রাফিকের মনটা আজ অস্থির। কাজে অনেক ঝামেলা হয়েছে। বড় সাহেব ডেকে পাঠিয়েছিল। বলল,” রাফিক সাহেব আপনার কাছ থেকে আমি এই রকম ভুল আশা করিনি। আপনি চৌকশ, বুদ্ধি দীপ্ত লোক। কি ভাবে হোল এই ভুল?” রাফিক জানেনা, কেন? শুধু জানে শোভার সাথে কয়দিন ধরে মনমালিন্য চলছে। হয়তো শে কারণে কাজে মন বসাতে পারেনি। শোভা তার স্ত্রী নয়, প্রেমিকা। দুবছর হোল পরিচয়। ইদানীং সে উপলব্ধি শোভা তার কাছ থেকে জেনো দুরে চলে যাচ্ছে। হয়তবা মনের ভুল। তাই বা কেন? যখন সে তাকে কোথাও যাবার কথা বলে শোভা এড়িয়ে যায়, কোন একটা অজুহাত দেয়। এটাতো আগে ছিলনা। তাই রাফিক ঠিক করেছে আজ সে একটা বোঝাপড়া করবে। আসতে বলেছে তুং শিং রেস্টুরেন্টে, বিকেল পাঁচ টায়।
যথা সময় রাফিক হাজির। ভিতরে যেয়ে দেখে এলো শোভা এসেছে কি না। না সে নেই। রাফিক বাইরে অপেক্ষা করলো। অস্থির ভাবে পায়চারি করতে থাকলো। মনে মনে ভেবে রেখেছে কি সে জিজ্ঞাসা করবে। বেশী কঠোর হওয়া যাবেনা। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। শোভা তার মনের মধ্যে অনেক খানি অংশ দখল করে রেখেছে। এটা অস্বীকার করা যাবেনা। ঘড়ি টা দেখলো রাফিক। আধা ঘণ্টা পেড়িয়ে গেছে। টাইম মেনটেন শোভা কোনদিন করেনি। কাজেই সে বিচলিত হলনা। দুরে একটা কাপলের অঙ্গ ভঙ্গি দেখে সে বিরক্ত হোল। এ ধরনের দৃশ সে দেখে অভ্যস্ত। তবুও রাফিকের কাছে এটা দৃষ্টি কটু লাগে। সে আর শোভা হাত ধরা ধরি করে হেঁটেছে, গলা জড়িয়ে নয়। তার মতে এ ধরনের দৃশ্য ঘরেই শোভা পায়, রাস্তায় নয়। রফিক ভাবে সে কি সেকেলে হয়ে গেছে। বয়স তার তিরিশের কোঠায়। অধিক আধুনিকতা তার কাছে বিরক্তিকর লাগে। ঘণ্টা পেড়িয়ে গেলো। না শোভা এলো না। দুঘণ্টা পেড়িয়ে গেলো। এবার যাওয়ার পালা।
শোভা আজ আর আসবেনা। তা সে যেই কারণেই হোক। রাফিক অশ্তীর। ফোন করতে চাইলো। না ভুল করে ফোন টাও ফেলে রেখে এসেছে। গাড়ী স্টার্ট দিয়ে বেড়িয়ে পড়ল রফিক। এমন তো হয়নি আগে। দেরী করতো কিন্তু আসেনি তা হয়নি কখনো। অনেক কিছু তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
আজ সে বাসাতে তাড়াতাড়ি ফিরবে না ঠিক করলো। উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরবে। গাড়ীর কাটা ৭০ এর ঘর পেড়িয়ে যাচ্ছে।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। শেষ মুহূর্তে রাফিক যেখানে এসে পোঁছিলো আগে সে কখনো আসেনি। মনে করতে পারেনা কোথায় কোন টার্ন সে নিয়েছিল। অন্ধকার চারিদিকে। বাসা ঘরের অস্তিত্ব সে দেখতে পেলো না। নির্জন। হটাৎ তার গাড়ীর সামনে দিয়ে একটা হরিণের বাচ্চা দোড়িয়ে গেলো। ছমছমে ভাব।
রাফিক ভীতু নয়। তবুও চতুরদিকের পরীস্তীতী তাকে ভাবান্বিত করছে। জানেনা সে কোথায়। দুরে একটা আলো জ্বলতে দেখল সে। বেশ দুরে। গেট টা খোলা। ঢুকে পড়লো সে। ওখানে যেয়ে জিজ্ঞাসা করবে কীভাবে সে ফিরে যাবে। না এটা বাড়ী নয়। অফিস মনে হচ্ছে। চারিদিকে ধুধু মাঠ। পীচ কালো অন্ধকার। রাফিকের গাটা ছমছম করে উঠল। কিছু দুরে দুরে ছোট ছোট আলো জ্বলছে নিভছে। পাশের গাছ থেকে একটা বড় পাখি পাখার ঝাপটা দিয়ে উড়ে গেলো।
এ কোথায় সে এসে পড়েছে। দুরে দেখা মিট মিট আলোর কাছে সে এগিয়ে গেলো। ফলকে লেখা “ পারভিন হোসেন”। এতো কবরস্তান। ঘুমন্ত সবাই। শুয়ে আছে এখানে। ছোটো বেলায় দাদী নানী শ্মশানের কথা বলে ভয় দেখাতো। ভুত পাত্নী নাচা নাচি করে শুনেছিল। আজ সে নিজেই সেখানে।
একটা দমকা হাওয়া রাফিকের মুখে ঝাপটা মাড়লো। আমাবস্যার রাত। আকাশে তারার ঝীলী মিলি ততটা নয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন। এ এক মায়া ময় পরিবেশ। দুরে একটা কান্নার মত শব্ধ কানে এলো রাফিকের। বুঝতে চেষ্টা করলো কোথা থেকে আসছে। মিলিয়ে গেলো ক্ষণিকের মধ্যে। গা টা শিরশির করে উঠল রাফিকের। শোঁ শোঁ বাতাসের শব্ধ। নির্জন অন্ধকার ময় মাঠে সে একা। ভুলে গেলো শোভার কথা, ভুলে গেলো কাজে যা ঘটেছে তার কথা। রফিকের মাঝে দারশনিকতার ভাব এসে জোড়ও হোল।
ভাবল এই খানে যারা শুয়ে আছে তারা একদিন আমাদের সাথে পায়ে পায়ে হেটে ছিল। দুঃখ কষ্ট আনন্দের মধ্যে কাটেয়ে ছিল দিন গুলো। সব ছেড়ে আজ নির্জন মাঠে শুয়ে। দেড় বছরেরে মেয়ে টা যে কিনা পৃথিবীর আলো দেখতে পেলোনা ভালভাবে সে শুয়ে আছে তার বাবার থেকে কিছু দুরে। দিনের আলো যখন নিভে আসে, সব পাখি যখন ঘরে ফিরে যায়। নেমে আসে অন্ধকার, তখন কি তার বাবা তাকে কোলে করে বলে,” মা, আমি তো তোড় জন্যই এসেছি এখানে”। দেড় বছরের মেয়েটা বাবার কোলে মুখ গুঁজে বলে,” আমি তো তোমার আদর না পেয়েই চলে এসেছিলাম বাবা”। এমন কি হয় এখানে ? যে বউ তার ভালবাসার স্বামী কে রেখে এসেছে, যে তার কোলের ধন রেখে এখানে ঘুমিয়ে আছে তারা কি শুনতে পায় ফেলে আসা ওদের আর্তনাদ। রাফিক জানেনা। শুধু জানে এই বিশাল মাঠে যারা শুয়ে আছে তারা সব এক। কোন ভেদা ভেদ নেই। গরীব, ধনী, ছোটো,বড়, ছেলে, মেয়ে সব এক গোত্রের। এখানে নেই কোন দল, নেই কোন কন্দল। এরা কি নিজেদের মধ্যে কথা বলে ? আফসোস করে ফেলে আসা দিন গুলোর জন্য ? রাফিক জানতে চায়। উত্তর নেই।
এ এক শান্তির পরিবেশ মনে হোল রাফিকের কাছে। একে অপরকে দাবিয়ে উপরে উঠার সংঘাত নেই। নেই হিংসা। জীবনের সব লেটা চুকিয়ে এই খানেই এসে একদিন আশ্রয় নিতে হবে সে কথা কেউ বুঝতে চায়না, শুনতেও চায়না।
একটা হাতের স্পর্শ রাফিক তার কাঁধে অনুভব করল। হাতটা সরছে না তার কাঁধ থেকে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখার সাহস সে সঞ্চয় করতে চাইল। বুকের দপদপানি টা বাড়ছে। হয়তো এই হাত টা কাঁধ থেকে গলার কাছে আসবে। তারপর সঙ্কুচিত হতে থাকবে তার শ্বাসনালী। নীল হয়ে যাবে তার সাড়া দেহ। কেউ জানবেনা সে কোথায়। সে হয়ে যাবে ওদের একজন।
“ এখানে রাতে আসা নিষেধ”। চমকে উঠল রাফিক। এতো কথা বলছে। স্পষ্ট ভাবে। তাহলে সে ওদের একজন নয়। ও আমাদের একজন। ফিরে তাকালো রফিক। ছ ফুট লম্বা। হাতে টর্চ লাইট। “ এখানে এতো রাতে কেন”? প্রশ্ন তার। “ পথ হারিয়ে, এই আমার ঠিকানা, ফেরে যাব কি ভাবে?”