই উপজেলার লোক। খুন খারাবি, চাঁদা বাজি, নারী ধর্ষণ এ ছিল তার  নিত্য নৈমিত্বিক ব্যাপার। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল টাকা দিয়ে। কেউ কোন নালিশ জানালে পরদিন তার লাশ পাওয়া যেতো নদীর ধারে। ভয়ে সবাই তটস্থ।

  রাখালের বাবা কাজ করতো এক কাপড়ের দোকানে। বাড়ী ছিল আরাপপুর গ্রামে। একদিন বাসায় এসে তাহেরা কে ডাক দিয়ে বলল,” রাখালের মা আমাকে এক গ্লাস পানি দাও, বুকটা যেন কেমন করছে”। পানি আর পান করা হয়নি। তার আগেই সব শেষ। রাখালের বয়স তখন বারো। ওর মা দিশাহারা। শোঁকের ছায়া মিলিয়ে যেতেই দেখতে পেলো সে কর্পদহীন। আত্মীয় স্বজন চলে গেছে যার যার পথে। কাজ নিয়ে ছিল চেয়ারম্যানের বাড়িতে। কাজ শেষে কিছু খাবার নিয়ে আসত বাসায়। তাই খেয়ে দুজনে রাত কাটাত। কিছু কিছু দুষ্ট লোকের উপদ্রব যে ছিলনা তা নয়। মার বাড়ন সত্ত্বেও রাখাল কাজ নিয়ে ছিল বাবার এক বন্ধুর দোকানে। অতি অল্প বয়সে পৃথিবী টাকে চিন্তে শিখলো।

 শেফালী, তাহেরার এক দুঃসম্পর্কের খালাতো বোন, খবর পেয়ে এলো দেখা করতে। থাকে কাঞ্চনপুর উপজেলায়। অবস্থা ভালো। ছেলে,মেয়ে নেই। তাহেরার চেয়ে বয়সে বড়। শেফালীকে দেখে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরল তাহেরা।

“ আমার কি হবে শেফালী আপা ? কি হবে?” বলতে বলতে কান্নার স্বর দ্বিগুণে উঠল।

শেফালী ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,” সেই জন্যই তো আমি এসেছি। তোকে নিয়ে যাবো আমার কাছে। আমার তো কোন অভাব নেই। শুধু একটারই অভাব। বাসা খালি। উনি তো বাইরে বাহিরেই থাকে কাজ কর্ম নিয়ে। আমার কথা বলার লোক নেই। তোর সাথে কথা বলে সময় কাটবে ”।

তাহেরার চোখের জলের বাঁধ ভেঙ্গে পড়ল। কি উত্তর দেবে সে জানিনা। শুধু বিধাতার কাছে হাত তুলে বলেছিল,” তুমি আছো। তুমি আমার দিকে মুখ তুলে চেয়েছ”।

রাখাল যেতে চায়নি। বলেছিল,” আমরা কষ্ট করে দাড়াতে পারবো না? মা?”

না, পারবো না। রাতে বেরাতে উপদ্রব সহ্য করেতে পারবো না। তুমি ছোট, তুমি বুঝবেনা।

সাত দিনের মধ্যে তল্পিতল্পা গুছিয়ে রওয়ানা হয়েছিল। ফেলে রেখে গেলো পুরনো দিনের স্মৃতি।

মনে পড়লো তাহেরার, কাজ শেষে জসীম ফিরে আসতো এই ছোট্ট ঘরে। তাহেরা আগিয়ে দিতো গামছা টা। বলত,” হাত মুখ ধুয়ে এসো, আমি ভাত বাড়ছি”।

জসীম খোজ নিতো রাখালের। “ কোথায় সে? সন্ধ্যা হয়ে এলো”।

তাহেরা ছেলেকে সামাল দিতে যেয়ে বলত,” মাঠে গেছে বন্ধুদের সাথে খেলতে। এখনি আসবে”।

“ ভালো করে লেখা পড়া করতে বলো, তা না হলে আমার মতো পরের দোকানে কাজ করে সারা জীবন কাটাতে হবে”।

যেতে যেতে আজ সব কথা মনে পড়ছে তাহেরার। বার বার ফিরে ফিরে তাকাল বাড়ীটার দিকে। দিয়ে গেলো জসীমের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে। বলেছিল,” ভাইজান, আপনি রইলেন, দেখা শোনা করে রেখেন। বাকি আল্লাহ ভরসা”।

 পৌছাতে পৌছাতে রাত হয়ে গিয়েছিল। কুতুব আলী, শেফালীর স্বামী তখনো ফেরেনি। খাওয়া শেষে শেফালী ওদের ঘর দেখিয়ে দিয়ে বলেছিল,” শুয়ে পড়। কাল সকালে রাখাল কে নিয়ে আমি স্কুলে যাবো। ওকে ভর্তি করে দেবো”।

রাখাল শুনছিল। একটা কথাও বলল না। স্কুলে যাওয়ার মন তার আর নেই। শুধু থেকে থেকে বাবার কথা মনে পড়ে।

মার মতো এতো সহজ ভাবে সে এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারে নি।

আফসারউদ্দিন, কাঞ্চনপুর উপজেলার দারোগা। ক্রাইম সিনের কাছে এসে বললেন সবায় কে সরে যেতে এখান থেকে।  রহমত তার এসিসটেন্ট। দুজনে ঘরে ঢুকল। আসবাব পত্র সব ঠিক মতো সাজানো। কেউ জোর করে ঢুকেছে মনে হোল না। হত্যা করার আগে মনে হোল  রাখালকে বাঁধা হয়েছিল পিলারের সাথে। মুখে ছেড়া কাপড় ঢুকানো। যাতে চিৎকার করতে না পারে। পাঁচটা ছুরির কোনটাতে হাতের ছাপ নাই। হত্যাকারী অথবা হত্যাকারীদের হাতে গ্লোভস ছিল মনে হয়। খুব প্লান মাফিক এই হত্যা করা হয়েছে। আফসারউদ্দিন লাশ পোস্ট মরটম করতে পাঠিয়ে দিতে বলে অফিসের দিকে রওয়ানা হোল।  যাবার আগে রহমতকে বলে গেলো কাজ শেষে তার সাথে দেখা করতে।

রহমতের কাজ শেষ করে আসতে আসতে দুই ঘণ্টা লেগে গেলো। ঘরে ঢুকতেই আফসারউদ্দিন বলল,” রাখালের যারা ডান হাত তাদের কে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করো । এরেস্ট করে নয়। বলবে, ইনটারওগেশনের জন্য ডাকছে। সেই সাথে রাখালের বিপরীতে, যারা ওর শত্রু তাদের নাম গুলো আমার দরকার”।

রহমত চলে গেলো।

নিয়ে এলো ফরিদ, পিকলু, শাহাদত কে। অনেক কুকর্মের সাথে জড়িত।

ফরিদকে নিয়ে আফসারউদ্দিন বসলেন ইনটারওগেশন রুমে।

“ কত দিনের পরিচয় রাখালের সাথে?” প্রশ্ন আফসারউদ্দিনের

“ অনেক দিনের স্যার।“

“বলে যাও”।

“ জুভীনাইল ডিটেসশন সেন্টারে ওর সাথে আমার দেখা। আমাদের দুজনের বয়স ছিল বারোর কাছাকাছি। ওকে গ্রেফতার করা হয়েছিল খুনের দায়ে”। বলে একটু থামল।

তারপর? কাকে খুন করেছিল ?

“ কুতুব আলিকে, যার বাসাতে ওরা থাকত। ও বলেছিল, একদিন স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল সময়ের আগে। বাসায় আসতেই শূনতে পেলো মার চিৎকার। দৌড়ে যেয়ে মার ঘরের দরজা খুলতেই দেখতে পেলো কুতুব আলী ওর মা কে জাপটে ধরেছে বিছানাতে। ওর মা চিৎকার করছে আর পা দিয়ে লাথি মারার চেষ্টা করছে। হিতাহিত জ্ঞান ছিলনা রাখালের। পাঁশে পড়েছিল এক বড় কাঠের টুকরা। সেটা উঠিয়ে জোড়ে মারলও কুতুব আলীর মাথায়। ছিটকে পড়লো কুতুব আলী। উঠবার চেষ্টা করতেই  আর একটা আঘাত আনলো ওর মুখে। নীস্তেজ হয়ে গেলো কুতুব আলীর দেহটা। রক্ত ছিটকে পড়েছিল রাখালের গায়ে। ওর মা থরথর করে কাঁপছিল। জড়িয়ে ধরেছিল রাখালকে। বলেছিল,” তুই চলে যা। আমি বলব আমি মেরেছি”। রাখাল যায়নি।

শেফালি বাহিরের থেকে ফিরে আসতেই তাহেরা বলেছিল সব। সে বিশ্বাস করেছিল কিনা জানেনা। পুলিশ ডেকে ছিল।

রাখালকে হাতকরা দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল থানায়। মাকে সেই তার শেষ দেখা। রাখালের জেল হয়েছিল দশ বছরের। সেই খানে আমার সাথে তার দেখা”। বলে থামল।

“আমি তো শুনেছি তোমাদের মধ্যে মন মালিন্য ছিল বিভিন্ন কুকর্মের নেতৃত্ব নিয়ে?” জিজ্ঞাসা করলো আফসারউদ্দিন।

 ফরিদ সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, “আমি খুন করিনি স্যার। ঐ সময়ে আমি কাঞ্চনপূরে ছিলাম না স্যার। আপনি খোজ নিয়ে দেখতে পারেন”।

ঠিক আছে বলে আফসারউদ্দিন ওকে যেতে বলল। আরও বলল এই এলাকা থেকে বাহিরে কোথাও যেন না যায়।

এরপর পিকলু কে ডেকে পাঠালও। বডি বিলডার। উচ্চতা ছয় ফুটের কাছাকাছি।

বসতে বলে বলল, তুমি তো রাখালের বডিগার্ড ছিলে? তাইনা?

কোন উত্তর দিলো না পিকলু। আফসারউদ্দিন জিজ্ঞাসা করলো কি ভাবে তার সাথে পরিচয়।

“ দেখা হয়েছিল মদন মোহন সরকারের চা র দোকানে। রাখাল আর ফরিদ এসেছিল টাকা নিতে। প্রতিমাসে বরাদ্দ ছিল কোন দোকান কত টাকা দেবে। ফরিদের কাছে শুনেছি জেল থেকে বেরিয়ে সে খুজেছিল মা কে। ওর মা ফিরে গিয়েছিল দেশের বাড়িতে। পাঁচ বছর আগে মারা গেছে। সেই শুরু। খোজ নিয়ে ফরিদের সন্ধান পেয়েছিল। দুজনে মিলে গরে তুলেছিল সংগঠন। ফরিদ এসে আমাকে বলেছিল দেখা করতে রাখালের সাথে। সেই থেকে পরিচয়”।

“পুলিশের রিপোর্ট অনুসারে পাঁচটা মেয়ের সে সর্বনাশ করেছিল ঐ বাসাতে এবং তুমিই তাদেরকে ধরে নিয়ে এসেছিলে। তাই না”?

“ আপনি তো জানেন, আদালতে তা প্রমান হয়নি”।

“ জানি, এবং এটাও জানি টাকা দিয়ে সবার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল”।

পিকলু এই কথার কোন উত্তর দিলো না।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আফসারউদ্দিন জিজ্ঞাসা করলো।“ খুনের দিন রাতে কোথায় ছিলে? তুমি তো সব সময় ওর সাথে থাকো। পাহারা দাও। ঐ দিন রাতে ছিলেনা কেন। তার মানে তুমি জানতে কিছু একটা ঘটতে চলেছে?”

“ না স্যার, আমার মা অসুস্থ থাকায় আমি ছুটি চেয়ে ছিলাম। রাখাল বলেছিল চলে যেতে। আজ আর সে কোথাও যাবেনা। আপনি খোজ নিতে পারেন আমার গ্রামের বাড়িতে।“

“ যদি সে বলে থাকে আর কোথাও আজ সে যাবেনা, তাহলে কার পরামর্শে এত রাতে বাংলো বাড়িতে গিয়েছিল?”

‘জানিনা স্যার”।

 “ হু, ঠিক আছে তুমি যাও।“ বলে আফসারউদ্দিন রহমত কে ডাক দিলো।

রহমত আসতেই আফসারউদ্দিন জিজ্ঞাসা করলো।“ আচ্ছা তোমার কি মনে আছে বছর দুয়েক আগে ঐ বাংলো তে বিভিন্ন সময়ে পাঁচটা মেয়ের সর্বনাশ করা হয়েছিল। যেটা কিনা আদালতে প্রমান হয়নি।“?

“ হাঁ স্যার, মনে আছে।“

“ কোথায় সেই পাঁচ জন? গ্রামে আছে না গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। খোজ নিয়ে তাদেরকে এখানে আনার ব্যবস্থা করো সাথে যেন গার্ডিয়ান থাকে।

“ আমি এখনি যাচ্ছি স্যার” বলে রহমত বেরিয়ে গেলো

আফসারউদ্দীন তাকিয়ে ছিল সামনের দেয়ালের দিকে। বিভিন্ন ক্রিমিনাল দের ছবি আটকানো। মাথায় শুধু একটা ভাবনাই ঘুরে ফিরে আসছে।

পাঁচটা মেয়ে। পাঁচটা ছুরি।

রহস্য টা ঘনীভূত হচ্ছে। তাহলে কি?

ক্রমশ

(শেষ পর্ব আগামী সোমবার ১২ ই ডিসেম্বর)

 

 

 

 

 

You may also like

5 Comments

  1. অপূর্ব !মানুষ জন্ম থেকে ক্রিমিনাল হয়না,পরিবেশ পরিস্হিতি তাকে ক্রিমিনাল বানায়।সময় উপযোগী গল্প।খুনের রহস্যটা ভালোই জমেছে।ক্রমশটা ভালো লাগলো,”পাঁচটা ছুরি,পাঁচটা মেয়ে”।অপেক্ষায় থাকলাম এরপর কি ঘটে।

  2. ভালো হয়েছে।অপেক্ষায় থাকবো শেষটুকু পড়ার জন্য। আশা করি সেখানেও একটা গলপ থাকবে যা পাঠককে মুগ্ধ হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *