ডায়রির পাতা থেকে ৪

 

পয়লা এপ্রিল।

দেশে ফোন করেছিলাম। বোনের কাছে। কুশল সংবাদ নিতে।

ফোনটা উঠিয়ে প্রথম প্রশ্ন,” কিরে, তোর ডায়রির পাতা ইদানীং খালি যাচ্ছে, কি হোল”?

বললাম, বড় নিরামিষ যাচ্ছে দিনকাল। এক ঘেয়েমী। কোন বৈচিত্র্য নাই। খাও দাও আর ঘুমাও। এসব তো লেখা যায় না। অন্তত পক্ষে পাঠকের জন্য নয়”’

-তাহলে ভুত, প্রেত নিয়ে লেখ। যেমন, হেটে আসছিস অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হঠাৎ খিলখিল করে হাসতে হাসতে এক বুড়ি তোর পথ আগলিয়ে ধরলও। (সুন্দরী মেয়ে বলব না, তাহলে তোর মেয়ে আমার মাথা ভেঙ্গে দেবে)

ইয়ার্কি পেয়েছিস। তবে মনে পড়ছে একজনের কথা। ঐ যে বললি ভুত, প্রেত। দেখেছিলাম।

তবে শোন,

আমার বয়স তখন পাঁচ। তোর তখনও জন্ম হয়নি। আমাদের বাসার পাশে মাঠ। মাঠের শেষে একটা টিনের ছাউনী দেওয়া বাড়ি। ওখানে থাকতো টুকু নামে আমার এক বন্ধু। আমরা এক বয়সী। ও থাকতো ওর  মা আর ভাইয়ের সাথে। বাবা গত হয়েছে অনেক দিন হোল। আমি যেতাম ওদের বাড়ীতে। টুকুর সাথে মার্বেল খেলতে।

ওর ভাবীর গায়ের রঙ দুধে আলতা দিয়ে গড়া। টানা টানা চোখ। আমাকে দেখলে ডাক দিতো। বলত, এই ছটকা এদিকে আয়।

আমি যন্ত্রের মত এগিয়ে যেতাম, কিসের যেন একটা টান অনুভব করতাম। কাছে এলে আমার গালটা টিপে দিতো।  কোলে বসিয়ে বলত,” তোকে আমি মধু বলে ডাকব। আর তুই আমাকে ছোটমা বলে ডাকবি। কেমন”?

-কেনও আমাকে মধু বলে ডাকবে? আমার নাম তো মিন্টু।

বলত, তুই যে আমার পরানের মধু। বলে আমাকে চেপে ধরত বুকের মাঝে।

আমি মুখ লুকাতাম ওর নরম বুকে।

তুই এখানে বস আমি আসছি ,বলে উঠে যেয়ে নিয়ে আসতো দুধ কলা।  আমাকে নিজে হাতে খাইয়ে দিতো।

কপালে চুমু দিয়ে বলত, কাল এবার আসবি তো?।

বলতাম, কাল এলে কি খেতে দেবে?

মুড়ি পাটালি।

আমি খুব পছন্দ করি মুড়ি পাটালি।

একদিন আমি টুনি দের বাসায় এক্কা দক্কা খেলছিলাম। পানির পিপাসা পাওয়াতে দৌড়ে বাসায় এসে দেখি ছোটমা বসে আছে মার পাশে। দুজনে গল্প করছে। আমাকে দেখে হাসল। ডাক দিলো।

“ একে বারে ঘেমে নেয়ে গেছিস”। বলে আঁচল টা দিয়ে আমার মুখ টা মুছে দিলো।

মা বলল,” তোর খুব নাওটা হয়েছে”।

“ আমি ওকে মাঝে মধ্যে দুধ কলা খাইয়ে দেই। তুমি কিছু মনে করোনা নাতো খালা”।

না, আমি জানি কেনও তুই ওকে এতো ভালবাসিস।

আমি পানি খাওয়ার কথা ভুলে যেয়ে ওর গা ঘেঁসে বসলাম।

টুনি এসে ডাক দিল খেলতে যেতে।

বললাম, আজ আর খেলবো না।

মা বলল, খেলবি না কেনও? এখানে বসে আমাদের কথা শুনবি। তাঁই না?

বললাম, আমার আর খেলতে ইচ্ছা করছে না। আসলে ছোটমার পাশ ছেড়ে যেতে চাইছি না।

ছোটমা আমার চুলগুলো হিজিবিজি করে দিয়ে বলল, যা পাজি, খেলতে যা।

আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে গেলাম। এক্কা দক্কায় আর মন বসলো না।

দুদিনের জন্য মামা বাড়ীতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দৌড়ে গেলাম টুকু দের বাড়ীতে। ছোটমা বসে আছে মাটির বারান্দায়। আমাকে ডাকল না। আমি পাশে যেয়ে বসলাম। আমার দিকে তাকাল। চোখে জল। আমি হাত দিয়ে চোখটা মুছিয়ে দিতেই  আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।

বলল,” তুই বাসায় যা। আজ তোকে আমি খাওয়াতে পারবো না”।

আমি খেতে চাইনা। আমি তোমার পাশে বসে থাকবো। কি হয়েছে তোমার?

-তুই বুঝবি না।

আমার কিচ্ছু ভালো লাগছিলো না। বাসায় এসে মা কে বললাম, মা, ছোটমা কাঁদছে? ওকে বোধ হয় কেউ মেরেছে।

মা বলল, না কেউ মারে নি। ওর বর টা আবার বিয়ে করেছে। ওর ঘরে সতীন এসেছে।

সতীন মানে কি, কিছুই বুঝলাম না। আর টুকুর ভাই কে তো ছোটমা অনেক ভালো করে খাওয়াত। তাহলে আবার বিয়ে করবে কেনও?

সেই রাতে আমার ঘুম এলোনা। সকালে উঠেই গেলাম ওদের বাড়ীতে। ছোটমার এমন অগ্নিমূর্তি আগে কখনো দেখিনি। হাতে একটা চেলা কাঠ। সামনে একটা মেয়ে দাঁড়ান। কালচে গায়ের রং। পরনে লাল শাড়ী। মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কথা বলছে। ছোটমা কে বেড়িয়ে যেতে বলছে বাড়ী থেকে। ছোটমা চেলাকাঠ নিয়ে এগিয়ে যেতেই চোখ পড়লো আমার উপর।

দু পা পিছিয়ে এসে আমাকে  বলল,” এখানে কি করছিস। বাসায় যা”। বলে একটা ধমক দিলো।

দুই তিনদিন যাইনি ঐ বাসায়। এক সকালে টুকু এসে হাজির। বলল,” চল এখুনি আমাদের বাসায়”।

কেন?

গেলেই দেখতে পারবি। বলল সে

যেয়ে দেখি বেশ কিছু আমার মত ছেলে মেয়ে আর বয়স্ক কিছু লোকজন সাথে টুকুর ভাই দাঁড়ানো।

ছোটমার ঘর বন্ধ। মাঝে মাঝে ঐ ঘর থেকে মোটা গলার স্বরে কে যেন কি বলছে। কিছুই বুঝলাম না।

 হঠাৎ করে ঘরের ভিতর জিনিস পত্র ছুড়ে ফেলার শব্দ হোল । তারপর সব চুপ।

আমি টুকু কে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে রে। আমার ভয় করছে।

টুকু বলল, ভাবী কে জিনে ধরেছে।

জিন মানে?

আমি জানিনা। ভাই বলল।

আবারও কর্কশ গলায় ভাই কে আসতে বলল দরজার কাছে। টুকুর মা ওর ভাই কে যেতে বারণ করলো,” যাসনে খোকা”।

দরজা টা কেঁপে উঠল। ভিতর থেকে বলল, আমি আজ যাচ্ছি। আবার আসব। ওর দিকে যত্ন নিবি।

টিনের ছাদে শব্দ হোল। দরজা খুলে গেলো। ছোটমা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো মাটিতে।

আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম।

পরদিন সকালে গেলাম ছোটমার বাসায়। ছোটমা উঠানে বসে চুল শুকাচ্ছে। আমাকে দেখে বলল,’ আয় আমরা কোলে আয়।

পাশে বসতেই আমাকে টেনে নিলো কাছে। মাথার চুলে আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে বলল, মুখটা শুকনো কেনও রে?

আমি কথা না বলে ছোটমার বুকের কাছে মাথাটা নামিয়ে দিলাম। ওর সদ্য গোসল করা শরীরের গন্ধ আমার ভালো লাগছিল।

বললাম, ছোটমা তুমিতো মরে গিয়ে ছিলে। ঐ লোকটা আবার আসবে?

না রে পাগল ছেলে, ও আমাকে কিছু করবে না। ও আসে আমার ভালোর জন্য।

ছোটমা আমার কপালে চুমু দিয়ে বলল, তুই অনেকদিন আসিস না।

বললাম, কেন? এসেছিলাম, তোমার হাতে চেলাকাঠ। তুমিই তোঁ বললে চলে যেতে।

ছোটমা হেসে বলল, একটু বস, গুর দিয়ে খির বানিয়েছি। তুই পছন্দ করিস তাঁই।

উঠে যেতে যেয়ে আমার গাল টা টিপে দিয়ে গেলো।

দুমাস কেটে গেছে। এর মধ্যে অনেক বার ছোটমা অজ্ঞান হয়ে গেছে।

মা কে জিজ্ঞাসা করতাম, মা ছোটমার খারাপ কিছু হবে নাতো?

মা বলত, না তোর ছোটমা ভালো থাকবে। কিছু হবে না তোর ছোটমার। বলে মা আমাকে আশ্বাস দিতো।

একদিন বাবা আসে বলল, বদলির চিঠি এসেছে। সামনের মাসে চলে যেতে হবে এখান থেকে। আমি শুনলাম। সারা বাসা ঘুরে ঘুরে কেঁদে বেড়ালাম। ছোটমা কে বলিনি। শুধু যেয়ে যেয়ে আদর নিয়ে এসেছি।

এবার সময় হোল বলার। আমি এলাম। ছোটমা রান্নাঘরে। পরনে হাল্কা হলুদ রঙের শাড়ী। আমাকে দেখে বলল, কি ব্যাপার সোনা, এতো সকালে?

তোমার সাথে কথা আছে ছোটমা। বলতে যেয়ে আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরে পড়ল। জড়িয়ে ধরলাম ছোটমা কে।

ছোটমা উনন থেকে হাড়ীটা নামিয়ে রেখে আমাকে নিয়ে এলো বারান্দায়।

মুখটা উচু করে ধরে বলল, কেউ বকেছে?

না।

তাহলে?

আমরা চলে যাচ্ছি ছোটমা। বলে হু হু করে কেঁদে উঠলাম।

চলে যাচ্ছি মানে?

বাবা বদলি হয়ে গেছে। সামনের সপ্তাহে গাড়ী আসবে নিয়ে যেতে। তোমার সাথে আর দেখা হবে না ছোটমা।

ছোটমা আমাকে ওর বুকের মাঝে চেপে ধরল। কোন কথা বলল না। ওর শাড়ী  ভিজে গেলো আমার চোখের জলে।

তারপর আমাকে চুমু দিয়ে বলল, তুই অনেক বড় হবি। বড় হয়ে আমাকে দেখেতে আসবি। আমি তোর পথ চেয়ে থাকব।

আর দেখা হয়েছিল?

না,

গিয়েছিলাম পঁচিশ বছর পরে কঙ্কনাকে নিয়ে। সেই জায়গা আমি চিনতে পারি নি। অনেক কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কেউ কোন খোঁজ দিতে পারেনি।

 জানিস আমার ছোটমা হারিয়ে গেলো। আমার দোষ। আমি আমাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কথা আমি রাখিনি। সে শুধু আমার পথ চেয়েই রইল। আমার পায়ের শব্দ শুনতে পেলনা।

এখনও মাঝে মাঝে যখন একলা বসে থাকি মনে হয়, কে যেন আমার গালটা টিপে দিয়ে বলছে

“ মধু আমার, আয়, দুধ কলা টা খেয়ে নে”।

 

You may also like

9 Comments

  1. দারুন লিখেছো।আমার মনে হয় তুমি যদি ভূত প্রেত নিয়েও লেখো তাও ভালো লিখবে।এ গল্পে ছোটমার মনস্তাত্বিক দিকটাকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছো।

  2. চরিত্র গুলো খুব পরিচিত। তোমার লেখায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে চরিত্রগুলি। খুব ভালো লাগলো।আমারো খুব জানতে ইচ্ছা করছে কেমন আছে ছোটমা।

  3. চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠলো। খুব ভালো হয়েছে। ছোটমার বাড়ীতে আমারও খুব যাওয়াআসা ছিল।এতদিন পর তোমার লেখা পড়ে খুব জানতে ইচ্ছা করছে ওদের কথা।জানতে ইচ্ছা করছে ছোটমা এখন কেমন আছে?

  4. লেখাটা দারুন হয়েছে। ভুতের গল্পের সাথে এত সুন্দর কাহিনী।
    খুব ভাল লাগলো।

  5. Out of side out of mind.Hoyto e karoney choto mar ar khoj neya hoyni.Etai reality.Nice writing.You are successful any types of writing.Waiting for the next.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *