একটা ভ্রমন কাহিনী ৩

স্কোয়ার দেখব,দেখব সেই বিখ্যাত বাজার। তাইতো ক্লান্তিকে তুচ্ছ করে আমরা ঠিক তিন টার সময় বেড়িয়ে পড়েছিলাম। সবাই ক্ষুধার্ত। ইব্রাহিম জিজ্ঞাসা করেছিল, ঠিক মতো যেতে পারবে তো স্কোয়ারে?

বলে ছিলাম বেড়িয়ে ডানে, একটু এগিয়ে আবার ডানে মোড়, তারপর বায়ে, শেষ মাথায় যেয়ে আবার বায়ে মোড় নিলে স্কোয়ারের যাওয়ার রাস্তায় উঠে যাবো। ঠিক বলিনি? সে হেসে বলেছিল, সব ঠিক আছে।

সেদিন তোমরা তাড়াতাড়িই সেজে নিয়ে ছিলে। 

তোমার পরনে সাদা কামিজ,কালোর উপর সাদা নক্সা করা সালওয়ার। মাথায় অফ হোয়াইট দোপাট্টা।

শম্পা পড়েছে ম্যাজেন্টা রঙের টপস, কালোর উপর ফুলফুল আঁকা প্যান্ট, মাথায় পীঙ্ক রঙএর হেড ব্যান্ড, চোখে ডিজাইনার সানগ্লাস। ভাবীর পরনে  নানা রঙ এর সমারহে বানানো কামিজ আর কচি কলাপাতা রঙের সালওয়ার। মাথা ডেকেছে  লাল ওড়না দিয়ে।  তোমাদের সবাই কে সত্যিই অপূর্ব লাগছিল।

এতোও তোমার মনে থাকে? এবার আমি বলি। ভুল হলে শুধরে দিও।

এসে দাঁড়ালাম রাস্তা যেখানে এসে শেষ হয়ে গেল। Jemaa-el- Fnaa. The square. বিখ্যাত মার্কেট প্লেস মারাকাসের। খালি আকাশের নিচে ব্যবসাদাররা বসেছে তাদের মালা মাল নিয়ে। কানের দুল, গলার মালা। আছে ফলের রসের দোকান। আমি, শম্পা আর ভাবী চেয়েছিলাম আম,ডালিম আর কমলা দিয়ে বানানো রস।

তুমি কেন যে খেলেনা, শুধু শম্পার  থেকে এক সিপ নিয়ে ছিলে। বলে ছিলে আগে দুপুরের খাওয়া তারপর এইসব।

সূর্য মাথার উপর থেকে সরে এসেছে। সহ্য করার মতো রৌদ্রের তাপ। দূরে দেখা যাচ্ছে কুতুবীয়া মসজিদ। দুপুরের তাপের মাঝেও অনেক লোকের আগমন। আমরা এসে বসলাম রেস্টুরেন্ট সেগ্রনীতে। দোতালায়। চারিদিক খোলা। বাজারের দিকে মুখ করে। মাথার উপরে ছাতি।

সজন ভাই ভোজন প্রিয়। অনেকক্ষণ ধরে মেন্যুটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। ওয়াটার এসে মীন্ট চা দিয়ে গেলো। মীন্ট চা হচ্ছে মরক্কান দের কালচারের সাথে জড়িত। তা তুমি কসমোপলিটান কাসাব্ল্যাংকাতে যাও অথবা অ্যাটলাস পাহাড়ের বারবার ভীলেজে যাও। শুধু একটি মাত্র দ্রুব সত্য the tea is served.

চা বানানোর প্রক্রিয়া বিভিন্ন জাগায় বিভিন্ন রকম, কিন্তু ভেতরের মালমসলা এক। green tea, mint leaves and sugar.

সজন ভাই বলল, কি খাবে?

তুমি বলেছিলে Tagine, শুনে এসে ছিলে তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে।

বীফ Tagine, চিকেন Tagine, ল্যাম্ব Tagine, সাথে থাকে তরিতরকারি। যেমন carrot, beans, peas.

রান্না করে মাটির পাত্রে উপরে লম্বা cone shaped এর ঢাকনা দিয়ে।

আমরা তিন রকমের খাবার আনতে বলেছিলাম। তোমরা বেশ পছন্দ করেই খেয়েছিলে।

খাওয়া শেষে নামে এলাম রাস্তায়। পড়ন্ত বিকেল। লোকের ভিড় বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে বিভিন্ন ধরণের স্টল।

কেউ দেখাচ্ছে জাদুর খেলা। কেউবা পাশে ঘুর ঘুর করে ঘুরে বলছে, নেবেন স্যার, এই হ্যাট টা। ১০০ দেরহাম।

শম্পা কে পেয়ে বসলো লোকটা। হ্যাটটা ওর মাথায় চাপিয়ে দিয়ে বলল, কি সুন্দরই না দেখাচ্ছে।

বললাম, না শম্পা মোটেও ভাল দেখাচ্ছেনা। দাড়াও তোমার ছবি উঠাই ওর সাথে, মাথায় হ্যাট পরে।

এ এক আজব জায়গা। ছবি উঠিয়েছি তার সাথে, ওর চেহারা তো patent করা। বিনে পয়সায় কিছু হয় না এখানে। ওর  সাথে ছবি উঠানোর খেসারত দিতে হোল। খসে গেলো দশ দেরহাম।

