দেখে ছিলেম তাকে রান্না ঘরের মেঝেতে বসে পিয়াজ ছুলতে , দেখে ছিলেম দৌড়ে যেয়ে নীচের থেকে বাজার নিয়ে আসতে। কাছে এসে বলতে শুনেছিলেম “ মামা, তোমার কফির পানি হয়েছে, খাবেনা ?”
বলেছিলাম,” এতো দোড় দোড়ি করছিস কেন? একটু বোস।”
বলেছিল সে,” বসব আমি রাত নটায়, তখন আরম্ভ হবে আমার সিরিয়াল টা।”
বলেছিলাম, ‘’ রাত হবে অনেক, বাড়ী যেতে ভয় পাবিনা?”
“ না মামা, ভয় আর পাই না , যেদিন চড় খেয়ে ছিলাম স্বামীর হাতে।”
বিয়ে হয়ে ছিল ১৩ বছর বয়সে। দুই ভাই এক বোন এর মধ্যে দিলারাই বড়।
বাবার সংসারে স্বচ্ছলতা না থাকায় মেয়ে কে পাড় করে দিতে হয়েছিল ১৯ বছরের এক ছেলের সাথে। রিক্সা চালক, থাকে ঢাকা তে। বস্তীর এক ছোট্ট ঘরে এসে ঠাই নিয়ে ছিল দিলারা । বশীর কর্মঠ। সকালে বেড়িয়ে যায় রিক্সা নিয়ে। ফেরে রাতে। দিলারা পথ চেয়ে বসে থাকে। যে মেয়ে কিছুকাল আগেও পুতুল নিয়ে খেলে ছিল আজ সে সংসারি। ভাতটা, ডাল টা, তরকারী টা তয়রী করে রাখে, কখন বশীর আসবে ক্লান্ত হয়ে।
এটাই নিয়ম। ১৩ বছরের মেয়ে বুঝে নিয়ে ছিল সংসার কি। ঘিঞ্জি বস্তীর চারিদিকে দূরগন্ধ ময় পরিবেশের মধ্যেও দিলারা খুঁজে পেয়ে ছিল সুখের সন্ধান। অবসর দিনে বশীর দিলারা কে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ত ওর রিক্সায়। দেখাতো বড় বড় দালান, বড় বড় বাড়ী, সিনেমা হল আরও কতো কি।
দিলেরা একটা ছুটা কাজ নিয়ে ছিল বাসার কাছে। সকালে যেয়ে ধোঁয়া মোছার কাজ সেরে ফিরে আসত দুপুরের মাঝে।
দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর পেড়িয়ে গেল। দিলারার কোলজুড়ে এলো এক ফুটফুটে মেয়ে। কাজ সেরে ক্লান্ত বশীর মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বস্তীর মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। দিলার
বাড়ে ভাত।
মেয়ে বড় হওয়ার সাথে সাথে বশীর ও পাল্টে যেতে থাকল। রাত করে বাসায় ফেরে। মুখে মদের গন্ধ। কোন কোন দিন না খেয়ে শুয়ে পড়ে। জিজ্ঞাসা করলে বলে,” খেয়ে এসেছি।”
“ কোথায়?”
“ সে কৈফিয়ত তোকে দিতে হবে?” ঝঙ্কার মেরে ওঠে বশীর।
দিলারা আড়ালে যেয়ে চোখের জল ফেলে।
মেয়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বড় হতে থাকল আর দিলারার ঘুণে ধরা সংসারের ফাটল বাড়তে থাকল। বশীর কোন কোন দিন রাতে আসত না। মেয়ে কে বুকে জড়িয়ে ধরে দিলারা রাত কাটিয়ে দিতো।
মতির মা বস্তির আদিবাসী । বয়স হয়েছে। সব ঘরের খবরা খবর সে জানে। লোকে তাকে বাংলা বেতার নাম দিয়েছে। এক পড়ন্ত বেলায় দিলারার দরজার সামনে এসে ডাকল ,” ও পদ্মার মা, ঘরে আছো।” দিলারা দরজা খুলে মতির মা কে দেখে বিরক্ত অনুভব করলো। সে জানে মতির মা এমনি আসেনি। নিশ্চয় কোন পরোনিন্দা কর খবর নিয়ে এসেছে।
“ কি ব্যপার ? এই বেলায়।” দিলারার কথা শেষ হওয়ার আগেই মতির মা বসে পড়ল দরজার সামনের ছোট্ট জাগাটা তে।
“ বলি কি পদ্মার মা, খবরা খবর কিছু রাখো?”
দিলারার বুঝতে অসুবিধা হলনা কোন দিকে মতির মা এগুচ্ছে। হৃদকম্পন বেড়েই চলেছে।
মনে হচ্ছে সামনের সব কিছু হলদে রং এ আচ্ছাদিত। পাকস্থলীতে ছোট ছোট পোকা গুলো শুর শুরি দিচ্ছে মনে হোল দিলারার। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,” কি খবর মতির মা।”
“ তোমার নাংর, বশীর, ঠাঠারি পাড়ায় আর এক সাং নিয়ে থাকে, তা জানো।”
পোকা গুলো এখন উপরের দিকে আসছে মনে হোল দিলারার। মনে হচ্ছে ঘুমে তার চোখ বুজে আসছে। মাথার শিড়াটা দপ দপ করছে।
“ আমাকে নিয়ে যেতে পার সেখানে, মতির মা?” কর্কশ কণ্ঠে বললও দিলারা।
“ তা পারবো না কেনে ? আমার ছোট নাতিকে দিয়ে তোমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি”। এই বলে মতির মা উঠে পড়ল।
দিলারা পৌছিয়েছিল ভর সন্ধ্যায় ঠাঠারি পাড়ার সেই বাসাটার সামনে। দরজায় টোকা দিতেই আলু থালু বেশে এক মেয়ে দরজা খুলে দাঁড়াল। “ কি চাই?”
বশীর কোথায় ? উচ্চও কণ্ঠে দিলারা প্রশ্ন করেছিল। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই বশীর এসে দাঁড়ালো দরজার কাছে। “ এখানে কেন?” ধমকের সুরে জিজ্ঞাসা করলো বশীর।
দিলারর শরীর রাগে দুঃখে থর থর করে কাঁপছে। “ বৌ মেয়ে রেখে এখানে এসে আনন্দ ফুর্তি করছ ?”
বশীর কোন কথা না বলে একটা থাপ্পড় দিয়েছিল দিলার গালে। দিলারা কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এসেছিল বাসাতে। মেয়ে টাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ছিল অনেক।
“ না, কাঁদলে হবেনা, আমাকে বাঁচতে হবে।” এই ছিল তার পণ। এই শপথ নিয়ে দোরে দোরে গিয়েছিল কাজের জন্য। মুখ ঝামটা শুনেছে, কেউবা ভিখিরি বলে দু মুঠো চাল দিতে চেয়েছে। অশোভন ইংগিত যে পাইনি তা নয়।
তিন বেলা খাবার জোটেনি অনেকদিন। তবুও মনোবল হারায় নি সে। হারায়নি আস্তা উপর ওয়ালা থেকে ।
দাঁড়িয়ে ছিল একদিন এক বাড়ীর গেঁটের পাশে। দারওয়ান ঢুকতে দেইনি। সুতীর শাড়ী পরা এক ভদ্রমহিলা ঢুকতে যেয়ে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। দিলারার চোখের চাউনিতে ছিল ব্যদনা। ভদ্রমহিলা থমকে দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ। দিলারা বলেছিল,” মা কাজ চাই।”
উপরওয়ালার কলকাঠি নাড়া কে বুঝবে। দিলারা কে কাজ দিয়েছিল। তাও তো অনেক বছর হয়ে গেল।
সেই বাসাতেই আমার সাথে দিলার দেখা। বলেছিল,” জানো মামা সেই হারামজাদা ফিরে এসেছিল আমার কাছে কয়েক মাস আগে। আমি তাকে ঢুকতে দেইনি বাসাতে। শুনেছি শুধু মদে নয়, এখন ড্রাগেও তার আসক্তি।”
আরও বলেছিল, মেয়েকে সে প্রাইভেট স্কুলে ভর্তি করবে। করেও ছিল, করেছিল উপরওয়ালার দোয়া আর মুনিবের সাহায্যে।
ওর চোখে দেখেছিলাম ভব্যিষতের নেশা। উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি। সামান্য এক মেয়ের কঠোর সাধনা। কতক্ষণ অন্য মনস্ক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম জানিনা।
মনে হোল এক পাখা ভাংয়া পাখি আবারো উড়তে চাইল। জড়িয়ে নিলো তার পাখার ছায়ায়
ছোট্ট শিশুটিকে। বললও, “ আমি উড়তে পারিনি, তুই পারবি। তুই উড়বি ওই বিশাল আকাশের মাঝে।”
মামা ,
কিরে
কি ভাবছ? তোমার কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
হা খাবো।
শোন, কাল আমার যাওয়ার পালা। ভালো থাকিস।
সে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। ওর চোখের কণে ছোট্ট জ্বলের কণা। ও জল নয়।
হীরের কণা। যার রস্মি ওকে পথ দেখাবে। চলে গেল সে তার কাজের জগতে। আমি কফির পেয়ালায় চুমুক দিলাম।