আজ বাহিরে বের হওয়ার কোন ইচ্ছা ছিলনা। গতকাল সন্ধায় গোটা চারেক বন্ধু তাদের সহধর্মীদের কে নিয়ে এসেছিল আমার এপার্টমেন্টে। আমিই বলেছিলাম। মেয়ে আমার খাবারের অর্ডার দিয়েছিল “নিউ চিলি এন্ড কারি”থেকে । আড্ডা সেরে সবাই যখন উঠল তখন ঘড়ির কাঁটা একটা পেরিয়ে গেছে।
সতী ছিলনা। সে গেছে বস্টনে তার মেয়ের কাছে। থাকলে সেই সবকিছু গুছিয়ে রাখতো।
ধোয়া মোছা শেষ করে যখন বেড রুমের দিকে এগোলাম তখন দুটো বাজে।
সকালে একটু দেরী করে উঠে কফির কাপ টা নিয়ে বসলাম। কয়েকটা ফোন কল সারতে হবে। দেশে বেশ কিছুদিন হোল কল করা হয়নি। আর ওই যে বললাম বাহিরে যাবার তাগাদা নেই আজ। অলস ভাবে কাটাব দিন টা।
তা আর হলনা। মানিব্যাগ থেকে ফোন কার্ড টা বের করতে যেয়ে সব কাগজ পত্র গুলো পরে গেলো মেঝে তে। ওগুলো উঠাতে যেয়ে চোখে পড়লো একটা ভিসা গিফট কার্ড। কবে পেয়ে ছিলাম কোথা থেকে পেয়ে ছিলাম মনে করতে পারিনা।
উঠিয়ে নিয়ে এপাশ ওপাশ করে দেখতেই চোখে পড়লো Expiration Date টা। আজই শেষ দিন।
অলস ভাবে আর কাটানো হোল না দিনটা।
রুজভেল্ট ফিল্ড মল খুব একটা দূরে নয় আমার এপার্টমেন্ট থেকে। বাহিরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। গাড়ীটা অটো স্টার্ট দিয়ে ফিরে এলাম ঘরে। এই অটো স্টার্টের চাবি সতীর দেওয়া গিফট। না করেছিলাম। শোনে নি।
ঠাণ্ডার জন্যই মলে লোকজনের ভিড় কম। গায়ে গায়ে ঠেলা ঠেলি করে কেনাকাটা করার মানসিকতা আগেও ছিলনা, আজও নেই। ভিসা কার্ড টা শেষ করাই আমার উদ্দেশ। কার্ডে অংকের পরিমাণ মন্দ ছিলনা।
কেনাকাটা শেষ করে ফুড কোর্টে এলাম। এক কাপ কফি খেলে মন্দ হয়না। সেই সাথে ফোন কল গুলো সারতে হবে। এই ভেবে নিরিবিলি একটা জায়গা বেছে নিয়ে বসলাম। কাপে দুই চুমুক দিয়ে ফোনটা বেড় করে ডায়েল করতে যাব, এই সময়,
“ মিন্টু ভাই”
থতমত খেয়ে হাত কেঁপে ফোনটা পরে যাওয়ার আগেই আবার আঁকড়ে ধরে ঘাড় ফিরে তাকালাম যেদিক থেকে ডাকটা এলো।এই নামে আমাকে এদেশে ডাকেনি কেউ। ভুলেই গিয়েছিলাম আমার Nick name টা। কে সে যে এখনও মনে রেখেছে আমার এই নাম টা। তাকালাম মহিলার দিকে। হাসির আভা ঠোঁটে।
“চিনতে পারছেন”?
অনেক পিছনে ফিরে গেলাম যেখানে আমাকে চিনত এই নামে। সেই স্মৃতির পাতায় এই মুখ ভেসে উঠলো না।
বললাম,” কিছু মনে করবেন না, চিনতে পারলাম না”
“ না চেনারই কথা। আমি দাড়িয়ে থাকতাম —“ কথা শেষ না করে বলল,” বসতে পারি”
“নিশচই।
“ কতকাল পরে দেখলাম আপনাকে,মিন্টু ভাই”। কথাটা ছুড়ে দিতেই আমার বুকে দুরুদুরু কম্পন শুরু হোল। এমন নয় যে মেয়েদের সাথে কথা বলতে আমি আড়ষ্টতা বোধ করি। শুধু আমার এক বান্ধবীর একটা কথা মনে করিয়ে দেয়। সে বলেছিল,” শমিত, তুমি কিন্তু এখন Most Eligible bachelor. সাবধানে থেকো”। এই সাবধানতা বজায় রাখতে যেয়ে অনেক কে আমি সন্দেহের মাপ কাঠিতে ফেলেছি। আজও যে তার বেতীক্রম তা নয়।
“ আমার এই নাম তো সবার জানার কথা নয়। আপনি জানলেন কি ভাবে”?
“ যা বলছিলাম, তার আগে বলি, আমার নাম সাধনা। চিনবেন না। কঙ্কনা আর আমি একি ক্লাসে একি হলে থাকতাম। তাই বলে যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল তা নয়”
“ ওর বন্ধুদের কে তো আমি চিনি। রেখা,মাগফের, ডলি, শান্তি”। বললাম
“ হাঁ, জানি, কঙ্কনার সাথে মাঝে মধ্যে কথা হতো। ওর কাছ থেকেই আপনার এই নামটা শুনেছিলাম। আজ যখন ওকে আপনার পাশে দেখছি না তখন আর কিছু জিজ্ঞাসা করবো না শুধু জানতে ইচ্ছে করে কতদিন হোল”।
“দু বছর, আপনি একা না সাথে কেউ আছে”।
“ একা”।একটু থেমে আরও বলল,” আপনাদের দুজনের জোড়া টা আমার খুব ভালো লাগত। হলের গেটের পাশে দাড়িয়ে আপনাদের কে দেখতাম। মনে মনে আপনাদের মত কাউকে নিয়ে এরকম জোড়া বেঁধে হাটতে চাইতাম। কিন্তু আমার ভাগ্যে তা আর হোল না”।
এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। সতী কল করেছে। বললাম,” কিছু মনে করেন না, এই কল টা আমাকে ধরতে হবে”।
সতীর জিজ্ঞাসা আমি কোথায়, কি করছি।
আমি কোথায় কার সাথে সেটা কিছুটা বিশ্লেষণ করতেই, ও বলল,”শমিত দা, কি বলছ? কার সাথে, মাথা মুণ্ডু কিছু বুজতে পারছিনা”
বুঝলাম অর্ধেক কথা গলার ভিতরে রেখে বলাতে ওর বোধগম্য হচ্ছে না। এদিকে সাধনা তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
বললাম, টেক্সট করে জানাচ্ছি।
পাল্টা টেক্সটে সতী জানালো, কোন ক্রমেই যেন আমি সাধনা কে টেলিফোন নাম্বার টা না দেই। আর সবশেষে ওকে যেন কল করতে না ভুলি। বিস্তারিত না জানা পর্যন্ত সে মোটেই স্বস্তি পাচ্ছে না।
সাধনার বয়স টা আন্দাজ করতে আমার বেগ পেতে হলনা। সেই তুলনায় একটু বুড়িয়ে গেছে মনে হোল। মাথার চুলে ঘনতা কম,তাতে কলপ দিলেও চোখের নিচ আর গলায় রীঙ্কেল গুলো ফুটে উঠেছে প্রকট ভাবে । পরনে সাদামাটা শালওয়ার কামিজ। সত্যি কথা বলতে কি আমি তো ধোয়া তুলসীপাতা নই, কাজেই সাধনাকে দেখতে যেয়ে তার বুকের অসমতলতা চোখে পড়ল।
সরি, কি যেন বলছিলেন?
আমার ভাগ্যের কথা। থাক, আপনাকে বিরক্ত করবো না। কঙ্কনার সাথে দেখা হলে ভালো হতো।
তাতো হবার নয়। আমার সাথে আপনার পরিচয় নেই তবু ও বলি, নিজের মনের ভার যদি লাঘব করতে চান তবে আমাকে বলতে পারেন।
নিজের কাজ আর করা হোল না। শুনলাম সাধনার কথা। আমাদের মত জোড়া বেঁধে চলতে চেয়ে ছিল। কিন্তু হলনা।
পল্লবের সাথে দেখা হয়েছিল ডিপার্টমেন্টে। সে এসেছিল ওর বোনের সাথে দেখা করতে। ঠিক সেই সময় সাধনা বেড়িয়ে আসছিল ক্লাস শেষ করে। করিডোরে দেখা। সেই থেকে পল্লব সাধনার পিছ ছাড়েনি।
বললাম,” সে তো খুব ভালো কথা। সে আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, এই তো আপনি চেয়েছিলেন”।
চেয়েছিলাম, পেয়েও ছিলাম কিছুদিনের জন্য।
কিছুদিন, মানে?
বিয়ের পরে জানলাম শুধু আমি নই ওর আরও কয়েক জন মেয়ে বন্ধু আছে যাদের সাথে সে হোটেলে রাত কাটায়।
কিছু বলতে যেয়ে ধমক খেয়েছি।
ডিভোর্স নেননি কেন? প্রশ্ন টা করে ভাবলাম আমি বলার কে।
নিয়েছি, নিয়েছি বললে ভুল হবে, সেই দিয়েছে, সে আরেক কাহিনী।
বলতে যখন শুরু করেছেন, বলেন।
সাধনা চোখ ফিরিয়ে নিলো আমার দিক থেকে।
আজিই প্রথম ডাইরি লিখতে শুরু করেছি। না প্রথম বলব না। ক্লাস নাইনে যখন পড়তাম তখন কিছুদিন লিখেছিলাম। বয়স ছিল ১৪। তাতে শুধু থাকতো সিনেমার কথা। খেলতে যেয়ে কাকে লেং মেরে ফেলে দিয়েছি। কোন মেয়েটা একবার তাকিয়ে হেসেছিল , তাই নিয়ে এক পাতা লিখে ফেলেছি। ভাগ্য ভালো বাবার হাতে পরেনি সেই লেখা। তা হলে খবর ছিল।
সে লেখা আর বেশি দুর এগোইনি।
আজ আবার শুরু করলাম।
সাধনা তাকাল, বলল, কিছুদিন যেতেই বুঝতে পারলাম আমি মা হতে চলেছি। পল্লব এলে ওকে বললাম। খুশীর পরিবর্তে রাগ হোল তার। কোন রকমে কিছু করতে পারি কিনা জিজ্ঞাসা করল। বললাম, না, হবেনা।
আমার লেখা টা যদি এখানেই শেষ হতো তাহলেই বোধ হয় ভালো ছিল।
কিন্তু হলনা, সাধনা বলতে থাকল,
গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে মার সাথে। ডাক্তার পরীক্ষা শেষে বলেছিল একটা মেমোগ্রাম করা দরকার। বা পাশের ব্রেস্টে একটা লাম্প আছে মনে হচ্ছে।
দুদিন পরে ডাক্তার ফোন করে বলেছিল, রেজাল্ট ভালো আসেনি। কেন্সেরাস। তবে ফার্স্ট স্টেজ। বলেছিল, নয় মাস অপেক্ষা করতে। তারপর masactomy করবে।
সাধনা রাজি।
পল্লব কে বলতেই সে বলেছিল,” কেন্সার, কেন্সের হলে মানুষ বাচেনা। শুধু গাদা গাদা টাকা নস্ট”। বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিল। আর ফেরে নি। তার পরিবর্তে পাঠিয়ে দিয়েছিল ডিভোর্সের কাগজ পত্র।
নয় মাস পর এলো এক পরী এই পৃথিবী তে। সেই সাথে একটা ব্রেস্ট কেটে ফেলতে হোল। রেডিয়েশন দিতে হয়েছিল। ভবিষ্যতে ভালো থাকার জন্য।
বড় বোনের সহযোগিতায় আমেরিকায় এসেছে। তাও আজ দশ বছর হয়ে গেল। শুনেছে পল্লব আবার বিয়ে করে লস এঞ্জেলিসে আছে ।
বললাম,যাক সব ঝামেলা চুকে গেছে।
না, চুকেনি। বিঁধি আমার সাথে আর একটু খেলায় মত্ত হয়েছে। দশ বছর পর আবার সেই বদ রোগ টা ফিরে এসেছে। এবার আর প্রথম স্টেজ নয়, ফীফথ স্টেজ। বলে তাকাল পাশে।
বুঝলাম চোখ মুছছে।
একটু চুপ করে থেকে বলল আজ উঠি মিন্টু ভাই। এই আমার ফোন নাম্বার, থাকি Commack এ। সময় পেলে কল দিয়েন।
4 Comments
অসম্ভব ভালো লাগলোগল্পটা।মনকে ছুঁয়ে গেলো।শেষ লাইনদুটো খুবই ভালো লাগলো ” ও আমার ফোন নাম্বার চায়নি দিয়ে গেলো ওর নাম্বার “।
This writing touches my heart.Last two lines really pathetic.
অসম্ভব সুন্দর হয়েছে লেথা মনে রাখার মত গল্প
Realy touchy story.like it.u