দুদিন হয়েছে মালতী এসেছে তার বান্ধবির কাছে । তার স্বামী চা বাগানের ম্যানেজার। ঘুম না আসায় উঠে এসে দাড়িয়ে ছিল নির্জন বারান্দাটা তে। এক ফালি চাঁদের আলো এসে পরেছে সেখানে। জোনাকি পোকার আলো নিভছে জ্বলছে । মায়া ময় পরিবেশ। আধো আলো, আধো অন্ধকার। গভীর রাতের নীস্তবতা ভেদ করে করুন বাঁশির সুর মালতীর কানে পৌছে। মালতী স্তম্ভিত। এ সুর তার চেনা । অনেক আগে এ সুর সে শুনেছিল। বাঁশির সুর আকাশে বাতাসে আনে অনির্বচনীয়ের আহবান। এ সুর মালতীর অন্তরের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে। মালতী ভাবে, কে এই বংশীবাদক ? বাঁশিতে বাজছে তার হারিয়ে যাওয়া গান গুলি । এক সময় নিস্তব্ধ হয়ে এলো সব। চাঁদের আলো নিভে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু জোনাকির আলো।
এলোচুলে মালতী এসে দাঁড়ালো তার খাটের পাশে। কি এক অজানা ভয় তাকে শিহরিত করে তুললো। ফিরে যেতে চাইলো অনেক পিছনে। না এ হতে পারে না । এ হবার নয় । ভাবলো, সকাল হলে জিজ্ঞাসা করবে কে এই বংশীবাদক।
পাখীর কিচির মিচিরে মালতীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভোরের সূর্যের আভা এসে পরেছে তার জানালায়। আকাশ টা লাল রং এ আচ্ছাদিত। আড়া মোড়া করে উঠে আসতেই বান্ধবীর ডাক শুনল সে। “ কিরে ঘুম হোল?”
‘ না, হয়নি। জানিস কাল রাতে দাঁড়িয়েছিলাম বারান্দায়। দূরে করুন সুরে কে জেনো বাঁশি বাজাচ্ছিল। বলতে পারিস কে?”
“ ও, উনি তো প্রতি রাতেই বাজায়। পাশের চা বাগানের ম্যানেজার। থাকে একলা। নিজেকে নিয়েই বাস্ত।”
আজ রাতে বাজালে, পারবি আমাকে নিয়ে যেতে ওখানে। মালতী বলে।
সে তো অনেক রাতে বাজায়। উৎকণ্ঠার সাথে বলে সুমীতা।
তা হোক , আমি যেতে চাই। দেখতে চাই উনাকে । প্রশ্ন করিস না কেন? তোদের ড্রাইভার কে বলিস সে জেনো আজ রাতে নিয়ে যায় আমাকে।
সুমীতা রাজি হোল। দু বান্ধবী বাকি সময় টা কাটিয়ে দিলো গল্প গুজব করে।
রাত তখন দু প্রহর। আধো রাতে শুনতে পায় বাঁশির সুরের আর্তনাদ। সেই চেনা সুর ছড়িয়ে পড়েছে অন্ধকারাচ্ছন্ন চা বাগানে ।
মালতী ডাক দিলো শম্ভু কে।
শম্ভু?
জি মা
আমাকে নিয়ে যেতে পারবে ঐখানে, যেখান থেকে ঐ গান ভেসে আসছে । জানো কোথায়?
জানি মা জি, শম্ভু বলে।
দু জনে বেড়িয়ে পড়ল গাড়ী তে করে। বেশি দূর নয়।
এসে গেছি মা জি, ঐ যে দেখছেন বাসাটা ঐখানে উনি থাকেন। বললও শম্ভু।
মালতী পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। কে সে যে একাকীত্ব ভাবে বাজিয়ে চলেছে বাঁশি । পাশে মদের বোতল। আবছা অন্ধকারে দেখতে পেলো একটা ছবি তার সামনে।
মালতী পেছনে এসে দাড়াতেই বাঁশি বাজানো বন্ধ করে সে তাকাল মালতীর দিকে।
চাঁদের আলো এসে পড়েছে বাদকের মুখে। পলক পড়েনা চোখে। পাশে রাখা মোমবাতি টা উঁচু করে ধরল মালতী।
অনুপম তুমি ?
আমারও তো সেই প্রশ্ন, তুমি এখানে মালতী?
এসেছি দুদিন হোল বান্ধবীর বাসাতে। রাতে গানের সুর আমাকে অন্যমনস্ক করে দিয়েছিল। আমার চেনা সুর কে বাজাচ্ছে তাই দেখতে ছুটে এলাম।
অনুপম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, এই সুর তোমাকে শুনিয়েছিলাম ১২ বছর আগে। মনে পড়ে? দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বসো। অনুপম বলে মালতীকে।
ঐ ঝাপসা করে তোলা ছবি টা তোমাকে দিয়েছিলাম । আজও রেখে দিয়েছ দেখছি?
হা, ওটার সামনে বসে বাজায়ই। ফিরে যাই আমার ফেলে আসা দিনগুলিতে।
মনে পড়ে, তোমার ভাই এর সাথে তোমাদের বাসাতে এসেছিলাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তুমি এস,এস,সি পরীক্ষা দেবে।
মনে পড়বে না কেন? মালতী ফিরে যায় অতিতে। অপু ভাই তোমাকে বলেছিল, অনুপম তুই কি আমার এই মাথায় গোবর পোড়া বোনের মাস্টার হতে পারবি?
মনে পড়ে, আমি রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। সেইতো শুরু। প্রতিদিন আসতাম, তোমার গোবর পোড়া মাথায় ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, অংক, ঢোকানোর চেষ্টা করতাম। তুমি বলতে, আমার দাড়া কিচ্ছু হবেনা অনুপম দা। কিন্তু হয়েছিল। তুমি ভালভাবে পাশ করেছিলে।
বলেছিলাম, এবার আমার পাঠ চুকল। এর আসতে হবেনা তোমাদের বাসাতে।
তুমি কি বলেছিলে মনে পড়ে?
পড়ে বৈকি? বলেছিলাম, বাসাতে না হয় নাই এলে, বাহিরে তোমার সাথে দেখা হবে। কখন যে আপনি থেকে তুমি তে চলে গেছি আমি নিজেও জানিনা। তুমিও আমাকে শুধরিয়ে না দিয়ে বলে ছিলে ,” দেখা হবে কাল ১২ টায় বলাকার সামনে”। দুটা বছর কোন দিক দিয়ে চলে গিয়েছিল আমরা নিজেরাও জানিনা।
মালতী, তুমি রবীন্দ্র সংগীত ভালবাসতে। আমার গলায় সুর নেই। তাই ভেবেছিলাম তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো। ভর্তি হয়ে ছিলাম গানের স্কুলে। বাঁশি শিখতে। তুমি জানতে না। হাতে খড়ী শেষ হবার পর তোমাকে নিয়ে বসেছিলাম এক নির্জন মাঠে । তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে , তোমার হাতে ওটা কি ? বলেছিলাম, এখানে বোসো। চোখ বন্ধ করো। আমি বাঁশিতে গান ধরে ছিলাম “ ঐ মালতী লতা দোলে,—“ গান শেষ হলে তুমি অনেকক্ষণ কেঁদে ছিলে ।
বাসাতে যেয়েও কেঁদেছিলাম। কেন জানিনা। তারপর, তারপরের ঘটনা মনে আনতে চাইনা। যুদ্ধের ডামাডোল বেজে উঠল। সব কিছু লনড ভনড হয়ে গেল। বাবা বাসাতে তালা লাগিয়ে দূরে গ্রামে মামার বাসায় আমাদের কে নিয়ে চলে এলো। তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না । তুমি কি ভাবে আছো তাও জানতে পারলাম না ।
জানো মালতী, সাত দিন পর আমি গিয়েছিলাম তোমাদের বাসাতে। দেখলাম তালা ঝুলছে। কাউ কিছু জানেনা। আমি অস্থির হয়ে অনেক্ষখন পায়চারি করেছিলাম। অনেক খুঁজেছি তোমাকে, পাইনি। প্রতি সপ্তাহে গেছি তোমাদের পাড়ায় । দেখেছি তালা বন্ধ। মাসের পর মাস পেড়িয়ে গেছে। আমার বন্ধু, মহসিন, তুমি তাকে চেনো, খবর দিয়েছিল তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, এক ইনজিনিয়ারের সাথে। বিশ্বাস করিনি।
ঠিকই শুনেছিলে। আমার করনীয় কিছু ছিলনা । ভাইয়া চলে গিয়েছিল মুক্তি যোদ্ধা হয়ে। খবর এসে ছিল সে আর নেই। বাবা পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় মামা এক প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল, উনার বন্ধুর ছেলে, ইনজিনিইয়ার। বাবা রাজি। সেদিন স্বার্থপরের মত তোমার কথা আমি ভাবিনি। দেখেছিলাম বাবা মার চোখে জল। ভাইকে হারানোর ব্যেথা। তোমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম । আকাশ কে নিয়ে ঘর বেধে ছিলাম। চলে গিয়েছিলাম জার্মানিতে।
সে খবর আমি পেয়েছিলাম। আঘাত যে পায়নি সে কথা বললে ভুল হবে । তবে নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম এই বলে, তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরীপেক্ষীতেই তোমাকে এ পথ বেছে নিতে হয়েছিল। চলে গিয়েছিলাম লন্ডনে পিএইচডি করার জন্য। ফিজিক্সে পিএইচডি করে ফিরে আসেছিলাম চার বছর পর।
ফিজিক্সে পিএইচড করে আজ তুমি চা বাগানের ম্যানেজার। কেন?
কোন কিছুতেই মন বসছিলো না, ভাবলাম দূরে কোথাও একাকীত্ব ভাবে জীবন কাটাবো। এক বন্ধুর সাহায্যে এই চাকরি টা পেয়েছিলাম। এবার তোমার কোথা বল।
এতো রাতে কর্তা আসতে দিলো।
সে নেই । চলে গেছে দুবছর হোল। তালা ঝোলা সেই বাসাতে থাকি। তুমি বোতল ধরলে কেন ? কেন নিজেকে শেষ করে দিলে এভাবে ।
সে কোথা থাক। অনেক রাত হোল। তোমার ফিরে যাওয়া উচেৎ।
আবার দেখা হবে কি? মালতীর জিজ্ঞাসা।
আজ থাক
মালতী চলে গেল। পেছন ফিরে চেয়ে ছিল বার বার। অনুপম দাঁড়িয়ে ছিল যতক্ষণ না গাড়ীটা মিলিয়ে যায়।
সকালে চা র পেয়ালায় চুমুক দেওয়ার আগেই মালী এসে বললও, “ মা জী আপনার চিঠি। “
আমার চিঠি? মালতী আশচার্জিন্নত হোল।
হা মা জী, ডেরাইভার দিয়ে গেল
চিঠি খুলল মালতী, “ তুমি জানতে চেয়ে ছিলে দেখা হবে কি না। না, মালতী, তোমার যে মূর্তি আমি গেঁথে রেখেছি আমার হ্রদয়ে সেটাকে ভাঙতে দিতে চাই না । যে দোলনায় আমরা দুলেছিলাম তাকে ছিঁড়তে চাইনা। আমার প্রেম থাকুক আমার মনের মাঝে নিষ্কলঙ্ক হয়ে। তুমি হারিয়ে যাওনি। রাতের অন্ধকারে তোমাকে ফিরে পাই আমার সুরে। তুমি আছো, তুমি থাকবে। বিদায়।”
দু ফোটা চোখের জল ঝরে পড়ল চা র পেয়ালার উপর। সে রাতে করুন সুরে বাঁশি আর বাজেনি.