একটু এগিয়ে যেতেই দেখা গেলো সাপুড়ে  তিনটা অজগর সাপ নিয়ে বসে আছে। খেলা দেখাবে পয়সা দিলে। তুমি, ভাবী ভয়ে চলে গেলে অন্য দিকে। আমি আর শম্পা এগিয়ে গেলাম। একজন একটা সাপ নিয়ে এলো। বলল, গলায় ঝুলিয়ে দিলে ৩০ দেরহাম দিতে হবে। বললাম, না, শুধু ছবি উঠাব। তাহলে ১০ দেরহাম।  ওতেই রাজি আমরা। আমি, শম্পা আর অজগর সাপ।

বিকেল পেড়িয়ে সন্ধ্যা এলো। আলো জ্বলে উঠলো চারিদিকে। সাপুড়ে মিলিয়ে গেলো অন্ধকারে। চারিদিকে আলোর মেলা।

ছোট্ট মেয়েটা তার হাতের খেলনা টা আকাশে ছুড়ে দিল। বিভিন্ন আলোর রঙয়ে রঞ্জিত হয়ে সে ফিরে এলো মাটিতে।

এগিয়ে এলো সে তোমার আর ভাবীর কাছে।

নেবেন, নেবেন ম্যদাম। সে পাঁচটা উরন্ত খেলনার দাম চাইল ২০ দেরহাম। শম্পা এগিয়ে এলো। বলল, আমারও ওটা চাই ।

ইব্রাহীম বলে দিয়েছিল, দরাদরি করবে। যা চাইবে তার চার ভাগের এক ভাগ দাম বলবে।

আমরা কিন্তু পাঁচ দেরহামে নিয়েছিলাম পাঁচটা। মনে পরে? মনে পরে ঐ মেয়েটা, যে কি না হেনা লাগাচ্ছিল মেয়েদের হাতে। আমাকে বলেছিল, হাতটা দাও, হেনা দিয়ে এঁকে দেবো ফুলের বাগান তোমার হাতে। পাশে থেকে একটা ছেলে তোমাকে বলেছিল, পানি খাবে? তুমি তাকিয়ে ছিলে ওর পরনের চোখ জুড়ান পোশাকের দিকে। হাতে তার চামড়ার পাউচে পানি।

তোমাকে অনেক সেধে ছিল। তুমি ঐ পানি খাওনি।

বাজারের মাঝখানে শুঁখানো ফলের স্টল। আপ্রীকট, কলা, চিনির আবরনে মোড়া বাদাম, আরও কত কি।

বাজারের শেষ প্রান্তে কুতুবীয়া মসজিদ মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে। ১১ শতাব্দীতে বানানো। মসজিদের মাথার উপর তিনটা সোনার বল। কথিত আছে, সাদীয়ান সুলতান আহমেদ এল মানসুর এর মা এই সোনার বল গুলো দিয়ে ছিলেন।

মসজিদের চারিদিকে হাটা পথ, সুন্দর পরে ছাটা বাগান।

সজন ভাই বলেছিল, আমরা একদিন এই মসজিদে নামাজ পড়ব।

উত্তর পশ্চিম কোণে বিভিন্ন জামা কাপড়, খেলনা সরঞ্জামের দোকান। লোকের ভিড় ওদিকেও কম নয়। আমরা হাটতে হাটতে গেলাম ঐ কর্নারে। ভাবী আমার কানে কানে  এসে বলেছি্ল, আমার কিন্তু খুব কেনাকাটা করতে ইচ্ছা করছে।

তুমি ভাবী কে বলেছিলে, আজ নয়। আজ আমরা সবাই ক্লান্ত। রাত এখন নয়টা। কাল ভোর সাতটায় মুস্তাফা আসবে আমাদের কে নিতে। রুমে ফিরে আমাদের বিশ্রাম আর ঘুমানো উচিৎ। কি বলেন?

আমরা রাজি হয়ে ছিলাম। সাহারায় যেতে পথে একরাত কাটাতে হবে। আর এক রাত কাটাব খোলা আকাশের নিচে।

আমরা ফিরে এলাম।

তোমার ফোন বাজছে?

হাঁ। আমার বান্ধবী কল করেছে।

তাহলে কি চলে যাবে?

না, ওখানে পরে গেলেও কিছু হবে না। তোমার সান্নিধ্য আবার কবে পাবো জানি না। ভাল লাগছে পুরানো দিনের গল্প করতে।

তারপর ?

তারপর শম্পা চলে গেলে আমাদের রুমে। ভাবী আর ভাই তাদের দরজা বন্ধ করে দিল।

তুমি আর আমি  আস্তে আস্তে সিঁড়ি পেড়িয়ে রুফ টপে এসে বসলাম।

দূরে আলোয় ঝলমল করা বাজার টা দেখা যাচ্ছে। আকাশে তারার ঝিকিমিকি। আধা চাঁদের আলো তোমার শরীরে মাখা।

তুমি গুনগুণ করে গাইছিলে, —“-আজি বিজন ঘরে নিশীথরাতে আসবে যদি শূন্য হাতে– আমি তাইতে কি ভয় মানি! জানি জানি, বন্ধু, জানি– তোমার আছে তো হাতখানি”.

তুমি তাকালে আমার দিকে। জানি তুমি আমাকে দেখছ না, দেখছ অনেক দূরে ফেলে আসা সেই মুখ খানি।

You may also like

5 Comments

  1. সবকিছুর বর্ননা এত সুন্দর মনে হচ্ছে আমিও সবার সাথে আছি।আমিও দেখছি তোমাদের চোখ দিয়ে।এরপর সাহারা দেখার অপেক্ষায়।

  2. ভ্রমন কাহিনী খুব সুন্দর করে বর্ননা করেছেন। লেখা পড়ে ভাল লাগল।
    সাহারার পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

  3. ভালো লাগছে। দেখি তোমার সাথেপথ চলতে কতক্ষণ ভালো লাগে।সাহারার অপেক্ষায় রইলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *