দূর দিগন্ত পারে-২

 ভোর চার টায় এসে পৌছালাম কুয়ালা লাম্পুর এয়ারপোর্টে। এত ভোরে লোক জনের আনাগোনা নেই বললেই চলে।

দুই একটা দোকান খোলা।  সতী পুরো জার্নিতে ঘুমিয়ে এসেছিল। ফলে কিছুটা ফ্রেশ হয়েই সে নামলো। তবুও চেহারায় কিছুটা মলিনতার ছাপ।

 আমরা ট্রানজিট যাত্রী। এর পরের প্লেন পাঁচ ঘণ্টা পর। আভ্যন্তরীণ ফ্লাইট। যাবো Langkawi. মাত্র এক ঘণ্টা লাগবে যেতে।  ইমিগ্রেশন শেষে গেটের কাছে এলাম। বসার জাগায় শুধু আমরা দুজন। সতী কে বললাম,” সতী, তুমি তোমার ব্যাগটা মাথায় দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়। অনেকক্ষণ থাকতে হবে এখানে। আমি একটু ঘুরে দেখে আসি কোথাও নাস্তা পাওয়া যায় কিনা”।

“ যাও, তবে তাড়াতাড়ি চলে এসো। তুমি তো সারা রাত ঘুমাও নি। একটু শুয়ে নিলে পারতে”?

এখন নয়। একেবারে হোটেলে যেয়ে ঘূমাবো।

ভালো লাগলো এই ভেবে যে সতীর স্বাভাবিক আচরণ ফিরে এসেছে। ও শুধু হাসলও। ও জানে হোটেলে যেয়ে ঘুমানোর বান্ধা আমি নই।

 একটা ফাস্ট ফুডের দোকান খোলা। ম্যাকডনালের আকারে সাজানো। তবে স্যান্ডউইচের আকার অনেক ছোট। করণীয় কিছু নেই। অন্যান্য দোকান গুলো খুলতে অনেক দেরী । সতী ও আমি দুজনেই রাতে কিছু খাইনি। এই মুহূর্তে পেটে কিছু দেওয়া দরকার। শুধু তাই নয়, সতী ঔষধ খেতে পারবেনা কিছু না খাওয়া পর্যন্ত। অগত্যা দুটো স্যান্ডউইচ, সাথে এক কাপ কফি আর একটা চা (সতী চা ছাড়া কিছু খায়না) নিয়ে এলাম।

  খাওয়া শেষে সতী উঠে গেলো রেস্ট রুমে। যাবার আগে বলল,” আমি একটু রুপচর্চা করে  আসি। চেহারার যা শ্রী হয়েছে?

ও চলে গেলো। আমি বসে সুটকেস গুলো পাহারা দিতে লাগলাম। এর মধ্যে বেশ কিছু লোক এসে গেছে। সময়ও পেরিয়ে গেছে। সতী এলো। হাল্কা করে প্রলেপ লাগানো মুখে।  সকালের কমল কুসুম আলোয় ওকে সুন্দর লাগছিল।

 জিজ্ঞাসা করলাম,” কি বলও, বৌদির কথা শুনে ভুল করেছ বলে মনে হয়”?

“না, ভুল করিনি”।

যথা সময় প্লেনে এসে বসলাম। একঘণ্টা দশ মিনিটের পথ। সেই তুলনায় প্লেন টি বড়ই বলতে হবে। দুই তিন দুই এই সমন্বয়ে  সীট ভাগ করা। আবারও জানালার পাশের দুটো সীট আমাদের জন্য বরাদ্দ। অবশ্য চেয়ে নিয়েছি। আগেই বলেছি সতীর পছন্দ জানালার পাশে বসা।

  সকাল সাড়ে দশটায় এসে পৌছালাম Langkawi এয়ারপোর্টে। প্লেনে আরোহী খুব একটা বেশি না থাকাতে লাগেজ পেতে দেড়ি হলনা। বাহিরে বেড়িয়ে দেখলাম শুভঙ্করের নাম কাগজে লিখে একজন দাড়িয়ে। যেহেতু সেই সবকিছু ঠিক করেছিল।

হাত উঁচু করতেই ভদ্রলোক এগিয়ে এলো । চারিদিকে সে একবার তাকাল।

  বললাম,” অন্য দুজন আসতে পারেনি”।  একটু হেসে বলল,” আমার নাম রাম। এই মুহূর্তে আমি আপনাদের গাইড।  আসুন”।  এই বলে সে সুটকেস দুটো টেনে নিয়ে গেলো তার গাড়ীতে।

বললাম, “ মিস্টার রাম আমার সিম কার্ড লাগবে, কোথায় পাবো’?

কোন অসুবিধা নেই আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি “। এই কথা বলে পাশে সিম কার্ডের দোকানে নিয়ে গেলো। পকেট থেকে টাকা বের করতে যেয়ে টাকা গুলো পেলাম না। মনে আছে দুশ ডলার ভাঙিয়ে ছিলাম এয়ারপোর্টে। অস্থির হয়ে এ পকেট ও পকেটে বার বার হাত দিতেই সতী ডাকল আমাকে।

“শমিত দা, টাকা তুমি প্যান্টের পকেটে রাখুনী, রেখেছ জ্যাকেটের পকেটে। আর সেই জ্যাকেট আমার কাছে। এই নাও”। বলে টাকা গুলো বের করে দিলো।

বললাম,” দেখতও, তুমি না থাকলে কি অবস্থা হতো। হন্নে হয়ে খুজতাম। আর চুল ছিঁড়তাম”।

“জানি, তোমার ধৈর্য একটু কম”।

 সতী সব কিছুতেই কাম এন্ড কুল। কোন কিছুতেই বিচলিত হয়না। এ একটা মস্ত বড় গুন ওর।

 গাড়ী চলতে চলতে জিজ্ঞাসা করলাম,” রাম, কতদিন আছো এদেশে”?

“ এদেশেই আমার জন্ম স্যার”। বলে আবারও বলল,” আমার বাবা কেরালা থেকে এসে ছিলেন এই দেশে অনেক আগে। আর ফিরে যায়নি। এদেশের পপুলেশনে ইন্ডীয়ানদের পারসেন্টেজ অনেক, স্যার”। বলে গর্বিত ভাবে আমার দিকে তাকাল।

রাস্তার চারিদিকে সারি সারি নারকেল গাছ। ছোট ছোট বাড়ী। মনে করিয়ে দিল বাংলাদেশের ফেলে আসা যশোর শহরের কথা, ফেলে আসা কোটচাদপুরের কথা। আম, কাঁঠাল, নারকেল গাছের সারি। কিছুক্ষণের জন্য অন্নমস্কক হয়ে গিয়ে ছিলাম।

সতীর ডাকে ফিরে এলাম। “ এসে গেছি”। বলে হাতের ব্যাগ টা কাধে ঝুলিয়ে নিলো।

   গাড়ী আসে থামল হলিডে ভিলার সামনে। সুন্দর ছিমছাম হোটেল। সামনে বিভিন্ন রঙে সাজানো বাগান। পাশে পানির ফোয়ারা। আমার ভালো লাগলো, সতীর ও। ও বলল,” কি সুন্দর তাই না শমিত দা”। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, সূর্যের আলোতে চিকচিক করছে। চোখে রৌদ ঠেকানো প্রাদা চশমা। আমার দিকে তাকাতেই পকেট থেকে কাগজের নেপকিণটা এগিয়ে দিলাম।

“ মুছে নাও কপালের ঘামটা”।

“ কি করে বুঝলে?”

“অনেক দিন ধরে চলছি তোমার সাথে, এটুকু বুঝব না”?

ও হাসল।

রাম গাড়ী থেকে নামিয়ে দিলো সুটকেস গুলো। বলল,” স্যার, আজকে রেস্ট নিন, কাল আমাদের গাড়ী আসবে ভোর আটটায়। আপনাদের কে সব ইম্পরটেন্ট জাগা গুলো ঘুরে ঘুরে দেখাবে”।

জিজ্ঞাসা করলাম,” তুমি আসবে না”?

“ আমি যদি না আসতে পারি, এমন একজন কে পাঠাবো আপনাদের তাঁকে পছন্দ হবে”। বলে সালাম দিয়ে গাড়ী স্টার্ট দিলো।

  কাউন্টারে এসে দাঁড়ালাম।  দুইজন মহিলা কাজ করছে, দুইজনই ব্যাস্ত। সতী পাসপোর্ট দুটি আমার হাতে এগিয়ে দিলো।

বললাম,” ঐ চেয়ারটাতে বসো। দরকার পড়লে তোমাকে ডাক দেবো”।

এই মুহূর্তে মনে হোল ওর ভালো মন্দ সবকিছু দেখার ভার আমার। এই বিদেশ বিভুয়ে আমিই ওর একমাত্র বন্ধু। সে সবকিছু আমার উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত। এই মহান দ্বায়িত্ব আমার উপর দিয়েই বৌদি ওকে পাঠিয়েছে আমার সাথে। আমাকে পালন করতে হবে সেই দ্বায়িত্ব।

Can I help you?

ভদ্রমহিলা ডাকছে আমাকে। এগিয়ে গেলাম। পাসপোর্ট আর রিজার্ভেশনের কাগজ গুলো সে হাতে নিলো। আবারও চারিদিকে চাইল সে। বললাম চারজনের পরিবর্তে দুজন এসেছি। দেখতে চাইল অন্য জন কে।

সতীকে আসতে বললাম কাউন্টারে।

“Do you need two rooms?” বলে তাকাল আমার দিকে।

বুঝলাম এই সমস্যা আমাকে ফেস করতে হবে সবখানে। কারন আপাতদৃশটিতে এই ধরনের সম্পর্ক চিন্তা করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

বললাম,” Yes, two rooms side by side if possible”.

সতী আস্তে আস্তে আমার কানে কানে বলল,” এ সবই জেন্ডারের প্রবলেম”।

দুটা রুম পাওয়া গেলো পাশাপাশি। ভদ্রমহিলা তার হাসি বজায় রেখে বলল, এক ঘণ্টা পরে এসো। রুমগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে।

“চলো, লাঞ্চ টা সেরে নেই”। বলে দুজন যেয়ে বসলাম হোটেলের ডাইং রুমে। সতী কে বললাম, তুমি পছন্দ মতো অর্ডার দেও। সে মালয়েশিয়ান ডিস আনতে বলল। আমরা বসে বসে কথা বলছিলাম। ডাইং রুমের চারিদিক খোলা। হয়ত বাহিরের

সৌন্দর্য দেখানো টাই মুল উদ্দেশ। অপূর্ব। চারিদিকে বিভিন্ন ফুলের সমারহ। একটু দূরেই সুইমিং পুল। আর একটু দূরে দেখতে পাচ্ছি হোটেলের প্রাইভেট বীচ। ঠিক করলাম বিকেলে হাটতে যাবো বীচের পাড়ে। আজ রীলেক্সের দিন।

একজন আসে খবর দিলো ঘর তৈরী। সতীকে বললাম,” বিশ্রাম নাও। বিকেল পাঁচটায় বের হবো”। ও চলে গেলো ওর, আমি এলাম আমার ঘরে।

 সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো। ছোট্ট বেল্কনী আছে। সেখান থেকে সুইমিং পুলটা দেখা যায়। অনেক ছোট বড় ছেলে মেয়েরা সাঁতার কাটছে, ডুব দিচ্ছে। কেউ বা রৌদ পৌহাচ্ছে। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে দেখলাম। তারপর বিছানায় এলিয়ে দিলাম ক্লান্ত শরীর টা।

 ঠক ঠক শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দরজা খুলতেই দেখি সতী দাড়িয়ে। “ কি? তৌরি হও নি ? পাঁচটা বাজে”?

“ এক মিনিট সময় দাও” বলে চোখে মুখে পানি দিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।

বিকেলের ঝিরঝিরে বাতাস সকালের রৌদ্রের তাপটাকে কমিয়ে দিয়েছে। রাস্তা দিয়ে হাঁটছি দুজনে। একদিকে অনেক উচু পাহাড়। সবুজের সমারোহ। আর এক দিকে বিভিন্ন ধরনের দোকান পাট, বিভিন্ন ধরনের রেস্টুরেন্ট।

বললাম,”সতী, কোন ধরনের খাবার রাতে খাবে ঠিক করে নেও। আর বীচে হাটতে গেলে বীচ স্যান্ডেল লাগবে, চলো, ঐ দোকান থেকে কিনে নেই”।

“চলো” বলে দুজনে এসে ঢুকলাম দোকানে। আমি নিলাম একটা ফ্লীপ-ফ্ললপ। সতী অনেক খুজে পারপেল রঙ এর একটা স্যান্ডেল পেলো। ওটার রঙ এর সাথে ওর পরনের আউট ফিটের রঙ মিলে গেলো।

বললাম,” নতুন স্যান্ডেল টা পড়ে নাও। আমরা বীচের দিকে যাব”।

আমিও ফ্লীপ-ফ্ললপ টা পায়ে দিয়ে নিলাম।

পরিষ্কার সচ্ছল পানি। কোন দিকে অপরিচ্ছন্নের বিন্দু মাত্র চিহ্ন নাই। কিছু লোক শুয়ে আছে বীচ বেঞ্চে। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে পাড়ে। দূরে স্পীড বোটে বাঁধা উরন্ত রঙ্গিন বালুনের মাঝে মানুষ উড়ছে। সতী আস্তে আস্তে গোড়ালি ভেজা পানিতে যেয়ে দাঁড়াল। ঢেউ আছড়ে এসে পড়ল ওর পায়ে।

বললাম ,”তাকাও, ছবি উঠাচ্ছি”।

ও তাকালও। হাসির রেখা ওর ঠোঁটে।

সূর্য ঢলে পড়লো সমুদ্রের শেষ প্রান্তে। আমরা এসে বসলাম বীচ বেঞ্চে।

সতী বলতে থাকলো তার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। আমি শুনতে শুনতে তাকিয়ে রইলাম, যেখানে আকাশ মিশেছে সমুদ্রের জলে।

ক্রমশঃ

You may also like

6 Comments

  1. ভালো লাগছে গল্পটা।ভালো লাগছে শমিতের সতীর প্রতিটি বিষয় কেয়ার করাকে।ভালো লাগছে দুজনের বন্ধুত্ব,দুজনের প্রতি দুজনের নির্ভরশীলতা।পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকবো।

  2. অতি সুন্দর এই ভ্রমন কাহিনী তে একে অপরের যে আন্তরিকতা সেটা মনকে দোলা দেয়।
    আগামী পরবে অপেক্ষায় থাকলাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *