কথোপকথন

“ শুভেন্দু না”, ডাক শুনে পাশ ফিরে তাকাল শুভেন্দু। এক কেতা দুরস্ত ভদ্রলোক, পরনে পলো সার্ট, বেনানা রিপাবলিকের প্যান্ট, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। চিনতে অসুবিধা হলো না। একসাথে স্কুল শেষ করে দুজন দুদিকে চলে গিয়েছিল। পরে আর একবার দেখা হয়ে ছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটির চত্বরে। আজ এতকাল পরে ব্যাংককের রাস্তায় দেখা। শশাঙ্ক বরাবরই চোঁওকস ছেলে।

“কি মনে করে এই বিদেশ বিভুয়ে” শশাঙ্ক প্রশ্ন করে।

বলতে পারিস রীক্রেসনাল টুর। এসে ছিলাম বাংলাদেশে কিছুদিনের জন্য, ভাবলাম ঘুরে যাই, দেখে যাই এই দেশ টা। এবার তোর কথা বল।”

চাকরী নিয়ে এসেছি এদেশে আজ দুবছর হোল। তারপরই প্রসঙ্গ পাল্টালো শশাঙ্ক, শেষ তোর সাথে যখন দেখা হয়েছিল, দেখে ছিলাম এক সুন্দরীর হাতে হাত ধরে চলতে, দেখছিনে কেন তোর পাশে?

চলে গেছে। ছোট্ট জবাব শুভেন্দুর।

চলে গেছে কোথায়, শশাঙ্কর কণ্ঠে বিস্ময়, কিছুটা বেদনার্তও।

বিধাতা ডেকে পাঠালেন তাকে।

কতদিন হোল ?

তা বেশ কিছুদিন। তোর কোথা বল। শুভেন্দু কথা ঘোরাতে চাইল।

হাসলো শশাঙ্ক। একটানা বলে গেল, ছন্নছাড়া জীবন, ডানা গুটিয়ে বসিনি কোঁথাও। Flying like a bird. পিছুটান নেই। চোখের জল আমিও ফেলিনা, আমার জন্যও কেউ ফেলেনা। তাই বলে ভাবিস না আমি gay। মেয়ে বন্ধু ছেলে বন্ধু দুই আছে। তুই তো এখন আমারই মত। তাই না ?

না, তুই হচ্ছিস রবীন্দ্রনাথের বনের পাখী, আর আমি খাঁচার। তুই উড়তে ভালবাসিস, আমি বসে থাকতে চাই কারোর ছায়াই। মায়া মমতায় ভরা। তোর আনন্দের সাথে আমার আনন্দ মেলে না। তাই বলে আমি বলছি না তোর টা সত্যি নয়। তাড়া আছে তোর? না থাকলে চল ওই কফি শপে বসি। চল।তাগাদা দিল শুভেন্দু।

কফির পেয়ালায় শশাঙ্কই কথা শুরু করলো। সত্যি বলতে কি তোদের ডানা ভেঙ্গে গেছে। তোরা উড়তে চাইলেও উড়তে পারবি না। তোদের মন একজন কে ঘিরে, তার বাহিরে তোদের দরজা বন্ধ। তোরা একাকীত্ব কে ভালবাসিস। ভালবাসিস দুঃসহ পীড়াকে। নিংড়ে তার থেকে রস বেড় করতে। এর মধ্যে তোরা খুঁজে ফেরিস জীবনের আনন্দ। আমি বলবো দুঃসহ আনন্দ। এই দেখ আমাকে, কোন কমিটমেনট নিই কারো কাছে। তাই বলে যে আমার লাইফ এ discipline নেই তা নয় I have very disciplined life. উচ্ছিরিংখলতা আমি ভালোবাসি না। তোর মনে প্রশ্ন জাগতে পারে আমার ভারজীনীটি নিয়ে। ওটা হারিয়েছে অনেকদিন হোল। কার সাথে মনে করতে পারিনা। আমি বর্তমানে বিশ্বাসী, অতীত কে আঁকড়িয়ে ধরে থাকতে চাইনা, ভবিষ্যতে বিশ্বাসী নই।

কি জানিস শশাঙ্ক, শুভেন্দু ওর কথায় যোগ দিল, লাইফ এর একটা সাইকেল আছে। জন্ম থেকে মিরতু। তোর সাইকেল টা মাঝ পথে ভেঙ্গে গেছে। ভেবে দেখ তোর জন্য কেউ দুফোঁটা জল ফেলবে না তোর অবর্তমানে। তুই বলে এ পৃথীবি তে কেউ ছিল তা কেউ জানবেনা। রাতের অন্ধকারে এক গেলাস জল ঢেলে কেউ তোকে এগিয়ে দেই নি। কেউ তোর পথপানে চেয়ে বসেছিল না, আজও নেই। বলবে না তোমাকে আজ বড় ক্লান্ত লাগছে।

ঝনঝন করে উঠল শশাঙ্ক । রাখ তোর বুজরুকী। এ শুধু সেন্টিমেন্টাল ব্যাপার। এটা উই পোকার মত। কুড়ে কুড়ে খাবে। এই বন্দন থেকে তোকে বেড়িয়ে আসতে হবে। যদি বাঁচতে চাস।

তুই ভেবে দেখ শশাঙ্ক। ধীর গলায় বলে শুভেন্দু, একলা ঘরে তুইও থাকিস, আমিও। তুই কি শুনতে পাশ টুং টাং চুড়ির শব্দ। দেখতে কি পাশ আবছা আলো ছায়ার মাঝে কে জেনো হেঁটে গেলো।

শশাঙ্কের কণ্ঠে এবার একটু উত্তাপ। না আমি পাইনে, অনন্যরা ও পায়না। তাড়া বেচে থাকার জন্য অন্য পথ অবলম্বন করে। ডুবে যায় অন্য কিছুর মধ্যে। তোকেও তাই করতে হবে। সন্ন্যাসী হয়ে বনে বনে ঘুরে লাভ নেই। তোকে সমাজের মধ্যে বাঁচতে হবে।

পারছি না। জীবনের মানে হারিয়ে ফেলেছি শশাঙ্ক। স্বপ্ন আর দেখি না। তুই বলবি আমি নিজেকে নিয়ে যাচ্ছি আত্মঘাতের চরম সীমায়। হয়তো তাই। এর শেষ কোথায় আমি জানিনা।

দেখ শুভেন্দু, তুই আমার মতও হতে পারবি না এবার ফিরেও যেতে পারবি না তোর আগের জাগায়। তোকে এই দুয়ের মধ্যটা বেছে নিতে হবে।

চেষ্টা করছি, চেষ্টা করছি বান্ধবী দের সাথে কথা বলে মনটা হাল্কা করতে। সাময়িক ভাবে যে উপশম হয়না তা নয়। সেটা একেবারেই সাময়িক। জানিস শশাঙ্ক জীবনের কোন মানে আমি আর খুঁজে পাই না। এইতো কিছুদিন আগেও যা ছিল আমার ধরাছোঁয়ার মাঝে আজ তা নাগালের বাহিরে। ম্রীতু কে এক সময় ভয় পেতাম, আজ পাইনা। বুকে বাথা উঠলে সবাই কে জাগিয়ে তুলতাম। আজ ভাবি ব্যথা টা বাড়েনা কেন।

শুভেন্দু, থামবি তুই। শশাঙ্কও ক্ষুব্ধ হয়। নইরাসশো ভাললাগে না আমার। তুই অতীত কে আঁকড়িয়ে ধরে বাঁচতে চাইছিস। তা হবার নয়। বর্তমান হচ্ছে তোর সমাধান। আমাকে দেখ, অতীত কে পরোয়া করি না, ভবিষ্যৎ কি কেউ জানেনা,। তোকে তাই করতে হবে। অতীত তোকে বারবার পিছে টেনে নেবে। ঝেড়ে ফেল অতীত কে। সামনে এগিয়ে চল।

শিউরে উঠে শুভেন্দু। কাতর কণ্ঠে বলে ওঠে, পারবো না। পারবো না শশাঙ্ক। অতীত আমার সব। বর্তমান আমার সাঁকো। আমি সাঁকো পাড় হচ্ছি। কোথায়, কতদূরে এর শেষ আমি জানিনা। তবে একটা সত্য জেনে রাখ শশাঙ্ক এই সাঁকো পেরিয়ে জীবনের শেষ অব্দি আমি নাও পোঁছাতে পারি। মাঝ পথেই এই জীবনের সাঁকো আমি ভেঙ্গে দিতে পারি। জানি এটাকে মাঝ পথে ভেঙে দেয়া যায়, ভেঙ্গে দেয়া যায়। চমকে উঠল শশাঙ্ক। কী বলতে চাইছে শুভেন্দু? এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল তার বুক।

ওই আমার বাস এলো PATTAY যাওয়ার। উঠে পড়ল শুভেন্দু

চলি শশাঙ্ক। হয়তো আবার দেখা হবে কোথাও, কোন খানে।

শুভেন্দু। এক অসহায় কণ্ঠে ডাকল শশাঙ্ক।

বল, বাস স্টপের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে জবাব দিল শুভেন্দু।

জীবনের সাঁকোটা মাঝ পথে ভেঙ্গে দিস নেরে শুভেন্দু। ভেঙ্গে দিসনে।

You may also like

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *