ছন্দা

মানুষের জীবনে দুইবার ভাঙ্গন আসতে কেউ দেখেছে কি? আমি দেখেছি। দেখেছি আমি সেই মেয়েটার চোখে যার সাথে আমার পরিচয় তার ছোট বেলায়।
দীর্ঘও দিন পাড় হয়ে গেছে। আমি ব্যস্ত আমাকে নিয়ে, সে বাস্ত তার সংসার নিয়ে।
কোন একদিন বিকেলে রিক্সায়  ফিরছিলাম। যানজটের মাঝে পড়ে আছি। ডাক শুনলাম, “ এই মিন্টু, এই মিন্টু”।
রাস্তার ওপাশে একটা গাড়ীর থেকে শব্দটা আসছে মনে হোল। তাকালাম। কাউকে দেখলাম না। ভাবলাম আমার মনের ভুল।
এই যানজটের মাঝে শুধু শব্দ আর শব্দ। চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
আবার ও সেই ডাক। এবার তাকাতেই দেখলাম রাস্তার ওপারে এক ভদ্রমহিলা গাড়ী থেকে নেমে আমাকে হাত নেড়ে ডাকছে। যানজটে তার গাড়ীও দাঁড়ান।
যদিও অনেক দিন পড়ে দেখা তবুও চিনলাম। চিৎকার করে বললাম, কেমন আছিস।
সে সেই কথার উত্তর দিলোনা। চিৎকার করে বলল, নেমে আয়।
চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম, লোকেরা আমাদের কথা ছোড়া ছুড়িতে বেশ আনন্দ উপভোগ করছে। কে যেন একজন বলে উঠলো,
এটা সিনেমার শুটিং নয় তো।
না আর দেরী নয়। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে, অনেক কসরত করে, ওপারে এসে পৌছালাম। সে গাড়ীর দরজা খুলেই রেখেছিল, আমি মাথা নিচু করে ডুকে পড়লাম।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম, আচ্ছা ছন্দা, কতদিন পরে দেখা তাই না। এই যানজটই আমাদের কে মিলিয়ে দিলো। জয় বাবা যানজট।
তুই একটুও পালটাস নি মিন্টু। কবে ফিরলি?
মাস খানেক হোল। সামনের মাসের চার তারিখে ফিরে যাওয়ার কথা। তোর কথা বল। যাচ্ছিস কোথায়।
পপুলার ল্যাবয়ে। ব্লাড রিপোর্ট টা আনতে।
কার রিপোর্ট?
হুমায়ুনের
কি হয়েছে?
সে অনেক কথা। চল আগে রিপোর্ট টা উঠাই, তারপর কোথাও বসে বলব সব। তোর তাড়া নেই তো?
না, মোটেও নেই।
গাড়ী চলতে শুরু করল। শুধু একটা কথাই জিজ্ঞাসা করেছিল, “ বিয়ে শাদি কি করেছিস”?
বলেছিলাম, না, ওই সুযোগ আসেনি ।
ও চেয়ে রইল বাহিরের দিকে। মনে হোল একটা কালচে হাওয়া ওর মুখের উপর এসে থমকে দাড়িয়ে গেছে । কোনকিছু জিজ্ঞাসা করতে সাহস পেলাম না।

আমি ফিরে গেলাম অনেক পিছনে, সেই ছোট্ট মফস্বল শহরে।
পাশের বাসায় থাকতো ছন্দারা। বয়সে আমার চেয়ে চার বছরের ছোট সে। আসতো আমাদের বাসায়। বসে বসে দুজনে গল্প করতাম। ছন্দা বলতো, এই মিন্টু তুই আমার ভাই হবি। ওর ও কোন ভাই নেই, আমারও কোন বোন নেই।
ঠিক আছে, কিন্তু তুই আমাকে আপনি বলে কথা বলবি। তা আর হয়ে উঠেনি। সেই তুইতে রয়ে গেছি আমরা।
স্কুল শেষ করে আমি চলে এলাম রাজধানী তে। ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটাতে কাটাতে হঠাৎ দেখা ওর সাথে মধুমিতা সিনেমা হলের সামনে। কয়েক জন বান্ধবীর সাথে।
কিরে চিনতে পারছিস?
মিন্টু তুই। অনেক খোঁজ করেছি তোকে, কোন হদিস পাইনি। কোথায় থাকিস?
ইউনিভারসিটির এক হলে । কার্জন হলের পিছনে।
তুই?
আমি আছি স্বামীবাগে। বোনের বাসায়। এই আমার ঠিকানা।
বলে একটা চিরকুট এগিয়ে দিল।
কবে আসবি?
আসব সময় করে।
ওরে বাবা, তোর এখনও সেই হেঁয়ালি করে কথা বলা গেলনা। বলে হাসতে লাগল। ওর হাসিতে সব সময় একটা মিষ্টতা ঝরে পড়তো।
ইয়ার্কি রাখ। আগামী রবিবার আসবো। চলি, একটু তাড়া আছে।
এরপর কত বার ওদের বাসায় গেছি, দেখা হয়েছে।

অনেক গুলো ক্যালেন্ডারের পাতা আস্তে আস্তে পিছনে চলে গেলো। ওর বাবা মা এসে বাসা বাধলও মালীবাগে।
একদিন শুনলাম ওর বিয়ে। এক জারনালীস্টের সাথে। দেখা হতেই পরিচয় করিয়ে দিলো।
ভালো লাগলো মুশফিক কে। প্রাণবন্ত। বছর ঘুরতে ছন্দার কোলে এলো এক ছেলে। বাসা নিয়ে ছিল টিকাটুলিতে। মাঝে মাঝে আমিও যেতাম সেখানে আড্ডা দিতে।

এরই মাঝে দেশের  রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পাল্টাতে শুরু করেছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ  সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করেও সরকার গঠনের আগেই ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ সেনা বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের উপর। দাবানল জ্বলে উঠল সারা দেশে।
সেনা বাহিনী কে পৃষ্ঠপোষকতা করতে গঠন হোল রাজাকার, আলবদর।
ধর পাকড় আরম্ভ হোল।
এমনি একদিন ছন্দা, মুশফিক আর তার ভাই বোনেরা মালিবাগের বাসায়। গল্প যখন জমে উঠেছে সেই ক্ষণে দরাম দরাম করে বাহিরের দরজায় প্রচণ্ড আওয়াজ। ওর বাবা দরজা খুলতেই তিন চারজন রাজাকার বন্দুক হাতে বাবা কে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে চলে এলো। কর্কশ স্বরে চিৎকার করে সবাইকে বাহিরে এসে লাইন করে দাড়াতে বললও। ছন্দার বড় ভাই কি যেন বলতে চেয়েছিল। রাজাকারের একজন রাইফেলের বাট দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত হানল ওর পেটে। ওর দাদা কুচকিয়ে পড়ে গেলো মাটিতে। সারা বাসা তল্লাশি করে নিয়ে এলো একটা রেডিও। সবার নাম সেই সাথে মুশফিকের নাম ঠিকানা লিখে রেডিও টা নিয়ে চলে গেলো। ওরা ভেবে ছিল এই বোধ হয় শেষ। কিন্তু তা হবার নয়। নিয়তির খেলা তখনো শেষ হয়নি।

দুইদিন পড়ে এক কাক ডাকা সকালে ছন্দা এসে কেঁদে পড়ল মালিবাগের বাসায়। মুশফিক কে রাজাকাররা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। সেই শেষ। মুশফিকের খোঁজ আর পাওয়া যায় নি। খবর পেয়ে দৌড়ে এসেছিলাম। দেখেছিলাম তার কান্না ভরা চোখ। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা সেদিন ছিলনা।

কিরে বাহিরেরে দিকে চেয়ে কি ভাবছিস?
তাকালাম ওর দিকে। কেনও জানি বুকটা দুর দুর করে উঠল।
এসে গেছি। তুই বোস গাড়ীতে, আমি দৌড়ে যেয়ে রিপোর্টটা নিয়ে আসি, বলে সে বেরিয়ে গেলো।

ফিরে এলো, হাতে একটা কাগছ। যে ছন্দা দৌড়ে গিয়েছিল, ফিরে এলো ধীর পদক্ষপে। গাড়ীতে বসে বলল, চল কোথাও নির্জনে যেয়ে বসি। কোলাহল ভাল লাগছে না।
বসলাম ছোট্ট একটা রেস্তোরায়।
কোন কিছু জিজ্ঞাসা করার মতো সাহস আমার হোল না।

আমি শুধু এক কাপ চা র অর্ডার দিলাম। সে ও তাই।
কিছুক্ষণ চুপ করে, চার কাপে দুই তিন সিপ দিয়ে বলল, তুই তো আমার আগের সব কথাই জানিস।
দেশ স্বাধীন হোল। তুইও চলে গেলি বাহিরে।
মুশফিক আর এলোনা। ওর আর কোন খোঁজই পেলাম না। সেই সময় আমি অন্তসস্তা। মেয়েটা এলো পৃথিবীতে। দুটো কে নিয়ে এসে উঠলাম মা বাবার বাসায়। মা বাবা অনেক করেছিল। কোলে পীঠে করে ওদেরকে মানুষ করেছিল। ওরা না থাকলে আমার কি হতো আমি জানিনা।
একটা চাকরি নিলাম। আস্তে আস্তে নিজের পায়ে দাড়াতে শিখলাম। কাজ আর কাজ। কাজ শেষে বাসায় ফিরে ছেলে মেয়ের লেখাপড়া দেখা। বুঝতেই পারছিস। পন করেছিলাম বাচ্চা গুলো কে মানুষ করে তারপর আমি বিশ্রাম নেবো।
সেই সময় আমি দেখা পেলাম হুমায়ুনের। চলতে পথে দুজনেরই দুজন কে ভাল লাগল।
আমি অনেক বছর পড়ে এবার ঘর বাধলাম। আমি সুখের মুখ দেখলাম। ছেলে মেয়ে দুটোকে হুমায়ুন কাছে টেনে নিলো। এর চেয়ে সুখ আর কি আছে বল।
এই বলে সে উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়াল। হয়তো চোখের জল মুছতে। আমি চা র পেয়ালায় চুমুক দিলাম। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। হাতের ইশারায় ওয়েট্রেসকে বললাম আর এক কাপ চা দিতে।
ছন্দা এসে বসলো।
বললাম, আজ থাক। বাকি টুকু না হয় আর একদিন শুনবো।
বলল, না, তোর সাথে আবার কবে দেখা হবে জানিনা।
জানিস, খুব ধুমধাম করে ছেলে আর মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলাম।
ওদের সুখ দেখে আমার খাটনির সার্থকতা খুজে পেয়েছিলাম।
সময় যে কোথা দিয়ে পাড় হয়ে গেলো টের পাই নি।
একদিন দেখলাম আমার চুলে পাক ধরেছে। ভাবলাম এবার পাখা গুটানোর পালা। চাকরি তো অনেক দিন করলাম।
অবশেষে রিটায়ারমেন্ট নিয়ে বাসায় এসে বসলাম। হুমায়ুন তার ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। আমি ব্যস্ত বই পড়া নিয়ে। মাঝে মাঝে দুজনে বেড়িয়ে পড়ি ভিন্ন দেশ দেখতে।

একবার হুমায়ুনকে ব্যবসার প্রয়োজনে কলকাতায় যেতে হোল। ফিরে এলো অসুস্থ হয়ে। হাসপাতালে ভর্তি করতে হোল। সমস্ত রকমের পরীক্ষা করার পর ডাক্তার আমাকে ডেকে নিয়ে গেলো অন্য ঘরে। প্রথমে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি ডাক্তার কি বলতে চাইছে।
বুঝে উঠতে পারিসনি মানে? ডাক্তার পরিষ্কার করে বলেনি? জিজ্ঞাসা করলাম।
বলেছে, তবে মেডিক্যাল টার্ম গুলো বুঝতে দেরী হোল। বলল, হুমায়ুনের Multiple Myeloma হয়েছে। অর্থাৎ ওর Bone Marrow তে রক্ত কনা ঠিকমত তৈরী হচ্ছেনা। তাছাড়া হেমগ্লবীন অনেক কমে গেছে। এই মুহূর্তে দুই ব্যাগ রক্ত দিতে হবে। ওর ব্লাড গ্রুপের লোকের সন্ধান করতে বলল। যারা রক্ত দিতে ইচ্ছুক তাদেরকে অতিসত্বর হাসপাতালে আসার কোথা বলল।
বুঝতে পারছিস আমার অবস্থা।
পারছি।
পায়ের তোলার মাটি কেঁপে উঠল। আমি কিচ্ছুক্ষণ ডাক্তারের সামনে হতভম্বের মতো বসে রইলাম। ভাবলাম, কেন, কেন আমার উপরে এতো পরীক্ষা করবে উপরওয়ালা। আমি কাঁদতে চাইলাম, পারলাম না।
হুমায়ুনের পাশে আমাকে দাড়াতে হবে। ওকে ভালকরে তুলতে হবে এই পন করে ডাক্তারের ঘর থেকে বেড়িয়ে এলাম।
সেই থেকে হসপিটাল,বাসা আর ল্যাবে দৌড়িয়ে বেড়াচ্ছি।
একটু থেমে বলল, তোকে আমি বিরক্ত করছি নাতো?
তোর কি তাই মনে হচ্ছে? বল, তারপর?

চিকিৎসা চলছে। বেশ কয়েক মাস হয়ে গেলো। কিছুটা ভাল হতে হতে আবার ফিরে আসে আগের জাগায়। আমি শুধু আল্লাহর কাছে বলি, আমাকে তুমি দুই বার একি আঘাত দিওনা।
এই বলে সে থামল।
রিপোর্টার দিকে তাকাল। আমার দিকে এগিয়ে দিল।
হাতে নিয়ে সংখ্যা গুলো দেখলাম। এই বিষয়ে আমি একেবারেই আনাড়ি। তবুও ভাল এবং মন্দের ঘরের ভিতরে মন্দের ঘরেই সংখ্যা বেশি।
তাকালাম ওর দিকে। বললাম, আমার দেখা একজনকে জানি, কেউ আশা করেনি সে ফিরে আসবে কিন্তু সে ফিরে এসেছে। দেখবি হুমায়ুন আবার আগের মতো হাসবে, খেলবে নাতিদের সাথে, মাতাবে আসর। তোকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে।

হাঁ তাই করব, চোখ টা মুছে বললও, চল তোকে নামিয়ে দিয়ে আমি বাসায় ফিরবো।
বললাম না, আমি একটা রিক্সা নিয়ে চলে যাব। তুই ভাল থাকিস। কথা হবে।
ও গাড়ীতে উঠল, আমি তাকিয়ে থাকলাম ওর চলে যাওয়ার পথে।

 

You may also like

8 Comments

  1. গল্পটা পড়ে মনটা গুমরে গুমরে কাঁদছে।জীবনের সত্যতা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।

  2. চোখের জলে ভাসছি।আর কিছু বলার নেই। নিয়তিকে মনে হয় এড়ানো গেলোনা।

  3. চোখেরজলে ভাসছি। কিছু বলার নেই। ছন্দাদের জন্য ঈশ্বর নিয়তির নিষ্ঠুর খেলাএভাবেই লিখে রাখে।এতেই তার আনন্দ।

  4. মানুষের জীবনের সত্যি কাহিনি অনেক সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে লেখার মাঝে আরো লেখেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *